মাওলানা হাসরাত মোহানী (রহ.): এক সংগ্রামী আলিমের জীবনকথা
জুলফিকার আহমদ কিসমতী
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকগুলো এই উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্যে বড় কঠিন পরীক্ষার দিন ছিল। ১৮৫৭ সালের পর ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী মুসলমানদের উপর চরম জুলুম চালাচ্ছিল। রাজনৈতিকভাবে মুসলমানরা তখন সম্পূর্ণ অসহায়ত্বের শিকার। হিন্দু রাজনীতিকরা তখন এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে এবং ইংরেজদের ইঙ্গিতে গোটা উপমহাদেশের রাজনৈতিক কর্তৃত্বেরই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে; অথচ গোটা ভারতে মুসলিম শাসকরা প্রায় পৌনে ৮শ’ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করেন। রাজা রামমোহন রায়, গোখলে তিলক এবং দয়ানন্দ স্বরস্বতি প্রমুখ নেতা হিন্দু জাতীয়তাবাদ পুনর্জীবিত করার পথ আগেই পরিষ্কার করে গিয়েছিলেন। ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং কর্তৃত্বে ১৮৮৫ সালে ন্যাশনাল কংগ্রেসও অস্তিত্ব লাভ করেছে। এটা অনেকটা রাজনৈতিক ঐক্যের প্লাটফরম হিসেবেই গঠন করে। এভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হতে থাকে। কিন্তু ষড়যন্ত্রের মধ্যে বড় ষড়যন্ত্র ছিল গোটা ভারতের জনপ্রিয় ভাষা উর্দুকে নাগরি বর্ণমালায় লেখার দাবি উত্থাপন। এর লক্ষ্য ছিল আরবি-ফারসি ভাষার সঙ্গে মুসলমানদের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা এবং নাগরিক বর্ণমালার মাধ্যমে হিন্দির নামে এমন এক ভাষার প্রসার দান যা গোটা হিন্দু সমপ্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করবে ও তাদের অধিকার সংরক্ষণ করবে। ইংরেজ ও হিন্দুদের এই যৌথ ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে পড়লে মুসলমানদেরও ঘুম ভাঙতে শুরু করে। এ ব্যাপারে স্যার সৈয়দ আহমদ তখন নেতৃত্বদানে এগিয়ে আসেন। তার সঙ্গে এগিয়ে আসেন বিখ্যাত কবি আলতাফ হোসেন হালী, মোহাম্মদ হোসাঈন আযাদ, মৌলভী চেরাগ আলী, মোহসীনুল মুলক, ভীকারুল মুলক, মাওলানা শিবলী নোমানী এবং তাদের সঙ্গে অন্যেরাও এ ব্যাপারে মনোযোগী হয়ে ওঠেন। কিন্তু এই মহান মনীষীগণ তখন ধীরে ধীরে বার্ধক্যে উপনীত হতে থাকলেন। মনে হচ্ছিল তাঁদের তিরোধানের পর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ভারতীয় মুসলমানরা এতিম হয়ে পড়লো। কিন্তু ১৮৯৮ সালে স্যার সৈয়দ আহমদের ইন্তেকালের মাত্র ১৫-২০ বছর পূর্বে মুসলমানদের মধ্যে প্রথমে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মাওলানা মোহাম্মদ আলী জাওহার, মাওলানা হাসরাত মোহানী, আল্লামা সৈয়দ সোলায়মান নদভী, মাওলানা আবদুল হক, মাওলানা জাফর আলী খাঁ প্রমুখ কতিপয় এমন নিষ্ঠাবান মেধাবী, চিন্তাবিদ, যুবক-সাহিত্যিক, কবি এবং সংস্কারক রাজনীতিক এগিয়ে আসলেন। তাদের দরুন স্যার সৈয়দ এবং তার সহকর্মীদের জ্বালানো প্রদীপ আর নিভে যাওয়ার সুযোগ পায়নি বরং তার আলোয়ই দিন দিন প্রখর হতে চললো। এই মশালকে উদ্দীন রাখার লক্ষ্যে সকলে নিজ নিজ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চললেন।
এই প্রেক্ষাপটে যে নামটি সবচাইতে অধিক প্রোজ্জ্বল হয়ে সামনে আসলো এবং যিনি নিজের জীবন থেকে শুরু করে রাজনীতি, নেতৃত্ব, ইসলামী জীবন-যাপন, কাব্যচর্চা, সাংবাদিকতা এবং জ্ঞান প্রজ্ঞান ও ভাষা সাহিত্যে সকলের মধ্যে এক বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন আর মুসলমানদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনিই হলেন সাঈয়েদ ফজলুল হাসান হাসরাত মোহানী, মাওলানা হাসরাত মোহানী জীবনের সকল স্তরেই দেশ, জাতি, ধর্মের অসাধারণ সেবা করে গেছেন। নিজের কথা ও কাজ এবং চারিত্রিক কর্মকাণ্ড দ্বারা ভারতীয় মুসলমানদেরকে এমনিভাবে প্রভাবিত করেছিলেন যে, তাদের মনীষীগণ ও সমসাময়িক বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব তাঁর জাতিসেবায় প্রশংসা না করে পারেননি। এমনি কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যার সম্পর্কে প্রচার ছিল যে তিনি সহজে কাউকে হিসাবে নিতেন না। তিনিও মাওলানা হাসরাত মোহানীর প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করেছেন এবং পাকিস্তান আন্দোলন থেকে নিয়ে তার প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত অনেক নাজুক ও জটিল সমস্যাবলীর সমাধানে তার সাথে পরামর্শ করতেন।
মাওলানা হাসরাত মোহানীর আসল নাম সাইয়েদ ফজলুল হাসান, আর পিতার নাম ছিল সাইয়েদ আজার হাসান। হাসরাত মোহানী ভারতের ইউকিজিলা আনাও নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাইমারি শিক্ষা তার ঘরেই সম্পন্ন হয়। মাধ্যমিক শিক্ষার সমাপ্তির পর তিনি তার নানাবাড়ি হতে ফুসসুহুয়াতে চলে যান। সেখান থেকে ১ম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং ফাতেপুর ইসলামিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা হযরত সাইয়েদ জহুরুল ইসলামের প্রতি তার বিশেষ ভক্তি শ্রদ্ধা ছিল। তিনি আরবি, ফারসি এবং ইসলামিয়াত মাওলানা জহুরুল ইসলামের কাছেই লাভ করেন। তার সঙ্গে এই শিক্ষাক্রমে নেয়াজ ফতেহপুরীও ছিলেন। ম্যাট্রিক পাস করার পর হাসরাত মোহানী আলীগড়ে চলে যান এবং ১৯০৩ সালে প্রথম বিভাগে বিএ পাস করেন। এখানে তার এডিশনাল সাবজেক্ট ছিল আরবি এবং অংক। এখান থেকেই তিনি তার সাংবাদিক জীবনের সূচনা করেন এবং বিএ পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হবার আগেই ১৯০৩ সালেই ‘উর্দু-এ মাওলা’ নামে একটি ম্যাগাজিন বের করেন। মাওলানা হাসরাত মোহানীর এই মাসিক পত্রিকা শুধু একটি পত্রিকাই ছিল না এটি আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে চিরকাল অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে বরং উপমহাদেশে রাজনীতি ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
হাসরাত মোহানী এবং তার পত্রিকা উর্দু-এ-মাওলাকে ব্রিটিশ সরকারের প্রথম বিদ্রোহী ও দুশমন বলা যেতে পারে। কারণ তার সূচনালগ্ন থেকেই তিনি ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ ছিলেন। এমনকি ১৯০৩ সালে এক প্রবন্ধ প্রকাশ করার অপরাধে মাওলানা হাসরাত মোহানীকে এক বছর সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়েছিল। এই সঙ্গে জব্দ করা হয়েছিলো তার প্রেসটিও। হাসরাত মোহানী ইচ্ছা করলে এই দণ্ড থেকে রেহাই করতে পারতেন কারণ প্রবন্ধটি তার লিখিত ছিল না। কিন্তু এর সম্পাদক হিসেবে তিনি এটিকে তার লেখারূপেই গণ্য করেছেন। আর এটিই হচ্ছে সাংবাদিক নৈতিকতার দাবি। মাওলানা হাসরাত মোহানী ইচ্ছা করলে আজকের বিভিন্ন সম্পাদকদের মত ক্ষমা চেয়ে দু’লাইন লিখে দিয়েই বেঁচে যেতে পারতেন। কিন্তু তার আত্মমর্যাদাবোধ তাকে এটি করতে দেয়নি। মাওলানা হাসরাত মোহানী স্বহাস্য এবং দৃঢ়তার সাথে অপরাধ স্বীকার করে নিলেন এবং তাকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয় যে, অবিভক্ত ভারতের কোথাও তার নজির মিলে না। ছাত্রজীবনেই তিনি এই শাস্তি ভোগ করেছিলেন। অতঃপর তিনি গোটা জীবন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন। তার জীবনের অধিকাংশ অংশই ফেরেঙ্গীদের জেলখানায় অতিবাহিত হয়েছে। ১৯৪৬ সালে তিনি মুসলিম লীগের টিকেটে ইউপি এসেম্বলি এবং কেন্দ্রীয় এসেম্বলি দিল্লীর সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার প্রচেষ্টায় পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও তিনি নিজে পাকিস্তানে যাননি। তার পুরো জীবদ্দশায় মুসলমানদের সেবা করে গেলেন এবং কংগ্রেস সরকার থেকে মুসলমানদের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম ও আন্দোলন করেছেন। হাসরাত মোহানীর ছাত্রজীবনেই এক অভিজাত পরিবারের কন্যা নিসাতুন নিসার সাথে তার বিবাহ হয়। এ রমনী মাওলানা হাসরাত মোহানীর সংসর্গের জন্য যথেষ্ট উপযোগী ছিলেন। কারণ তিনি ছিলেন অত্যন্ত যোগ্য এবং সাহসী। মাওলানা মোহানী যখন ননীতাল ও এলাহাবাদের কারাগারে আবদ্ধ ছিলেন তখন তার প্রথম কন্যা অত্যন্ত রুগ্ন ছিল। সরকার চেয়েছিল যে, এই অবস্থায় মাওলানা হাসরাত কারণ দর্শীয়ে লিখিতভাবে অনুকম্প আবেদন করলে তাঁকে মুক্তি দিয়ে দিবেন। কিন্তু তিনি সেই লিখিত আবেদন করেননি। তখন তার স্ত্রী নিসাতুন নিসা যে বিরাট ভূমিকার পরিচয় দিয়েছেন তা কম মহিলাই করতে পারেন। মাওলানা হাসরাতকে এক চিঠির মাধ্যমে জানালেন যে, কন্যার অসুস্থতা আপনার জন্য একটি পরীক্ষা। মেয়ের স্নেহ-ভালোবাসায় যদি আপনি হতাশ হয়ে পড়েন এবং সরকারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন তাহলে ব্যাপারটি আমার কাছে ভালো লাগবে না। স্ত্রীর চিঠি হাসরাতের নৈতিক দৃঢ়তাকে আরো শক্তিশালী করলো, এদিকে রুগ্ন কন্যাটির ইন্তিকাল ঘটলো। সরকার তাঁকে জানাযায় শরিক হওয়ার অনুমতিও দিলেন কিন্তু তিনি জেল থেকে বের হলেন না। সরকারের এই দয়া অনুগ্রহ তার স্বাধীনতাপ্রিয় প্রকৃতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী ছিল। মাওলানা হাসরাত মোহানী তার স্ত্রীকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। স্ত্রীর মৃত্যুতে তিনি গজলের সুরে বহু শোকগাঁথা লিখেছিলেন।
মাওলানা হাসরাত মোহানী ছিলেন বহুমুখী গুণ প্রতিভা মণ্ডিত ব্যক্তিত্ব। ধর্মীয় ঐতিহ্যের অধিকারী ছিলেন পারিবারিকভাবে। বাল্যাবস্থায়ই তিনি রোযা নামাজে অভ্যস্ত ছিলেন। যৌবনেও তিনি এবাদত-বন্দেগীর ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন না। সকল সময় শরীআত অনুসরণ করে চলতেন। তার প্রকৃতি ছিল সূফী প্রেমিকসুলভ। বাল্যকালেই তিনি ফিরিঙ্গি মহলের শাহ আবদুর রাজীদের মুরীদানভুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। শাহ আবদুর রাজ্জাকের ইন্তিকালের পর মাওলানা হাসরাত মোহানী তার স্থলাভিষিক্ত মাওলানা আবদুল ওহাবের কাছে নতুনভাবে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। কঠোর থেকে কঠোর পরিস্থিতিতেও তিনি কখনো নামাজ রোযা ত্যাগ করতেন না। জীবনে ১৩ বার হজ্বব্রত পালন করেন।
কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠেও তিনি রোযা রেখেছেন এবং তার সহাস্য বদন ও দীনী প্রেরণা তাঁর মধ্যে প্রত্যক্ষ করা গেছে। কাব্যচর্চার সাথে সাথে তিনি সাংবাদিকতা ও রাজনীতির সাথেও জীবনভর জড়িত ছিলেন। এই সঙ্গে সামাজিক জীবনের স্বাভাবিক ব্যস্ততা কর্মকাণ্ডের প্রতিও তার আগ্রহ কম ছিল না। স্বাভাবিক চিত্ত-বিনোদনও করতেন, ঈমানবর্ধক হামদ-নাত, গযল, কাউয়ালীও শুনতেন এবং বুযুর্গ ব্যক্তিদের মাজার জিয়ারত করে ফাতেহা পড়া ইত্যাদি তার অভ্যাস ছিল। মোটকথা তার জীবন ছিল বহুমুখী ব্যস্ততার। বাহ্যত মনে হত তিনি বৈপরীত্যের সমষ্টি। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। বরং এক বিশেষ ভূমিকা এবং চারিত্রিক দৃঢ়তারই অধিকারী লোক ছিলেন।