ইসলাম অবমাননা: ব্লাসফেমি আইন নাকি ফৌজদারি দণ্ডবিধি?
তারেকুল ইসলাম
ব্লাসফেমি আইন বা এই পরিভাষাটি মুসলমানদের ব্যবহার করা একদম উচিত নয়। কারণ, এই পরিভাষাটির সাথে ইসলাম ও মুসলিম সভ্যতার ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। বরং ইউরোপীয় খ্রিস্টান ধর্মসভ্যতার গর্ভে এই পরিভাষা ও আইনের জন্ম। মূলত ক্যাথলিক ক্যানন ল’-এর একটি অংশ হচ্ছে এই ব্লাসফেমি আইন। এটি মধ্যযুগে ইউরোপে ক্যাথলিক চার্চের যাজক নেতৃবৃন্দ কর্তৃক ‘এক্লিসিয়াসটিকাল জুরিসডিকশান’ হিসেবে চর্চিত হতো।
সুতরাং, মুসলমানদের জন্য ‘ব্লাসফেমি’ পরিভাষাটির ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আলেম-ওলামার পক্ষ থেকে একটা ফতোয়া আসা জরুরি। ইসলামের অবমাননা বোঝাতে ‘ব্লাসফেমি’র বিকল্পস্বরূপ ইসলামী পরিভাষা ব্যবহার করা যেতে পারে। তৌহিদি জনতার কাছে এ বিষয়গুলো পরিষ্কার করা একটি অপরিহার্য ঈমানি দায়িত্বও বটে। বাংলায় আমরা ‘ইসলামাবমাননা/ধর্মাবমাননা’ বলতে পারি। ইংরেজিতে ‘ডিফেমেশন ক্রাইম ও ডিফেমেশন ল’ বলা যেতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই খ্রিস্টান ‘ব্লাসফেমি’ পরিভাষাটি উচ্চারণ করা মুসলমানদের জন্য যৌক্তিক হবে না।
এমনকি ‘ব্লাসফেমি আইন’ চাওয়ার দাবি করাটা কৌশলগত কারণেও ভুল। আমাদের দেশে আলাদা করে ব্লাসফেমি আইন করার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ বাংলাদেশ পেনাল কোড বা ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২৯৫ থেকে ২৯৮ পর্যন্ত ধারাগুলোতে ধর্মাবমাননা সংক্রান্ত অপরাধ ও শাস্তির কথা পরিষ্কারভাবে বিবৃত আছে। এই দুই ধারা মোতাবেক ধর্মাবমাননা কিংবা ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অপরাধ প্রমাণিত হলে অর্থদণ্ডসহ সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ডের কথা উল্লেখ আছে। তাই, আলাদাভাবে ‘ব্লাসফেমি আইন’ করার পরিবর্তে বরং পেনাল কোডের এই ধারাগুলোর সময়োপযোগী সংস্কার করা যেতে পারে। সামপ্রতিককালে ধর্মাবমাননার তীব্রতা বিবেচনায় শাস্তির পরিমাণ বাড়িয়ে আইনটিকে আরো কঠোর করা জরুরি, যাতে করে আইনটি বেইলেবল বা জামিনযোগ্য না হয়। এ বিষয়ে ওলামায়ে কেরাম আওয়াজ তুলতে পারেন। এই আইনের যথাযথ প্রয়োগের দাবি তোলাও জরুরি যেন ভবিষ্যতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার উপর্যুপরি প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ইসলামবিদ্বেষী কটূক্তিকারী নাস্তিক আসাদ নূরের মতো আর কেউ বিনাবিচারেয মুক্তি বা জামিন না পায়।
দেশের ওলামায়ে কেরাম কখনোই আইন নিজের হাতে তুলে নিতে প্ররোচনা দেন না। তারা কোনোপ্রকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও সমর্থন করেন না। বরং তারা সবসময়ই আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে ইসলামাবমাননাকারী ও রাসূলের নামে কটূক্তিকারীদের বিচার চেয়ে এসেছেন। যদি রাষ্ট্র তাদের দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে বিদ্যমান ফৌজদারি আইন অনুসারে যথাসময়ে কালপ্রিটদের বিচার করার উদ্যোগ নিতো, তাহলে সংক্ষুব্ধ গোষ্ঠী কর্তৃক আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা রোধ করা যেতো। কিন্তু এখন ইসলামাবমাননাকারী বা কটূক্তিকারীরা আততায়ীদের হাতে খুন হলে বর্ণবাদী মিডিয়া ইসলামপন্থিদের ওপর এর দায় চাপাতে প্রপাগাণ্ডা চালায়, যা প্রকারান্তরে প্রকৃত খুনিদের আড়ালে রাখার সুযোগ তৈরি করে।
যাই হোক, ‘ব্লাসফেমি’ হচ্ছে একটি ইউরোপীয়ান খ্রিস্টান পরিভাষা। এর ভাবার্থ ধর্মাবমাননা বা ঈশ্বরাবমাননা হলেও এটি প্রধানত খ্রিস্টধর্মের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু পরবর্তীতে পাকিস্তানসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশ ইসলামাবমাননা রোধে আইন করার জন্য খ্রিস্টান ‘ব্লাসফেমি’ পরিভাষাটি গ্রহণ করেছে। এটা মুসলিম উম্মাহ’র জন্য লজ্জাজনক। কারণ, আমরা দিনরাত ইহুদি-নাসারাদের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করলেও অনেকক্ষেত্রে ঠিকই ওদের মডেল অনুসরণ করি। অথচ মুসলমানদের উচিত খ্রিস্টান ইউরোপকে অনুকরণের ঔপনিবেশিক গোলামি মানসিকতা পরিহার করা। পাকিস্তানে এই ব্লাসফেমি আইনের রাজনৈতিক অপব্যবহারের ফলে বিশেষত মুসলিম দেশগুলোতে আইনটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। যেভাবে ইউরোপে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল গির্জার পাদ্রীদের অপব্যবহারের কারণে।
আজকের মডার্ন ইউরোপে ব্লাসফেমি আইনকে ‘ডেড লেটার’ হিসেবে গণ্য করা হয়। ইউরোপের বেশ কিছু রাষ্ট্রে এই আইনটি এখনো কাগজে-কলমে থাকলেও এর প্রয়োগ তেমন একটা হয়না। কারণ মডার্নিজম ও সেকুলারিজমের প্রভাবে পাশ্চাত্যের খ্রিস্টানরা এখন নিজ ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। ফলে তাদের জীবনযাপনে ধর্মীয় অনুভূতি এতই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, খ্রিস্টধর্ম বা যীশুর অবমাননা করলেও সেটাকে তারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে সহ্য করতে পারে।
কিন্তু বিপরীতে মুসলমানরা অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ জাতি। আল্লাহ, ইসলাম ও রাসূল (সা.)-এর অবমাননা তারা বরদাশত করে না। কারণ এটাও তাদের ঈমান-আমান হেফাজতের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো এবং নবী-রাসূলদের নিয়ে অশালীন ভাষায় কটূক্তি করাকে মুসলমানরা জঘন্য সভ্যতাবিরোধী ও মানবতাবিরোধী কাজ হিসেবে দেখে।
এছাড়া, ধর্মাবমাননাকে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’ হিসেবে অভিহিত করে জাতিসংঘে রেজুল্যুশনও পাস হয়েছিল। লক্ষণীয় যে, বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে নাস্তিকতা, মুক্তমনা ও মুক্তচিন্তার নামে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঘৃণাজনিত ও উস্কানিমূলক লেখালেখি, ব্লগিং ও বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে।
রাসূল (সা.)-এর নামে বহুবার অশ্লীল ভাষায় কটূক্তি করা হয়েছে। ফলে এদেশের মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি তীব্রভাবে আঘাত পেয়েছে, যা সুস্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন জাতিসংঘের রেজুল্যুশন অনুসারে। সুতরাং যারা মুক্তচিন্তা, মুক্তমনা ও নাস্তিকতার চর্চা করতে চায়, তারা এসবের দোহাই দিয়ে গায়ে পড়ে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে হেইট স্পিচ বা ঘৃণামূলক বক্তব্যের মাধ্যমে অন্যের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল!
ব্রিটেনের কয়েকটি আইনে হেইট স্পিচকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ব্রিটেনের পাবলিক অর্ডার আইন-১৯৮৬, রেসিয়াল অ্যান্ড রিলিজিয়াস হেটরেড অ্যাক্ট-২০০৬ এবং ক্রিমিনাল জাস্টিস অ্যান্ড ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট-২০০৮ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির বর্ণ, জাতি, অক্ষমতা, জাতীয়তা (নাগরিকত্বসহ), নৃতাত্ত্বিক অথবা জাতিগত ব্যুৎপত্তি, ধর্ম, অথবা লিঙ্গকে উদ্দেশ্য করে প্রকাশিত যেকোনো ঘৃণামূলক উক্তিই নিষিদ্ধ (forbidden)|
বিশেষত, ব্রিটেনের পাবলিক অর্ডার অ্যাক্ট ১৯৮৬-এর ২৯ (খ) ধারা অনুসারে কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা ধর্মকে উদ্দেশ্য করে বিদ্বেষপ্রসূত ও উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়াকে অফেন্স বা অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
এছাড়া আমেরিকার সুপ্রীম কোর্টও মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা আরোপ করে রেখেছে। আমেরিকার ইলিনোইস রাজ্যে ‘হেইট স্পিচে’র বিরুদ্ধে একটা আইন আছে। আইনটির মূল মর্ম হলো: An Illinois law making it illegal to publish or exhibit any writing or picture portraying the ‘depravity, criminality, unchastity, or lack of virtue of a class of citizens of any race, color, creed or religion’ was constitutional.
অর্থাৎ এককথায়: কোনো বর্ণ, জাতি বা ধর্মীয় সমপ্রদায় সম্পর্কে অবমাননামূলক লেখালেখি/ছবি প্রদর্শন করাকে বেআইনি বলে আখ্যা দিয়েছে এই ইলিনোইস আইনটি। পরবর্তীতে আমেরিকার সুপ্রীম কোর্ট এই আইনটিকে সাংবিধানিকভাবে সমন্বয় করে আরো উন্নত করেছে।
সুতরাং, এদেশে যারা আদর্শ নাস্তিক কিন্তু অন্যের ধর্ম ও ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তাদেরও উচিত হেইট স্পিচের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা ও প্রতিবাদ করা।
সমালোচনা ও অবমাননা-এ দুটোর মধ্যে মৌলিক তফাত আছে। একটা গ্রান্টেড, কিন্তু পরেরটা অবশ্যই সববিচারে দণ্ডনীয় অপরাধ। সমালোচনাকে স্বাগত জানানো যায়, কিন্তু কটূক্তি, অবমাননা, গালাগালি ও হেইট স্পিচের মাধ্যমে অন্যের বোধবিশ্বাস ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার নাম বাকস্বাধীনতা কিংবা মুক্তচিন্তা হতে পারে না।
পরিশেষে বলবো, হেইট স্পিচের বিরুদ্ধে আদর্শ, ধর্ম ও দল-মত নির্বিশেষে আমাদের দেশের বিবেকবান সবারই ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়াজ তোলা উচিত। অন্যথায়, আজকে পবিত্র কুরআনের অবমাননা কিংবা রাসূলের নামে কটূক্তি করা হয়েছে, কিন্তু কাল বা পরশু হয়ত বেদ, গিতা, ত্রিপিটক বা বাইবেলের অবমাননা করতেও কোনো ঘৃণাজীবী নাস্তিক দ্বিধাবোধ করবে না।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক