দুর্যোগ ঝুঁকিতে রোহিঙ্গারা
মাহমুদুল হক আনসারী
অতিবৃষ্টি, ঢল, ভূমিধস আর ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগের ঝুঁকিতে রয়েছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। ছোট বড় টিলার ঢালে বাঁশ পুতে ৪ দিকে তোলা হয়েছে মাটি বা চাটাইয়ের দেয়াল, তার ওপরে থাকা পলিথিন ছাউনি বৃষ্টি ঠেকাতে পারছে না। ঘরের ভেতরে নানা দিক থেকে পড়ছে পানি। বাইরের হলুদ কাদায় পিচ্ছিল পথেও বৃষ্টির পানি স্রোত হয়ে নামছে। যতদূর চোখ যায়, টিলার ওপর গায়ে গায়ে লাগানো অসংখ্য ঝুঁপড়ি ঘর ভারি বৃষ্টিতে ভিজছে। নামমাত্র এই আশ্রয়ের নিচে বর্ষা মওসুম পার করছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। নিজের দেশ মায়ানমারে নিপীড়নের শিকার হয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হওয়া এ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া আর তাদের প্রতিদিনের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানোর চ্যালেঞ্জ ছাপিয়ে মাথাব্যাথার বড় কারণ হয়ে উঠছে অতিবৃষ্টি, ঢল, ভূমিধস আর ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি। কক্সবাজার টেকনাফের বালুখালি ক্যাম্পে মোটামুটি দেড়শ বর্গফুট মাপের এরকম একটি ঝুঁপড়ি ঘর এখন আলতাফ হোসেন ও তার পরিবারের আশ্রয়। তিনি জানালেন, তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৫ জন। কোনো কোনো ঘরে ৮-৯জন মানুষও থাকছে। এই বর্ষা তাদের কষ্ট বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারি বৃষ্টি হলে পানি তো ঢুকছেই, ঘরগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নতুন ক্যাম্পে সেভাবে রাস্তাঘাট তৈরি না হওয়ায় পিচ্ছিল পথে চলাফেরাও কঠিন হয়ে পড়ছে। সীমান্তের জিরো লাইনে মাথা গোঁজার ঠাই নেই। অনেক কষ্টের মধ্যে কোনো রকম বেঁচে আছি। তার ওপর গত একমাসে দু-দু’বার ঢলের পানিতে ক্যাম্প তলিয়ে যাওয়ায় মরার ওপর খাড়ার ঘা অবস্থা’ কথাগুলো বলছিলেন বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তের জিরো লাইনের বয়ষ্ক রোহিঙ্গা নারী আমিরা খাতুন। তার মতো এই রোহিঙ্গা শিবিরের সবারই একই অবস্থা। এই শিবিরের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার রোহিঙ্গা এখন চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। প্রবল বর্ষণ এবং পাহাড়ি ঢলে তুমব্রু খালের পানি বেড়ে যাওয়ায় জিরো লাইনের রোহিঙ্গা শিবিরটি দ্বিতীয়বারের মতো পানিতে তলিয়ে গেছে। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে খালের পানি বাড়তে থাকায় শিবিরের বেশীরভাগ অংশই এখন নিমজ্জিত। গত মাসের প্রথম দিকেও নিম্নচাপের কারণে প্রবল বর্ষণে এই শিবিরটি পানিতে তলিয়ে যায়। মাত্র একমাসের ব্যবধানে দু’বার পানি উঠায় রোহিঙ্গারা দিশেহারা হয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গা নুরুচ্ছফা জানান, গত আগস্টে প্রাণ বাঁচিয়ে অনেক রোহিঙ্গার মতো আমরাও জিরোলাইনের শিবিরে আশ্রয় নিই। কিন্তু এখানেও নানা প্রতিকূল পরিবেশে আমাদের দিন কাটছে। মিয়ানমার বাহিনীর কারণে নিজ দেশে যেতে পারছি না। আর বিজিবির প্রহরায় জিরো লাইন ছেড়ে বাংলাদেশেও আশ্রয় নেয়া যাচ্ছে না। মধ্যখানেই আমাদের মরতে হচ্ছে। রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ জানান কদিন আগে ত্রাণ বন্ধ থাকায় খাদ্য সংকট ছিল জিরো লাইনের এই রোহিঙ্গা শিবিরে। এছাড়া বার্মার বিজিপির গুলিতে আহত এক শিশু এখন পঙ্গু হওয়ার উপক্রম। সবসময় ভয়ের মধ্যে আতঙ্কের মধ্যে আমাদের দিন কাটে। এরমধ্যে নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে বন্যার পানি। ঘর ছেড়ে রোহিঙ্গার ঢিলা মাচান ঘরে গাদাগাদি করে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এভাবে জীবন চলে না। একই কথা বলছিলেন রোহিঙ্গা আমির হোসেন ও তার স্ত্রী হাজেরা বেগম। ঘুনধুম ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ জানান,মানবিক সহায়তা হিসেবে রোহিঙ্গা শিবিরে কিছু মাচান ঘর বেধে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পর্যাপ্ত নয়। এক মাসের ব্যবধানে দুবার পানি উঠায় তারা চরম অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। তিনি জানান, শিবিরে আরো কিছু মাচান ঘর তৈরি করা গেলে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হবে। এদিকে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় তুমব্রু খালের পানি কমতে শুরু করেছে। রোহিঙ্গা শিবির থেকে পানি নেমে গেলেও কাঁদাপানিতে ভোগান্তির শেষ নেই। রাতে রোহিঙ্গাদের মাচান ঘরও টিলায় অবস্থান করতে হবে বলে জানান তারা।
উল্লেখ্য গত আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইনে ব্যাপক সহিংসতায় ১০ লাখেরও বেশী রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এখনো রোহিঙ্গাদের আশা থামে নি। সে সময় বান্দরবানে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুনধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তের জিরো লাইনে প্রায় ৭ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়। পরে এ শিবির থেকে অনেক রোহিঙ্গা কুতুপালং আশ্রয় শিবিরে পালিয়ে গেলেও বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার রোহিঙ্গা এ শিবিরে অবস্থান করছে। সীমান্ত সংক্রান্ত জটিলতায় তাদেরবাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয নি। গত বছর আগস্টে রাখাইনে নতুন করে সেনা অভিযান শুরুর পর বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গাদের ঢল নামলে তাদের আশ্রয়ের জন্য অল্প সময়ের মধ্যে বিশাল এলাকাজুড়ে এই ক্যাম্প গড়ে ওঠে। পাহাড়ের উপরে, ধাঁর ঘেষে ও নিচে মাটি ও গাছ কেটে তৈরি করা হয় এই ঝুপড়ি ঘর। কিন্তু যেভাবে পাহাড় কেটে ওই ঘরগুলো তৈরিহয়েছে, তাতে আলগা মাটি বেরিয়ে আসছে। ইতোমধ্যে ছোট-খাটো ভূমিধসের খবর পাওয়া গেছে। ঘরের দেয়াল ঘেষে একজনের মৃত্যু হয়েছে। আর ঘূর্ণিঝড় হলে এসব ঝুপড়ি ঘরের কী দশা হতে পারে, তা কল্পনা করা কঠিন নয়। সমপ্রতি ক্যাম্পগুলো সফর করে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব আন্ত্যোনিও গুতেরেসে বলেছেন,চলতি বর্ষায় এবং ঘূর্ণিঝড়ের কবল থেকে বাঁচাতে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গাকেএই ক্যাম্প থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া প্রয়োজন। গত ১০ মাসে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়া ১০ লাখ রোহিঙ্গার বেশিরভাগই আছেন বালুখালিতে। এই ক্যাম্পের বাসিন্দা আলতাফ হোসেন বলেন,নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা ছাড়া তাদের আর উপায় ছিল না। যেখানে জায়গা পেয়েছেন, সেখানেই ঘর তুলেছেন। এভাবে রোহিঙ্গাদের দিন আর কত যাবে। তারা চায় নিরাপদে স্বাধীনভাবে নাগরিক অধিকার নিয়ে মায়ানমারে ফেরত যেতে। কিন্তু তারা যেতে চাইলেও মায়ানমারের সামরিক জান্তা নিত্য নতুন কৌশল করে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। বাংলাদেশ সরকারের শত আন্তর্জাতিক চেষ্টা ও লবিংয়ের মধ্যেও মায়ানমারকে সহজেই কাবু করতে পারছে না। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক দেশের প্রতিনিধি সংস্থা সংগঠন রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করছে। তারা মায়ানমার সরকারকে চাপ সৃষ্টি করে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বাধ্য করার জন্য বক্তব্য রাখছে। আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে সাধুবাদ দিচ্ছে। নানা ধরনের সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দিচ্ছে। কথা হচ্ছে, এত বড় একটা বিশাল জনগোষ্ঠীকে দীর্ঘদিন পয্র্ন্ত জনবহুল বাংলাদেশে নির্দিষ্ট স্থানে আশ্রয় দেওয়া কঠিন বিষয়। নিজস্ব দেশের জনগণের চাপ খাদ্য পরিবেশ বৈরী আবহাওয়ার প্রতিকূল অবস্থায় দীর্ঘদিন তাদের দেশে আশ্রয় দেয়া বাংলাদেশের জন্য কঠিন হয়ে দেখা দিয়েছে। তাই বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী দেশের সহযোগিতায় এ সংকটের স্থায়ী একটি সমাধানের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আঞ্চলিক প্রতিবেশী দেশ যদি এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা না দেখায় তাহলে বাংলাদেশ একার পক্ষে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। আশার কথা হচ্ছে ইতিমধ্যে ভারত ও চীন এ সমস্যার সমাধানের পথে এগিয়ে আসছে বলে মনে হয়। আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের সাথে পার্শ্ববর্তী এসব দেশ আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসলে হয়তো বা হতভাগা রোহিঙ্গারা তাদের বাড়ি ভিটা ফেরত পেতে পারে। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসরত বিশাল এ জনগোষ্ঠীর কোনো ধরনের স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ আবাসস্থল নেই বললেই চলে। অত্যন্ত অমানবিক অপরিচ্ছন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং দুর্যোগ মাথায় রেখে তাদের বসবাস। বসবাসকারী রোহিঙ্গা নেতাদের এমন বক্তব্যই বারবার বেরিয়ে আসছে। তাদের দাবী নিরাপদে সম্পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিয়ে তাদের যেন মায়ানমার সরকার ফেরত নেয়। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে যেনো বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের চেষ্টা অব্যাহত থাকে।