তুরস্কের রাজনৈতিক পরিক্রমা: আতাতুর্ক থেকে এরদোগান
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন
গত ২৪ জুন’১৮ তারিখের জাতীয় নির্বাচনে রজব তাইয়েব এরদোগান ৫৩% ভোট পেয়ে তুরস্কের ১৩তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন এবং তাঁর দল জাস্টিস এন্ড ডেপেলেপমেন্ট পার্টি (একেপি) সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। প্রতিদ্বন্ধী সিএইচপির’র প্রার্থী মুহার্রম ইনজে পেয়েছেন ৩১% ভোট। ২০০৩ থেকে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও এরদোগানের জনপ্রিয়তা হৃাস পায়নি। দেশি-বিদেশি প্রবল বিরোধিতার মুখে তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন তুরস্কের সাত কোটি জনগণ তাঁকে ভালবাসেন। তাঁর গৃহীত পদক্ষেপ ও পরিকল্পনাসমূহকে তাঁরা পছন্দ করেন। তিনি আগের তুলনায় আগামীতে সাংবিধানিকভাবে আরো অধিকতর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন সূচিত হবে। এরদোগানের বিজয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের স্বপ্ন ভেঙ্গে দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোভূক্ত দেশসমুহ এরদোগানের বিজয়কে ভাল চোখে দেখছে না। নির্বাচনোত্তর এক জনসমাবেশে ভাষণ দানকালে তিনি বলেন,
‘আমরা আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করবো না। প্রায় ৯০% ভোটার উপস্থিতির মাধ্যমে তুরস্ক দুনিয়াকে গণতন্ত্র শিক্ষা দিয়েছে। এ নির্বাচনে তুরস্কের জনগণ, এ অঞ্চল ও দুনিয়ার সব নিপীড়িত মানুষের বিজয় অর্জিত হয়েছে।’
সামান্য একজন রুটি ও জুসবিক্রেতা থেকে মেধা, শ্রম, দৃঢ়তা ও সাহসিকতার ফলে তুরস্কের কর্ণধার হতে পেরেছেন তিনি। সামরিক অভ্যুত্থান প্রতিরোধ, বেকারত্বের হার হৃাস, অর্থনৈতিক সূচকের প্রবৃদ্ধি, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে তুরস্কের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি তাঁর জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। হাফেযে কুরআন ও বিজনেস ষ্টাডিতে স্নাতক ডিগ্রীধারী এরদোগান ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন। দেড় কোটি লোকের এ শহরকে যানজট ও বায়ুদূষণ থেকে মুক্ত করার কারণে তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তুরস্কের সর্বজন শ্রদ্ধেয় বুযুর্গ আলিম মাওলানা শায়খ মাহমুদ আফেন্দী নকশবন্দীর সাথে ইসলাহী সম্পর্কের কারণেএরদোগানের মধ্যে ধর্মীয় চেতনা সজীব রয়েছে। কৈশোর থেকে তিনি কট্টর সেক্যুলার নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে চলেছেন। বিক্ষোভ সমাবেশে একটি কবিতা আবৃত্তির কারণে আগের সেক্যুলার সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে। কবিতটি ছিল,
‘মসজিদ আমাদের ক্যান্টনমেন্ট,
গম্বুজ আমাদের হেলমেট,
মিনার আমাদের বেয়নেট,
ঈমানদাররা আমাদের সৈনিক।’
দ্বিতীয় মেয়াদে বিজয়ী এরদোগানকে লেখা একটি চিঠিতে মালয়েশিয়ার নেতা আনোয়ার ইবরাহীম বলেন, তুরস্কের অগ্রগতি এবং বিশ্বে তার অবস্থান এরদোগানের ‘গতিশীল নেতৃত্বের’ অধীনে আরো বিকশিত হবে। আমি বিশ্বাস করি আপনার এই বিজয় ইসলামি বিশ্বের জন্যও একটি বিজয়। আমাদের বিশ্বাসের মূল্যবোধ ও মহানবী (সা.)-এর মৌলিক শিক্ষার কোনো পরিবর্তন না ঘটিয়ে ইসলামকে একটি আধুনিক এবং প্রগতিশীল রূপ দিতে এই বিজয় প্রয়োজন ছিল।’
মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক (১৯২৩-১৯৩৮) প্রবর্তিত কট্টর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বা ধর্মবিদ্বেষী তুরস্কের রাস্ট্রীয় ও সামাজিক চরিত্রকে এরদোগান ধীরে ধীরে মুসলমানদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, উত্তরাধিকার ঐতিহ্য ও সভ্যতায় প্রত্যাবর্তনের প্রয়াস চালাচ্ছেন। তিনি তাঁর দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর কাছে আইডল ও আইকন। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণীগণ হিজাব পড়তে ও পর্দা মেনে চলছে স্বতঃস্ফর্তভাবে। মদ বিক্রিতে কড়াকড়ি আরোপিত হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলসমূহে ছাত্র-ছাত্রী সহাবস্থান নিষিদ্ধ করেন। ১৫ বছরের শাসনকালে অসংখ্য রাস্তা-ঘাট, সেতু, স্কুল, হাসপাতাল তৈরি করে তুর্কী জনগণের জীবনকে বদলে দিয়েছেন এরদোগান। যে কারণে প্রেসিডেন্টের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রশ্নাতীত।
৯৬.৫ শতাংশ লোক মুসলমান হওয়ার কারণে তুরস্কে ইসলামী ঐতিহ্য প্রাধান্য পাবে এটাই স্বাভাবিক স্বাভাবিক। মাত্র ০.৩ শতাংশ খ্রিস্টান ও ৩.২ শতাংশ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী তিনি তুর্কী জনগণের মাঝে বিলুপ্ত খিলাফতের গৌরবোজ্জ্বল চেতনাকে জাগ্রত করার প্রয়াস পেয়েছেন।
মুুস্তাফা কামাল পাশা ছিলেন চরম ধর্মবিদ্বেষী। আধুনিকতার নামে ইসলাম ধর্মের বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন। সেনা, পুলিশ, সীমান্তরক্ষী, শিক্ষক, পেশাজীবি, শ্রমিক-মজুর, সরকারী বেসরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের মগজ ধোলাই করে ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন। খিলাফত ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেন, ধর্মীয় শিক্ষা বন্ধ করে ইউরোপীয় শিক্ষা চালু করেন, হিজাব-পর্দা নিষিদ্ধ করেন, ধর্মীয় পোষাক তথা জুব্বা, টুপি, পাগড়ি বন্ধ করে, শার্ট, প্যান্ট, টাই, স্যুট, নেকটাই ও পানামা হ্যাট চালু করেন, আরবী ভাষায় আযান বন্ধ করেন, তুর্কী ভাষার আরবী বর্ণমালা পরিবর্তন করে ল্যাটিন হরফ চালু করেন, সকল সূফি কার্যক্রম, খানকাহসমূহ বন্ধের আদেশ জারি করেন এবং খানকাহগুলোকে জাদুঘরে রূপান্তরের আদেশ দেন, শরীয়াহ আদালতগুলো বন্ধ করে দিয়ে ইতালীয় দন্ডবিধির উপর ভিত্তি করে নতুন আইন প্রবর্তন করেন। কামাল আতাতুর্ক প্রবর্তিত ধর্মদ্রোহীতা বহু বছর তুরস্কে কার্যকর ছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আদনান মেন্দেরেসকে ফাঁসি দেয়া হয় আযান পুনপ্রবর্তনের অভিযোগে। হজব্রত পালনেও বাধার সৃষ্টি করা হয়।
১৯২৫ সালের ৩০ আগস্ট ধর্মীয় কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের উপর মোস্তফা কামালের দৃষ্টিভঙ্গি তার কাস্তামনু (Kastamonu) বক্তৃতায় স্পষ্ট হয়। তিনি বলেন,
‘জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সভ্যতার সামনে দাঁড়িয়ে আমি তুরস্কের সভ্য সমাজের জনগণকে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক লাভের জন্য শেখদের নির্দেশনায় চলতে দিতে পারি না। তুর্কি প্রজাতন্ত্র শেখ, দরবেশ ও অনুসারীদের দেশ হতে পারে না। সর্বোৎকৃষ্ট রীতি হল সভ্যতার রীতি। মানুষ হওয়ার জন্য সভ্যতার প্রয়োজনীয়তা পূরণ করাই যথেষ্ঠ। দরবেশ প্রথার নেতৃবৃন্দ আমার কথার সত্যতা বুঝতে পারবেন এবং তাদের খানকাহগুলো গুটিয়ে নেবেন ও স্বীকার করবেন যে তাদের রীতিগুলো পুরনো হয়ে গেছে।’
ডেন্টিস্ট সাইফ নামে এক ব্লগার লিখেছেন, কামাল আতাতুর্ক বংশ পরম্পরায় একজন ইহুদী, যারা স্পেন থেকে বিতাড়িত ইহুদীর বংশধর। কামালের মা একজন আলবেনীয় বংশোদ্ভুত। জাতিসত্ত্বায় তিনি কোনভাবে তুর্কী নন। তথাপিও তিনি তুর্কী জাতির পিতা হিসেবে নিজেকে দাবী করেছেন।’
সামরিক কৌশলগত ও ভূ রাজনৈতিক কারণে বিশ্বব্যাপী তুরস্কের একটি আলাদা গুরুত্ব ও মর্যাদা রয়েছে। ৮১টি প্রদেশে বিভক্ত এশিয়া ও ইউরোপের বিশাল ও শক্তিধর দেশ তুরস্ক। জেলার সংখ্যা মোট ৯২৩টি । ৭ লাখ ৮৩ হাজার ৫৬২ বর্গকিলোমিটার আয়তনে পৃথিবীতে ৩৭তম বৃহত্তম দেশ। এর তিন দিকে সমুদ্র। পশ্চিমে এজিয়ান সাগর, উত্তরে কৃষ্ণসাগর, দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর। এ ছাড়া দেশটির উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে মর্মর সাগর।
তুরস্কে প্রতিরক্ষা বিভাগে মোট ১০ লাখ ৪৩ হাজার ৫৫০ জন সামরিক সদস্য রয়েছে। ন্যাটোভুক্ত যে পাঁচটি দেশ যৌথ পরমাণু কর্মসূচি গ্রহণ করেছে তুরস্ক তার অন্যতম সদস্য। বাকি দেশগুলো হলো বেলজিয়াম, জার্মানি, ইতালি ও নেদারল্যান্ড।
আন্তঃমহাদেশীয় দেশ তুরস্ক। তুরস্কের ৯৭ শতাংশ ভূভাগ এশিয়া মহাদেশের অন্তর্ভুক্ত এবং বাকি ৩ শতাংশ ইউরোপ মহাদেশে। এশিয়া ও ইউরোপের অংশের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে বসফরাস প্রণালী, যা সংযুক্ত করেছে কৃষ্ণসাগর ও ভূমধ্যসাগরকে। তুর্কি জনগণের প্রায় ৭০ দশমিক ৫ শতাংশ লোক শহরে বসবাস করে। মাথা পিছু আয় ৯,৫৬২ ডলার।
তুরস্ক একসময় ছিল ঐতিহ্যগতভাবে মুসলিম উম্মাহর অভিভাবক। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিশেষত হাঙ্গেরি, ভিয়েনা, ক্রিমিয়া, বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, বসনিয়া, পোল্যান্ড, ভেনিস, আলবেনিয়া সাইপ্রাস ও ফ্রান্সে ইসলামের ক্রমবিকাশ ধারায় তুর্কী খলিফাদের অবদান অবিস্মরণীয়। দেশ জয় ও আগ্রাসন প্রতিরোধে উসমানীয় খলিফাগণের মেধা, কুরবানী, শ্রম ও অর্থ ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। তুর্কী সেনা ও জেনিসারীদের অপরিমেয় রক্তের নজরানায় ইউরোপে ইসলামের অগ্রযাত্রা সাধিত হয়। মুসলিম বিশ্বে নেতৃত্ব দিয়েছেন তুর্কী খলিফাগণ। ৬শ’ বছর ধরে মুসলমানদের অভিভাবক ছিলেন তাঁরা। ক্ষমতার ভারসাম্য থাকায় প্রতিপক্ষ শক্তি কোন অঞ্চলে মুসলমানদের নির্যাতন করার দুঃসাহস দেখাতে পারেনি। ১৯২৪ সালের পর থেকে মুসলিম উম্মাহ অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে।
আমাদের প্রত্যাশা প্রেসিডেন্ট এরদোগান ও তাঁর দলের বিজয়ের মাধ্যমে তুরস্ক তাঁর হারানো গৌরব ও ঐতিহ্য ফিরে পাবে। এ প্রত্যাশা সঙ্গতভাবে করা যায় কারণ সিরিয়ার যুদ্ধ, শরণার্থী ইস্যু, রোহিঙ্গা সংকট, ফিলিস্তিন সমস্যা, কাতার অবরোধ ও ওআইসি নিয়ে তাঁর সাহসী উচ্চারণ ও পদক্ষেপ দরদী মনের পরিচয় বহন করে। মুসলমানদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহে তিনি আগামীতে আরো জোরালো ভূমিকা রাখতে সমর্থ হবেন। কারণ তিনি জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত নেতা। তুরস্ক ও ইরান ছাড়া গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে প্রচলিত রয়েছে রাজতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্র। জোর করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার কারণে তৃণমূল জনগণের সাথে রাজা বাদশাহদের সম্পর্ক নেই বললেই চলে। তাঁরা মেরুদণ্ডহীন বিলাসী। বৃহৎশক্তির সাথে আপোষ ও নতজানু হওয়া ছাড়া তাঁদের গত্যন্তর নেই। ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থ তাঁদের কাছে গৌন। ক্ষমতায় টিকে থাকাটা মূখ্য। এখানেই তুরস্কের এরদোগান ও আরব রাজা-বাদশাহদের পার্থক্য।
নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর জারি করা প্রেসিডেন্সিয়াল এক ডিক্রিতে এরদোগান তুরস্কের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের নামাযের সুবিধার্থে মসজিদ নির্মাণের ঘোষণা দেন। সাথে সাথে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন তিনি। শিক্ষা, প্রশাসন, সেনা, নৌ, বিমান, পুলিশ, গোয়েন্দা বাহিনী ও দপ্তরে ঘাপটি মেরে থাকা ১লাখ ১০ হাজার চরম ধর্মবিদ্বেষী, কট্টর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও ব্যর্থ অভুত্থানের কুশিলবদের চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে।