বৃহস্পতিবার-২২শে জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি-২২শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মুসলিম বিশ্বে সংকটের নেপথ্যে

মুসলিম বিশ্বে সংকটের নেপথ্যে

মুসলিম বিশ্বে সংকটের নেপথ্যে

ইবরাহিম কালিন

 

মুসলিম বিশ্ব সংকটপূর্ণ অবস্থায়। সংকটটা অতো বেশি রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক নয়। যদিও বর্তমান অবস্থায় এগুলোর বেশ ভালোই প্রভাব আছে। তবে সেটা অস্তিত্বসম্বন্ধীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটের মতো নয়।

মুসলিম বিশ্ব নিজেদের ব্যাপারে স্বচ্ছ না। বিশ্বকেও তারা গঠনমূলকভাবে গড়তে পারছে না। তারা নিজেরা নিজেদের কর্মকাণ্ডের কর্তা হিসেবে হাজির হতে পারছে না। অতীতের সোনালি ইতিহাস আর বর্তমানের উদাসীনতা আর দুর্দশার মধ্যে দোদুল্যমান মুসলিম বিশ্ব।

বহু মুসলিম দেশ রাজনৈতিক সংকট, অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা, দুর্বল অবকাঠামো, নিম্নমানের শিক্ষাব্যবস্থা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে প্রতিযোগিতার অভাব, দূষিত ও বাজে ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত শহর ও পরিবেশগত বিপর্যয় প্রভৃতি সমস্যায় ভুগছে।

তারা আজ পঙ্গু হয়ে আছে সামাজিক অসাম্য, নারীদের প্রতি অবিচার, সামপ্রদায়িক সংঘাত, চরমপন্থা, সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদে। পার্থিব ক্ষমতার নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতার কবলে শান্তি, সাম্যতা ও সহানুভূতি ইত্যাদি ইসলামের মৌলিক শিক্ষা হারিয়ে গেছে।

রাজনৈতিক নেতা, ধর্মীয় স্কলার এবং বুদ্ধিজীবীরা মুসলিম বিশ্বের অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষয় বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। হয় তারা ক্ষমতার কাছে নতি স্বীকার করেছেন, নয়তো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছেন। এগুলোর পেছনে যদিও বিশ্বশক্তি এবং বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে দোষারোপ করার যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে, এটাও সত্য যে মুসলিমেরা নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।

যেমনটা আমি আগেও লিখেছি, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের ধারা, ব্যর্থ রাষ্ট্র, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা এবং অধিকারচ্যুত ও বিচ্ছিন্নতাবোধ মধ্যপ্রাচ্যের সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিতে সৃষ্টি করেছে গভীর ক্ষত। বিভেদসৃষ্টিকারী আইডেন্টিটির রাজনীতি শক্তিশালী ভাবাদর্শিক উপকরণে পরিণত হয়েছে। ধর্ম, জাতীয়তাবাদ বা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার নামে রাজনৈতিক সুবিধাভোগী ও চরমপন্থীরা সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের দুঃখ-দুর্দশাকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে ব্যবহার করেছে।

এগুলো তো সত্যই, সাথে আছে পশ্চিমা গণতন্ত্র। তারা তাদের নিজেদের মূল্যবোধ ও মূলনীতির সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তারা দেখেছে কিভাবে ফিলিস্তিনকে বেদখল করা হয়েছে এবং প্রায় ৫০ বছর ধরে তা সমপ্রসারণ করা হচ্ছে। তারা সমর্থন করেছে মিসরের রক্তাক্ত অভ্যূত্থানকে। ইরাকে তৈরি করেছে সর্বনাশা পরিস্থিতি। তারা সিরিয়ান নাগরিকদের সহযোগিতা করতে ব্যর্থ হয়েছে।

মিয়ানমার, সোমালিয়া ও অন্যান্য জায়গার লাখ লাখ মানুষের দুর্দশা যেন তাদের নজরে আসে না। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পরিবেশ দূষণকারী হিসেবে তারা ধ্বংস করেছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। এরাই মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অস্ত্রের বৃহত্তম উৎপাদনকারী। আর তারা এগুলো বিক্রি করছে দরিদ্র দেশগুলোতে। তারা এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দাঁড় করিয়েছে যাতে কেবল ধনীরা বিশেষ সুবিধা পায়, আর গরিবেরা নিচেই পড়ে থাকে। আন্তর্জাতিক আইনকে তারা নিজেদের স্বার্থে নিশ্চিত করে। অন্যদের ব্যাপারে তোয়াক্কা করে না। কেউ কেউ মুসলিমদের সঙ্গে এই বৈষম্য ও বর্ণবাদকে উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে সমর্থন করে। এগুলো সবই সত্য এবং এই তালিকা আরো দীর্ঘ।

তবে অন্যকে দোষারোপ করলেই আমাদের সমস্যা সমাধান হয়ে যায় না, বরং এটা শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক অলসতা এবং নৈতিক প্রথানুবর্তিতার দিকে নিয়ে যায়। ক্ল্যাসিকাল ইসলামি সভ্যতার অর্জন নিয়ে গর্ব করা এক জিনিস, আমাদের তা করা উচিত এবং এর থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। কিন্তু তাকে নতুন করে আজকের সময়ে ফুটিয়ে তোলা সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। এটি একটি কার্যকর শিক্ষা ব্যবস্থার কাজ হওয়া উচিত। মুসলিম সমাজের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ বন্ধ না করে নিজেদের দুর্ভাগ্যের জন্য পশ্চিমা বিশ্ব বা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে দায়ী করা অর্থহীন।

একটু চিন্তাভাবনা করলেই তিক্ত সত্য বের হয়ে আসে: শক্তিধর দেশগুলোর মতো মুসলিমরাও তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। অবিচার, অসাম্য, দরিদ্র্যতা, চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদকে সুযোগ করে দিয়েছে নিজেদের মধ্যে পচন ধরানোর জন্য। মুসলিমদের মধ্যকার যৌক্তিক ক্ষোভগুলোকে নৈতিকভাবে অর্থপূর্ণ ও যুক্তিসম্মত কার্যকর উপায়ে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। জ্ঞান ও ধৈর্যের সঙ্গে সমস্যাগুলো নিরসন করার চেয়ে তারা আশ্রয় নিয়েছে অসহিষ্ণুতা, উগ্রপন্থা ও সহিংসতার। আর এর ফলাফল হচ্ছে আল-কায়েদা, আইএস ও বোকো হারামের মতো সংগঠনগুলোর ব্যাপক বিস্তৃতি।

মুসলিমদের এখন প্রয়োজন বর্তমান অবস্থা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা। আর তার শুরু হওয়া উচিত নিজেদের ভেতর থেকেই। ইসলামি বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য ,গোপন, (আল-বাতিন) ও প্রকাশ্য, (আয-যাহির) দুটো দিককেই সমান গুরুত্ব দেয়। বাইরে যা প্রকাশ পায় সেটা আপনার ভেতরের অবস্থানেরই বহিঃপ্রকাশ।

আপনার ভেতর যে ভালোত্ব আছে, বাইরের জগতে সেটাই শান্তি, সুবিচার ও রহমত প্রতিষ্ঠার জন্য বেরিয়ে আসা উচিত।

আল-কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, যতক্ষণ লোকেরা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে না, ততক্ষণ আল্লাহ তাদের অবস্থা বদলান না।

মুসলিম নেতা, স্কলার, শিক্ষিত নারী ও পুরুষ, ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মী- সবার এগিয়ে আসা উচিত এবং বিশ্বাস, যুক্তি ও উত্তম গুণাবলির ওপর ভিত্তি করে সংস্কৃতি নির্মাণ করা উচিত। তাদের উচিত অহংকার এবং অন্য ধর্মের প্রতি বৈষম্য ছাড়াই মুসলিমদের বিশ্বাসের আত্ম-মর্যাদা পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করা। এটা তাদের পক্ষে সম্ভব। আল-ফারাবি ও ইবনে সিনা যেমনটা করেছিলেন দর্শনের ক্ষেত্রে, আল-বিরুনি ও ইবনে আল-হায়সাম যেমনটা করেছিলেন বিজ্ঞানে, ইবনে আল-আরাবি ও মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমি যেমনটা করেছিলেন আধ্যাত্মিকতায়, আন্দালুসিয়ার শাসকেরা যেমনটা করেছিলেন দক্ষিণ ইউরোপে এবং অসংখ্য মুসলিম শাসক, বিজ্ঞানী ও শিল্পীরা যেমনটা করেছিলেন তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে, তারাও তেমনি সৃজনশীল ও গঠনমূলকভাবে কিভাবে এই বিশ্বে কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করতে হবে সেটা দেখাতে সক্ষম হবেন।

মুসলিম দেশগুলো প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে অনুগৃহীত। তাদের উচিত দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষা, সুশাসন, নগর উন্নয়ন এবং যুবক ও নারীর ক্ষমতায়নের মতো ব্যাপারগুলোতে বিনিয়োগ করা।

হাতে গোনা কিছু মুসলিম দেশ রয়েছে যারা এসব ক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে বিনিয়োগ করে। কিন্তু মুসলিম ভূমিগুলো আবারো যেন শান্তি, সুবিচার, ঈমান এবং গুণের আধার হতে পারে, সেজন্য আরও বেশি সংখ্যক মুসলিম দেশগুলোর উচিত তাদের প্রাকৃতিক সম্পদের যথোপযোগী ব্যবহার করা। এজন্য প্রয়োজন উন্নততর শাসন, রাজনীতি ও পরিকল্পনা। কিন্তু সবকিছুর উপরে প্রয়োজন আমাদের মানসিক বিপ্লবের যেখানে দুনিয়ার সঙ্গে আমরা আমাদের সম্পর্ককে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করব, এবং একে বিবেচনা করব আমাদের প্রতি এক আমানত হিসেবে। আর আমাদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে এবং স্রষ্টার সৃষ্টিকে সহানুভূতি আর বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করে এসবের সূচনা করতে হবে।

সূত্র: ডেইলি সাবাহ

লেখক: ইবরাহীম কালিন বর্তমানে তুরস্কের প্রেসিডেণ্টের বিশেষ উপদেষ্টা। তিনি জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিন্স আওলাদ সেন্টার ফর মুসলিম-খ্রিস্টিয়ান আন্ডারস্টান্ডিং এর একজন সম্মানিত ফেলো

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ