মেধার বিকাশ, সংরক্ষণ ও মূল্যায়ন
অধ্যক্ষ ডা. মুহাম্মদ মিজানুর রহমান
মোমবাতি নিজে জ্বলে অন্যদের আলো দান করে। কংঙ্কালসার রুক্ষ শুষ্ক খেজুরগাছ শরীরের অবস্থার দিকে না তাকিয়ে নিজেকে বিদীর্ণ করে সৃষ্টিকুলের ক্ষুধা আর তৃষ্ণা মেটায়। সবদেশে এমন অনেক মানুষের আবির্ভাব হয়েছে যারা নিজের স্বার্থ আর মৌলিক অধিকারের কথা ভুলে গিয়ে, সৃষ্টির কল্যাণে নিঃস্বার্থভাবে অকাতরে নিজের অমূল্য জীবন উৎসর্গ করেন। বিনিময়ে দেশ ও জাতি গড়ে ওঠে প্রতিষ্ঠিত হয় সুসভ্য শান্তির সমৃদ্ধ সমাজ।
জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, ধর্ম-সংস্কৃতি তথা চিকিৎসাবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিগত জগতে আদিমযুগ, প্রাগৈতিহাসিক যুগ, ক্যামব্রিয়ান যুগ থেকে আধুনিক যুগের বর্তমান সভ্যতার রূপান্তরে বহু ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ ও মহিয়সী নারীর আগমন ঘটেছে, যারা বিচিত্র কর্মময় জীবনযুদ্ধে সাফল্য অর্জন করে নিজেদেরে নাম ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। সে পর্যন্ত পৌঁছাতে তাদের অফুরন্ত পরিশ্রম, অধ্যবসায়, ত্যাগ করে ধ্যান ও জ্ঞানের অধিকারী হতে হয়েছে বৈ কী।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, প্রথম অসভ্য মানবসমাজকে সভ্য করার একমাত্র পথ ও পাথেয় হলো যুগে যুগে নবী ও রাসুল (সা.)-এর জীবনদর্শন। স্রষ্টা কর্তৃক প্রেরিত এই প্রতিনিধিরাই সভ্য ও আদর্শ সমাজ গঠনের কর্ণধার। এছাড়াও কালের বিবর্তনে এমনকিছু মানুষের আবির্ভাব হয়েছে যারা স্বীয় কর্মযজ্ঞে বিশেষ সফলতা অর্জন করে বিশেষ অবদানে মানবতার পরম বন্ধু হয়ে উঠেছেন।
উন্নতবিশ্বে বিশেষ বিশেষ পারদর্শী, সৃজনশীল ব্যক্তিবর্গকে সরকার সেবরকারি উদ্যোগে পৃষ্ঠপোষকতা দান করা হয়। উন্নয়শীল দেশে এমনটা সহযোগিতা না করলেও ব্যক্তিগতভাবেই নানাজন নানারকম কর্মকাণ্ডে ব্যাপক সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। যারা নিজসাধনায় শিক্ষায়, পরিশ্রমে, ধ্যানে, জ্ঞানে, সাধারণ মানুষের চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির ও ভিন্ন চরিত্রের অধিকারী।
আপাতদৃষ্টিতে সমাজে যারা বসবাস করেন তারা হচ্ছেন, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ধর্মীয় নেতা, রাজনৈতিক নেতা, চিকিৎসক, আইনবিদ, প্রকৌশলী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, নির্মাণশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতী, শ্রমিক, কৃষক, এরা সকলেই দেশের সম্পদ। এছাড়া সেনা, নৌ, বিমান, আনসার, ভিডিপি বাহিনীসহ ব্যাংক, বীমা, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মকর্তা ও উন্নয়ন কর্মীরাও দেশের বিরাট সম্পদ।
এসব পেশায় এমন কিছু লোক আছেন যারা স্বীয় কর্মে নিয়োজিত থেকেও বিশেষ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তাদের অবস্থান হতে পারে কোনও নগরীতে বা অজো পাড়াগাঁয়ে। এদের মধ্যে কেউ শখের বশে ডাকটিকেট সংগ্রহশালা, বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহশালা, নানা রকম যন্ত্রপাতির সংগ্রহশালা, সমৃদ্ধ পাঠাগার, ম্যাগাজিন, পত্র-পত্রিকার প্রবন্ধ সংগ্রহশালা, তৈজসপত্র সংগ্রহশালা, শিলালিপি সংগ্রহশালা, প্রতিকৃতি সংগ্রহশালা, মুদ্রা সংগ্রহশালা, ক্যালিওগ্রাফি সংগ্রহশালা, আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহশালা, যানবাহন সংগ্রহশালা, শিলালিপি সংগ্রহশালা, কলম সংগ্রহশালা, চেরাগবাতি বা বাল্ব সংগ্রহশালা, তলোয়ার সংগ্রহশালা, রেডিও সংগ্রহশালা, মোবাইল সংগ্রহশালা, ঘড়ি সংগ্রহশালা, টাইপ মেশিন সংগ্রহশালাসহ সিডি, ভিসিডি, কবিতা, সাহিত্য ইত্যাদির দুর্লভ সংগ্রহে সমৃদ্ধি অর্জন করেছেন। এ সব সংগ্রহ আবিষ্কার, লেখা আগামীদিনে জাতির বহুবিধ কল্যাণ সাধনে সহায়ক। এ বিষয়ে আপনার ইচ্ছা মেধা ও সৃজনশীল প্রতিভা বা সংগ্রহশালা সমৃদ্ধকরণে নিরাপত্তা ও ভারসাম্য রক্ষায় সামান্যতম সাবধানতা আগামীদিনের জাতিকে ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে পারে।
তাই বলছি আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, যে পেশাতেই নিয়জিত থাকুন না কেন, যদি আপনি সৃষ্টিশীল, জাতির উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থেকে থাকেন তবে তার সুবিন্যস্ত সংরক্ষণ ও মেধার বিকাশ করুন। আজই বিষয়টিকে আমলে নিন। আপনার মেধা, যোগ্যতা মননশীলতা, সৃজনশীলতার যথাযথ গুরুত্ব দিন। এতদবিষয়ে এতদিন যা কিছু সংগ্রহ করেছেন তার নিরাপত্তা ও সংরক্ষণের কার্যকরী ব্যবস্থা নিন। হতে পারে একদিন আপনার সামান্যতম সংগ্রহ জ্ঞান, মেধা জাতিকে অনেকদূরে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
বৃষ্টি, বন্যা, অগ্নিকাণ্ড, সিডর, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ তেলাপোকা, উইপোঁকা, ইঁদুরের আক্রমণে প্রয়োজনীয় সাবধানতা অবলম্বন অতীব জরুরি, কারণ এসব বিপর্যয়ে ও ক্ষতির ফলে আপনার দীর্ঘদিনের কষ্টার্জিত সংগ্রহ ক্ষণিকের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। যা আর পুষিয়ে নেয়ার কোনও উপায় থাকে না। নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে জমি ভেঙ্গে গেলে নতুন চর পড়বে। অর্থনৈতিক ক্ষতি, সম্পদের ক্ষতি হলে তা হয়তো সময়ের ব্যবধানে পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হতে পারে, কিন্তু জ্ঞানভাণ্ডার বা সংগ্রহশালার ক্ষতি হলে অথবা চরিত্রের ক্ষতি সাধন হলে তা পুষিয়ে নেয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার।
আমি জানি সমাজে অনেক মানুষ আছেন যাঁরা নিজে পাঠক, লেখক, নানা রকম দুর্লভ সংগ্রহ কারক কিন্তু তা প্রকাশিত নয় বা প্রকাশের পদ্ধতি সম্বন্ধে পূর্ণাঙ্গ ধারণা নেই। তারাও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারদর্শী ব্যক্তির সহায়তা নিতে পারেন। বিশেষ করে আপনার নিকটস্থ সাংবাদিক বন্ধুর সহায়তা নিতে পারেন। তাকে আপনার মনের কথা খুলে বলুন। তথ্য দিয়ে সাহায্য করুন তিনিই তার বিবেক দিয়ে জাতির দরবারে আপনার স্বপ্নের কথা লিখে সাহায্য করতে পারেন। সমাজে আমি অনেক মানুষকে দেখেছি বই পড়তে পড়তে, পত্রিকা পাঠ করতে করতে যথেষ্ট পণ্ডিত্ব অর্জন করে ফেলেছেন, নিজে নিজে অনেক বিষয়ে ভাবেন কিন্তু লেখা হয়ে ওঠেনি। সময় করে লেখালেখি শুরু করুন। হতে পারে এমন যে আপনিই জাতির জন্য একদিন একজন ভাল কলামিস্ট হয়ে উঠবেন। মনে রাখবেন আজ যারা লেখক তারাই আগামীদিনের প্রাবন্ধিক। অনেক লেখক, সাংবাদিক, গবেষক আছেন যাদের সংগ্রহশালা সুবিন্যস্ত নয়, অগোছালো। তারা কালবিলম্ব না করে গুছিয়ে নিন। যেসব সংগ্রহ বা প্রবন্ধ বিদ্যমান তার একটি তালিকা তৈরি করুন, যেকোনও প্রয়োজনে স্বল্প সময়ে তা বের করা সহজ হবে।
মূলত ভালো লেখা, ভালো সাংবাদিক, ভালো বৈজ্ঞানিক, ভালো গবেষক তৈরির কোনও কার্যকরী পদক্ষেপ উন্নয়নশীল দেশে নেই। এটি আমাদের জাতীয় জীবনে একটি মৌলিক সমস্যা। যে দেশে শিল্পীর আকাঁ ছবি, কবির কবিতা, লেখকের লেখা, গবেষকের গবেষণা, বৈজ্ঞানিকদের বিজ্ঞানাগার, পাঠকের পাঠাগার, কুটিরশিল্পীর শিল্প কারখানার যথার্থ মূল্যায়ন না হবে ততদিন জাতি উন্নত ও সভ্য হবে না। এজন্য এসব বিষয়ে ব্যক্তির উদ্যোগ, বেসরকারি সংস্থা, সর্বোপরি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, যথার্থ মূল্যায়ন ও উৎসাহ প্রদানের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা নেওয়া অতীব জরুরি। আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে গুরুত্ব দেবেন।