কুদৃষ্টি সব অনিষ্টের মূল
হযরত মাওলানা পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী (দা. বা.)
অনুবাদ: মাও. উমায়ের কোব্বাদী নকশবন্দী
পরনারীর প্রতি কামনার দৃষ্টিতে তাকানো সকল অনিষ্টের মূল। শয়তান পরনারীর চেহারাকে খুব নয়নলোভন পদ্ধতিতে উপস্থাপন করে। দূর থেকে সব জিনিস ভালোই দেখায়। এজন্যই প্রবাদ আছে, দূরের ঢোল শ্রুতিমধুর হয়। কুদৃষ্টির ফলে মানবহৃদয়ে পাপের বীজ তৈরি হয়। সুযোগ পেলেই তা ফুলে-ফেঁপে বিশাল হয়ে ওঠে। কাবিল হাবিলের স্ত্রীর রূপ-যৌবনের প্রতি কুদৃষ্টি দিয়েছিল। পরিণামে তার কাঁধে এমনই ভূত চড়ে বসেছিল, আপন ভাইকে হত্যা করতেও তার কলিজা কাঁপেনি। পবিত্র কুরআনে তার এহেন কর্মকাণ্ডের আলোচনা এসেছে। গুনাহর ভিত্তি রচনা করার কারণে কেয়ামত পর্যন্ত ঘটিতব্য সকল হত্যার বোঝা তার ঘাড়েও চাপানো হবো।
বোঝা গেল, প্রথমদৃষ্টির ব্যাপারে তো ছাড় আছে। কিন্তু দ্বিতীয়বারের ক্ষেত্রে এই ছাড়টা আর থাকবে না।
چلے كہ ايك نظر تيرى بزم ديكھ آئيں
يہا ں جوآ ے تو بے اختيار بيٹھ گے
‘চল, একপলক দেখে আসি সভা তোমার,
মনের অজান্তেই এখানে এসেই তুমি বসে পড়লে।’
এজন্য এটাই শ্রেয় যে, প্রথমদৃষ্টির হেফাজত করবে। আশঙ্কার ভেতরে পড়ে যাওয়া সচেতন লোকদের স্বভাব নয়।
কুদৃষ্টি ব্যভিচারের প্রথম সিঁড়ি
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
«الْعَيْنَانُ زِنَاهُمَا النَّظَرُ وَالْأُذُنَانِ زِنَاهُمَا الِاسْتِمَاعُ وَاللِّسَانُ زِنَاهُ الْكَلَامُ وَالْيَدُ زِنَاهَا الْبَطْشُ وَالرِّجْلُ زِنَاهَا الْـخُطَا وَالْقَلْبُ يَهْوَىٰ وَيَتَمَنَّىٰ وَيُصَدِّقُ ذَلِكَ الْفَرْجُ وَيُكَذِّبُهُ»
‘দুই চোখের ব্যভিচার হল হারাম দৃষ্টি দেয়া, দুই কানের ব্যভিচার হল পরনারীর কণ্ঠস্বর শোনা, যবানের ব্যভিচার হল অশোভন উক্তি, হাতের ব্যভিচার হল পরনারী স্পর্শ করা, পায়ের ব্যভিচার হল গুনাহর কাজের দিকে পা বাড়ান, অন্তরের ব্যভিচার হল কামনা-বাসনা আর গুপ্তাঙ্গ তা সত্য অথবা মিথ্যায় পরিণত করে।’ (মিশকাত শরীফ, ১/৩২)
ইমাম গাযালী (রহ.) বলেন, ‘দৃষ্টি অন্তরে খটকা তৈরি করে। খটকাটা কল্পনায় রূপ নেয়। কল্পনা জৈবিকতাড়নাকে উসকে দেয়। আর জৈবিকতাড়না ইচ্ছার জন্ম দেয়।’ সুতরাং বোঝা গেল পরনারীকে দেখার পরেই ব্যভিচারের ইচ্ছা জাগে। না দেখলে ইচ্ছাও জাগবে না। প্রতীয়মান হল, ব্যভিচারের প্রথমসিঁড়ির নাম হল কুদৃষ্টি। প্রবাদ আছে, পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম সফর এক পা ওঠালেই শুরু হয়ে যায়। অনুরূপভাবে কুদৃষ্টির মাধ্যমে শুরু হয় ব্যভিচারের সফর। ঈমানদারের কর্তব্য হল সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা ফেলা থেকে বিরত থাকা।
কুদৃষ্টি থেকে বেঁচে থাকার
মাঝে রয়েছে ঈমানের স্বাদ
মুসনাদে আহমদে এসেছে, নবীজী (সা.) বলেছেন,
«مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَنْظُرُ إِلَىٰ مَحَاسِنِ امْرَأَةٍ أَوَّلَ مَرَّةٍ، ثُمَّ يَغُضُّ بَصَرَهُ إِلَّا أَحْدَثَ اللهُ لَهُ عِبَادَةً يَجِدُ حَلَاوَتَهَا».
‘কোনো মুসলিমব্যক্তি কোনো নারীর সৌন্দর্যের দিকে তাকাল, এরপর সে তার দৃষ্টি নামিয়ে নিল, আল্লাহ তাআলা তার অন্তরে ইবাদতের এমন স্বাদ দান করবেন, যা সে অনুভব করবে।’ (মুসনদে আহমদ, ৩৬/৬১০, হাদীস: ২২২৭৮)
তাবারানী শরীফে পরনারী থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে,
«مَنْ تَرَكَهَا مِنْ مَخَافَتِيْ أَبْدَلْتُهُ إِيْمَانًا يَجِدُ حَلَاوَتَهُ فِيْ قَلْبِهِ».
‘যে আমার ভয়ে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবে, আমি অন্তরে এমন ঈমান সৃষ্টি করব, যাতে সে তার স্বাদ পাবে।’ (আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব, ২/৩৭)
কত উপকারী বেচাকেনা। কুদৃষ্টির সাময়িক ও তুচ্ছ স্বাদ ছেড়ে দিলে ঈমানের স্থায়ী মিষ্টতা ভাগ্যে জুটে। প্রতীয়মান হল, মহান আল্লাহ এমন ব্যক্তির বুকে প্রশান্তি দান করেন। এটা নিয়মের কথাও যে, আমলের প্রতিদান অনুরূপ বস্তু দ্বারা দেয়া হয়। সুতরাং পরনারীর প্রতি দৃষ্টি দেয়ার ক্ষণিকের মজা ছেড়ে দিলে, এর বিনিময়ে আল্লাহ ঈমানের স্বাদ দান করবেন।
কুদৃষ্টি দ্বারা কখনও তুষ্ট হওয়া যায় না
হযরত থানভী (রহ.) বলেন, কুদৃষ্টি যতই দাও, এমন কি হাজার হাজার নারী-পুরুষ চোখের সামনে ঘোরালেও, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কুদৃষ্টি দিলেও পরিতৃপ্ততার নাগাল পাওয়া যাবে না।
কুদৃষ্টি এমন পিপাসার নাম যা নিবারণ হয় না। পানিখেকো রোগীর মত। পানি যতই পান করুক, এমন কি পেট ফেটে যাওয়ার মত অবস্থা হলেও যেন পিপাসা মিটে না।
সৌন্দর্য আপেক্ষিক বিষয়। আল্লাহতাআলা একজনের চাইতে আরেকজনকে বেশি সৌন্দর্য দান করেছেন। যত সুন্দরী নারীই দেখুক না কেন, আরেকজনকে দেখার পিপাসা অন্তরে রয়েই যায়। এই সমুদ্রে সারাজীবন সাতার কেটেও তীরের নাগাল পাবে না। কারণ এই সমুদ্র কূল-কিনারাবিহীন।
কুদৃষ্টি ক্ষতকে গভীর করে
কুদৃষ্টির তীর বিঁধে গেলে অন্তরের জ্বালা শুধু বাড়তেই থাকে। কুদৃষ্টির বৃদ্ধির পাশাপাশি হৃদয়ের এ ক্ষত আরো গভীর হতে থাকে। হাফেজ ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, দৃষ্টির তীরে প্রথমে বিদ্ধ হয় নিক্ষেপকারী নিজেই। কারণ হল, দৃষ্টি নিক্ষেপকারী অপরপক্ষের দৃষ্টিবিনিময়কে নিজের ক্ষতের ওষুধ বলে মনে করে। অথচ তা ক্ষতকে আরো গভীর করে। (আল-জাওয়াবুল কাফী, পৃ. ৪১৭)
لو گ كا نٹو ں سے بچ كے چلتے ہيں
ہم نے پھو لو ں سے زخم كھا ۓ ہيں
‘লোকেরা চলে কাঁটা এড়িয়ে আর আমি/ফুলের আঘাতে আহত।’
হাফিয ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন,
الصَّبْرُ عَلَىٰ غَضِّ الْبَصَرِ أَيْسَرُ عَلَى الْصَّبْرِ عَلَى الْقَدِّ بَعْدَهُ.
‘চোখ বুজে নেওয়া কঠিন নয়, তবে চোখ খোলা রাখার পরবর্তী কষ্টে ধৈর্যধারণ করা কঠিন।’ (প্রাগুক্ত)
এ থেকে বুড়োরাও নিরাপদ নয়
ব্যভিচার থেকে অনেকেই বেঁচে থাকতে পারে। কারণ, এটি করার জন্য আয়োজন লাগে। প্রথমত সঙ্গীর সম্মতি লাগে। দ্বিতীয়ত উপযুক্ত স্থান ও সুযোগের দরকার হয়। তৃতীয়ত মানুষের সামনে ধরা খেলে লাঞ্ছিত হতে হয়, তাই নির্জনতারও প্রয়োজন হয়। এজন্য ভদ্র ও সম্মানিতলোকেরা এতে কম জড়ায়। পেশাদারনারীর সাথে ব্যভিচার করতে হলে টাকা-পয়সা পানির মত ঢালতে হয়। তাছাড়া এইডস সিফিলিস টাইপের যৌন রোগের ভয় তো আছেই। পক্ষান্তরে কুদৃষ্টির গুনাহ করতে হলে এত কিছুর দরকার হয় না। এতে মানসম্মান যাওয়ার ভয় থাকে না। কারণ, কে কোন্ দৃষ্টিতে কার দিকে তাকাচ্ছে- এটা তো আল্লাহই ভালো জানেন। বৃদ্ধ লোকটি যে কি-না যৌনক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, সেও খারাপ দৃষ্টিতে দেখতে পারে। বরং অনেক সময় সে গুনাহ না করতে পারার আফসোসেও কুরে কুরে জ্বলতে পারে। কবির ভাষায়:
جوا نى سے زياد ہ وقت پيرى جوش ہوتا ہے
بهڑ كتا ہے چراغ صبح جب خاموش ہوتا ہے
‘অনেক সময় যৌবনের চাইতে বার্ধক্যের তেজ বেশি হয়,
(যেমন) নিস্তব্ধ ভোরে প্রদীপ জ্বলে ওঠে।’
অনেকে দেহের দিক থেকে বৃদ্ধ হলেও অন্তরের দিক থেকে সতেজ থাকে। এরা যৌবনের স্মৃতি সবসময় নিজেদের মাঝে খুঁজে ফিরে। কবির ভাষায়:
پيرى تمام ذكر جوانى كٹ گئ
كيا رات تھى كہ ايك كہانى ميں كٹ گئ
‘যৌবনস্মৃতিতে চলে গেল গোটা বার্ধক্য,
কী সে রাত ছিল যে, এককাহিনীতেই শেষ হয়ে গেল।’
অনেকের এক পা চলে যায় কবরে, কোমরটা সোজা রাখতে পারে না, তবুও খুঁজে বেড়ায় হারিয়ে যাওয়া যৌবনকে। কবির ভাষায়:
عہد پيرى ميں جوانى كى امنگ
أه كسى وقت ميں كيا ياد آيا
‘বৃদ্ধবেলায় যৌবনের উদ্দামতা,
আহ! কোন্ সময় কী যে মনে পড়ে গেল।’
তামাশার আরেকটি দিক হল, অনেক সময় নারীরা পরপুরুষকে ‘বুড়ো মানুষ’ মনে করে পর্দা করে না, ফলে বুড়োমানুষটি কুদৃষ্টির গুনাহ সহজেই করে নিতে পারে। কামনালিপ্সু বৃদ্ধরা চুল সাদা করে ফেলে, কিন্তু অন্তর থাকে কলুষিত। বিচারদিবসে সময়ের ভাষাতে বলবে:
ناكرده گنا ہو ں كى بهى حسرت كى ملے داد
يا رب! ا گران كرده گنا ہو ں كى سزا ہے
‘না করা গুনাহগুলোর যে আফসোস, তারও আজ সাজা হবে।
প্রভু হে! যদি শুধু কৃত গুনাহগুলোর শাস্তি হত।’
হযরত থানভী (রহ.) বলেন, এক বৃদ্ধকে আমি চিনতাম। অনেক কাজে তিনি ছিলেন আল্লাহভীরু। কিন্তু তিনি নিজে বলেছেন, তিনি কুদৃষ্টির রোগে আক্রান্ত। কুদৃষ্টির গুনাহ এতটাই ভয়াবহ। বুড়োমিয়া কবরের পাড়ে চলে গেছেন কিন্তু পুরনোরোগ তার সাথে লেগেই আছে।
কুদৃষ্টির কারণে আমলের
তওফীক ছিনিয়ে নেয়া হয়
শায়খুল হাদীস মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া (রহ.) বলেন, কুদৃষ্টি অত্যন্ত খতরনাক রোগ। এ বিষয়ে আমার নিজেরও একটা অভিজ্ঞতা আছে। আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব যিকির ও মুজাহাদার প্রথম দিকে জোশ ও মজার ঘোরে থাকেন। কিন্তু কুদৃষ্টির কারণে ইবাদতের মজা হারিয়ে ফেলেন। পরিণামে ধীরে ধীরে ইবাদত ছেড়ে দেয়ার দিকে অগ্রসর হন। (আপবীতী, ৬/৪১৮)
উদাহরণস্বরূপ, সুস্থ যুবকের যদি জ্বর হয়, ভালো হওয়ার নামও না থাকে তাহলে দুর্বলতার কারণে সে চলাফেরাতেও অক্ষম হয়ে পড়ে। কাজের প্রতি সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তার মন চায় বিছানায় পড়ে থাকতে। অনুরূপভাবে কুদৃষ্টির রোগে আক্রান্তব্যক্তিও আধ্যাত্মিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। নেককাজ করা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। কিংবা কথাটা এভাবেও বলা যেতে পারে যে, আমলের তাওফিক তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়। নেককাজের নিয়তও করে, কিন্তু কুদৃষ্টির কারণে নিয়তে দুর্বলতা চলে আসে। কবির ভাষায়:
تيار تهے نماز كو ہم سن كے ذكر حور
جلوه بتو ں كا ديكھ كر نيت بدل گئ
‘জান্নাতিহূরের কথা শোনে নামাযের জন্য
প্রস্তুত ছিলাম, মূর্তিগুলোর দাপানি দেখে নিয়ত পাল্টে গেল।’
কুদৃষ্টির কারণে স্মৃতিশক্তি
দুর্বল হয়ে পড়ে
মাওলানা খলিল আহমদ সাহারানপুরী (রহ.) বলেন, পরনারী কিংবা সুশ্রীবালকের প্রতি কামনার দৃষ্টিতে তাকালে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এ কথার সত্যতার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, কুদৃষ্টিদানকারী হাফিযের ‘মঞ্জিল’ মুখস্থ থাকে না। হিফযপড়ুয়া ছাত্রদের কুরআন মুখস্ত করা জটিল হয়ে দাঁড়ায়।
ইমাম শাফিয়ী (রহ.) নিজ শিক্ষক ইমাম ওয়াকী (রহ.)-এর কাছে স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার অভিযোগ করেন। তিনি তাঁকে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার দিকনির্দেশনা দেন। ইমাম শাফিয়ী (রহ.) এ ঘটনাকে কবিতার পোশাক পরিয়ে বলেন,
شَكَوْتُ إِلَىٰ وَكِيْعٍ سُوْءَ حِفْظِيْ
فَأوْصَانِيْ إِلَىٰ تَرْكِ ا لْـمَعَاصِيْ
فَإِنَّ الْعِلْمَ نُوْرٌ مِّنْ إِلَـهِيْ
وَنُوْرُ اللهِ لَا يُعْطَىٰ لِعَاصِيْ
‘আমি ইমাম ওয়াকীর কাছে নিজের স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা সম্পর্কে অভিযোগ করলাম। তিনি আমাকে উপদেশ দিয়ে বললেন, হে ছাত্র! গুনাহ ত্যাগ কর। কেননা, ইলম আল্লাহতাআলার নূর। আল্লাহর নূর কোনো গুনাহগারকে দেয়া হয় না।’
কলেজ ইউনিভার্সিটি বিশেষত মাদরাসার ছাত্রদের জন্য এতে শিক্ষাগ্রহণের উপকরণ আছে।
কুদৃষ্টি লাঞ্ছণার কারণ
শায়খ ওয়াসিতী (রহ.) বলতেন, মহান আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে লাঞ্ছিত করতে চান, তখন তাকে সুন্দর চেহারা দেখার অভ্যাসে লিপ্ত করে দেন। বোঝা গেল, কুদৃষ্টি অপমানিত হওয়ার মৌলিককারণ। যেসব সৌভাগ্যবান নিজেদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে তারা অনেক আপদ-মুসিবত থেকে বেঁচে থাকতে সক্ষম হয়। মীর তকী মীরের ভাষায়,
اس عاشقى ميں عزت سادات بهى گئ۔
‘প্রেমের এ খেলায় সাইয়েদদের সম্মানও গেল।’
মির্জা গালিব বলেন,
عشق نے غالب كو نكما كرديا
ورنہ ہم بهى آدمى تهے كام كے
‘প্রেমমগ্নতা গালিবকে করেছে অকর্মা,
অন্যথায় আমিও ছিলাম কাজের মানুষ।’
কুদৃষ্টির কারণে বরকত শেষ হয়ে যায়
কুদৃষ্টির অন্যতম মন্দপ্রভাব হল, এর কারণে রুটি রুজি ও সময়ের বরকত শেষ হয়ে যায়। ছোট ছোটকাজে বড় বড় সমস্যা ছুটে আসে। যাপিতজীবনের কষ্ট ও চেষ্টা সফলতার মুখ দেখে না। আপাতদৃষ্টিতে কাজ সম্পন্ন মনে হলেও যথাসময়ে কাজ অসম্পন্ন দেখা যায়। পেরেশানি ও টেনশনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ মনে করে, কেউ কিছু একটা করেছে। অথচ সে নিজের আত্মিককলুষতার কারণে বিপদাপদের মধ্যে পড়ে থাকে। নিজেই স্বীকার করে যে, একটা সময় ছিল যখন সে মাটিতে হাত রাখলেও সোনা হয়ে যেত। আর এখন সোনায় হাত রাখলেও মাটিতে পরিণত হয়। এসবই কুদৃষ্টির কারণে হয়।
কুদৃষ্টিদানকারীর কাছে
শয়তানের অনেক আশা-ভরসা
জনৈক বুযুর্গের শয়তানের সাথে দেখা হল। তিনি শয়তানের কাছে জানতে চাইলেন, যে কারণে মানুষ তোমার জালে ধরা পড়ে সে ধ্বংসাত্মক কাজ কোনটি? শয়তান উত্তর দিল, পরনারীর প্রতি কামনার দৃষ্টি দেয়া এমন কাজ, আমি তার ব্যাপারে প্রত্যাশা রাখি যে, সে আমার জালে যেকোনো সময় ফেঁসে যাবে। দৃষ্টি অবনত রাখে এমন লোকের ব্যাপারে আমি নিরাশায় ভুগতে থাকি, আমার অনেক চেষ্টা-তদবির তার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে যায়। আমি শপথ করেছিলাম, আদমসন্তানকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরব। চারিদিকের মধ্যে নিচের দিক পড়ে না। তাই এই দিকটা নিরাপদ। যেব্যক্তি দৃষ্টি নিচু করে সে আমাকে আশাহত করে।
কুদৃষ্টির কারণে নেকি নষ্ট
এবং গুনাহ অনিবার্য
পরনারীর প্রতি কামনার দৃষ্টিদানকারী নগদ হোক কিংবা দেরিতে হোক ইশকেমাজাযী তথা অনৈতিক সম্পর্কে সাধারণত আটকা পড়ে। সে মাখলুককে নিজের প্রেমপাত্র বানিয়ে নেয়। জনৈক লোকের ভাষায়:
تو ہى ميرا دين و ايمان سجنا ں
‘হে প্রিয়তম! তুমিই আমার দীন ও ঈমান।’
এ জাতীয় কাজকে শিরকেখফী তথা গোপন শিরক বলা হয়। অথচ শিরক এমন গুনাহ যার কারণে সকল নেকি ধ্বংস হয়ে যাবে। এটাকেই বলে, নেকী ধ্বংস এবং গুনাহ অনিবার্য।
কুদৃষ্টির কারণে মহান
আল্লাহর অহঙ্কার জেগে ওঠে
নবীজী (সা.) বলেছেন-
أَنَا غَيُوْرٌ وَاللهُ اَغْيَرُ مِنِّيْ وَ مِنْ غَيْرَتِهِ حَرَّمَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَماَ بَطَنَ.
‘আমি আত্মমর্যাদাশীল। আল্লাহ তাআলা আমার চেয়েও অধিক আত্মমর্যাদাশীল। আত্মমর্যাদাবোধের কারণে আল্লাহ বাহ্যিক ও গোপন অশ্লীলতা হারাম করেছেন।’
কুদৃষ্টি বেহায়াপনার ভূমিকাস্বরূপ এটিতে কেউ লিপ্ত হলে মহান আল্লাহর অহঙ্কারে আঘাত আসে। তাকে তাঁর মহান দরবার থেকে অভিশপ্ত করে তাড়িয়ে দেয়া হয়। কুদৃষ্টিদানকারীকে নিজ রহমত থেকে দূরে ঠেলে দেয়া হয়। যারা সৎজীবনযাপন করতে চান, তারা যেন কুদৃষ্টির গুনাহ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকেন। এতে তাঁর রহমতঘনিষ্ঠ হওয়া যাবে।
কুদৃষ্টিদানকারী অভিশপ্ত
হাদীস শরীফে আছে,
لَعَنَ اللهُ النَّاظِرَ وَالْـمَنْظُوْرَ إِلَيْهِ.
‘মহান আল্লাহ অভিশম্পাত দেন দৃষ্টিাদানকারী পুরুষ ও দৃষ্টিদানে সুযোগদানকারী নারীর ওপর।’ (বায়হাকী, মিশকাত শরীফ, পৃ. ২৭০)
যেসব মেয়ে সাজগোজ করে পর্দার তোয়াক্কা না করে ঘুরে বেড়ায় এবং যারা তাদের দিকে কামনার দৃষ্টিতে তাকায় উভয় শ্রেণী অভিশপ্ত। এটা কত বড় ক্ষতির কথা! কুদৃষ্টিদানকারী গুনাহে লিপ্ত থাকাবস্থায় আল্লাহর রহমত থেকে ছিটকে পড়ে এবং তাঁর লা’নতের পাত্র হয়ে যায়। সুতরাং তাওবা করা উচিত। এমন যেন না হয়, মৃত্যু চলে এল অপরদিকে লা’নতের মধ্যে পড়ে রইল। মহান আল্লাহ বলেন,
خَسِرَ الدُّنْيَا وَالْاٰخِرَةَ١ؕ ذٰلِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِيْنُ۰۰۱۱
‘এটা দুনিয়া ও আখেরাতের অপদস্থতা এবং স্পষ্ট অপদস্থতা।’ (সুরা আল-হজ: ১১)
কুদৃষ্টিকে মানুষ সাধারণ মনে করে
কুদৃষ্টি বড় ধরনের গুনাহ হওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ মানুষ একে সাধারণ মনে করে। এজন্য দেদারসে এটি করে যায়। যৌবনের শুরুতে যৌবনের প্রাবল্যের কারণে গুনাহটি করে থাকে। পরে তা এমন দূরারোগ্যব্যাধিতে রূপ নেয় যে, কবরে যাওয়া পর্যন্ত এটি আর ছাড়াতে পারে না। সুতরাং এটি সাধারণ গুনাহ নয় বরং,
إِنَّهُ مِنْ أَعْظَمِ الْـمَصَائِبِ.
‘এটি মহা বিপদের একটি।’
কুদৃষ্টি থেকে কুকর্ম পর্যন্ত
হাফেজ ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, দুর্ঘটনার শুরু হয় দৃষ্টি থেকে। যেমন- লেলিহান আগুনের শুরুটা একটিমাত্র কয়লা দিয়ে। সুতরাং লজ্জাস্থানের সংরক্ষণের জন্য দৃষ্টির সংরক্ষণ জরুরি। (আল-জাওয়াবুল কাফী, পৃ. ২০৪)
যেসব লোক কুদৃষ্টিতে জড়িয়ে পড়ে তারাই কুকর্মে লিপ্ত হয়। যাদের দৃষ্টি স্বাধীনতার শিকার হয় তাদের লজ্জাস্থান নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তখন মানুষ অপরিহার্যভাবে কুকর্মে জড়িয়ে পড়ে। সুতরাং জানা গেল, চোখ প্রথমে শুরু করে এবং লজ্জাস্থান তার শেষটা করে।