কালজয়ী মনীষী আল্লামা ড. ছানাউল্লাহ ব্যারিস্টার (রহ.)
মাওলানা শেখ খালেদ
ভূমিকা
রাসূল (সা.)-এর আদর্শে বলীয়ান মনাবদের মর্যাদা আল্লাহ প্রদত্ত স্বীকৃত। তারা মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি আমার নির্বাচিত বান্দাদেরকে কিতাবের উত্তরাধিকারী বানিয়েছি। (সূরা ফাতির)
এমনিভাবে নবীয়ে রহমত বলেন, ‘আলেমগণই নবীদের উত্তরসূরি।’ আরও বলেন, ‘সর্বোত্তম ব্যক্তি সে যে মানবহিতৈষী তথা কল্যাণকামী।’
উক্ত আয়াতে করীমা ও হাদীসের বাণী থেকে একথা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যারা দীনের সেবায় ব্রতী হয় তারাই তো কালজয়ী এবং চির অমর হয়। এমনি একজন লোকের সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত তুলে ধরার প্রায়াস পাব। (ইনশা আল্লাহ) যেন তাদের পরিচালিত জীবন ধারা আমাদের চলার পাথেয় হয়। নিম্মে তার কিছু আলোচনা করছি,
জন্ম ও পরিচয়
আল্লামা ড. ছানাউল্লাহ ১৯০৫ সালে ১ মার্চ চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার অন্তর্গত উত্তর মাদার্শা গ্রামে একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম আনর আলী তৎকালীন ব্রিটিশ রাজ্যের আকিয়াবের ওয়াসিগরী (হেডম্যান) ছিলেন। তিনি কর্মদক্ষতার স্বীকৃতিতে অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে আসীন হন এবং তাঁর সততা, দায়িত্বপরায়ণতার জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করেন। তাঁর মাতা রাফেয়া খাতুন একজন ধর্মভীরু মহিলা ছিলেন।
বাল্যকাল ও শিক্ষাজীবন
বাল্যকাল থেকেই তিনি ধর্মচর্চায় বেশ আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু পিতা ব্রিটিশদের সংস্পর্শে থাকার ফলে স্বীয় পুত্রকে ইংরেজি শিক্ষিত করার ইচ্ছে পোষণ করেন। কিন্তু আল্লামা ড. ছানাউল্লাহ (রহ.) নিজের জীবনে ইসলামী জাতীয়তাবোধ ও ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব ধারণ করার কারণে তার শিক্ষা জীবন শুরু হয় আরবি শিক্ষার মধ্য দিয়ে। প্রাথমিক শিক্ষা নিজ গ্রামের মক্তব দিয়ে শুরু করে তারপর তিনি বাংলা, উর্দু, ফার্সি ভাষার ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। অতপর দক্ষিণ এশিয়া মহাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম বিদ্যাপীট হাটাহাজারী মঈনুল ইসলাম মাদরাসা থেকে ফযিলত (ফাযিল) পাশ করেন। পরে বিদেশ গমন করে মাজাহারে উলুম সাহারানপূর থেকে দাওরা হাদীস (মাস্টার্স)-এর ডিগ্রি লাভ করেন। আল্লামা ছানাউল্লাহ ১৯২৫ সালে বিশ্ববিখ্যাত দীনী ইদারা দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে ইসলামিক পড়াশোনার ওপর সর্বোচ্চ ডিগ্রি ফখরে মুহাদ্দিসীন লাভ করেন। এরপর তিনি দীনী শিক্ষার পাশাপাশি জাগতিক শিক্ষার প্রয়োজনবোধ করলে ১৯২৭ সালে SSC পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ইর্ষণীয় মার্ক পেয়ে পাশ করেন এবং তৎকালীন দশ টাকার একটি বৃত্তিও পান। পুনরায় আবার বৃত্তিসহকারে ১৯২৯ সালে প্রথম বিভাগে HSC পাশ করেন। ১৯৩১ সালে আরবি, অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে ডিস্টিংশন মার্ক পেয়ে তৎকালীন বিশ টাকার বৃত্তি সহকারে প্রেসিডেন্সি কলেজ হতে প্রথম শ্রেণীতে BA পাশ করেন। ১৯৩৩ সালে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (ICS) পরীক্ষায় সর্বকনিষ্ঠ প্রার্থী হিসাবে দুই দু’বার উত্তীর্ণ হন। তিনি লিংকনস ইন থেকে রেকর্ড সংখ্যক নাম্বার পেয়ে বার এট ল ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৩৫ সালে ইতিহাসের ওপর ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন হতে Ph.D ডিগ্রি অর্জন করেন। তার থিসিসের বিষয়বস্তু ছিল The decline of the saljuqid empire|
কর্মজীবন
এত কিছু অর্জন সত্ত্বেও তিনি তার ধর্মীয় মূল্যবোধে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়তে দেয়নি। সেটি তার কর্মকালের সূচনা হতে পরিষ্কার। তিনি বিলাতে অবস্থানকালে ওকিং মসজিদের ডেপুটি ইমাম হিসাবে কর্মজীবনের সূচনা করেন। ১৯৩৩-৩৪ সালে গ্রেট ব্রিটেন মুসলিম সোসাইটির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। সে সময়ে তিনি প্রতি শুক্রবার Essex hall প্রাঙ্গণে সাপ্তাহিক আলোচনা সভা ও ইসলামী দাওয়াত প্রচারসহ কুরআনের তাফসীর করতেন। উচ্চশিক্ষা শেষে তিনি কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে আরবি সাহিত্য প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৪২ সালে পাবলিক সার্ভিস কমিশন তাকে স্মল কজেস কোর্টে জজ পদে মনোনিত করেন।
১৯৪৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ সিনিয়র এডুকেশন সার্ভিস তাকে প্রফেসর পদে নিযুক্ত করেন। পেশাগত জীবনে তিনি বার বছর আইন পেশার বিভিন্ন পদে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয় তাকে ফেডারেল সার্ভিস কমিশনার পদে মনোনীত করেন। ড. আল্লামা ছানাউল্লাহ তাঁর কর্মজীবনে রাজনীতির সাথেও জড়িত ছিলেন। তিনি ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের প্রার্থী হিসেবে ১৯৩৭-৪৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে বিজয় লাভ করেন।
মানবকল্যাণে ড. আল্লামা ছানাউল্লাহ
তিনি জনদরদী মানবকল্যাণকামী মানুষ ছিলেন। ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের বছর সরকার কর্তৃক জানানো হয় চট্টগ্রামের জন্য চাল-ডাল ও গমের বরাদ্দ হয় কিন্তু তা চট্টগ্রামে না পৌঁছলে আল্লামা ছানাউল্লাহ প্রশ্ন তুলেন এ বরাদ্দ গেল কোথায়? সংসদে তিনি কবিতার অংশও উচ্চারণ করেন, ‘এযে ক্ষেতে শষ্য ভরা/ তোমার নয়ত একটি ছড়া, / তোমাট হল পরের দেশে চালান কেন হয়? / তোমরা শুধু চাষের মালিক গ্রাসের মালিক নয়। / কার স্বদেশে সর্বনাশে এমন অভিনয়?’
দ্যা ইন্ডিয়া এ্যাক্ট ১৯৩৫ অনুযায়ী সংসদে ইংরেজি ছাড়া অন্য কোনো ভাষা ব্যবহার করা যেত না, কিন্তু সেই ভিনদেশিদের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলা কবিতা চর্চা এদেশের আলেম তথা বিদ্বান সাংসদদের মন-মানসিকতা কতটা মাতৃভাষার ভালবাসায় সিক্ত ছিল তা উল্লিখিত বাংলা চর্চার ঘটনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। তিনি চট্টগ্রামের জেলা পরিষদেরও চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়াও চট্টগ্রামের জেলা স্কুল বোর্ডের প্রেসিডেন্ট এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক একাধারে বার বছর পরীক্ষক, প্রধান পরীক্ষক এবং ডেপুটি এডমিশনাল ক্লেইম কমিশনার নিযুক্ত হন। তিনি ঢাকা কোর্টের অফিসিয়াল পেপার সেটার, স্ক্রুটিনাইজার, টেবুলেটার এবং আরবীর পাশাপাশি পারস্য ও ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে খণ্ড কালীন প্রভাষক ছিলেন। ১৯৫৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের রিসিভার এবং এডমিনিস্ট্রেটর জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। আর এই দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় অমায়িক লোকটি এ জগৎকে বিদায় জানিয়ে মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে পরলোক গমন করেন। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতে উচু মাকাম দান করুন!।
অর্জনসমূহ
তিনি দেশের জন্য অনেক গৌরব অর্জন করেন তার প্রমাণ মেলে ১৯৩৮ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় আল্লামা ড. ছানাউল্লাহ কর্তৃক লিখিত থিসিস the decline of the saljuqd empire-†K পাঠ্য বই হিসেবে প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে। এছাড়াও ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত The biographical Encyclopedia of the world তৃতীয় সংস্করণে তাঁর নাম পৃথিবী বিখ্যাত ব্যক্তিদের সাথে লিপিবদ্ধ রয়েছে। তিনি ১৯৬০ সালে জেদ্দা-পাকিস্তান দূতাবাস কর্তৃক আমীরুল হজ্জও মনোনীত হন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে Bulletin of the school of oriental studies J STOR-Gi ওয়েব সাইটে তাঁর উল্লিখিত রচনা সম্পর্কে লিখিত আছে, Dr. Sanaullah’s book ca be recommended asR bM a contribution তার অন্যতম আরেকটি ইংরেজি রচনা Islamic conception of state and some political institution of Islam| তাছাড়া অন্যান্য রচনাবলির মধ্যে রয়েছে, নিত্য প্রয়োজনীয় সুন্নাত, হক রাস্তা ও দরবেশ দর্শন, প্রকৃত উন্নতির পথ, আসহাবে সুফফাহ, হুকুকে বাহায়ীম বা পশুপক্ষীর অধিকার, সুন্নাত ও বেদাতের পার্থক্য এবং ওহাবীর ইতিহাস, সত্যবাদিতা ইত্যাদি গ্রন্থ। এ মহান মানুষটির এতো অর্জন সত্ত্বেও নিজেকে আল্লাহর সাচ্চা বান্দা বানানোর চেস্টায় নিয়োজিত ছিলেন। তার দুনিয়া বিমুখতার (পার্থিব লোভ লালসা) প্রমাণ ও মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা তার এ উক্তি থেকে বোঝা যায়, ‘বর্তমান মুসলমানদের মধ্যে ধর্মবিবর্জিত পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে বস্তুবাদের আসন সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু টাকা আর সুখ, বিত্ত-বৈভবে মত্ত হইয়া এ দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সামান্য আরাম আয়েশের জন্য পরকালে চিরস্থায়ী অসীম সুখ সম্পর্কে একেবারে ভুলিয়া গেছে।’
আধ্যাত্মিক সবক হাসিল
আল্লামা ড. ছানাউল্লাহ শৈশবকাল থেকেই ধর্মপরায়ণ ছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি বাংলা দেশের মুফতিয়ে আযম ফয়যুল্লাহ (রহ.)-এর শরাণাপন্ন হন, দীর্ঘ সময় তাঁর কাছে থেকে আধ্যাত্মিক জ্ঞানার্জন করেন এবং নিজের হুসনে খুলুকের কারণে অল্প সময়ে খেলাফতপ্রাপ্ত হন । আর এভাবেই সর্বাত্মকভাবে ইবাদতে মগ্ন হয়ে পড়েন এবং আল্লাহ প্রেমে পাগল হয়ে যান।
সংস্কার কাজে আল্লামা ড. ছানাউল্লাহর ভূমিকা
এ মহান চরিত্রের অধিকারী মানুষটি জাহেরী ও বাতেনী জ্ঞান অর্জনের পর মানব সেবায় ব্রতী হন। তিনি মানুষের সূখে দুঃখে ঝাপিয়ে পড়তেন। বিশেষ করে মানুষকে কিভাবে জান্নাতমুখী করা যায় তার ফিকিরে থাকতেন। তাই প্রখ্যাত দাঈ হযরত ইলিয়াস (রহ) কর্তৃক যে দওয়াতের কাজ চালু হয় সে মিশনে তিনি একনিষ্ঠের সাথে কাজ করতে থাকেন। এভাবে নববী আদর্শে সজ্জিত হয়ে অহংকারকে গুড়ো করে মানুষের ধারে ধারে গিয়ে কুরআন হাদীসের বাণী প্রচার করতে থাকে। তিনি বেদয়াত ও কুসংস্কার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তিনি সত্যিই রাসূলে আশেক ও মাটির মানুষ ছিলেন এবং ইসলামের একনিষ্ঠ খাদেম ছিলেন।
চারিত্রিক গুণাবলি
আল্লামা ড. ছানাউল্লাহ ব্যারিস্টার (রহ.)-এর কোন আত্মম্ভরিতামূলক আচরণ ছিল না। তিনি অত্যন্ত মৃদুভাষী এবং কোলমনা ধর্মপ্রাণ, অসাধারণ মানবহিতৈষী এবং জনকল্যাণকারী মহৎ মনের মানুষ ছিলেন। অত্যন্ত ধর্মভীরু, বিদ্বান, পণ্ডিত এবং সাদা-মাটা জীবন যাপন করতেন। পরিশেষে, এখানে আল্লামা ড. ইকবালের কথাই মনে পড়ে যায়, ‘স্কুলে পড়, কলেজে পড় লন্ডনও যদি যাও, কিন্তু তুমি ভুলবে না আপনখোদা মেহেরবান।’ আল্লামা ইকবাল জনৈক ব্যক্তির প্রশ্নোত্তরে বলেন, ‘আমি অক্সফোর্ডে পড়লেও তাদের কালচার আমাকে গ্রাস করতে পারেনি কেননা আমার চোখে মদীনার সুরমা ছিল।’ আমাদেরও একথার বলতে কোন কুণ্ঠাবোধ হবে না যে আল্লামা ড. ছানাউল্লাহও মদীনার ফুলের সুগন্ধি তার দেহ অবয়বে মেখে ছিলেন। তাই তার জীবনে পাশ্চাত্য ছোয়া থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ ও তার রাসূলের (সা.) আদর্শকে ভুলেননি। আল্লাহ আমাদেরকে সকল রাহে হক্ক মনীষী দের রূহানী ফয়ুযাত হাসিল করার তওফীক দান করুন। আমীন ইয়া রাব্বাল আলামীন।