জামেয়া ওয়েবসাইট

বুধবার-৯ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-১৩ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৮শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতি

কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতি

কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতি

তরুণ আলিম বৃন্দ

[কওমি মাদরাসা সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে অনেক আলোচনা, সমালোচনা পর্যালোচনা সমান্তরালভাবে চলছে। এমনকি সুন্নী অন্দোলন নামে একটি গ্রুপ স্বীকৃতি বাতিলের দাবি জানিয়ে ব্যানার প্লেকার্ড নিয়ে রাজপথে মানববন্ধন করেছে। পক্ষে বিপক্ষের কিছু আলোচনা নিছক বিরোধিতা; আবার বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা। কারো আছে শংকা ভীতি। কারো আছে সুপারিশ প্রস্তাবনা। অনেকে দরদি মন নিয়ে বিষয়টি ভেবে দেখেছেন। আমরা এসব ভাবনাগুলোকে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে চাই। ভাবনা প্রস্তাবনাগুলো লেখকদের একান্ত নিজস্ব। এর সাথে মাসিক আত-তাওহীদ বা জামিয়া আল ইসলামিয়া কর্তৃপক্ষের একমত হওয়া জরুরি নয়সম্পাদক]

 

কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতি: কিছু ভাবনা, কিছু অনুভূতি

ড. মাওলানা সাদিক হুসাইন

কওমি সনদের স্বীকৃতির বিলটি মন্ত্রী পরিষদে অনুমোদিত হয়েছে। একেবারে নির্বাচনের আগমুহূর্তে নেয়া এ উদ্যোগ যতটা সুসংবাদ তার চাইতে বেশি তাৎপর্যময়। এটা ব্যাখ্যা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তাছাড়া এ প্রসঙ্গে এখনও শেষকথা বলার সময় আসেনি। সংসদে পাশ হলেই কেবল সরকার তা বাস্তবায়নের পথে এগোতে পারবে। কারণ ইতোমধ্যেই স্বীকৃতি বিরোধী একটা লবি আদাজল খেয়েই মাঠে নেমেছে।

তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, আলেমসমাজের দীর্ঘদিনের মেহনত ও সংগ্রামের ফসল এ স্বীকৃতি। সেই খতিবে আজম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.) থেকে আরম্ভ করে বর্তমান প্রজন্ম পর্যন্ত। যারা এ ক্ষেত্রে সময় দিয়েছেন, আন্দোলন করেছেন, পরিশ্রম করেছেন, তারা নিশ্চয়ই যুগসচেতন দেশদরদী। কারণ কওমি সমাজের ন্যায় এতো বিরাট জনসংখ্যার অবদান ও ভূমিকাকে উপেক্ষা করে দেশের সার্বিক উন্নতি সুদূরপরাহত। সবার প্রতি সম্মান রেখেই আমার ক্ষুদ্র দৃষ্টিতে কয়েকটি ভাবনা পেশ করছি:

এক. আমার মতে দাওরা হাদিসের মান সরাসরি মাস্টার্স না চেয়ে বিএ/বিএ অনার্সের মান চাইলে বেশি ভালো ও কার্যকর হতো। যেমনটা ভারত ও পাকিস্তানে ঘটেছে। আমার জানা মতে, দেওবন্দের দাওরায়ে হাদিস এবং নদওয়াতুল ওলামার আলেমিয়তের সনদ ভারতে বিএ অনার্সের মান দেয়া হয়েছে। ফলে ওসব ডিগ্রিধারী সেসব সনদ দিয়ে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে থাকেন। একইভাবে পাকিস্তানের জামেয়া আশরাফিয়ার দাওরা-পাশ ছাত্র পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যলয়ে মাস্টার্সে ভর্তির সুযোগ পায়।

বিএ অনার্সের মান দিলে তা দিয়ে দেশের যে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে পরবর্তীতে মাস্টার্স ও পিএচডি করার সুযোগ পেত। তখন ডিগ্রির ভেল্যুটা অনেকটা জেনেরাল পর্যায়ে চলে আসতো। চাকরির ক্ষেত্রেও তুলনামূলক বেশি মূল্যায়িত হতো। বর্তমানে স্বীকৃতি বিরোধীরা দাওরা হাদিসের মান সরাসরি মাস্টার্সের মান কেমনে হয় বলে চিল্লাচিল্লি করারও সুযোগ কম পেত।

দুই. মুতাওয়াসসিতা ও সানভিয়াকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের সমমান দিতে হবে। প্রয়োজনে তা দেশে প্রচলিত মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের ন্যায় একটা কওমি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে হতে পারে। তখন উচ্চশিক্ষা ও চাকরির সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে কওমি ছাত্ররা অনেক এগিয়ে থাকবে। কারণ শিক্ষাগত যোগ্যতা তো ছিলই কওমি ছাত্রদের, সনদের অভাব ছিল। তাও যোগ হয়ে গেল এবার। তখন তাদের অগ্রযাত্রায় আর কোনো বাধা থাকবে না। বিদেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহেও তারা তখন উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদন করতে পারবে। ইনশা আল্লাহ।

তিন. তবে সবক্ষেত্রে কওমি শিক্ষার মূল স্বকীয়তা বজায় রাখতে হবে। নৈতিকতার মানদণ্ড কোনোভাবেই নিচে নামানো যাবে না। কারণ কওমি মাদরাসা কোনো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রচলিত সরকারি মাদরাসা নয়; এটা একটা বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মেডিকেল কলেজে পড়লে যেমন ডাক্তার হয়, বুয়েটে পড়লে যেমন প্রকৌশলী হয় তেমনি কওমি মাদরাসায় পড়লে দক্ষ আলেমে দীন তৈরি হবে। এখান থেকে অন্য কোনো পেশাদার আশা করা অবান্তর। হলেও হতে পারে। তা হবে দেশের জন্য বাড়তি সৌভাগ্য।

লেখক: দাওরায়ে হাদীস, হাফিযে কুরআন, সাহিত্যিক অনুবাদক, সিনিয়র কর্মকর্তা, বাংলাদেশ দূতাবাস,  রিয়াদ, সৌদিআরব, সাবেক উস্তাদ, জামেয়া দারুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়া, চট্টগ্রাম, মাস্টার্স পিএইচডি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

কওমি সনদের স্বীকৃতি সবার উদ্দেশ্যই মহৎ

সৈয়দ শামছুল হুদা

বাংলাদেশে কওমি মাদরাসা এখন আর কোন অবহেলার বিষয় নয়। দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে অনন্য অবদান রেখে চলেছে কওমি মাদরাসাগুলো। কওমের সরাসরি সাহায্যে চলে বলে এগুলো কওমি মাদরাসা। কওমই এর তদারক। কওমই এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক। কওমি মাদরাসাগুলো রাষ্ট্রের কোন পৃষ্ঠপোষকতা কোনকালেই গ্রহণ করেনি। ফলে রাষ্ট্রের সাথে এর একটি অঘোষিত দূরত্ব চলেই আসছে।

৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম প্রশ্ন আসে কওমি মাদরাসাগুলো কি এভাবেই চলবে, নাকি রাষ্ট্রের সাথে এর কোন সম্পর্ক থাকবে। ৪৭এর আগে ব্রিটিশ ক্ষমতায় থাকায় এ প্রশ্ন আসেনি। কারন কওমি মাদরাসাগুলোর জন্মই হয়েছে তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের নির্মুল করার জন্য। শাসকগোষ্ঠীর মূলোৎপাটনের জন্য। রাষ্ট্র থেকে কওমকে উচ্ছেদ করাই, অস্ত্রের মুখে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ায় কওমি মাদরাসাগুলো কখনোই শাসকদের থেকে কোন প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা গ্রহণ করেনি। কিন্তু বর্তমানে সেই শাসনও নেই, শাসকও নেই। তাহলে কি এখনো সেভাবেই চলবে?

এভাবে চলতে পারে না বলেই কওমি মাদরাসাসমূহ তার স্বকীয়তা বজায় রেখে রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক সৃষ্টি করতে চায় বলেই উলামায়ে কেরাম রাষ্ট্রের একটি সম্মানজনক স্বীকৃতির জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছেন। পাকিস্তানে কওমি মাদরাসাগুলোর সাথে রাষ্ট্রের একটি সম্মানজনক সুরাহা হয়েছে। মাদরাসাগুলো নিজস্ব সিলেবাসে চলে। তবে সরকারের অনুমতি থাকায় তাদের কাজের কোন অসুবিধা হয়না এবং সর্বোচ্চ সনদের একটি সম্মানজনক মান দেওয়ার বিষয়টি সেখানে রাষ্ট্রীয় আইনের আওতায় স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এখনও পর্যন্ত এর কোন সম্মানজনক সুরাহা হয়নি। চারদলীয় জোট সরকারের অন্যতম শরীক শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) এই সম্মানজনক সুরাহার জন্য চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু করেন। এর আগেও অনেক আন্দোলন হয়েছে। মিছিল হযেছে। দাবি-দাওয়া পেশ করা হয়েছে। বিএনপির আমলে কিছু চালাক মানুষের চালাকির কারনে বেগম জিয়ার শত আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও এর সম্মানজনক সুরাহা হয়নি।

বর্তমান সরকারের শুরুতে এ নিয়ে কেউ কেউ আবার আওয়াজ তুলতে থাকেন। তার মধ্যে আল্লামা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ অন্যতম। তিনি এ সরকারের প্রিয়ভাজন হিসেবে এবং ভারতবান্ধব ব্যক্তি হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত। সরকারের উচ্চমহলে তিনি সে আওয়াজটা পৌছে দিতে সক্ষম হন। নড়েচড়ে বসে গোটা কওমি অঙ্গন। এক পর্যায়ে এই স্বীকৃতির ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়ে গোটা কওমি অঙ্গন। গঠিত হয় কমিশন। রাগ-অভিমান চলে এর কিছুদিন। অবশেষে সম্মিলিতভাবেই স্বীকৃতির ঘোষণা আদায় করা সম্ভব হয়। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে আবারও কিছুটা ভিন্নমত তৈরি হয়েছে। এখানে যে বিষয়টি স্মর্তব্য, সেটা হলো এখানে সবার উদ্দেশ্যই মহত। কওমি মাদরাসার স্বকীয়তা এবং বৈশিষ্ট্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে কোন ছাড় নয়। এ ব্যাপারে সকলেই একমত।

কওমি মাদরাসা স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে গঠিত কমিটি বা হাইয়াতুল উলয়া বারবার মিটিং করে যাচ্ছে। যেহেতু কওমি মাদরাসাগুলোর মূল প্রাণ সাধারণ জনগণ। তাই তাদের সাথে যেন কোন প্রকার ভুল বুঝাবুঝি না হয়, কওমি মাদরাসাসমূহের শিক্ষা ব্যবস্থায় যেন কোন পরিবর্তন না হয়, সে দিকে লক্ষ্য রাখতে গিয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে দ্বিমত আসছে। ভিন্নমত আসছে। কিন্তু বর্তমানে কেহই আর স্বীকৃতি বিরোধী নয়, সরকারের সাথে ন্যূনতম সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে দ্বিমত নয়। এখানেই কওমি অঙ্গনের আলেমদের সফলতা।

কওমি মাদরাসার সনদের ব্যাপারে যে ঘোষণা সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এসেছে, তা বাস্তবায়ন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবে একটি বিষয় খুব পরিস্কার। এই সরকারের নিকট থেকে যতটা সহজে স্বীকৃতি নেওয়া সম্ভব ততটা বিএনপি থেকে সম্ভব নয়। কারণ বিএনপি একটি দুদোল্যমান দল। তারা সিদ্ধান্ত নিতে এত বেশি বিলম্ব করে যে, যার ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে দিবে। তাছাড়া বিএনপির শরীক দলদের চরম চালাকির খপ্পরে কওমি মাদরাসাকে পড়তে হবে।

অতএব স্বীকৃতির বিষয়টি চুড়ান্ত হওয়ার শেষ পর্যায়ে, আর বর্তমান সরকারের মেয়াদও প্রায় শেষ পর্যায়ে। বিষয়টি এখনই শেষ করে ফেলা দরকার। এটাকে পরবর্তী সরকার পর্যন্ত নিয়ে নেওয়া হবে বোকামী।

৬ বোর্ডের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব এসেছে সেটাকে উড়িয়ে না দিয়ে কিভাবে তাদের সবাইকে সন্তুষ্ট করেই সম্মিলিতভাবে দ্রুত স্বীকৃতি আদায় করা যায় তা দেখার জন্য সকল মহলের প্রতি উদাত্ত আহবান জানাই। সকলে এক থাকলে কোন সরকারই আমাদেরকে ক্ষতির মধ্যে ফেলতে পারবে না। যদি হাইয়াতুল উলয়াকে ইউজিসি বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মর্যাদায় উন্নীত করা যায়, সেটা যুক্তিপূর্ণই হবে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কওমি মাদরাসাগুলো গেলে হয়তো ক্ষতির সম্ভাবনাই আছে। যদি হাইয়াতুল উলয়াকে ইউজিসির মর্যাদায় উন্নীত করা যায়, তাহলে বাংলাদেশে এমন কমপক্ষে ১০০টি মাদরাসা আছে, যেগুলো বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার যোগ্যতা রাখে। যেমন- হাটহাজারী, পটিয়া, লালবাগ, রাহমানিয়া, নাজিরহাট, বাবুনগর, জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ, জামিল মাদরাসা বগুড়া, ফরিদাবাদ, বারিধারা, আরজাবাদ, জামিয়া চরমোনাই ইত্যাদি মাদরাসা সত্যিকার অর্থেই জামেয়া হওয়ার যোগ্যতা রাখে।

কওমি সনদের স্বীকৃতি: দূর হোক শংকা উন্মোচিত হোক সম্ভাবনার দুয়ার

মাওলানা মামুনুল হক

ভারত উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র হল কওমি মাদরাসা। কওমি মাদরাসাকে দরসে নেযামী বা দেওবন্দী মাদরাসাও বলা হয়। দরসে নেযামী উপমহাদেশের ঐতিহাসিক ইসলামী শিক্ষার এক বিশেষ পাঠ্যসূচীকে বলা হয়, যেই পাঠ্যসূচীর সংস্কার ও সংশোধন হয়ে বর্তমানে কওমি মাদরাসা নামে পরিচালিত হচ্ছে। ১৮৬৬ সালে তৎকালীন ঔপনিবেশিক আমলে সাহারানপুরের দেওবন্দে একটি মাদরাসার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল, সেটিই ইতিহাসে দারুল উলুম দেওবন্দ নামে পরিচিত। ব্রিটিশ শাসনের পরাধীনতা থেকে মুক্তি অর্জনের লক্ষে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ কিংবা শামেলীর স্বাধীনতা যুদ্ধে বিপর্যয়ের পর যখন ভারতে ইসলাম ও মুসলিম জাতিসত্তার অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে যায়, তখন সরকার ও রাষ্ট্রের সব ধরনের সংশ্লিষ্টতা পরিহার করে প্রতিষ্ঠা লাভ করে দারুল উলুম দেওবন্দ। অতীত তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকেই দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতাগণ সময়োপযোগী এ সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলেন। এরপর ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয় এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে ভিন্ন ভিন্ন দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। দেওবন্দের ধারায় পরিচালিত কওমি মাদরাসাগুলো নিজস্ব ঐতিহ্যের ধারায়ই পরিচালিত হতে থাকে। কিন্তু পরাধীনতার কাল থেকে স্বাধীনতার আমলে এসে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। সেই সাথে স্থানীয় ও বিশ্ব প্রেক্ষাপটেও সূচিত হয় ব্যপক ভিন্নতা। এই সুবাদে কওমি মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির প্রশ্ন আসে। পাকিস্তানে কওমি সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি কার্যকর রয়েছে।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশেও উনিশ শ আশির দশক থেকে কওমি মাদরাসা শিক্ষা সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি গ্রহণের লক্ষে তৎপরতা শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে বিষয়টি নিয়ে সরকারের সাথে ব্যপক দেন-দরবারের পরিস্থিতিও তৈরি হয়। সনদের স্বীকৃতির রূপরেখা ও পথ-পদ্ধতিতে কিছু মতপার্থক্যও দেখা দেয় খোদ কওমি আলেম সমাজের মধ্যে। চার দলীয় জোট সরকারের আমল থেকে বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের আমল পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে অনেক বিতর্কও হয়েছে। অতিসম্প্রতি এ বিষয়ক বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। চায়ের কাপে ঝড় উঠার পাশাপাশি মাঠ-ময়দান পর্যন্তও গড়াচ্ছে বিষয়টি। কিন্তু সে তুলনায় শিক্ষাবিদ ওলামায়ে কেরামের গবেষণা ও পর্যালোচনার কমতি রয়েছে বলে অনুভব হচ্ছিল। এমন পরিপ্রেক্ষিত থেকেই মাসিক রাহমানী পয়গাম বহুল আলোচিত এ বিষয়টি নিয়ে বিশেষ আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। শিক্ষাবিদ ও চিন্তাশীল ওলামায়ে কেরামকে নিয়ে একটি তাৎপর্যময় গোলটেবিলেরও ব্যবস্থা করে।

আমাদের কামনা, কওমি মাদরাসা শিক্ষা সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নিয়ে চলমান শংকাগুলো দূর হোক। কওমির স্বকীয়তা, স্বাধীনতা অটুট থাকুক। আর কল্যাণকর উপায়ে আদায় হোক লাখো কওমি জনতার প্রাণের দাবি। সব চেয়ে গুরুত্বের সাথে যেটা উপলব্ধি হচ্ছে, সেটা হল যে কোনো মূল্যে ঐক্যবদ্ধ থাকুক কওমি ওলামায়ে কেরাম।

আলিয়ার দৃষ্টিতে কওমি সনদের স্বীকৃতি

কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দেয়ায় খুশি আলিয়া মাদরাসার আলেমরাও। তাদের কথা, এই স্বীকৃতির ফলে বিশাল একটা জনগোষ্ঠী মূল স্রোতধারায় আসবে এবং সমাজ, রাষ্ট্রে অবদান রাখবে। তবে এই স্বীকৃতি যেন শুধু কাগজে না হয় সেদিকে কর্তৃপক্ষ ও কওমি আলেমদের নজর রাখতে হবে। একই সঙ্গে কওমি মান যথাযথভাবে রক্ষা করে তারা যেন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুযোগ পায় সেটি নিশ্চিত করারও তাগিদ দেন তারা। এই উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ টেনে আলেমরা বলেন, কওমি মাদরাসায় পড়াশুনা করে সেনাবাহিনী, প্রশাসন, বিচার ও শিক্ষা বিভাগের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছে। ইসলামের বিভিন্ন জায়গার উচ্চতর গবেষণা করছে। যা সমাজ ও রাষ্ট্রের অবদান রাখছে। বাংলাদেশের কওমি মাদরাসা শিক্ষার্থীরা যাতে সেই সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।

আলেমরা জানান, আমাদের কওমি মাদরাসায় স্বভাবতই ইসলামী বিষয়াবলি তথা আল-কুরআন, আল-হাদীস, ইসলামের ইতিহাস এবং আরবি ভাষা ইত্যাদি পড়ানো হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও ইসলামী নানান বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্স পড়ানো হয়। বিভিন্ন ইসলামী বিষয়ে এমফিল-পিএইচডি করারও সুযোগ আছে। অনেক কওমি গ্র্যাজুয়েটের এসব বিষয়ে শিক্ষকতার মতো যোগ্যতা থাকলেও শুধু কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতির অভাবে শিক্ষকতার আবেদন করা তো দূরের কথা, স্নাতক-স্নাতকোত্তর কোর্সে ভর্তি হওয়ার ন্যূনতম সুযোগ পেতো না। বহির্বিশ্বের বিভিন্ন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও একমাত্র এই সনদের সরকারি স্বীকৃতি না থাকার কারণেই অনেক শিক্ষার্থী আবেদন করতে পারছেন না। এখন সেই আবেদনের সুযোগ হলো। তবে এর জন্য নিচের স্তরের স্বীকৃতির প্রয়োজন হবে। এটাও তাদের আদায় করতে হবে। এটা নিয়ে কওমিপন্থিদের নানান মত আছে। তারপরও জাতীর স্বার্থেএকটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে।

কওমি মাদরাসায় পড়াশুনা করে অনেকেই এখন জনপ্রতিনিধিত্বশীল বিভিন্ন নির্বাচনে অংশগগ্রণ করছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচন থেকে নিয়ে একেবারে সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত অংশ নিচ্ছেন। বর্তমান সরকারের আমলে ইসি বা নির্বাচন কমিশন স্তরভেদে বিভিন্ন নির্বাচনে বিভিন্ন শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্তারোপ করেছেন।

ইসলামী দলগুলোর সমন্বয় পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা ও জাতীয় ফতোয়া বোর্ডের সেক্রেটারি ড. খলিলুর রহমান মাদানী বলেন, কওমি স্বীকৃতি প্রকৃত পক্ষে আমাদের আলেম-ওলামা ও ইসলামের জয়। তারা যদি মান পায়, স্বীকৃতি পায় এটা অবশ্যই আলেম-ওলামাদের জন্য খুবই পজিটিভ। সর্বোপরি ইসলাম ও মুললিম উম্মাহর জন্য ভালো। এতোদিন যারা সমাজের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতো স্বীকৃতিও মান না থাকার কারণে তারা আজ মূল স্রোতধারায় আসবে। তিনি বলেন, নিচের স্তরের স্বীকৃতি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য আলাদা সিলেবাস বা বোর্ড করতে পারে। কারণ যে কোনো প্রতিষ্ঠান তাকে ভর্তি করাতে নিচের দিকে সর্ার্টিফিকেট চাইবে। সংশ্লিষ্টদের এই বিষয়গুলো দেখতে হবে। এটা যেন শুভংকরের ফাঁকি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

বাংলাদেশ মসজিদ মিশনের সভাপতি ও তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ যাইনুল আবেদীন বলেন, কওমি মাদরাসার স্বীকৃতি মানে ইসলামী শিক্ষার স্বীকৃতির এই স্বীকৃতিকে কাজে লাগিয়ে অনেকদূর যেতে পারবে তারা। এজন্য তাদের কারিকুলাম সময়োপযোগী করতে হবে। একই সঙ্গে এটা নিয়ে যাতে আর কেউ তালবাহানা করতে না পারে সেদিকেও নজর রাখতে হবে।

আইয়িম্মা পরিষদের সভাপতি মাওলানা মহিউদ্দিন রব্বানী বলেন, লাখ লাখ কওমি শিক্ষিত বাংলাদেশেরই সন্তান। তাদের নানান অফিসিয়াল কাজে বিভিন্ন সরকারি ফরম পূরণ করতে হয়। ফর্মে নাম-ধাম, জন্ম তারিখ, ঠিকানার পরই শিক্ষাগত যোগ্যতার একটা অংশ থাকে। কিন্তু কওমি শিক্ষিতরা এ অংশটুকু পূরণ করতে মারাত্মক বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। কারণ ফরমে সাধারণ শিক্ষার বিভিন্ন সনদের নাম থাকলেও কওমি শিক্ষার কোনো সনদের নাম নেই। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ শিক্ষার স্বীকৃতি থাকলে অবশ্যই বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি ফরমে কওমি সনদের নাম থাকত আর কওমি সনদধারী কেউই বিব্রতবোধের শিকার হতেন না। মানবজমিন রিপোর্ট ২১ এপ্রিল ২০১৭

মাস্টার্সের পাশাপাশি স্নাতক, উচ্চ মাধ্যমিক মাধ্যমিক স্তরের সনদের প্রয়োজন বেশি

মাওলানা মীযান হারুন

সৌদিসহ বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনার্সে ভর্তি হতে হলে এইচএসসি বা আলিমের সার্টিফিকেট লাগবে। মাস্টার্সে হতে হলে অনার্সের সার্টিফিকেট লাগবে। পিএইচডিতে হতে হলে মাস্টার্সের সার্টিফিকেট লাগবে। একাডেমিকভাবে দাওরার ভবিষ্যৎ কী তাহলে? উদাহরণত সৌদিতে দাওরা দিয়ে আপনি অনার্সে ভর্তি হতে পারবেন না (কারণ ওটা সেকেন্ডারি না মাস্টার্স সমমান)। আবার মাস্টার্সেও পারবেন না (কারণ ওটা অনার্সের সর্টিফিকেট না)। আবার পিএচডিতেও পারবেন না (কারণ দাওরার একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন আন্তর্জাতিক মাস্টার্সের রিকোয়ারমেন্ট উত্তীর্ণ না)। তাহলে দেখা যাচ্ছে একাডেমিকভাবে আপনি অন্তত বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কিছুই করতে পারছেন না। উটও না পাখিও না। দেশের বিশ্বদ্যিালয়গুলোতেও আমি আশার আলো দেখি না।

প্রতি বছর সৌদি আরবে অসংখ্য ছাত্র আসছে দেশ থেকে। তবে এতে কওমি ছাত্রদের সংখ্যা নেহায়াত কম। অথচ এই সংখ্যাটা বৃদ্ধি পাওয়ার দরকার ছিল। অনেক দরকার ছিল। দীনের স্বার্থে, উম্মাহর স্বার্থে, আকাবিরদের স্বার্থে, নিজেদের স্বার্থে। সবদিক থেকেই সংখ্যাটা বৃদ্ধি পাওয়ার দরকার ছিল। এখানে এলেই আকাবিরের ওপর বিদ্রোহ করে বসবে এমন ধারণা পানসে হয়ে গেছে। ওগুলো শোনার সময় কই? আমরা ভাই-বেরাদররা এখানে যারা আছি, প্রত্যেকেই আকাবিরের প্রতি ওফাদার। এটা বোধহয় কাউকে আর নতুন করে প্রমাণ দেয়ার দরকার নেই। যাইহোক যেটা বলছিলাম, এখানে কওমি ছাত্রদের উপস্থিতি জরুরি। নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই জরুরি। কথাটার মানে আরও কয়েক বছর পর আরও স্পষ্ট হবে।

তাহলে করণীয় কী? এক্ষেত্রে করণীয় হচ্ছে দুটোর একটা:

এক. এইচএসসি পর্যায়ে একটা অধ্যায় যোগ করতেই হবে। সেটা শরহে বেকায়া বা আগে-পরে হলে ভালো। ওটা শেষ করে ফেললে ছাত্রদের সামনে পুরো পৃথিবীর দুয়ার খোলা থাকবে। দেশে-বিদেশে সকল জায়গার জ্ঞানের জগত উন্মুক্ত হবে। যদি আলিয়ার ফাজিল আর কামিলের মতো মিশকাত-দাওরাতে ছাত্র না পাওয়া ভয় থাকে, কিংবা ছাত্রদের পদস্খলনের ভয় থাকে তবে সেটার প্রতিরোধে অন্য ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। কিন্তু মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক সব ডিঙিয়ে এক লাফে মাস্টার্স এটার অন্যান্য বিভিন্ন উপকারিতা থাকলেও একাডেমিকভাবে ছাত্ররা মোটেও উপকৃত হবে না এটা থেকে। ছাত্রদের আলিয়া ও স্কুলে যাওয়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকবেই।

দু্‌ই. দ্বিতীয় পথটা হচ্ছে সৌদি সরকারের সঙ্গে দাওরার মুআদালা (সমমান) করে ফেলা। আল হাইআতুল উলইয়ার অধীনে যে-ই দাওরা পরীক্ষা দেবে সৌদির যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সে আবেদন করতে পারবে- এমন একটা পদক্ষেপ নিলেই হয়। খুব সহজ। সৌদির পক্ষ থেকে কোনো সমস্যা নেই। কিছু কিছু মাদরাসাতো প্রাইভেটভাবেও কাজটি করে ফেলেছে। এখন যদি কেবল বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে এব্যাপারে কথা বলে জাতীয়ভাবে কাজটি করার উদ্যোগ নেয়া হয় তবে খুব সহজেই হয়ে যাবে ইনশআল্লাহ। এটা আমাদের উলামারা করবেন কি?

লেখক: ইসলামী চিন্তক ও গবেষক,  কিং সাউদ বিশ্ববিদ্যালয়, রিয়াদ হতে ধর্মতত্ত্ব ও তুলনামূলক ধর্ম বিষয়ের গ্রাজুয়েট এবং জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ অনার্স

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ