খলিফায়ে মাদানী মাওলানা শাহ মুহাম্মদ নোমান (রহ.)-এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
মুহাম্মদ রুহুল আমীন নগরী
প্রখ্যাত আলেম, বুর্যুগ ব্যক্তিত্ব ও শায়খুল ইসলাম সাইয়েদ হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ.)-এর অন্যতম খলিফা হযরত মাওলানা শাহ মুহাম্মদ নোমান (রহ.) একজন সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তাঁর কথা বার্তায় মনে হতো সত্যিই তিনি একজন ‘মাটির মানুষ’। তিনি আজ আমাদের মাঝে আর নেই। গত ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ মঙ্গলবার সকাল ৭:৪৫ মিনিটে চট্টগ্রাম পটিয়ায় নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। খলিফায়ে মাদানী হযরত মাওলানা শাহ নোমান ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন।
জন্ম
তিনি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার ছনহারা এলাকার আলমদারপাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম মাওলানা আব্দুল করিম। ভোটার আইডি কার্ড অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ২১ মে ১৯২৭ ঈসায়ী। তবে তাঁর প্রকৃত বয়স আরো বেশি।
জিরি মাদরাসায় শিক্ষাজীবন শুরু। পরে দারুল উলুম মুইনুল ইসলাম হাটহাজারী ও দারুল উলুম দেওবন্দে তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। দেওবন্দে ৪ বছর অধ্যয়ন এবং ২ বছর স্বীয় মুরশিদ শায়খুল ইসলাম সায়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ.)-এর সান্নিধ্যে থেকে মোট ৬ বছর দেওবন্দে অতিবাহিত করেন। পরে মাদানী (রহ.) কর্তৃক খেলাফত প্রাপ্ত হন।
কর্মজীবন
দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে দেশে ফিরে ঢাকা আশরাফুল উলুম বড়কাটারা মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবনের সুচনা। এখানে তিনি ৫ বছর শিক্ষতার মহান পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। এছাড়া চট্টগ্রামের মুজাহেরুল উলুম মাদরাসা, বান্দরবান ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্রেও অধ্যাপনা করেন। জীবনের শেষ বয়সে তিনি মাদরাসা থেকে অবসর নিয়ে বাড়িতে ছিলেন। এসময় বিভিন্ন স্থানে ইসলাহী ময়দানে, ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে জনগণের নিকট দীনের দাওয়াত দেন। সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তার হাজার হাজার ভক্ত-মুরিদ রয়েছেন।
তিনি পটিয়া নিবাসী সিরাজুল ইসলামের ২য় কন্যা ফাতেমা বেগমের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। ৬ ছেলে, ৩ মেয়ের জনক ছিলেন তিনি। তাদের সন্তানগণ হলেন, মাওলানা রেজওয়ান আহমদ, হাফিজ ওসমান, লোকমান আহমদ, মাওলানা সালমান আহমদ, হাফিজ সুফিয়ান আহমদ, মোহাম্মদ বুরহান উদ্দীন। এবং কন্যাগন হলেন, সফওয়ানা, রেহেনা ওফারহানা। মাওলানা নোমান আহমদ ২ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ট।
রাজনৈতিক ময়দানে তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ২০০৮ সালের ২৬ জুন ঢাকায় অনুষ্ঠিত জমিয়তের জাতীয় কাউন্সিলে তিনি উপস্থিত থেকে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। তাঁর সাথে আমার (এই লেখকের) এই প্রথম সাক্ষাত হয়। এরপরে ২০০৮ সালের ২৬ আগস্ট মাসিক মদীনা সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের গেন্ডারিয়া বাসভবনে অসুস্থ খান সাহেবকে দেখতে আসেন। সেদিন আমি প্রবীণ এই বুযুর্গের সাথে র্দীঘ সময় কথা বলা সুযোগ পেয়ে যাই। এরপরে সিলেটের দক্ষিণ কাছে মাওলানা রেজাউল করিম কাসেমীর বাসায় এক ইসলাহী মাহফিলে তিনি আসেন। ২ দিন সিলেট অবস্থান করার সুবাদে আমি তখন তার সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত সংগ্রহ করি। সে দিন তিনি মওলানা ভাসানী, মুফতি মাহমুদ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন নিয়ে আলোচনা করেন। এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে তার অংশ গ্রহণের কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, দেশ স্বাধীনের পরে ‘শেখ সাহেব আমার বাড়ীতে লোক পাঠিয়ে ছিলেন। আমাকে উলামা লীগের দায়িত্ব গ্রহণের কথা বলেছিলেন, কিন্তু আমি তা বিনয়ের সাথে প্রত্যাখান করেছি।’
গত জানুয়ারি ২০১১ সালে সিলেট দক্ষিণকাছে মাওলানা নোমান বলেন, ইসলামী বিধান অনুযায়ী পাকিস্তানের সংবিধান তৈরির জন্য মুফতী মাহমুদ (রহ.) শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের সাথে আলোচনা করেন। তখন শেখ সাহেব বলেছিলেন, মুফতি সাহেব! এই প্রস্তাবটি আরো কয়েকদিন আগে দিলেন না কেনো? এখনতো আমি নির্বাচনী ইশতেহার জনগণের হাতে দিয়েদিছি। এই মুহূর্তে আমার করার কিছু নেই। তবে আপনি যখন পার্লামেন্টে ইসলামী শাসনতন্ত্র উত্থাপন করবেন, তখন আমি বিরোধিতা করবো না বরং চুপ থাকবো।’
এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি দেশব্যাপী আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন চলছে, যার দরুন আইয়ুব শাহির টনক নড়ল। মসনদে বসে নিজের খেয়াল খুশি মতো রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব নয় দেখে বাধ্য হয়ে গোল টেবিল কনফারেন্স আহবান করত সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে একটি সমঝোতায় পৌছতে চাইলে জমিয়ত নেতা মুফতী মাহমূদ সাহেব নির্দিষ্ট তারিখে পূর্বপাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে অনুপস্থিত দেখে কনফারেন্সে বসতে অসম্মতি প্রকাশ করে বললেন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বৈঠকে কোন একজন নেতাকে অনুপস্থিত রেখে বৈঠকে বসা মোটেই সমীচীন নয়। এতে গোল টেবিল বৈঠক ব্যর্থ হবে। আমি কখনও এ জাতীয় কনফারেন্সে যোগ দেব না।’ মুফতি সাহেবের এই ন্যায়সংগত দাবির চাপে সেই দিনের কনফারেন্স মুলতবি হল। তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলার কেইসে জেল হাজতে ছিলেন। আইয়ুব খান অনন্যোপায় হয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে তার সঙ্গী-সাথীসহ মুক্তি দিলেন। অতঃপর গোলটেবিল কনফারেন্স বসল।’
ফখরে মিল্লাত মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (রহ.) মাওলানা নোমান সাহেব প্রসঙ্গে একদিন আমাকে বলেছেন, ‘তিনি একজন বড়মাপের আল্লাহঅলা লোক। শায়খুল ইসলাম মাদানীর খলিফা।’
মাওলানা খান আরো বলেন, খলিফায়ে মাদানী মাওলানা আমিনুল হক মাহমুদী (যিনি আমার ভগ্নিপতি), মাওলানা আবদুল হক শায়খে গাজিনগরী ও চট্টগ্রামের মাওলানা নোমান সাহেব এই তিনজনের মধ্যে অত্যন্ত গভীর সুসর্ম্পক ছিলো।
পরিশেষে আমরা দোয়া করি, মহান আল্লাহ তার সকল দীনি খেদমত কবুল করে তাকে যেনো জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করেন। আমীন।