ফররুখ সাহিত্যে উত্তরাধিকার ঐতিহ্যের চেতনা
কুদরত-ই-হুদা
ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪) বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসে একটি ট্যাবু হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর কবিতা এবং নামের গায়ে প্রতিক্রিয়াশীলতার সিল আঁটা পড়েছে। এর কারণ বহুবিধ। উল্লেখযোগ্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তানের পক্ষে কবিতা লেখা, কবিতায় পর্যাপ্ত আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার, রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে চল্লিশজন স্বাক্ষরদাতার একজন হয়ে স্বাক্ষর দেওয়া ইত্যাদি। এ থেকে কেউ কেউ মরিয়া হয়ে মুক্ত করতে চান তাঁকে। আবার কেউ কেউ তাঁকে বারবার এদিকেই ঠেলতে চান। এই ঠেলাঠেলির সংস্কৃতির মধ্যে ফররুখকে দেখা একটু মুশকিলই বটে। তবে আমাদের বিবেচনায় এসব কোনো কাজের কথা না। ইতিহাসের গভীর পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়। আমরা এই বিতর্ক পাশে সরিয়ে রাখতে চাই। তবু যাঁরা ব্যক্তিগততার মধ্যে থেকে ফররুখকে দেখতে চান, তাঁদের জন্য আহমদ ছফার ‘কবি ফররুখ আহমদের কি দোষ’ লেখাটি পড়ার নিমন্ত্রণ জানাই। এ বছর ফররুখ আহমদের জন্মশতবর্ষ। পূর্ববঙ্গের এই কবির জন্মশতবর্ষে ঠেলাঠেলি সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে ইতিহাসের পটে রেখে ফররুখকে দেখা জরুরি বলে মনে হয়।
ইতিহাস থেকে একটু ঘুরে আসা যাক। ব্রিটিশ উপনিবেশিত কলকাতায় বাঙালি মুসলমানকে বিভিন্ন ধরনের চাপের মধ্যে বেড়ে উঠতে হয়েছিল। ঔপনিবেশিক শক্তি তাঁদের দেখত সন্দেহের চোখে। চাকরি-বাকরির সুবিধা দিতে চাইত না। এমএ পাস করে ভালো সরকারি চাকরি না পেয়ে শিক্ষকতা করতে হয়েছে—এমন বয়ান-বর্ণনা মূলধারার ইতিহাস বইয়ে বেশুমার আছে। এ ছাড়া অগ্রসর হিন্দু সমপ্রদায়ের উপেক্ষার চাপ, গণ্য না করার চাপ ছিল। আর নিজের হীনম্মন্যতার চাপ তো ছিলই। এই সব চাপের মধ্যে অন্য অনেকের মতো বেড়ে উঠতে হয়েছে ফররুখ আহমদকেও। এসব কারণে বাঙালি মুসলমান ব্রিটিশশাসিত ভারতরাষ্ট্রে নিজেদের অনেক ক্ষেত্রে অপর ভাবত। ফররুখও নিশ্চয় ভাবতেন।
১৯৪০-এ লাহোর প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে দৃশ্যপটে চলে এল পাকিস্তান আন্দোলন। বাঙালি মুসলমান ইতর-ভদ্র-নির্বিশেষে ঝাঁপিয়ে পড়ল এই আন্দোলনে। নাওয়া-খাওয়া-পড়াশোনা প্রায় বাদ দিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য কাজে লেগে গেল সবাই। বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১৪) বইয়ে তখনকার তরুণদের মনোভাব বলতে গিয়ে লিখছেন, পাকিস্তান আনতে না পারলে লেখাপড়া শিখে কি করব? তিনি আরও লেখেন, অখণ্ড ভারতে যে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না এটা আমি মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম। আনিসুজ্জামান তাঁর আত্মজীবনী কাল নিরবধি (২০১৫)-এ বলেছেন, আমার জ্ঞান হতে দেখি, বাড়ির সকলে পাকিস্তান চান, মুসলিম লীগকে সমর্থন করেন এবং জিন্নাহ্ক নেতা মানেন। আশপাশেও এই ভাবটাই প্রবল ছিল। …এই আবহাওয়ায় আমিও পাকিস্তানের খুদে সমর্থক হয়ে উঠেছিলাম। স্কুলে টিফিনের জন্যে যে পয়সা পেতাম, হঠাৎ করে একটা সিগারেটের টিনে তা জমাতে আরম্ভ করলাম। উদ্দেশ্য: জিন্নাহ ফান্ডে দান করা। বাঙালি মুসলমানের পাকিস্তান আন্দোলনে এভাবে হামলে পড়ার কারণ মূলত অর্থনৈতিক মুক্তি আর আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার অদম্য স্বপ্ন। বাঙালি মুসলমান এমন একটি রাষ্ট্র চাচ্ছিল, যে রাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠমোর মধ্যে তার একটা অবস্থান থাকবে। থাকবে সক্রিয় অংশগ্রহণ। আশা ছিল, সেখানে সে কোনো অন্যায্যতার শিকার হবে না। এ জন্য দ্বিজাতিতত্ত্বের মতো একটি সামপ্রদায়িক রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডার হয়ে কাজ করতেও সে দ্বিধা করেনি। অন্য সবার মতো ফররুখও এর বাইরের কেউ ছিলেন না।
পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালি মুসলমানের এই বেদিশ হয়ে পড়ার সাক্ষ্য বহন করছে চল্লিশের দশকের বাংলাদেশের কাব্য-কবিতা। হুমায়ুন আজাদ এই বিদিক পরিস্থিতিকে বলেছেন, পাকিস্তানি জ্বর ও ঘোর। আজাদ তাঁর শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ (২০০৫) বইয়ে লিখেছেন, .. এমনকি আধুনিক শিক্ষিতরা ও কবি-গল্পকার-প্রাবন্ধিক-ঔপন্যাসিকেরা ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন পাকিস্তানি জ্বর ও ঘোরে। তিনি সময় নির্দিষ্ট করে আরও লিখেছেন,চল্লিশের দশকের শুরু থেকে যে-পাকিস্তানবাদী সাহিত্যতত্ত্ব রচিত ও প্রচারিত হয়, তা বায়ান্নো পর্যন্ত বেশ প্রবল ছিলো। সুফিয়া কামাল থেকে শুরু করে সৈয়দ আলী আহসান, আবদুল গণি হাজারী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সিকান্দার আবু জাফর, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ—সবাই পাকিস্তানি আবেগ নিয়ে রচনা করেছেন কবিতার পর কবিতা। এ সময়ের মাসিক সওগাত, মাসিক মোহাম্মদী এবং অপরাপর পত্রপত্রিকায় এই ধারার কবিতাই ছিল মূলধারার কবিতা। ঘাঁটাঘাঁটি করলেই বোঝা যাবে, কত তীব্র ছিল সেই আবেগ। ফররুখ আহমদ এই বাস্তবতার ব্যতিক্রম কিছু ছিলেন না; বরং ফররুখ ছিলেন এই সময়ের সবচেয়ে প্রতিভাবান ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ কবি।
মনে রাখতে হবে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রশ্নহীন ছিলেন না ফররুখ আহমদ। তিনি মূলত ছিলেন ইসলামী ভাবধারার মানুষ। এ কারণে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম তাত্ত্বিক আবদুল হক বলেছেন, ফররুখের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা ছিল সাহিত্য, তবে শুধু সাহিত্য নয়, রাজনৈতিক আদর্শ। যাঁরা মনে করতেন মুসলিম লীগ নেতৃত্বের বড় অংশই প্রতিক্রিয়াশীল এবং ধনতন্ত্রের সমর্থক, ফররুখ আহমদ ছিলেন সেই দলের মানুষ। হকের ভাষায়, ধনতন্ত্র পাকিস্তানের মৌলিক লক্ষ্যের বিরোধী এবং এ ব্যাপারে রাজনৈতিক কর্মীদের মতো লেখকদেরও কর্তব্য আছে, এ বিষয়ে ফররুখ আহমদ এবং আমি একমত ছিলাম। …আরও অনেকের মতো গোটা পাকিস্তান আন্দোলনই আমাদের চোখে একটা রোমান্টিকতায় মণ্ডিত ছিল। (ফররুখ আহমদ ফররুখ আহমদ: কবি ও ব্যক্তি)। সমকালের অন্য অনেকের মতোই ফররুখ আহমদও ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া এক কবি; সবচেয়ে প্রতিভাবান কবি। অন্য অনেকের মতো বললাম এ জন্য যে, তখন সবাই পাকিস্তান, পাকিস্তান আন্দোলন, ইসলাম নিয়ে অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। আহমদ ছফার ভাষায়, পাকিস্তান এবং ইসলাম নিয়ে আজকের বাংলাদেশে লেখেননি, এমন কোনো কবি-সাহিত্যিক নেই বললেই চলে। অন্য অনেকের কথা বাদ দিয়েও কবি সুফিয়া কামালের পাকিস্তান এবং জিন্নাহ্ ওপর নানা সময়ে লেখা কবিতাগুলো জড়ো করে প্রকাশ করলে সঞ্চয়িতার মতো একখানা গ্রন্থ দাঁড়াবে বলেই আমাদের ধারণা।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক তোড়জোড় যখন চলছে, তখন পূর্ব বাংলার মুসলমানরা নতুন রাষ্ট্রের, নতুন সাহিত্য রচনার তোড়জোড় শুরু করলেন। হাত দিলেন সাহিত্যের নতুন ভাষা নির্মাণের কাজে। সাহিত্যে তাঁরা তাঁদের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব খোদাই করার বাসনায় কাতর হয়ে উঠলেন। সোজা কথায়, এত দিন পূর্ববঙ্গের যে ব্যক্তি ভারতরাষ্ট্রের আওতায় সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতার সাহিত্য ও ভাষার যেসব কাঠামোর মধ্যে সাহিত্যচর্চা করে আসছিল, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সেখান থেকে সরে এসে সে এবার প্রতিষ্ঠা করতে চাইল নিজের স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব। এ জন্য আরবি-ফারসি শব্দ আর মুসলমানি উপাদানের ওপর ভর করে নতুনতর সাহিত্য রচনায় মনোযোগী হলো সে। এর বাইরেও একই সময়ে অবশ্য আবুল হোসেন, আহসান হাবীব প্রমুখ কবি কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্যের মূলধারার ভাষাকাঠামোর মধ্য থেকে কাব্য-কবিতা লিখেছেন। কিন্তু সে সময় এ ধারাটি ছিল ক্ষীণ।
ফররুখ আহমদও চাইলেন নতুন রাষ্ট্রের নতুন সাহিত্যিক ভাষা। সাত সাগরের মাঝি কাব্যে বাংলার সঙ্গে আরবি-ফারসির মিশ্রণে নির্মাণ করলেন অপূর্ব এক সাংগীতিক মূর্ছনা, রোমান্টিক সম্মোহন। তাঁর সমকালে একই ধারার কবিতায় তাঁর জুড়ি নেই। এই ধারার আরেক শক্তিশালী কবি সৈয়দ আলী আহসান পর্যন্ত ব্যর্থতা স্বীকার করেছেন। ফররুখের কবিতার এই মূর্ছনা, এই কবিত্বের প্রশংসা করেননি এমন সমালোচক বাংলাদেশের সাহিত্যে বিরল। সাত সাগরের মাঝির পর নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রে বসে তিনি ইসলামি ইতিহাস-ঐতিহ্য আর আরবি-ফারসি শব্দের মিশেলে একাদিক্রমে রচনা করে চললেন সিরাজাম মুনীরা (১৯৬১), নৌফেল ও হাতেম (১৯৬১), হাতেম তায়ী (১৯৬৬) কাব্যগ্রন্থ ও কাব্যনাট্য। কিন্তু এসবের মধ্যে কবি আর আগের মতো রোমান্টিক মোহমুগ্ধতা এবং সাংগীতিক মাধুর্য সৃষ্টি করতে পারলেন না। এসব কাব্যের অধিকাংশেই বাণীভঙ্গি তাৎপর্যহীন পোয়েটিক ডিকশনে পরিণত হয়েছে। শব্দের ওপর কবি তাঁর অধিকার প্রমাণ করেননি, শব্দই কবির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে। (স্বতত স্বাগত, সৈয়দ আলী আহসান)। অর্থাৎ ফররুখের স্বপ্নের কাব্যধারা মোটামুটি মার খেয়ে গেছে। শুধু ফররুখ নয়, পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী আদর্শধারার কাব্য-কবিতাই এ সময় তার শক্তিসামর্থ্য হারিয়ে প্রায় নির্জীব হয়ে পড়ে। এর মধ্যে বিশেষত ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকে ক্রমে প্রতাপশালী হয়ে উঠতে শুরু করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারার কাব্য-কবিতা। বিজয় সূচিত হতে থাকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারার কবিতার। কারণ তখন একসময়ের পাকিস্তানের আবেগে কাঁপা জনগোষ্ঠী আবার আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রাণপণ লড়াইয়ে শামিল হতে শুরু করেছে।
কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হল জানি না তা।
নারঙ্গি বনে কাঁপছে সবুজ পাতা।
দুয়ারেতোমারসাতসাগরেরজোয়ারএনেছেফেনা।
তবুজাগলেনা?তবু,তুমিজাগলেনা?
সাতসাগরেরমাঝিচেয়েদেখোদুয়ারেডাকেজাহাজ,
অচলছবিসে,তসবিরযেনদাঁড়ায়েরয়েছেআজ।
হালেপানিনাই,পালতারওড়েনাকো,
হেনাবিক!তুমিমিনতিআমাররাখো;
তুমিউঠেএসো,তুমিউঠেএসোমাঝিমাল্লারদলে
দেখবেতোমারকিশতিআবারভেসেছেসাগরজলে,
নীলদরিয়ায়যেনসেপূর্ণচাঁদ
মেঘতরঙ্গকেটেকেটেচলেভেঙেচলেসববাঁধ।
তবুতুমিজাগো,কখনসকালঝরেছেহাসনাহেনা
এখনোতোমারঘুমভাঙলোনা?তবু,তুমিজাগলেনা?
দুয়ারেসাপেরগর্জনশোনোনাকি?
কতঅসংখ্যক্ষুধিতেরসেথাভির,
হেমাঝি!তোমারবেসাতিছড়াও,শোনো,
নইলে যে সব ভেঙে হবে চৌচির।
কিন্তু তাই বলে ফররুখের মতো একজন প্রতিভাবান বড় কবিকে আমরা ত্যাগ করব! তাঁকে ট্যাবু বানিয়ে অপাঙ্ক্তেয় করব! এ ক্ষেত্রে তো আরও সমস্যা দেখা দেবে। তাঁর মুহূতের্র কবিতা (১৯৬৩) সনেট গ্রন্থের ময়নামতীর মাঠে, মোতিঝিল, বৈশাখী, জিঞ্জিরা, ধানের কবিতা সিলেট রেল স্টেশনে একটি শীতের প্রভাত’—এ রকম অসংখ্য কবিতা সম্পর্কে কী বলা হবে! এসব কবিতা দেখে আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেছেন, ফররুখ ক্রমশ সমুদ্র থেকে বন্দরে ফিরে আসছিলেন। সেই বন্দর তাঁর নিজস্ব জন্মভূমির নিসর্গ পথ-প্রান্তর। সাত সাগরের মাঝি কাব্যের ইসলাম-পাকিস্তান-মুসলিম-ঐতিহ্য-মুক্ত ‘ডাহুক, লাশ পুরানো মাজার, দোয়েলের শিস’—এসব কবিতাকে কীভাবে পড়া হবে! ফররুখই তো ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালিয়ে হত্যা করলে এর প্রতিবাদে রেডিও পাকিস্তান থেকে তাৎক্ষণিকভাবে সব অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিলেন। নেতৃত্ব দিয়ে সবাইকে নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাস্তায়। তিনিই তো বলদর্পী স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের হাত থেকে পুরস্কার নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। আবার হায়াতদারাজ খান ছদ্মনামে পাকিস্তানি শাসকচক্রের অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে রচনা করেছিলেন অসংখ্য ব্যঙ্গ কবিতা। ফররুখের অপরাধ, তিনি তাঁর জনগোষ্ঠীর ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী নতুন জাগরণকে ধরতে পারেননি। আহমদ ছফার ভাষায়, ‘তিনি অন্যান্য বিশ্বাসঘাতকের মতো স্লোগান বদল করতে পারেননি। সৎ কবিরা অনেক সময় ধরতাই বুলিতে গা ঢেলে দিতে পারেন না। সেটাই তাঁদের একমাত্র অপরাধ। কবি ফররুখ আহমদও এই একই অপরাধে অপরাধী।
প্রায়ই এ কথা মনে হয়, ফররুখ পাঠে আমাদের কোথায় যেন একটু ঘাপলা থেকে যাচ্ছে। তাঁকে আমরা আক্ষরিক অর্থে পড়ছি। ইতিহাসের পটে রেখে ফররুখের পাঠ দেওয়া দরকার। ফররুখকে অস্বীকার করলে তো এই জনগোষ্ঠীর একসময়ের আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ও আত্মমর্যাদার বাসনাকে অস্বীকার করা হয়। বাংলাদেশের কবিতার বিকাশের যে ধারা, তার যে চড়াই-উতরাই, সংগ্রাম, ঘাত-প্রতিঘাত, তাকেই অস্বীকার করা হয়। ভাষা আন্দোলনের পরে বাংলাদেশের কবিতার যে ধারা বলবান হয়েছে, তাকে তো ফররুখী ধারাকে মোকাবিলা করে পুষ্ট হতে হয়েছে। এর শক্তিকে বোঝার জন্যও তো ফররুখের পাঠ আর বহুমাত্রিক বিবেচনা অতীব জরুরি। এ বিষয়টি হাসান হাফিজুর রহমান ঠিকই বুঝেছিলেন। আধুনিক কবি ও কবিতা (১৯৯৩) বইয়ে তিনি লিখেছেন, ফররুখ আমাদের কাব্য সাহিত্যে আধুনিক উত্তরণে প্রকৃত সাহায্যটা করেছেন তাঁর কাব্যভাষা এবং আঙ্গিকের প্রয়োগে। ফররুখকে বাদ দেওয়া মানে আমাদের জাতিসত্তার এবং কবিতার একটি অনিবার্য সংগ্রামী ইতিহাসকে কেটে ফেলে দেওয়া। এই প্রবণতা বোধ করি পৃথিবীর কোনো জাতির ইতিহাসেই পাওয়া যাবে না। ফররুখ আমাদের বহুস্বর ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বর হিসেবে আদরণীয় হোক। বহুস্বরের মধ্যে প্রধান স্বরের গুরুত্ব বাড়ে বই কমে না।