বুধবার-২১শে জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি-২১শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আধুনিক আরবি সাহিত্যের ক্রমবিকাশধারা

আধুনিক আরবি সাহিত্যের ক্রমবিকাশধারা

আধুনিক আরবি সাহিত্যের ক্রমবিকাশধারা

ড. মুহাম্মাদ আবদুস সামাদ

 

ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনাতে মিসর এবং অন্যান্য আরবদেশগুলো চোখ কচলাতে কচলাতে অবচেতন সুখনিদ্রা থেকে জাগ্রত হয়। অলস চোখের মিটিমিটি চাহনীতে পৃথিবীর চারদিকে মানব জীবনোপকরণে আধুনিকতার সয়লাব, প্রাকৃতিক শক্তিকে পরাভূত করার যাবতীয় উপায় উপকরণ এবং প্রকৃতিকে মানুষের অধিনস্ত করার সকল আয়োজন দেখে হতবাক। চিন্তার জগতে, ভাব ও অর্থের ক্ষেত্রে, সাহিত্যে, কাব্যে, সর্বত্রই নতুন নতুন আবিস্কার, আধুনিক তথ্য, তত্ব ও প্রযুক্তির ছড়াছড়ি। পাশ্চাত্যের সাহিত্যিকগণ নতুন আঙ্গিক, অবয়ব ও রূপে সাহিত্য চর্চা করছে, কবিতা লেখছে। বাস্তব উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার নিদর্শন তাদের লেখার মধ্যে ফুটে উঠছে। সাহিত্যকে গণমানুষের জীবন ঘনিষ্ট করতে তথ্য, তত্ত্ব, যুক্তি-প্রমাণাদির অবতারণা সাহিত্য কর্মকে উচ্চমানের সৃষ্টি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। তখন থেকে আরব দেশগুলো পাশ্চাত্য, পাশ্চাত্যের অধিবাসী, তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে নিজেদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। তবে এটাও সত্য যে, আরবগণ পাশ্চাত্যের সাথে নিজেদেরকে ঘনিষ্টভাবে জড়িয়ে ফেললেও তারা তাদের সোনালি অতীত, বর্ণাঢ্য ঐতিহ্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে একেবারে ভুলে যায়নি। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত আরবি সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডারকে তারা পুনর্জীবিত করেন। পুরাতন সাহিত্য এবং আধুনিক সাহিত্যের উত্তম দিকগুলো বিবেচনায় রেখে, দুই সংস্কৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে উন্নত সাহিত্য সৃষ্টির চেষ্টা করে। আধুনিক আরবি সাহিত্য সৃষ্টির পিছনে অনেকগুলো কারণ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :

১. উচ্চশিক্ষার জন্যে পাশ্চাত্যে গমন: আরবদেশ থেকে বিশেষ করে মিসর থেকে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় মেধাবী ছাত্র, শিক্ষার্থী ও গবেষকগণ উচ্চতর ডিগ্রি এবং গবেষণাকর্মের জন্য পাশ্চাত্যের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেন। তারা সেখানে দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলীর নিকট থেকে বিদ্যা অর্জন করে দেশে ফেরার সময় সেখানকার নতুন আচার আচরণ, চিন্তা-চেতনা ও জীবন উপকরণও আমদানি করেন।

২. অনুবাদ কর্ম: পশ্চিমা দেশের জ্ঞানীগুণী, চিন্তাশীল ও সাহিত্যিকদের লেখা বইপুস্তক, দর্শন, শিল্প, সাহিত্য, আইনকানুন ইত্যাদি বিষয় আরবি ভাষায় অনূদিত হয়। আরব জাতির বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী সেগুলো অধ্যয়ন করার ফলে তাদের মধ্যে নতুন চিন্তার সঞ্চার হয়। সময়ের পরিবর্তনে সেসব চিন্তা-চেতনা আরবদের জাতীয় সম্পদে পরিণত হয়। জাতীয় সংস্কৃতির অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে। তাই কোন রকম ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা ছাড়াই পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণার বহিঃপ্রকাশ বক্তা-বাগ্মীদের বক্তৃতা, বিবৃতি, লেখক-সাহিত্যিকদের কলম-কালিতে, কবিতার লাইনে লাইনে এবং শিল্পকর্মের মাধ্যমে হতে থাকে। ফলশ্রুতিতে সাহিত্য ও শিল্পকর্ম নতুন আঙ্গিকে রূপ নেয়। নিজস্ব অবয়বে আপন বৈশিষ্ট্যে আত্মপ্রকাশ করে। যা পূর্বের যেকোন সময়ের সাহিত্য ও শিল্প থেকে ভিন্নতর।

৩. শিক্ষার প্রসার: আরব দেশের সরকারগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় পাশ্চাত্যের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরিত প্রতিনিধিদল জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে ফিরে আসার ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। বিশেষ করে মিসরের শাসক মুহাম্মাদ আলী, ও ইসমাঈল পাশার শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখার ফলে শিক্ষার প্রসার ও উন্নতি সাধিত হয়। ফলে শিক্ষাকার্যক্রমে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশের সাথে আরবদের যোগাযোগও গভীর হয়। একইভাবে শিক্ষা বিপ্লবের জোয়ার সিরিয়া এবং লেবাননেও পৌঁছে। ফলে একজন আরবি ছাত্র কায়রো, বৈরুত, দামেস্ক এবং বাগদাদের স্কুলগুলোতে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময়েই পাশ্চাত্যের সাহিত্যকর্ম; গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ এবং কবি সাহিত্যিকদের জীবনী সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞানার্জন করে। অধ্যয়নলব্ধ জ্ঞান তাদের সচেতন বা অবচেতন মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। যা তাদের দৈনিন্দন জীবনের চিন্তা-ভাবনা, কথাবার্তা, লেখালেখি ও কবিতা রচনার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। তা ছাড়াও লেখা পড়ার উচ্চস্তরের ইনস্টিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্দিষ্ট বিষয়ে আরো গভীর অধ্যয়ন ও গবেষণার মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষা আরবদের মনে দৃঢ়ভাবে স্থান করে নেয়। তাই তারা পাশ্চাত্যের ধ্যান-ধারণায় নিজেদের মন মানসিকতাকে প্রস্তুত করে তোলে।

৪. সংবাদপত্রের উন্নতি: পাশ্চাত্যের সঙ্গে আরবদের ব্যাপক যোগাযোগের ফলে আরব দেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। পাশ্চাত্যের অনেক নতুন বিষয়বস্তু সংবাদপত্রের সাথে যোগ হওয়ার ফলে পাঠকসমাজ এমনকি সাধারণ জনগোষ্ঠীর নিকট এটি একটি বিশাল জগত হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পাশ্চাত্যের মানুষেরা যেমন এক জাতিও নয়। অনুরূপভাবে তাদের সংস্কৃতিও এক নয়। বস্তুত তারা নানা জাতিতে বিভক্ত। তাদের রুচি, আদব-শিষ্টাচার এবং ভাষাও ভিন্ন ভিন্ন। প্রত্যেক জাতির নিজস্ব চিন্তাপদ্ধতি আছে। জীবনের পৃথক দর্শন রয়েছে। মিসরসহ অন্যান্য আরবদেশগুলো পাশ্চাত্যের কোন একটি জাতির সাথেই যোগাযোগ করেছে তা নয় বরং তারা গোটা পাশ্চাত্য সমাজের সাথেই বিভিন্ন মিশন ও তাদের অনূদিত সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়।

তাদের এ যোগাযোগ ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, ইতালী, রাশিয়া, স্পেন, আমেরিকা এবং আরো অন্যান্য দেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এ যোগাযোগের মাধ্যমে পশ্চিমা দেশের প্রতিটি সমাজ ও জাতির লোকদের সাহিত্য ও দর্শন সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ লাভ হয়। বিশেষ করে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে আকাশ পথে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ার ফলে তাদের সাথে যোগাযোগ ও মেলামেশা বৃদ্ধি পায়। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর নানা সংস্কৃতির মধ্যে কোন জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতি দ্বারা আরবি সাহিত্য অধিক প্রভাবান্বিত হয়েছে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা না গেলেও এতটুকুন বলা যেতে পারে যে, প্রথমত ফ্রান্সীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রভাবটিই আরবি সাহিত্যের ওপর পড়ে। আরবগণ সেখান থেকে জীবনঘনিষ্ঠ সব কিছুই অর্থাৎ চিকিৎসা, কারিগরি, বিজ্ঞান, ব্যবসা-বাণিজ্য, আইন-কানুন, সাহিত্য সংস্কৃতি ইত্যাদি আমদানি করে। তারপর ব্রিটেনসহ পাশ্চাত্যের অন্যান্য সংস্কৃতি থেকেও কিছু গ্রহণ করা হয়। তবে সেসব সংস্কৃতির বড় ধরনের কোন প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি। অপরদিকে লেবানন ফ্রান্সের সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়। আমেরিকা ও ব্রিটেনের সভ্যতা-সংস্কৃতি থেকেও অনেকাংশ গ্রহণ করে।

তা ছাড়াও পাশ্চাত্যের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও সভ্যতা সমানভাবে তাদের জীবন, সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর প্রভাব বিস্তার করে। পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির এই ভাবধারার মধ্য দিয়েই আধুনিক আরবি সাহিত্য গড়ে উঠে। আরব জাতির জীবন, মন-মানসিকতা ও সাহিত্য জগতে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির শক্তিশালী প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি আরব-জনগোষ্ঠীর হৃদয়-মনে তাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীতের প্রেরণাও তাদেরকে শক্তভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। তারা অতীতের প্রসিদ্ধ ব্যক্তিবর্গের সম্মান, মর্যাদার কথা সর্বদাই গর্বের সাথে উল্লেখ করতেন। তাদের কৃতিত্বপূর্ণ কর্মের আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের ব্যক্তিত্বকে শক্তিশালী করার প্রয়াসী হন। এসব কিছুর একমাত্র মাধ্যম ছিল প্রাচীন আরবি সাহিত্য। আরবদের সার্বিক জীবনে এ সাহিত্যের বিশাল বিস্তৃতি ছিল। সত্যি কথা বলতে কি আরব জাতির মন-মানসিকতার প্রতিচ্ছবি ছিল আরবি সাহিত্য। সাহিত্যের মাধ্যমে খুব সহজেই তাদের সম্পর্কে স্ববিস্তারে ধারণা পাওয়া যেত। তাদের চিন্তা, চেতনা, অনুভূতি, আদত-অভ্যাস, কৃষ্টি-কালচার, আকীদাহ-বিশ্বাস, ও স্বভাব-প্রকৃতির পরিচয় সাহিত্যের মধ্যে ফুটে উঠে। সুতরাং পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রবাহ যখন আরবদের মধ্যে বৈতে শুরু করে, তখন আরবদের জীবনঘনিষ্ঠ প্রাচীন ঐতিহ্য আরবি সাহিত্যের সয়লাব প্রচণ্ডভাবে নতুন সভ্যতার ওপর যদি আছড়ে পড়ে, তাতে বিস্মিত হওয়ারও কোন কারণ নেই।

তবে লক্ষ্য করার বিষয় হলো আরব বিশ্বের সাহিত্যিকগণ প্রায় দীর্ঘ এক যুগ পর্যন্ত এ দুটি ধারায় প্রভাবান্বিত হওয়ার ক্ষেত্রে কিন্তু এক রকম ছিলেন না। সাহিত্যিকদের একদল নিজেদের সভ্যতা-সংস্কৃতি, পরিবেশ, স্বতন্ত্র সামাজিক বিধি-বিধান ও উপায় উপকরণ এবং জীবনযাপনের পৃথক রীতি-নীতির যুক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে আরবি সাহিত্যের প্রাচীন ধারার মধ্যেই নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। ভাব, খেয়াল, বিষয়বস্তু, পদ্ধতি এবং উপস্থাপন রীতিনীতি ইত্যাদির ক্ষেত্রে প্রাচীন আরবি সাহিত্যের প্রভাবই তাদের ওপর অধিক মাত্রা ছিল। এতদ সত্ত্বেও নতুন সভ্যতার বহুল প্রচলিত চিন্তা-ভাবনা এবং পাশ্চাত্যের বিভিন্ন প্রকারের সাহিত্যকর্ম অনূবাদ হয়ে আরবিপত্র-পত্রিকা ও শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে প্রকাশিত হওয়ার ফলে তারাও পশ্চিমা সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রভাব বলয় থেকে পরিপূর্ণভাবে মুক্ত থাকতে সক্ষম হননি। কোন কোন সাহিত্যিকের উপরে পশ্চিমা সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। তাদের সাহিত্যকর্ম পাঠকালে পাঠকগণের মনে হবে, তারা যেন ফরাসী কিংবা ইংরেজ সাহিত্যিকদের লেখা আরবি ভাষায় পাঠ করছে। তৃতীয় আরেক দল সাহিত্যিক পুরাতন ও নতুন সাহিত্যের মধ্যে সমন্বয় করে সাহিত্য জগতকে একটি সমন্বিত ধারার সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। তারা একদিকে প্রাচীন সাহিত্যের বলিষ্ঠ লেখনপদ্ধতি, প্রাঞ্জল ভাষা ও সুস্পষ্ট বিষয়গুলোকে অনুসরণ করেছেন।

অপরদিকে আধুনিক সাহিত্যের সুন্দর উপস্থাপনা এবং অভিনব ও মৌলিক বিষয়বস্তুকেও গ্রহণ করেছেন। তবে চিন্তা, ভাব ও খেয়ালের ক্ষেত্রে কখনো প্রাচীন সাহিত্যের আবার কখনো নতুন সাহিত্যের অনুসরণ করেছেন। এ সকল কবি সাহিত্যিদের মধ্যে মাহমুদ সামী আল-বারুদী (১৮৩৭-১৯০৪ ঈ.) অন্যতম। প্রকৃত পক্ষে তিনি আরবি কবিতাকে বিপর্যস্তের কবল থেকে মুক্ত করেছেন। তিনি আরবি কবিতাকে ধ্বংসের হাত থেকে উদ্ধার করে এর পুনর্জন্ম দিয়েছেন। এজন্যই তাকে আধুনিক আরবি সাহিত্যের রেনেসাঁর জনক বলা হয়। অপরদিকে পশ্চিমা সাহিত্যের প্রভাববলয় সৃষ্টির শেষ সময়গুলোতে কতিপয় সাহিত্যিক ইউরোপের জাতিগুলোর জীবন ও সভ্যতার উন্নতির ভিত্তিতে এবং তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারণে গড়ে উঠা বিভিন্ন সাহিত্য দর্শন ও মতবাদ (Schools of Literature)-এi অনুকরণে সাহিত্য রচনার চেষ্টা করেন। তাদের এ চেষ্টার উদ্দেশ্য বিশেষ কোন সাহিত্য সৃষ্টি ছিল না। নিছক নতুনত্বের প্রতি প্রবল আকাঙ্ক্ষা এবং পশ্চিমা সাহিত্যের অনুকরণের অভিপ্রায়ই তাদের মধ্যে প্রবল ছিল। আধুনিক সাহিত্যে কবিতার পাশাপাশি গদ্যেরও উন্নতি সাধিত হয়েছে। বিগত শতাব্দীগুলোর কৃত্রিমতা নির্ভর ও সাহিত্যের মৌলিকত্ব বিবর্জিত গদ্যসাহিত্যের অক্টোপাশ থেকে গদ্য সাহিত্য বেরিয়ে আসার সুযোগ পায়। আধুনিক যুগে গদ্য মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ এবং বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে নানা সমস্যা সম্ভাবনা ও নানা সামাজিক বিষয়াদি নিয়ে রচিত হতে শুরু করে। দীর্ঘ দিনের দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মাযলুম মানবতাকে রক্ষা করা, শোষিত বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, শুরাভিত্তিক শাসন পদ্ধতির দিকে আহ্বান করা, উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধাচরণ এবং গণমানুষকে সচেতন করা, সমাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় রোধ করা, সমাজসংস্কার করা, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, সুষম বণ্টন, সামাজিক সুবিচার ইত্যাদি বিষয়ের ওপর গদ্য রচিত হয়। সুতরাং গদ্যের উল্লেখযোগ্য বিষয়বস্তু হলো সমাজ, রাজনীতি এবং সাহিত্য ইত্যাদি। এ বিষয়বস্তুগুলোর প্রত্যেকটির পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সামাজিক গদ্যের ভাষা বাক্য যেমন বিশুদ্ধ হওয়া অপরিহার্য, অনুরূপভাবে তা হতে হয় কৃত্রিমতা ও অলংকারমুক্ত। যথার্থ ও স্পষ্ট মর্মার্থ ও তত্ত্ব সমৃদ্ধ, যুক্তি ও প্রমাণ নির্ভর। অপরদিকে সংবাদপত্র ও রাজনীতি বিষয়ক গদ্যের ভাষা ও ভাব উভয়ই হতে হয় সহজ, প্রাঞ্জল ও সুস্পষ্ট। কেননা এ ধরনের লেখার পাঠকদের মধ্যে সাধারণ ও কম শিক্ষিত পাঠক থাকেন। এসব লেখাতে অকাট্য যুক্তি, বাস্তব প্রমাণাদি ও তাত্ত্বিক কথার চেয়ে সাধারণ জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ ও আত্মতৃপ্তিমূলক কথাই মুখ্য বিষয় থাকে।

তবে গদ্য সাহিত্যের ক্ষেত্রে শব্দ চয়ন, নির্বাচিত গাঁথুনী, বাক্য রীতির সুর ও ঝংকার অত্যাবশ্যক। যাতে করে পাঠকের মনে আবেগ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। পাঠকের নিকট তা সুখপাঠ বলে অনুভূত হয়। আধুনিক গদ্যের উল্লেখযোগ্য প্রকার হলো গল্প, নাটক, উপন্যাস ও প্রবন্ধ ইত্যাদি। এগুলোর ওপরও পাশ্চাত্যের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। যাইহোক আধুনিক গদ্য সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য পথকৃৎ হলেন শায়খ জামাল উদ্দিন আফগানী, শায়খ মুহাম্মাদ আবদুহু, আবদুল্লাহ নাদীম, আদীব ইসহাক ও কাসিম আমীন প্রমুখ। তা ছাড়াও আধুনিক আরবি সাহিত্যের উন্নতি ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রাচ্যবিদদেরও একটি ভূমিকা রয়েছে। বস্তুত আরববিশ্ব যখন শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন ও সভ্যতা-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ ছিল তখন পশ্চিমা দেশ থেকে অনেকেই প্রাচ্যে শিক্ষার্জন করতে আসেন। এভাবে আরবগণ ইউরোপীয় সভ্যতা নির্মাণে বিরাট অবদান রাখেন। কিন্তু আরবদের সঙ্গে ইউরোপের যোগাযোগ কিছুদিন বিচ্ছিন্ন থাকলেও ক্রুসেড যুদ্ধের পর তারা আবার আরব বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ পুনঃস্থাপন করে। ততদিনে ইউরোপ জ্ঞান-বিজ্ঞান সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে মানবতার জন্যে অনুকরণীয় হয়ে উঠে। তাদের পুনঃযোগাযোগের মাধ্যমে আধুনিক যুগে প্রাচ্যে তাদের কার্যক্রম নতুন করে মাত্রা যোগ করে। তাদের এসব কার্যক্রমের উল্লেখযোগ্য হলো:

(১) এশিয়া সংঘ: প্রথমে ব্রিটেন ও ফ্রান্স আরব দেশে এশিয়া সংঘ নামে একটি সংস্থা গঠন করে। তারপর তাদের অনুসরণে আমেরিকা, জার্মান, ইটালী ও অন্যান্য দেশও প্রাচ্য ভিত্তিক বিভিন্ন সংস্থা গড়ে তোলে।

(২) আন্তর্জাতিক সম্মেলন: এ সব সম্মেলনে গবেষণামূলক বিষয়বস্তুর ওপর আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতো। এখানে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের বিখ্যাত গবেষক ও শিক্ষাবিদগণ অংশগ্রহণ করতেন।

(৩) গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা: বস্তুত আরব ও মুসলিম বিশ্বের অনেক মূল্যবান সম্পদ আরব দেশগুলোতে না থাকলেও পাশ্চাত্যের অনেক লাইব্রেরিতে সেগুলো রক্ষিত আছে। এসব সম্পদ তারা মুসলিম দুনিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করেছেন। পরবর্তীতে আরব সাহিত্যিকগণ ইউরোপের বিভিন্ন গ্রন্থাগার থেকে অমূল্য ও দুস্প্রাপ্য পুস্তক সম্পদ সংগ্রহ করে আরব বিশ্বের গ্রন্থাগারগুলোতে সংরক্ষণ করেন।

(৪) প্রাচ্য ভাষা ইনস্টিটিউট: ইউরোপের বড় বড় রাজধানী শহরগুলোতে প্রাচ্য ভাষা ইনস্টিটিউট গড়ে উঠে। প্রাচ্যবিদগণ কর্তৃক পরিচালিত এসব প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ভাষার সাথে আরবি ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়ার ফলে আধুনিক আরবি সাহিত্যে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। বরং আধুনিক আরবি সাহিত্যের উন্নতি ও ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে প্রাচ্যবিদদের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের গবেষণা পদ্ধতি, একাডেমিক আলোচনা পর্যালোচনা, সাহিত্য সমালোচানার নিয়মনীতি, সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের জীবন ইতিহাসের সূক্ষ্ম মূল্যায়ন ধারা, বিয়য়বস্তু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে তারা অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জন করেন। প্রাচ্যবিদদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: ডি সাসী, কাতারমীর, ডি প্রেসভাল, কারলিল, এ্যডওয়ার্ড লীন, স্যার টমাস আরনল্ড, মার্গালিয়ট, জীব, ব্রুকলম্যান প্রমুখ। প্রকৃতপক্ষে সাহিত্য ও সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে বর্তমানে যে ধারার সৃষ্টি হয়েছে তা প্রাচ্যবিদদেরই অবদান। তাদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে অনেক আরব সাহিত্যিক ও লেখকগণ সাহিত্য ও সাহিত্যের ইতিহাস রচনা করেছেন। যেমন- জুরজি যায়দানের আরবি সাহিত্যের ইতিহাস, ফাদার লুইয়াস শীখুর আরবি সাহিত্য, মোস্তফা সাদিক রাফিয়ীর আরবদের সাহিত্যের ইতিহাস, হাফনী নাসেফের সাহিত্য বিজ্ঞান।

তবে তাদের একাডেমিক ও গবেষণার ক্ষেত্রে যথেষ্ট কৃতিত্ব থাকলেও মনে রাখা প্রয়োজন যে, অনেক প্রাচ্যবিদ আরবদের বিষয় নিয়ে লেখতে গিয়ে তাদের সাহিত্যের প্রতি সব সময় সুবিচার করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং নিজেদেরকে নিরপেক্ষতার ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারেননি। পক্ষপাতমূলক আচরণের মাধ্যমে আরবদের আকীদাহ বিশ্বাস, ইতিহাস ঐতিহ্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিষোদগার করেছেন এবং সন্দেহ ও সংশয়ের সুযোগ তৈরি করেছেন। যাইহোক পাশ্চাত্যের চিন্তা-ভাবনা আরব সাহিত্যিকদের মন মগজ ও সাহিত্যকর্মে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতে। এর ফলে পাশ্চাত্যের অনুকরণে আরবি সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমরা কতিপয় সাহিত্য দর্শন, মতবাদ ও স্কুল এর আবির্ভাব লক্ষ্য করি। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

১. আরবি সাহিত্যের নবজাগরণ স্কুল (মাদরাসাতুল ইহইয়া): ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত আরবি সাহিত্য তার স্বকীয়তা নিয়ে দাঁড়াতে পারিনি। এ সাহিত্যের ওপর কৃত্রিমতা ও অলংকার শাস্ত্রের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ে ছিল। এ সময়ের সাহিত্য তখন রীতিমতো একটি অধপতিত সাহিত্য। এ যুগের মাঝামাঝির আগমন হতে না হতেই আরবি সাহিত্যে পরিবর্তনের আবহাওয়া লাগতে থাকে। একদল সচেতন আরব সাহিত্যিক জাহিলী যুগের কবিতার দিকে গভীরভাবে লক্ষ্য করে দেখেন যে, প্রচীন কবিতাই তো স্বাভাবিক কবিতা। এখানে অকৃত্রিমভাবে মানুষের জীবনের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। এখানে কৃত্রিমতার কোন ছাপ নাই। জাহিলী যুগের ইমরুউল কায়েস, উমাইয়া যুগের জারীর, আববাসীয় যুগের আল মুতানাববীসহ অসংখ্য কবিগণ কত সুন্দরভাবে তাদের সমাজ, পরিবেশ, মানুষ ও তাদের জীবনের চিত্র তুলে ধরেছেন কবিতার মাধ্যমে। অলংকার শাস্ত্রের জগদ্দল পাথর থেকে তাদের কবিতা মুক্ত। কবি আলী লাইছী, আবদুল্লাহ ফিকরী এবং আয়েশা তাইমুরিয়্যাদের মতো কবিগণের মাধ্যমে এ ধারার পরিবর্তন হতে শুরু করলেও তারাও কৃত্রিমতা থেকে পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পারেননি। মূলত আবরি সাহিত্য তার পতন অবস্থা থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হয়েছে মাহমুদ সামী আল-বারুদীর হাতে। এ কারণে সাহিত্যিক সমালোচকগণ তাকে আরবি সাহিত্যের নবজাগরণ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা বলে অভিহিত করেছেন। তার অনুসরণে তার ছাত্রগণ এ ধারাকে গতিশীল করেছেন এবং স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন। মূলত তারা আরবি সাহিত্যকে তার প্রাচীন সোনালি যুগের দিকে ফিরেয়ে দিয়েছেন এবং এর সাথে নতুনত্বের প্রলেপ দিয়ে আরবি সাহিত্যকে আরো অধিক সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে এ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মাহমুদ সামী আল বারুদী আরবি সাহিত্যের প্রাণ এবং এর স্বকীয়তা ফিরিয়ে দিয়েছেন। দুর্বল পদ্ধতির শোচনীয় অবস্থা থেকে আরবি সাহিত্যকে পরিত্রাণ দিয়েছেন। মাহমুদ আল-বারুদীর কবিতার মধ্যে যে প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্য ও কবিতার বৈশিষ্ট্যের সমাহার ঘটেছে। নিম্নের আলোচনা থেকে তা পরিস্কারভাবে ফুটে উঠে:

(ক) আল-বারুদীর কবিতায় প্রাচীন বৈশিষ্ট্য:

১. মাহমুদ আল বারুদী কবিতার বিষয়বস্তুতে কোন নতুনত্ব উদ্ভাবন করেননি। তিনি আববাসীয় যুগের কবিতার বিষয়বস্তুর অনুসরণে কবিতা রচনা করেছেন। যেমন- স্তুতি কবিতা, বর্ণনামূলক কবিতা, তিরস্কার ও ভৎর্সনামূলক কবিতা, শোকগাঁথা কবিতা, গৌরবময় কবিতা, প্রেম কবিতা ইত্যাদি। তার কবিতা পাঠে মনে হয়, তিনি আববাসীয় যুগের কবি হিসেবে কবিতা লেখছেন।

২. প্রাচীন কবিদের মতো বন্ধুর বাড়ি ঘরের ধ্বংসাবশেষের সম্মুখে দাঁড়িয়ে তার বর্ণনা দিয়ে কবিতার সূচনা করা। জাহিলী যুগের কবিতার তত্ত্ব, অর্থ, খেয়াল, অবয়ব ও বাহ্যিক গঠন প্রকৃতি, সকল দিক মিল রেখে কবিতা রচনা করেছেন। সেই যুগের কবি না হয়েও তিনি যে তাদের ভঙ্গিতে কবিতা রচনা করতে পারতেন সে স্বাক্ষর রেখেছেন।

৩. প্রেমময় কবিতার মাধ্যমে নারীর বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রাচীন কবিতার মতো হরিনী এবং আকাশের চাঁদের সাথে নারীর তুলনা করেছেন।

৪. প্রাচীন কবিদের মতো অলংকার শাস্ত্রের ব্যবহার সহ প্রাচীন বিষয়বস্তুকে অধিক মাত্রায় গ্রহণ করেছেন।

(খ) আল বারুদীর কবিতায় আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য: কবি আল বারুদী প্রাচীন কবি-সাহিত্যিকদের অনুসরণ করলেও তার কবিতায় আধুনিকতা ও নতুনত্বের ছাপ স্পষ্টভাবে রয়েছে। ভাব, খেয়াল, বিষয়বস্তু, সুর, ছন্দ, আবেগ-অনুভূতি ও গঠন আকৃতি, সবকিছুতে এ নতুনত্বের স্বাক্ষর রয়েছে। যেমন-

(ক) বর্ণনামূলক কবিতা: বর্ণনামূলক কবিতায় আলবারুদীর নতুনত্ব রয়েছে। রয়েছে আধুনিকতার স্পষ্ট প্রভাব। যেমন-

১. প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি প্রচণ্ড বৃষ্টির রাতের বর্ণনা দিয়েছেন। উত্তাল সাগর ও প্রচণ্ড ঝড়ের বর্ণনা তুলে ধরেছেন। মেঘমালা, বিদ্যুত, বজ্র এবং মানুষের জীবনে এগুলোর প্রভাব কি তার বর্ণনাও সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন।

২. গ্রামীণ দৃশ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবিতায় গ্রাম ও পল্লীর মনরোম দৃশ্যের বর্ণনা তুলে ধরেছেন। তুলা, সুতা, নৌকা, ক্ষেত-খামার, পাখি এবং মৌমাছির এক ফুল থেকে আরেক ফুলে বিচরণের বিবরণকে সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

৩. মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে মানুষের আবেগ-অনুভূতি, যুদ্ধবিগ্রহ, চলাফেরা, উঠাবসা, লেনদেন ইত্যাদির ইত্যাদির কথা তুলে ধরেন। এগুলো ছাড়াও আরো অনেক বিষয়ের বর্ণনা কবিতার মাধ্যমে তুলে ধরেন।

(খ) রাজনৈতিক কবিতা:

রাজনৈতিক কবিতা প্রাচীন সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়বস্তু। আধুনিক আরবি সাহিত্যেও এ বিষয়বস্তুর ওপর কবিতা লেখা হয়েছে। প্রাচীন সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে নতুনত্বের প্রলেপ জড়িয়ে আধুনিক সাহিত্যে সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর সবটুকু কৃতিত্ব মাহমুদ আল বারুদীর। আলবারুদীর রাজনৈতিক কবিতায় যুলুম নির্যাতন ও সর্ব প্রকার নিপীড়নের বিরুদ্ধে একদিকে তার প্রচণ্ড ক্ষোভ ও বিদ্রোহাত্মক মনোভাব, অপরদিকে মানুষের মধ্যে ন্যায়, ইনসাফ, সুবিচার এবং সাম্য প্রতিষ্ঠার তীব্র আবেগ অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। এ কারণে তাকে কারাবরণ করতে হয় এবং দীর্ঘ দিন পর্যন্ত নির্বাসনে জীবন, যৌবন, শক্তি, সামর্থ্য, কর্মস্পৃহা সবকিছু হারাতে হয়। তিনি তার এসব কবিতার মাধ্যমে মিসরের সামাজিক বিশৃঙ্খলা, নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরেন। বিপর্যস্ত জীবনযাপনে ক্ষুব্ধ জনমানুষের রোষানল রক্তাক্ত বিপ্লবের দিকে মোড় নিতে পারে সেদিকেও সতর্ক করেছেন। যালিমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্যে মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন। সমাজের আশু সংস্কার এবং শুরাই নিযামের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে মানুষকে সচেতন করেছেন। এসব বিষয়বস্তু পুরাতন সাহিত্যের বিষয়বস্তু হলেও আল বারুদী নতুন আঙ্গিকে সেগুলোকে পেশ করেছেন। প্রাচীন ধারা থেকে কিছুটা বেরিয়ে এসে বর্ণনার মধ্যে বৈচিত্র্য এনেছেন। মাহমুদ আল বারুদী কর্তৃক অনুসৃত পদ্ধতি পরবর্তীতে ‘Shool of revival of Arabic Literature’ বা ‘আরবি সাহিত্যের পুনর্জাগরণ স্কুল’ বলে প্রতিষ্ঠিত হয়। আধুনিক আরবি সাহিত্যের প্রসিদ্ধ কবি সাহিত্যিকদের অনেকে এ মতবাদের অনুসারী ছিলেন। যেমন- আহমাদ শাওকী, হাফিয ইবরাহীম ও তাওফীক আমীনসহ অনেকে। এসব কবি সাহিত্যিকদের অধিকাংশই পাশ্চাত্য ভাবধারার সাথে রীতিমতো পরিচিত। যেমন- আহমাদ শাওকী, আহমাদ মুহাররমসহ আরো অনেকে। নীলনদের কবি বলে খ্যাত হাফিজ ইবরাহীম পাশ্চাত্যের দ্বারা ততটা প্রভাবান্বিত না হলেও তিনি যুগ ও সময়ের চাহিদার প্রতি উদাসীন ছিলেন না বরং বলা যায় তিনি স্বজাতির দাবি ও যুগের চাহিদার প্রতি বেশি সশ্রদ্ধ ছিলেন। অপরদিকে ইসলামের পক্ষেও আপোষহীন ছিলেন। ইসলাম ও আরবি ভাষার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করেছেন। তাকে অনুসরণ করেছেন সৌদী আরবের মুহাম্মাদ বিন উসাইমীন, ইরাকের মা’রুফ রাসাফী, সিরিয়ার উমার আবু রীশাহ এবং লেবানন ও মিসরে খালীল মাতরান প্রমুখ। এ মতাদর্শের সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো:

প্রাচীন আরবি কবিতার অনুকরণ, আরবি সাহিত্যের অধ:পতিত অবস্থা থেকে পুনরুদ্ধার, শক্তিশালী পদ্ধতি, ভাষাগত ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত করা, প্রাচীন কবিতার ‘আদলে ওযন, শব্দ ও ছন্দের মিল, বিষয়বস্তু ইত্যাদিতে প্রাচীন কবিদের অনুসরণ করা। এর সাথে যুগের চাহিদাকেও সমন্বিত করা হয়েছে। এ স্কুলের কবিগণও কবিতাকে বাস্তব জীবন ও সমাজের সাথে মিলিয়ে এর সমস্যা, সমাধান ও সম্ভাবনাকেও তুলে ধরেছেন।

২. মাদরাসাতু আদ্দীওয়ান (School of Al-Dewan): আধুনিক আরবি সাহিত্য মতবাদের (স্কুল) এটি একটি ইনস্টিটিউট। এ মতবাদের মূলকথা হলো কবি তার কবিতায় নিজের কথা বললেও মূলত: গোটা মানবজাতি তার উদ্দেশ্য। কবিতা একদিকে মানুষের জীবনের দুঃখ-কষ্ট, হাসি-আনন্দ, ভাল-মন্দ সব কিছুই তুলে ধরবে। অপরদিকে কবিতা বিশ্বপ্রকৃতি, এর-

নীলনদের কবি বলে খ্যাত হাফিজ ইবরাহীম পাশ্চাত্যের দ্বারা ততটা প্রভাবান্বিত না হলেও তিনি যুগ সময়ের চাহিদার প্রতি উদাসীন ছিলেন না বরং বলা যায় তিনি স্বজাতির দাবি যুগের চাহিদার প্রতি বেশি সশ্রদ্ধ ছিলেন। অপরদিকে ইসলামের পক্ষেও আপোষহীন ছিলেন। ইসলাম আরবি ভাষার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করেছেন। তাকে অনুসরণ করেছেন সৌদী আরবের মুহাম্মাদ বিন উসাইমীন, ইরাকের মারুফ রাসাফী, সিরিয়ার উমার আবু রীশাহ এবং লেবানন মিসরে খালীল মাতরান প্রমুখ।

রহস্য ও অজানা বিষয় নিয়েও কথা বলবে। কবিতা শুধু জাতি, ও সপ্রদায়ের গুনগান করার নাম নয়। এমনকি জাতির ইতিহাস ও ঘটনা প্রবাহের বর্ণনা দেয়ার নামও নয়। এ মতবাদের প্রবক্তা ও অনুসারীগণ ইউরোপ ও পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবান্বিত হলেও তারা তাদের অন্ধঅনুকরণ করেননি বরং তাদের লেখাগুলোকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করে সেখান থেকে ভাব নিয়ে নিজেরা নিজেদের মতো করে লেখার চেষ্টা করেছেন। যেমন- আবদুর রহমান শুকরী, ইবরাহীম আবদুল কাদির আল মাযিনী ও মাহমুদ আববাস আল ‘আক্কাদ প্রমুখ কবি ও সাহিত্যিক এ স্কুলের অনুসারী। তারা নিজেদের কবিতায় সহজসরল ভাষা ও বাক্যের ব্যবহার করতেন। কবিতার জন্যে পৃথক শব্দ চয়ন করতে হবে, এ কথায় তারা বিশ্বাসী ছিলেন না। সব ধরনের শব্দই কবিতার জন্যে প্রযোজ্য বলে মনে করতেন। স্কুল অব আদ্দীওয়ানের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো:

এ মতাদর্শের অনুসারীগণ প্রাচীন আরবি কবিতা বিশেষ করে আববাসীয় যুগের কবিতা পাঠ করেন। তবে সেগুলোর হুবহু অনুকরণ করেননি। তা ছাড়াও তারা পাশ্চাত্যের সাহিত্য বিশেষ করে ইংরেজি সাহিত্য থেকে প্রয়োজনীয় ও উপকারী বিষয়গুলো গ্রহণ করেছেন। অধিকন্তু তারা কবিতার বিষয়বস্তু, বাহ্যিক গঠন এবং ভাব ও অর্থের মধ্যে নতুনত্ব আনয়নের দিকে গুরুত্বারোপ করেছেন। এ ধরনের কবিতায় কবির ব্যক্তিত্ব প্রকাশের প্রয়াস থাকে এবং কবির নিজের কথার মাধ্যমে গোটা মানব জাতির কথার অভিব্যক্তি বর্ণনা করা হয়ে থাকে।

৩. School of Romanticism বা প্রবল আবেগধর্মী মতবাদ: আরবি সাহিত্যে রোমান্টিক সাহিত্য মতবাদের সূচনা হয় ১৯৩২ঈ. সালে। এ দর্শন প্রবর্তনের নেতৃত্বে ছিলেন আহমাদ যাকী ও আবু শাদী। মূলত সনাতন দর্শন ও পূর্বোল্লেখিত স্কুল অব আদ্দীওয়ানের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত বিতর্কের কারণে আরবি সাহিত্যে রোমান্টিক দর্শনের আবির্ভাব হয়। এ দর্শনে কবিতার বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। সনাতন ও ক্লাসিক মতবাদের বিপরীতেই এ মতবাদের অবস্থান। এমন কি স্কুল অব আদ্দীওয়ানের উত্থানের সঙ্গে পাল্লা দিতেও এ মতবাদের প্রতি বিশেষভাবে জোর দেয়া হয়। কবিতার শৈল্পিক, সামাজিক এবং বাস্তবতার দিক থেকে কবিতার মান বৃদ্ধি এ মতবাদের অন্যতম লক্ষ্য। এ দর্শনের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন : ইবরাহীম নাজী, ‘আলী মাহমুদ ত্বয়াহা, মাহমুদ হাসান ইসমাঈল, মুহাম্মাদ আবদুল মু’তী আল হামসারী প্রমুখ। আরবি সাহিত্যে এ মতবাদের স্থায়ীত্ব দীর্ঘকাল না হলেও আরববিশ্বে সাহিত্যের জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। অনেক সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচকগণ এর অনুসারী হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে আবুল কাসিম আশ শাবী, ঈসা ইসকান্দার এবং সৌদি আরবের মুহাম্মাদ হাসান আওয়াদ, হুসাইন সারহান এবং পশ্চিমা দেশে আরবি সাহিত্যে নতুন ধারার প্রবর্তক মিখাইল নাঈমাহ উল্লেখযোগ্য।

এছাড়াও আরবি সাহিত্যিকদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেকে ‘বাস্তববাদী মতবাদ’ (School of Realism)-Gi অনুসারী বলে দাবি করেন। কোন কোন সাহিত্যিক আবার ‘প্রতীকবাদ দর্শন’ (ঝপযড়ড়ষ ড়ভ ঝুসনড়ষরংস) এর অনুকরণে সাহিত্য রচনার চেষ্টা করেন। এছাড়াও আরো অনেক সাহিত্যিক পাশ্চাত্যে সৃষ্টি হওয়া এ ধরনের বিভিন্ন সাহিত্য দর্শন ও মতবাদের অনুসরণে সাহিত্য সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। এ সকল অনুকরণপ্রিয় সাহিত্যিকের সাহিত্য রচনা ছিল নিছক পাশ্চাত্য সাহিত্য। আরবি ভাষায় এ সাহিত্য লেখা হলেও তার রচনাশৈলি এবং বাক্যের গাঁথুনি ও সাবলীলতা ছিল অত্যন্ত দুর্বল। এসব সাহিত্যিক পাশ্চাত্যের এ ধরনের অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে নিজস্ব আরবি রুচি ও মানসিকতাকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করেছে। ফলে তারা সফলভাবে না পাশ্চাত্যের সাহিত্যকে সাহিত্যের মানদণ্ডে শক্তিশালীরূপে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। না প্রাচীন আরবি সাহিত্যের ঐতিহ্যগত সুনাম অক্ষুণ্‌ণ রাখতে পেরেছেন। স্বকীয় ও স্বতন্ত্র উন্নত সাহিত্য সৃষ্টি তো দূরে থাক বরং অন্ধঅনুকরণ নির্ভর সাহিত্য রচনা করতে গিয়ে সাহিত্যের স্বাভাবিক মানও ক্ষুন্ন করেছেন। সাহিত্য অঙ্গনে নিজেদেরকে হেয়প্রতিপন্ন করেছেন।

৪. স্কুল অব আল মাহজার: (পাশ্চাত্যে আরবি সাহিত্য স্কুল): উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের সূচনাতে সিরিয়া, লেবানন এবং ফিলিস্তীন থেকে অনেক আরব বিশেষত: রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকাসহ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে মাইগ্রেটেড হয়ে বসবাস শুরু করেন। অপেক্ষাকৃত শান্তি, নিরাপত্তা, স্থিতিশিলতা, সামাজিক স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার ফলে সাহিত্য প্রেমিকগণ পাশ্চাত্যের এসব দেশে সাহিত্য চর্চার আগ্রহ অনুভব করেন। তা ছাড়াও আরবগণ নতুন দেশে অপরিচিত পরিবেশে নিজেদেরকে নিঃসঙ্গ মনে করা, সুদূরে অবস্থিত নিজেদের দেশের প্রতি হৃদয়ের আকুতি এবং ভিন দেশের ভিন্ন সমাজের মধ্যে নিজেদের আরবি ভাষা ও স্বকীয়তা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশংকা সৃষ্টি হওয়া ইত্যাদি কারণে মুহাজির আরবগণ পরস্পরের সাথে পরস্পরের বন্ধনকে সুদৃঢ় করার প্রয়াসী হন। ফলে তারা বিভিন্ন সংস্থা, সমিতি, ক্লাব, পত্রপত্রিকা ও ম্যাগাজিন ইত্যাদি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এসব প্রতিষ্ঠানে তারা মিলিত হয়ে নানা ধরনের সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। এদের মধ্য থেকে সাহিত্যিক ও কবি বেরিয়ে আসে। তারা আরবি সাহিত্য স্কুল ও ইনস্টিটিউশন গড়ে তোলেন। এ প্রতিষ্ঠানের নামই হলো, আল-মাহজার স্কুল বা পাশ্চাত্যে আরবি সাহিত্য মতবাদ। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পাশ্চাত্যে আরবগণ আধুনিক আরবি সাহিত্যের উন্নতি ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করেন। আল-মাহজার স্কুল আবার দু’ভাগে বিভক্ত।

এক. কলম সাহিত্য সংঘ: সিরিয়ার মুহাজিরগণ ১৯২০ ঈ. সনে উত্তর আমেরিকার নিউইয়র্কে এটি গড়ে তোলেন। প্রসিদ্ধ কবি জাবরান খলীল জাবরান এ প্রতিষ্ঠানের মূল পরিকল্পনাকারী। তিনি এর নেতৃত্ব দেন। পরবর্তীতে অনেক কবি সাহিত্যিকই এ সংঘের সাথে যোগ দেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: নুদরাহ হাদ্দাদ, আবদুল মাসীহ হাদ্দাদ, নাসীব আরীযা, রশিদ আইউব, মিখাইল না‘ঈমাহ, ইলিয়া আবু মাযী, উইলিয়াম কাতসফ্লিস, ওয়াদী বাহুত এবং ইলিয়া আতাউল্লাহ।

দুই. স্পেন সাহিত্য সংঘ’: ১৯৩২ ঈ. সালে ব্রাজিলের সাও বওলু নামক স্থানে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্ভবত স্পেনের মনোরম পরিবেশের কারণে দক্ষিণ আমেরিকায় বসবাসরত আরবদের মনে স্পেনে তাদের পূর্বপুরুষদের গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা গভীরভাবে নাড়া দেয়। এ অনুভূতি থেকেই সর্ব প্রথম কবি শুকরুল্লাহ আল জার এ ধরনের সংঘ গড়তে উদ্যোগ নেন। মিশিল আল মা‘লুফের বাড়িতে তাকে সভাপতি করে এ সংঘের ঘোষণা দেয়া হয়। এ সংঘের উল্লেখযোগ্য কবি সাহিত্যিকগণ হলেন: শুকরুল্লাহ আল জার, মিশিল মালুফ, নাযীর যাইতুন, হাবীব মাসউদ, ইস্কান্দার কারবাখ, নসর সামআন, দাউদ শাকূর, ইউসুফ আল বাইনী, হুসনি গুরাব, ইউসুফ আস‘আদ গানিম, আনতুন সেলিম সা‘দ সহ আরো অনেকে। এ সাহিত্য সংস্থার লক্ষ্যও কলম সাহিত্য সংঘের অনুরূপ। আরবি ভাষার রক্ষা, গোটা পাশ্চাত্যজুড়ে আরব মুহাজির সাহিত্যিকগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সুসম্পর্ক, ঐক্য ও সহমর্মিতা সৃষ্টিও এসব সংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। তা ছাড়াও আরবি সাহিত্য ও পাশ্চাত্যের সাহিত্যের মধ্যে একটি সেতুবন্ধনের কাজ করাও এসব সাহিত্য সংঘের একটি প্রধান কাজ। তবে উত্তর আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত কলম সাহিত্য সংঘের তুলনায় ‘স্পেন সাহিত্য সংঘের সাহিত্যে অনুকরণের দিকটি বেশি লক্ষ্যণীয়। এ বিষয় নিয়ে কলম সাহিত্য সংঘের সাহিত্যিকগণ স্পেন সাহিত্য সংঘের সমালোচনা করে থাকেন।

৫. আধুনিক কবিতা: ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে আধুনিক আরবি কবিতার রীতি পদ্ধতিতে পরিবর্তনের সূচনা হয়। নতুনত্বের গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল কবিতার বিষয়বস্তুর সাথে সংশ্লিষ্ট। তখন পর্যন্ত কবিতা লেখার বাহ্যিক গঠন অবয়ব ছিল সনাতন পদ্ধতি অনুযায়ী। এ সময়ে কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু হয় উদ্দীপনা সৃষ্টি, উপনিবেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, দেশপ্রেম, সমাজসংস্কার, দারিদ্র বিমোচন, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সুস্বাস্থ্য এবং অন্যান্য জাতির উন্নতি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে চলার প্রতি আহ্বান ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট কবিতা। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আধুনিক আরবি কবিতায় শৈল্পিক বিপ্লব শুরু হয়ে বিংশ শতাব্দীতে তা পূর্ণতা পায়। এ পর্যায়ে আধুনিক কবিতা তার অর্থ, ভাব, খেয়াল ও অবস্থানের গণ্ডি পেরিয়ে শৈল্পিক দিক অবলম্বন করে, যা কবিতার বাহ্যিক গঠন ও অবয়বের সাথে সম্পৃক্ত। এ সময়ই ‘মুক্ত কবিতা’, ‘মিল ও ছন্দ বিহীন কবিতার’ আত্মপ্রকাশ ঘটে। এ ধরনের কবিতা রচনা করার সময় কবিকে মিল, ছন্দ, শব্দের সংখ্যা, তরঙ্গ, বাক্যের সুর ও ঝঙ্কার ইত্যাদির কথা ভাবতে হয় না। ইউরোপের রোমান্টিক সাহিত্যিকগোষ্ঠী মুক্ত কবিতার রচনার প্রতি ঝুঁকে পড়লেও আমেরিকার ওয়ালট ওয়েটম্যান ঊনবিংশ শতাব্দীতে ‘মুক্ত কবিতার’ জন্ম দেন। তবে আরবি কবিতায় কবি নাযিক মালাইকাহ সর্ব প্রথম ‘মুক্ত কবিতা’ রচনা করেন। বদর শাকির আস সাইয়্যাব এবং আহমাদ বাকাছীরও অনুরূপ কবিতা রচনা করেছেন বলে প্রতিয়মান হয়। আধুনিক কবিতার আরেকটি প্রকার হলো অমিল যুক্ত ছন্দময় গদ্য কবিতা। এ ধরনের কবিতায় কবি কখনো কখনো মিল ও ছন্দ রীতির অনুসরণ করলেও প্রতি ছত্রের পরিমাপ ঠিক রাখে না। বস্তুত সনাতন পদ্ধতিতে কবিতা রচনা করার চেয়ে এ ধরনের কবিতা রচনা করা অধিকতর কঠিন। কারণ এ কবিতা রচনা করতে ভাষার সূক্ষ্ম ও নিগুঢ় রহস্য জানা, শব্দের সুর ও ঝঙ্কার বুঝা, অলঙ্কার রীতিসহ শব্দসমূহের সুরের মধ্যে সামঞ্জস্য ও মিল জানা অত্যাবশ্যক। এ প্রকারের কবিদের মধ্যে নাজীব কিলানী, নিযার কাববানীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অপরদিকে আধুনিক আরবি সাহিত্যে আরেক প্রকারের কবিতার অস্তিত্ব বিদ্যমান। তা হলো গদ্য কবিতা। ফ্রান্সের বুদলীর সর্ব প্রথম এ ধরনের কবিতা রচনা করেন। তার অনুসরণে বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাশ্চাত্যে বসবাসরত আরবি কবিগণের কেউ কেউ এ ধরনের কবিতা রচনায় প্রয়াসী হয়। পরবর্তীতে এর আরো বিকাশ ঘটে। আমীন রায়হান, মিখাইল নাঈমাহ ও জাবরান খলীল জাবরান উত্তর আমেরিকাতে এই গদ্য কবিতার চর্চা করেন। এতদসত্বেও সার্বিক বিচারে আরবি কবিতা ওযন, মিল ও ছন্দের ওপর কোন না কোনভাবে নির্ভরশীল বলে এ ধরনের কবিতা ব্যাপকভাবে প্রসারলাভ করেনি। আধুনিক আরবি সাহিত্যে আরেক প্রকারের নতুন কবিতার প্রচলনও দেখা যায়, তা হলো: কাব্য কবিতা’ বা গল্প কবিতা।

এ ধরনের কবিতায় যুদ্ধবিগ্রহের বর্ণনা, বীর সেনানীদের বীরত্বগাঁথা জীবনী, প্রকৃত ইতিহাসের বর্ণনা খেয়াল ও কল্পকাহিনীর মাধ্যমে তুলে ধরা এবং মানুষের আবেগ অনুভূতি ইত্যাদি বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়। তাই অনেক সময় এ কবিতা অনেক দীর্ঘ হয়ে থাকে। কখনো কখনো তা হাজার পংক্তি ছেড়ে যায়। এ ধরনের কবিতার প্রচলন প্রাচীন গ্রিস ও রোমান সাহিত্যে বিদ্যমান। গ্রিক কবি হুমারের গ্রিস যুদ্ধ সংবলিত ইলিয়াযাহ কবিতা এবং যুদ্ধ পরবর্তী গ্রিসে ফিরে আসার ঘটনা নিয়ে লেখিত আওদীসাহ কবিতা অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। অপরদিকে রোমান কবি ফিরজীলের হুমিরুসের মহাকাব্যের অনুকরণে বীর ইনিয়াসের ঘটনা সংবলিত লেখা ‘ইলিয়াযা’ও প্রসিদ্ধ। একইভাবে ইউরোপসহ অন্যান্য দেশের কবি সাহিত্যিকগণও এ ধরনের গল্প ও কাব্য কবিতা রচনা করেছেন। ফ্রান্সের ‘রোলান, পারস্যের শাহনামা এবং ভারতের মহাভারত ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন আরবি সাহিত্যে এ ধরনের গল্প ও কাব্য কবিতার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু আধুনিক যুগে আরব কবিগণ তাদের প্রাচীন ও আধুনিক ইতিহাসের প্রেরণা থেকে আরবি ও ইসলামী বীরত্বগাঁথা কাহিনী নিয়ে কবিতা রচনায় প্রয়াসী হন। এক্ষেত্রে মিসরীয় কবি আহমাদ মুহাররম (মৃ. ১৯৪৫ ঈ.) চার খণ্ডে ‘ইসলামী ইলিয়াযাহ’ কবিতা রচনা করেন। এ কবিতায় তিনি রাসূল (সা.)-এর মাক্কী ও মাদানী জীবন, যুদ্ধবিগ্রহ, বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ, পরবর্তী যুদ্ধসমূহ, বীরত্বপূর্ণ কাহিনী, তাঁর বিদেশনীতি ও বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দলের আগমন ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরেছেন। তা ছাড়াও খলীল মাতরান কাল পাহাড়ের বালিকা নামক কাব্যিক কবিতা রচনা করেছেন। সেখানে তিনি তুর্কীদের বিরুদ্ধে আরবদের বিদ্রোহের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। আধুনিক আরবি সাহিত্যে আরেক প্রকারের কবিতা হলো নাট্য কবিতা। এ প্রকারের কবিতাও আরবি সাহিত্যে ছিল না। এমনকি আধুনিক আরবি সাহিত্যেও এ ধরনের কবিতার অস্তিত্ব অতি বিরল। সর্বপ্রথম এ ধরনের কবিতা রচনা করেন আহমাদ শাওকী। এ বিষয়ে তিনি ছয়টি কবিতা লেখেন। তিনটিতে ক্লিওপেট্রা, কামবীয এবং আলী বেক আল কাবীরের ওপর। অপর দুটি ভালবাসার কবিতা, যা মাজনু ও লাইলা এবং ‘আনতারাহকে কেন্দ্র করে। ষষ্ঠ কবিতা মিসর সম্পর্কিত। আহামদ শাওকীর পর আযীয আবাযাহ শাজারাতুদ দুররাহ, কায়েস ও লুবনাহ, কাফিলাতুন নূর ইত্যাদি কবিতা লেখেন। পরবর্তীতে আধুনিক কবিগণ এ ধরনের কবিতা ব্যাপকভাবে লেখার প্রয়াসী হন। তাদের মধ্যে সালাহ আবদুস সবুর, ওমার আবু রীশাহ ও আবদুর রহমান আশ শারকাভী উল্লেখযোগ্য। এভাবে আধুনিক আরবি সাহিত্য যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আরবি সাহিত্যের স্বকীয়তা বজায় রেখেই আধুনিক বিশ্ব সাহিত্যের সাথে পাল্লা দিয়ে উন্নত সাহিত্য হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছে।

তথ্যসূত্র ১. ফীল আদাবিল হাদীছ, ওমার আদ দাসূকী ২. ইত্তিজাহাতুশ শি‘রিল হাদীছাহ, ড. ইবরাহীম নাজী ৩. ইন্টারনেট, www. almassrawy.com

লেখক: সহকারী অধ্যাপক বিভাগীয় প্রধান, আরবি ভাষা সাহিত্য বিভাগ, আইআইইউসি

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ