প্রতিবন্ধী: ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
আবদুল্লাহ আল-মামুন আল-আযহারী
সব প্রশংসা আল্লাহর, অসংখ্য সালাত ও সালাম রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর, তাঁর পরিবার পরিজন, সাহাবীগণ ও কিয়ামত পর্যন্ত একনিষ্ঠার সাথে তাঁর অনুসরণকারী সকলের ওপর বর্ষিত হোক।
প্রতিবন্ধীর মান-সম্মান সংরক্ষণ, মানুষ হিসেবে তাদের অধিকার প্রদান ও তাদের সাথে কোমল ও সদাচরণ করতে ইসলাম চৌদ্দশ’ বছর আগেই সবার প্রতি আহ্বান করেছে। অবহেলা ও অবজ্ঞার স্বীকার না হয়ে সমাজে একজন সফল নাগরিক হিসেবে তাদেরকে জীবন যাপনের ব্যবস্থা করেছে। বাস্তবে দেখা গেছে তাদের কেউ কেউ সফলতার এমন পূর্ণ শিখরে আরোহণ করেছে যা অন্যদের জন্য মডেল হয়ে রয়েছে। ইসলাম প্রতিবন্ধীর প্রতি শুধু মানবিক আহ্বানই করে ক্ষান্ত হয়নি, বরং সব ধরণের অসুস্থ ও রোগাক্রান্ত মানুষ এ আহ্বানের মধ্যে শামিল। যে কোনো ধরণের রোগী ইসলামের পতাকাতলে অনুকম্পা, রহমত, দয়া ও কল্যাণ পেতে পারেন এবং ইজ্জত ও সম্মানের সাথে জীবন যাপন করতে পারেন। তাছাড়া প্রতিবন্ধীর প্রতি ইসলামের এ আহ্বান কোনো মৌসুম বা উপলক্ষ্যের সাথে নির্দিষ্ট নয়, বরং এ বিধান রাসূল (সা.)-এর নুবুওয়াতের মিশন থেকে শুরু হয়ে কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে।
প্রতিবন্ধী কাকে বলে?
আভিধানিক অর্থে প্রতিবন্ধী হচ্ছে, দৈহিক শক্তির একান্ত অভাব বা অঙ্গহানি হেতু যাহারা আশৈশব বাধাপ্রাপ্ত, মূকবধির, অন্ধ, খঞ্জ ইত্যাদি। [সংসদ বাংলা অভিধান, পৃ. ৩৮২] পারিভাষিক অর্থে প্রতিবন্ধী হচ্ছে, দেহের কোনো অংশ বা তন্ত্র আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে, ক্ষণস্থায়ী বা চিরস্থায়ীভাবে তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলা। [উইকিপিডিয়া, বাংলা]
অস্বাভাবিক সৃষ্টির রহস্য
মহান আল্লাহ সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। তিনি ভালো-মন্দেরও সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু তাঁর সৃষ্টিকুলের মধ্যে কিছু সৃষ্টিকে আমরা অনেক সময় অস্বাভাবিক ও বিকৃত দেখতে পাই। অনেকে এর দোষটা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকে দেয়; অথচ তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র দোষমুক্ত, আবার অনেকে সেই সৃষ্টিকেই দোষারোপ করে। বাস্তবে এদের সৃষ্টির পিছনে তাঁর উদ্দেশ্য ও রহস্য মহান। সেটা একমাত্র তিনিই জানেন।তবে কিছু কারণ অনুমান করা যেতে পারে যেমন-
- বান্দা যেন মহান আল্লাহর একচ্ছত্র ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারে যে, তিনি সব বিষয়ে ক্ষমতাবান। তিনি যেমন স্বাভাবিক সুন্দর সৃষ্টি করতে সক্ষম, তেমন তিনি এর ব্যতিক্রমও করতে সক্ষম।
- আল্লাহ যাকে এই আপদ থেকে নিরাপদে রেখেছেন সে যেন নিজের প্রতি আল্লাহর দয়া ও অনুকম্পাকে স্মরণ করে, অতঃপর তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। কারণ আল্লাহ চাইলে তার ক্ষেত্রেও সেইরকম করতে পারতেন।
- প্রতিবন্ধীকে আল্লাহ তাআলা এই বিপদের বিনিময়ে তাঁর সন্তুষ্টি, দয়া, ক্ষমা এবং জান্নাত দিতে চান। নবী (সা.) বলেছেন, ‘আমি যার দুই প্রিয়কে (দুই চোখকে) নিয়ে নিই, অতঃপর সে ধৈর্য ধরে ও নেকীর আশা করে, তাহলে আমি তার জন্য এর বিনিময়ে জান্নাত ছাড়া অন্য কিছুতে সন্তুষ্ট হই না।’ [সুনানে তিরমিযী: ২৪০১, ইমাম তিরমিযী (রহ.) বলেছেন, হাদীসটি হাসান সহীহ]
প্রতিবন্ধীর প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
ড. আবদুল্লাহ নাসেহ উলওয়ান তাকাফুল ইজতিমায়ী ফিল ইসলাম কিতাবে বলেন, প্রতিবন্ধীর প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি পাশ্চাত্য চিন্তাধারার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এ সব শারীরিক অক্ষম ও প্রতিবন্ধীরা রাষ্ট্র, সমাজ ও ধনীদের থেকে সাহায্য সহযোগিতা, ভালবাসা ও রহমত পাবে।
হাদীসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাযি.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ দয়ালুদের ওপর দয়া ও অনুগ্রহ করেন। যারা জমিনে বসবাস করছে তাদের প্রতি তোমরা দয়া কর, তাহলে যিনি আকাশে আছেন, তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। রাহেম শব্দটি (দয়া) রাহমান হতে উদ্গত। যে লোক দয়ার সম্পর্ক বজায় রাখে, আল্লাহও তার সাথে নিজ সম্পর্ক বজায় রাখেন। যে লোক দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করে, আল্লাহও তার সাথে দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করেন।’ [সুনানে তিরমিযী: ১৯২৪, ইমাম তিরমিযী (রহ.) বলেছেন, হাদীসটি হাসান সহীহ; সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৪১ ও মুসনদে আহমদ: ৬৪৯৪]
নুমান ইবনে বশীর (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তুমি মুমিনদের পারস্পরিক দয়া, ভালবাসা ও সহানুভূতি প্রদর্শনে একটি দেহের ন্যায় দেখতে পাবে। যখন দেহের একটি অঙ্গ রোগে আক্রান্ত হয়, তখন শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গ রাত জাগে এবং জ্বরে অংশ গ্রহণ করে।’ [সহীহ আল-বুখারী: ৬০১১]
আমরা একথা নির্দ্বিধায় দাবি করতে পারি যে, ইসলামের ছায়াতলে প্রতিবন্ধীরা সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই বিখ্যাত আলেম ও মুহাদ্দিস ছিলেন। যেমন ইবনে আব্বাস (রাযি.), আসিম আল-আহওয়াল, আমর ইবনে আখতাব আল-আরাজ, আবদুর রহমান আল-আসম ও আ’মাশ প্রমুখ।
নবী (সা.) কর্তৃক তাদেরকে
সম্মান ও সহমর্মিতা
আনাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত যে, এক মহিলার বুদ্ধিতে কিছু ত্রুটি ছিল। সে বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনার সাথে আমার প্রয়োজন আছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে অমুকের মা, তুমি কোনো রাস্তা দেখে নাও, আমি তোমার কাজ করে দেব। তারপর তিনি কোনো পথের মধ্যে তার সাথে দেখা করলে সে তার কাজ সেরে নিল। [মুসলিম: ২৩২৬]
আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা আমার কাছে অহী পাঠিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণের রাস্তায় চলবে আল্লাহ তার জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দিবেন। আর আমি (আল্লাহ) যার দুপ্রিয় জিনিস (দু’চোখ) নিয়ে নিয়েছি তার জন্য জান্নাত রেখে দিয়েছি। [শুআবুল ঈমান: ৫৩৬৭]
ইসলাম তাদের জন্য অনেক কঠিন কাজ সহজ করে দিয়েছে এবং তাদের থেকে কষ্ট দূর করেছে, সাহল ইবনে সা’দ সাঈদী (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, আমি মারওয়ান ইবনে হাকামকে মসজিদে বসা অবস্থায় দেখলাম। তারপর আমি তাঁর দিকে এগিয়ে গেলাম এবং তাঁর পাশে গিয়ে বসলাম। তিনি আমাকে বর্ণনা করেন যে, যায়দ ইবনে সাবিত (রাযি.) তাঁকে জানিয়েছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর ওপর অবতীর্ণ আয়াত, (মুসলমানদের মধ্যে যারা ঘরে বসে থাকে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করে তারা পরস্পর সমান নয়) যখন তাকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন, ঠিক সে সময় অন্ধ ইবনে উম্মে মাকতুম (রাযি.) সেখানে উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি যদি জিহাদে যেতে সক্ষম হতাম, তবে অবশ্যই অংশ গ্রহণ করতাম।’ সে সময় আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূলের ওপর ওহী নাযিল করেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উরু আমার উরুর ওপর রাখা ছিল এবং তা আমার কাছে এতই ভারী মনে হচ্ছিল যে, আমি আমার উরু ভেঙ্গে যাওয়ার আশংকা করছিলাম। এরপর ওহী অবতীর্ণ হওয়ার অবস্থা কেটে গেল, এ সময় আল্লাহ তাআলা ‘তবে যাদের সমস্যা রয়েছে তার ব্যতীত’ এ আয়াতাংশটি নাযিল করেন। [সহীহ আল-বুখারী: ২৮৩২]
‘আয়িশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তিন ব্যক্তি থেকে কলম উঠিয়ে রাখা হয়েছে, ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না সে জাগ্রত হয়, নাবালেগ, যতক্ষণ না সে বালেগ হয় এবং পাগল, যতক্ষণ না সে জ্ঞান ফিরে পায় বা সুস্থ হয়। অধস্তন রাবী আবু বাকর (রহ.)-এর বর্ণনায় আছে, বেহুঁশ ব্যক্তি যতক্ষণ না সে হুঁশ ফিরে পায়।’ [সুনানে ইবনে মাজাহ: ২০৪১; সুনানে আবু দাউদ: ৪৩৯৮ ও সুনানে তিরমিযী: ১৪২৩]
অন্ধ লোককে পথ না দেখিয়ে বিপথগামী করা, তাদেরকে অনর্থক কষ্ট দেওয়া ও উপহাস করা থেকে নবী (সা.) কঠরভাবে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, ‘সে ব্যক্তি অভিশপ্ত যে অন্ধকে পথভুলিয়ে দিল।’ [মুসনদে আহমদ: ১৮৭৫]
প্রতিবন্ধীদের প্রতি ইসলামের নবীর রহমত আরো স্পষ্ট হয় যখন তিনি তাদের কষ্ট লাগবে শান্ত্বনা ও বিপদে ধৈর্য ধারণের জন্য দুআর প্রচলন করেছেন। এতে তাদের মনের শক্তি ও চেতনা বৃদ্ধি পায়। যেমন- ওসমান ইবনে হুনাইফ (রাযি.) থেকে বর্ণিত, এক অন্ধ লোক নবী (সা.)-এর নিকট এসে বললো, আপনি আল্লাহর কাছে আমার জন্য দুআ করুন। তিনি যেন আমাকে রোগমুক্তি দান করেন। তিনি বলেন, তুমি চাইলে আমি তোমার জন্য দুআ করতে বিলম্ব করবো, আর তা হবে কল্যাণকর। আর তুমি চাইলে আমি এখনি দুআ করবো। সে বললো, তাঁর নিকট দুআ করুন। তিনি তাকে উত্তমরূপে অযু করার পর দু’রাকাআত সালাত পড়ে এ দুআ করতে বলেন, ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করছি, রহমতের নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর মাধ্যমে দিয়ে, আমি তোমার প্রতি নিবিষ্ট হলাম। হে মুহাম্মাদ (সা.)! আমার চাহিদা পূরণের জন্য আমি আপনার মাধ্যমে দিয়ে আমার রবের প্রতি মনোযোগী হলাম, যাতে আমার প্রয়োজন মিটে। হে আল্লাহ! আমার জন্য তাঁর সুপারিশ কবুল করো।’ [সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৩৮৫]
রাসূল (সা.) আমর ইবনে জামুহ (রাযি.)-কে সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে বলেছিলেন, তোমাদের সর্দার হলো ফর্সা ও কোকড়ানো চুল বিশিষ্ট আমর ইবনে জামুহ। [হিলইয়াতুল আওলিয়া, ৭/৩১৭]
আবু কাতাদা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমর ইবনে জামুহ (রাযি.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি যদি আল্লাহর পথে জিহাদ করে শহীদ হই তাহলে জান্নাতে আমি কি সুস্থ স্বাভাবিক পায়ে হাঁটতে পারব? তার পা পঙ্গু ছিল। রাসূল (সা.) বললেন, হ্যাঁ। অহুদের যুদ্ধে তিনি, তার এক ভাইপো ও তাদের একজন দাস শহীদ হন। তার কাছ দিয়ে রাসূল (সা.) যাওয়ার সময় তাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আমি যেন তোমাকে জান্নাতে সুস্থ স্বাভাবিক পায়ে হাঁটতে দেখছি।’ রাসূল (সা.) তাদের দু’জন ও গোলামকে এক কবরে দাফন করতে আদেশ দিলেন, ফলে তারা তাদেরকে এক কবরে দাফন করলেন। [মুসনদে আহমদ: ২২৫৫৩, মুহাক্কিক শুআইব আরনাঊত বলেছেন, হাদীসের সনদটি হাসান।]
আনাস ইবনে মালিক (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইবনে উম্মে মাকতুম (রাযি.)কে মদীনায় দু’বার তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেছেন, তিনি অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও সালাতের ইমামতি করেছেন। [মুসনদে আহমদ: ১৩০০০, মুহাক্কিক শুআইব আরনাঊত বলেছেন, হাদীসের সনদটি হাসান।]
ইসলামের খলিফাগণও প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে রাসূল (সা.)-এর পথ অনুসরণ করেছেন। তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবন্ধীদের শারীরিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক ও তাদের সব ধরণের প্রয়োজন পূরণ করেছেন। খলিফা উমর ইবনে আবদুল আযীয রাসূল (সা.)-এর এ মহান উদার পন্থা অনুসরণ করে সব প্রদেশে ফরমান জারি করলেন যে, সব অন্ধ, অক্ষম, প্লেগ রোগী ও এমন অঙ্গ বৈকল্য যা তাকে সালাতে যেতে বাঁধা দেয় তাদের পরিসংখ্যান করতে আদেশ করেন। ফলে তারা এ সব লোকের তালিকা করে খলিফার কাছে পেশ করলে তিনি প্রত্যেক অন্ধের জন্য একজন সাহায্যকারী নিয়োগ করেন, আর প্রতি দু’জন প্রতিবন্ধীর জন্য একজন খাদেম নিযুক্ত করেন যে তাদের দেখা শুনা ও সেবা করবে।
এমনিভাবে তিনি সব প্রতিবন্ধীর পরিসংখ্যান করেন এবং সবার জন্য সাহায্যকারী ও খাদেম নিযুক্ত করেন যাতে তারা সালাতে উপস্থিত হতে পারে।
একই কাজ উমাইয়া খলীফা ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক করেছেন। তিনি সর্বপ্রথম প্রতিবন্ধীদের দেখাশোনার জন্য বিশেষ ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সেবাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ৮৮ হিজরী মোতাবেক ৭০৭ খ্রিস্টাব্দে তাদের দেখবালের জন্য বিশেষ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এতে তিনি ডাক্তার ও সেবক নিয়োগ করেন, তাদের জন্য বেতন প্রচলন করেন। প্রতিবন্ধীদেরকে নিয়মিত ভাতা প্রদান করেন। তিনি তাদেরকে বলেন, তোমরা মানুষের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে না। এভাবে তিনি তাদেরকে মানুষের কাছে হাত পাতা থেকে মুক্ত করেন। সব অক্ষম, পঙ্গু ও অন্ধের জন্য খাদেম নিযুক্ত করেন।
মামলুকদের যুগে সুলতান কালাউন প্রতিবন্ধীদের জন্য মারিসতান তথা হাসপাতাল নির্মাণ করেন, এতে প্রতিবন্ধী রোগীরা বিশেষ চিকিৎসা ও সুযোগ সুবিধা পেতো। রোগীর চিকিৎসা শেষে তাদেরকে বিশেষ ভাতা দেওয়া হতো যা দ্বারা তারা সম্পূর্ণ আরোগ্যলাভ পর্যন্ত কাজ না করে চলতে পারত।
প্রতিবন্ধীরা ইসলামের ছায়াতলে
অনন্য সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী
ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধীরা বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা ভোগ করে থাকেন যা অন্য কোন সমাজে পাওয়া সম্ভব নয়। যেমন, রাসূল (সা.) আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেছেন। তিনি বিভিন্ন যুদ্ধ ও বিদায় হজ্জের সময় তাকে মদীনায় চৌদ্দবার স্থলাভিষিক্ত করেছেন। এ সম্মানিত সাহাবী কাদেসিয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং সে যুদ্ধে শহীদ হন। তিনি অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও সেদিন তাঁর হাতে মুসলিমগণের ঝাণ্ডা ছিল। তাঁর প্রতিবন্ধী হওয়া তাকে সম্মান ও গুরুত্ব দিতে ইসলাম সংকোচ ও বাঁধা দেয়নি।
আরেক সাহাবী মুআয ইবনে জাবাল (রাযি.)-কে রাসূল (সা.) ইয়ামেনের গভর্নর করে পাঠান। বরং তিনি ইয়ামেনবাসীর কাছে লিখে পাঠান যে, ‘আমি আমার পরিবারের উত্তম একজনকে তোমাদের কাছে পাঠালাম।’ অথচ মুআয (রাযি.) একজন পঙ্গু ছিলেন। তাঁর পঙ্গুত্ব ইসলামী রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা লাভে বাঁধা দেয়নি।
আরেক সম্মানিত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.), যিনি উম্মতের মহাপণ্ডিত, আল-কুরআনের ভাষ্যকার ছিলেন, তাঁর যুগে তিনি ইলমের ভাণ্ডার জমা করেছিলেন ফলে শরয়ী ইলমের ব্যাপারে তিনি উম্মতের জন্য রেফারেন্স হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন। তার চক্ষু শক্তি না থাকা সত্ত্বেও সব চক্ষুবান তাঁর কাছে ফতওয়া জিজ্ঞেস করতেন। ইবনে আব্বাস (রাযি.) তাঁর অবস্থা সম্পর্কে বলেন, যদিও আল্লাহ আমার চোখের আলো নিয়ে গেছেন, তবে আমার জবান ও শ্রবণ শক্তিতে রয়েছে আলো।
আমার অন্তর পবিত্র ও প্রখর, আর আমার বুদ্ধিমত্তা হলো সরল সঠিক, আমার মুখে আছে সত্য বলতে ধারালো তলোয়ারের ন্যায় শক্তি। বাশশার ইবনে বুরদ, যিনি তাঁর যুগের অন্ধ কবিদের অন্যতম ছিলেন। তাঁর অনেক কবিতাই বর্তমান যুগেও বহুল প্রচলিত ও প্রসারিত হয়ে আছে। অনেক চক্ষুবান কবি তার সমকক্ষ এতো সুন্দর কবিতা রচনা করতে পারনি।
‘আতা (রহ.) একজন কৃষ্ণাঙ্গ, অন্ধ, খাঁদা নাক বিশিষ্ট, হাতে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ও ল্যাংড়া লোক ছিলেন। বলতে গেলে একজন অর্থহীন লোক, কেউই তার থেকে কিছু আশা করতে পারে না, কিন্তু আমাদের চিরন্তন ও উদার শরীআত তাকে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ, বিজ্ঞ আলেম ও ইমাম বানিয়েছে। তিনি মানুষের ফতওয়ার রেফারেন্স ও উৎসস্থল ছিলেন। তার মাদরাসা থেকে হাজার হাজার আলেম বের হয়েছেন। তিনি তাদের কাছে গর্ব-অহংকার, ভালবাসা, সম্মান ও মর্যাদার পাত্র ছিলেন।
প্রতিবন্ধিতা যাদেরকে বিশ্বের
মধ্যে অনন্য প্রতীক করেছে
ইসলামি বিশ্বের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে কিছু লোককে তাদের প্রতিবন্ধীতা বিশ্বে অনন্য প্রতীক বানিয়েছে। তাদের কয়েক জনের নাম এখানে উল্লেখ করছি।
- আল-আহওয়াল (ট্যারা চক্ষুবিশিষ্ট): ‘আসিম ইবনে সুলাইমান আল-বসরী (মৃত্যু ১৪২ হি.), তিনি হাফিযুল হাদীস ও সিকাহ ছিলেন। আধ্যাত্মিকতা ও ইবাদত-বন্দেগিতে তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন।
- আল-আখফাশ (দিন-কানা): আলিমদের কাছে এ নামে চারজন পরিচিত, তারা হলেন, বড় আখফাশ, মেঝ আখফাশ, ছোট আখফাশ ও দামেস্কের আখফাশ। আখফাশ আল-আকবার হলেন আবদুল হামীদ আবদুল মজীদ (মৃত্যু ১৭৭ হি.), তিনি আরবী ভাষার বড় পণ্ডিত ছিলেন। আখফাশ আল-আওসাত হলেন সাঈদ ইবনে মাসআদা আল-জামাশায়ী (মৃত্যু ২১৫ হি.), তিনি আরবী ভাষা ও সাহিত্যের বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন। আখফাশ আল-আসগার হলেন আলী ইবনে সুলাইমান ইবনে ফদল (মৃত্যু ৩১৫ হি.), তিনি নাহু বিশেষজ্ঞ ছিলেন। আর আখফাশ আদদামেস্কী হলেন হারুন ইবনে মূসা ইবনে শরীক আস-সা‘আলাবী (মৃত্যু ২৯২ হি.), তিনি দামেস্কের কারীদের শায়খ ছিলেন। তিনি তাফসীর, ইলমে মা‘আনী ও কবিতা জানতেন।
- আল-আসাম (সাদা পা বিশিষ্ট): আলেমদের কাছে এ নামে দু’জন প্রসিদ্ধ। তারা হলেন, হাতিম ইবনে উনওয়ান (মৃত্যু ২৩৭ হি.), তিনি আল্লাহভীরুতা, আত্মসংযম ও অনাড়ম্বরতায় বিখ্যাত ছিলেন। তাকে এ উম্মতের লুকমান হাকিম হিসেবে বলা হয়ে থাকে। আর দ্বিতীয়জন হলেন মুহাম্মদ ইবনে ইয়াকুব ইবনে ইউসুফ আল-উমাবী। তিনি ৩৪৬ হি. মৃত্যুবরণ করেন। তিনি একজন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, সিকাহ ও আমীন ছিলেন।
- আল-আ’রাজ (খঞ্জ): ইনি হলেন আবদুর রহমান ইবনে হরমুয, ১১৭ হিজরীতে মৃত্যু বরণ করেন। তিনি বনী হাশিমের দাস ছিলেন। তিনি একজন হাফিয ও কারী ছিলেন। আবু হুরাইরা (রাযি.) থেকে ইলম অর্জন করেন। কুরআন ও সুন্নাহতে বিখ্যাত ছিলেন। তিনি আরবদের নসব সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ ছিলেন।
- আল-আ’মাশ (ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন): সুলাইমান ইবনে মিহরান আল-আসাদী, ১৪৮ হিজরীতে মৃত্যু বরণ করেন। তিনি একজন বিখ্যাত তাবেয়ী ছিলেন। তিনি কুরআন, হাদীস ও ফারায়েয সম্পর্কে বিজ্ঞ ছিলেন। তিনি দরিদ্র ও অভাবী থাকা সত্ত্বেও তার মজলিসে রাজা বাদশারা নিজে এসে উপস্থিত হতেন।
- আল-আ’মা (অন্ধ): মুআবিয়া ইবনে সুফইয়ান, (মৃত্যু ২২০ হি.)। তিনি ইমাম কাসায়ীর শিষ্য ও বাগদাদের কবি ছিলেন।
- আল-আফতাস (চেপ্টা নাক বিশিষ্ট): আলী ইবনে হাসান আল-হুযালী, (মৃত্যু ২৫৩ হি.)। তিনি নিসাপুরের বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও তাদের শায়খ ছিলেন। তিনি হাফেযে হাদীস ছিলেন এবং তার নিজস্ব মুসনাদ রয়েছে।
প্রতিবন্ধীদের জন্য আমাদের করণীয়
- নিজের সুস্থতা ও আরোগ্যতার কারণে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং প্রতিবন্ধী ভাইদের জন্য দুআ করা। ইসলাম তাদের যে সব অধিকার দিয়েছে তা যথাযথভাবে আদায় করা।
- যথাসম্ভব প্রতিবন্ধীদের সাহায্য-সহযোগিতা করা। সেটা অন্ধ ব্যক্তিকে রাস্তা চলায় সাহায্য করা হোক কিংবা তাদের জীবন-যাপনের ক্ষেত্রে সাহায্য করা হোক কিংবা তাদের শিক্ষাদানে সহযোগিতা হোক। সুস্থদের সামান্য সাহায্যে তাদের জীবন-যাপন সহজ হতে পারে, তাদের মুখে ফুটতে পারে হাসি এবং তারা দাঁড়াতে পারে সমাজের সবার সাথে এক লাইনে।
- আমাদের মনে রাখা দরকার, প্রতিবন্ধীর দেখাশোনা করা তার ওপর জরূরী, যে তার অভিভাবক। আর সমষ্টিগতভাবে সকল মুসলিমের জন্য ফরযে কিফায়া। অর্থাৎ সমাজের কিছু লোক তাদের দেখাশোনা করলে বাকি লোকেরা গুনাহগার হবে না।
- তাদের জন্য এমন কিছু শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার যা তাদের প্রয়োজনীয় কাজ নিজে করতে সাহায্য করবে এবং নিজে রোজগার করে স্বয়ং সম্পন্ন হতে পারে। তাদের শিক্ষা-প্রশিক্ষণে বর্তমান যুগে বিভিন্ন ধরনের উপকরণ আবিষ্কৃত হয়েছে, যেমন স্পষ্ট হস্তলিপি, সাঙ্কেতিক ভাষা, হুইল চেয়্যার, চলন্ত চেয়ার, কম্পিউটার প্রোগ্রাম ইত্যাদি। এই রকম যাবতীয় উপকারি উপকরণ ব্যবহার করে তাদেরকে দক্ষ করে গড়ে তোলা উচিত।
- প্রতিবন্ধীর কল্যাণে আমাদের দেশে ১৯৯৯ সালে ‘জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন’ গঠিত হলেও ২০০৯ সালে এর কার্যক্রমে নতুন গতি সঞ্চার হয়। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠান নিজস্ব ভবনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার, বিনামূল্যে চিকিৎসা, শিক্ষা উপকরণ ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করছে যা পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন জেলায় সমপ্রসারণ করা হবে। এছাড়াও সমাজ সেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় দরিদ্র প্রতিবন্ধী ভাতা ও ছাত্রদের জন্য শিক্ষা বৃত্তির ব্যবস্থা রয়েছে। বিভিন্ন সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধীদের কোটা রয়েছে। অনেক বেসরকারি সংস্থা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সরকারিভাবে এসব কার্যক্রম মনিটরিংয়ের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। আমাদের উচিত প্রতিবন্ধীদেরকে এ সব সাহায্য সহযোগিতার কথা জানানো। তাদের অনেকেই এ সুযোগ সুবিধার কথা আদৌ জানে না, বা জানলেও যথাযথ উদ্যোগের অভাবে ভোগ করতে পারে না।
- বিশ্বের প্রায় শতকরা ১০ ভাগ জনগোষ্ঠী যে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধিতার সমস্যায় আক্রান্ত। তাদের অন্যসব নাগরিকের মতো সমান অধিকার ও সুযোগের সমতা বিধান ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ ও বিশ্বব্যাপী সচেতনতা তৈরিতে প্রতিবছর ৩ ডিসেম্বর ‘বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস’ পালিত হয়। প্রায় ত্রিশ বছর আগে জাতিসংঘ এ দিবসের সূচনা করে ২০০৬ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কনভেনশন (Convention on the Rights of Persons with Disabilities) প্রণয়ন করার মধ্য দিয়ে অধিকার রক্ষায় একটি নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। কিন্তু সিআরপিডির আদলে এখনো আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১ কিংবা প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন ২০১০ কোনটিরই পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি যা দুর্ভাগ্যজনক। কালবিলম্ব না করে এ বিষয়ে দ্রত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন। কারণ এ আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, কর্মসংসংস্থানসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার ও রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক অধিকার সুরক্ষা ও সমতা নিশ্চিত করা সম্ভব। বাংলাদেশ ২০০৭ সালে সিআরপিডিতে স্বাক্ষর ও অনুসমর্থন করেছে।
আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, শুধুমাত্র আইনি সুরক্ষা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সমাজে সহজগম্যতা বা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য যথেষ্ট নয়। এজন্য প্রয়োজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতি আমাদের সমাজে বিদ্যমান নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা। ইসলাম তাদেরকে যেভাবে সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে তা সবার মনে রাখা দরকার। আল্লাহর কাছে তাকওয়া ছাড়া শারীরিক অবকাঠামোর কোনো মূল্য নেই। প্রতিবন্ধীরাও মানুষ। আর আল্লাহ সব মানবজাতিকে সম্মানিত করেছেন।