হাদিসবিষয়ক জরুরি কিছু তথ্য
মাহফুয আহমদ
এক. একজন মাদরাসাশিক্ষার্থী (তালিবুল ইলম) এর জন্য সহিহ ও গ্রহণযোগ্য হাদিস শেখার পাশাপাশি মওজু ও ভিত্তিহীন এবং হাদিস হিসেবে লোকমুখে প্রচলিত কথাগুলো সম্পর্কেও সচেতনভাবে অবগত হওয়া চাই। যাতে নিজ সমাজকে এব্যাপারে সতর্ক করবার মতো যোগ্যতা অর্জন হয়। আল্লামা মোল্লা আলী কারি রাহিমাহুল্লাহ (১০১৪ হি.) এর ‘আল মাসনূ ফি মা’রিফাতিল হাদিসিল মাওজু’ কিতাবের তাহকিকের ভূমিকায় শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহিমাহুল্লাহ (১৩৩৬-১৪১৭ হি.) এবিষয়ে তালিবুল ইলমদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
আলহামদুলিল্লাহ! যুগে যুগে সচেতন মুহাদ্দিস আলেমগণ সমাজকে সতর্ক করার জন্য বহুল প্রচলিত হাদিস এবং বানোয়াট বর্ণনাগুলো সম্পর্কে কিতাব রচনা করেছেন। আমরা সেসব গ্রন্থ সামনে রাখতে পারি।
সাধারণত মনে করা হয় যে, আল্লামা আবদুর রাহমান আস সাখাওয়ি রাহিমাহুল্লাহ (৮৩১-৯০২ হি.)-এর আল-মাকাসিদুল হাসানাহ গ্রন্থটি এবিষয়ে লিখিত সর্বপ্রথম গ্রন্থ। কিন্তু মুহাক্কিক আলেমগণ বলেন, সাখাওয়ির পূর্বেও মুহাদ্দিসগণ এক্ষেত্রে কাজ করে গেছেন। যেমন- শায়খুল ইসলাম হাফিয ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ (৬৬১-৭২৮ হি.) লিখেছেন আহাদিসুল কুসসাস, আল্লামা বদরুদ্দিন আয যারকাশি রাহিমাহুল্লাহ (৭৪৫-৭৯৪ হি.) লিখেছেন আত তাযকিরাহ ফিল আহাদিসিল মুশতাহিরাহ এবং আল্লামা হাফিয ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ (৭৭৩-৮৫২ হি.) লিখেছেন আল-লাআলিল মানসুরাহ ফিল আহাদিসিল মাশহুরা। এসবের পর সাখাওয়ি কর্তৃক আল-মাকাসিদুল হাসানাহ সংকলিত হয়েছে। অবশ্য তাঁর গ্রন্থটিই এবিষয়ক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী গ্রন্থ হিসেবে আলেমসমাজের নিকট বিবেচিত হয়। সুতরাং কোনো তালিবুল ইলমের জন্য এই গ্রন্থ অধ্যয়ন থেকে মাহরূম হওয়া উচিত নয়। মিশকাতুল মাসাবিহ পড়ার সময়ই আল-মাকাসিদুল হাসানাহ দেখতে শুরু করে দিলে ভালো হয়।
আলহামদুলিল্লাহ! যুগে যুগে সচেতন মুহাদ্দিস আলেমগণ সমাজকে সতর্ক করার জন্য বহুল প্রচলিত হাদিস এবং বানোয়াট বর্ণনাগুলো সম্পর্কে কিতাব রচনা করেছেন। আমরা সেসব গ্রন্থ সামনে রাখতে পারি।
সাখাওয়ির পর আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ূতি রাহিমাহুল্লাহ (৮৪৯-৯১১ হি.) যারকাশির গ্রন্থে কিছুটা সংযোজন-বিয়োজন করেন এবং ‘আদ দুরারুল মানসুরাহ ফিল আহাদিসিল মুশতাহিরাহ’ নামে পৃথক একটি গ্রন্থ সংকলন করেন। এ সম্বন্ধে আরও অনেক মূল্যবান গ্রন্থ সংকলিত হয়েছে। যেমন- হাফিয ইসমাঈল আল আজলুনি রাহিমাহুল্লাহ (১০৮৭-১১৬২ হি.) পূর্ববর্তী আলেমগণ কর্তৃক এবিষয়ে রচিত সকল গ্রন্থ সামনে রেখে সংকলন করেছেন কাশফুল খাফা ওয়া মুযিলুল ইলবাস।
মাওজু হাদিস সম্পর্কে হাফিয ইবনুল কায়্যিম রাহিমাহুল্লাহ (৬৮১-৭৫১ হি.) এর আল-মানারুল মুনিফ ফিল হাদিসিস সাহিহি ওয়াজ জায়িফ এবং আল্লামা মোল্লা আলি কারি রাহিমাহুল্লাহ (১০১৪ হি.)-এর আল-মাসনু ফি মা’রিফাতিল হাদিসিল মাওজু গ্রন্থদ্বয় অনেক সুন্দর। আর শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহিমাহুল্লাহ (১৩৩৬-১৪১৭ হি.)-এর তাহকিক ও গবেষণালব্ধ নাতিদীর্ঘ ভূমিকা কিতাবদুটির সৌন্দর্য ও উপকারিতা বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিয়েছে।
এখানে উদাহরণস্বরূপ কয়েকটিমাত্র গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হলো। অনুসন্ধিৎসু তালিবুল ইলমের সামনে অধ্যয়ন ও গবেষণার এক বিশাল সমুদ্রপথ খোলা রয়েছে।
দুই. সুনানে তিরমিযির ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘আরিজাতুল আহওয়াযি’ সহ বহু ইলমি কিতাবের লেখক হাফিয আবু বকর ইবনুল আরাবি রাহিমাহুল্লাহ (৪৬৮-৫৪৩ হি.) আমাদের কাছে অতি পরিচিত একটি নাম। আন্দালুসিয়া (ইশবিলিয়া, ফাস) ছিল তাঁর জন্মভূমি। জ্ঞান অর্জনের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে তিনি দুনিয়ার বহু অঞ্চল সফর করেছেন। জীবনের বেশ কয়েকটি বসন্ত শুধু ইলমি সফরেই কাটিয়ে দিয়েছেন।
ইতিহাস গবেষক আলেমগণ বলেন, হাফিয ইবনুল আরাবি রাহিমাহুল্লাহর দীর্ঘ ইলমি সফরের অন্যতম একটি ফলাফল হলো, আন্দালুসিয়ায় এমন প্রচুর ইলমি কিতাব প্রবেশ করতে পেরেছে; যার সম্পর্কে সেখানকার আলেমগণ শুধু শুনেছেন এবং দেখেন নি কিংবা নামই শুনেননি। সেই কিতাবগুলো ছিল বিচিত্র বিষয়ের বিভিন্ন দেশের লেখকদের এক বিশাল সংগ্রহ। যেমন- ইবনে মাকুলা রাহিমাহুল্লাহর আল-ইকমাল প্রভৃতি। মরক্কোর প্রখ্যাত গবেষক ড. আবদুল্লাহ আত তাওরাতি এবিষয়ে চমৎকার একটি প্রবন্ধ রচনা করেছেন। কিতাবগুলোর একটি নাতিদীর্ঘ সূচি তিনি সেই প্রবন্ধে পেশ করতে সক্ষম হয়েছেন।
সেজন্য বিদেশ থেকে ইলমি সফর শেষে প্রত্যাবর্তনের পর তালিবুল ইলমের উচিত নিজ দেশের তালিবুল ইলমদের সঙ্গে মুযাকারায় বসা। নতুন বিষয়গুলো আলোচনা করা। নিত্যনতুন গ্রন্থাদির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া। তেমনি বহির্বিশ্বের নিভর্রযোগ্য বিশেষজ্ঞ আলেম গবেষকদের সম্পর্কে তথ্য পেশ করা এবং ফলপ্রসূ নতুন কোনো শিক্ষাব্যবস্থা ও পদ্ধতি আবিষ্কার করে থাকলে তাও জানিয়ে দেয়া উচিত।
তিন. কখনও এমন হয় যে, হাদিসের তালিবুল ইলমের সামনে কোনো হাদিস বা ‘আসার’ আসে এবং তিনি ওই বর্ণনার ব্যাখ্যা জানতে আগ্রহী হন। কিন্তু হাদিসের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাগ্রন্থসমূহে তিনি সেটা খুঁজে পান না, যেমন- ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ (৭৭৩-৮৫২ হি.) এর ফাতহুল বারি, ইবনে রজব হাম্বলি রাহিমাহুল্লাহ (৭৩৬-৭৯৫ হি.)-এর ফাতহুল বারি, ইমাম নাওয়াওয়ি রাহিমাহুল্লাহ (৬৩১-৬৭৬ হি.) এর আল-মিনহাজ শারহু সাহিহি মুসলিম এমনকি সুনানের শারহ ও হাশিয়াগুলোতেও সেটা মেলে না।
হাদিসবিশেষজ্ঞ আলেমগণ বলেন, হাদিসের তালিবুল ইলম এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে তার জন্য উচিত আল্লামা আবদুর রউফ আল মুনাওয়ি রাহিমাহুল্লাহ (৯৫২-১০৩১ হি.)-এর ফায়জুল কাদির শারহুল জামিয়িস সাগির অথবা ইমাম সানআনি রাহিমাহুল্লাহ (১০৯৯-১১৮২ হি.)-এর আত-তানওয়ির শারহুল জামিয়িস সাগির গ্রন্থের শরণাপন্ন হওয়া।
এই দুটো গ্রন্থেও পাওয়া না গেলে ইমাম বাগাওয়ি রাহিমাহুল্লাহ (৪৩৩-৫১৬ হি.) প্রণীত মাসাবিহুস সুন্নাহ এবং সেটার বর্ধিত সংকলন খতিব তাবরিযি রাহিমাহুল্লাহ (৭৪১ হি.)-এর মিশকাতুল মাসাবিহের ব্যাখ্যাগ্রন্থসমূহে অনুসন্ধান অব্যাহত রাখা উচিত। কেননা ‘মিশকাত’ কিতাবের শারহগুলো অনেক উপকারী। এসব ব্যাখ্যাগ্রন্থে এমন কিছু দুর্লভ কথা রয়েছে; যা অনেক প্রসিদ্ধ গ্রন্থেও সচরাচর পাওয়া যায় না। যেমন- মুহাক্কিক ফজলুল্লাহ তুরপিশতি রাহিমাহুল্লাহ (৬৬১ হি.)-এর আল-মুয়াসসির, ইমাম তিবি রাহিমাহুল্লাহ (৭৪৩ হি.) এর আল-কাশিফ আন হাকায়িকিস সুনান (যা শারহুত তিবি’ নামে সমধিক পরিচিত) এবং আল্লামা মোল্লা আলী কারি রাহিমাহুল্লাহ (১০১৪ হি.)-এর মিরকাতুল মাফাতিহ শারহু মিশকাতিল মাসাবিহ প্রভৃতি।
চার. হাদিসশাস্ত্রের পণ্ডিত আলেমগণের মন্তব্যের আলোকে বলা যায় যে, হাদিসের তালিবুল ইলম সাথীবৃন্দের জন্য হাফিয ইবনু আবিদ দুনিয়া রাহিমাহুল্লাহ (জন্ম: ২০৮ হি., মৃত্যু: ২৮১ হি.) রচিত গ্রন্থাদি অনেক উপকারী ও গুরুত্বপূর্ণ। কেননা তাঁর রচনাদিতে প্রচুরসংখ্যক ‘আসার’ও উদ্ধৃত হয়েছে।
ইবনে আবিদ দুনিয়ার কিতাবগুলো দুর্বল হাদিসে ভরপুর এমনভাবে বলে তাঁর গ্রন্থাদি থেকে মাহরূম থাকা উচিত নয়। কেননা একথা মেনে নিলেও তাঁর গ্রন্থাদির একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি সনদ উল্লেখপূর্বক বর্ণনাগুলো একত্রিত করেছেন।
এর সমর্থনে উল্লেখ করা যায় যে, খতিব বাগদাদি রাহিমাহুল্লাহ (জন্ম: ৩৯২ হি., মৃত্যু: ৪৬৩ হি.) বাগদাদ থেকে দামেস্ক যখন সফরে গিয়েছিলেন তখন ইবনে আবিদ দুনিয়ার ৪০টি বই তাঁর সাথে ছিল। সর্বজনবোধ্য যে, সফর একটি কষ্টকর বিষয়। একজন মুসাফির শুধুমাত্র নিতান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো সফরে নিজের সাথে রাখেন। এর দ্বারা খতিব বাগদাদির দৃষ্টিতে ইবনে আবিদ দুনিয়ার গ্রন্থাদির গুরুত্ব প্রস্ফুটিত হয়। ড. মাহমুদ আত-তাহহান তাঁর আল-খতিবুল বাগদাদি ওয়া আসারুহু ফি উলুমিল হাদিস গ্রন্থে ওই ৪০টি কিতাবের নাম উল্লেখ করেছেন।
তাছাড়া এর সমর্থনে আরও বলা যায় যে, আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলি রাহিমাহুল্লাহ (জন্ম: ৭৩৬ হি., মৃত্যু: ৭৯৫ হি.) নিজের একাধিক গ্রন্থে ইবনে আবিদ দুনিয়া রচিত জুযসমূহ থেকে হাদিস উদ্ধৃত করতেন। উদাহরণস্বরূপ ইবনে রজব হাম্বলি রচিত জামিউল উলুমি ওয়াল হিকাম গ্রন্থের প্রথম হাদিস إنما الأعمال بالنيات– এর ব্যাখ্যা দেখুন! সেখানে উল্লিখিত বেশিরভাগ হাদিস ও আসার ইবনে আবিদ দুনিয়ার আল-ইখলাস গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত।