অটোমান তুরস্ক ও এরদোগান: ঈমান-কুফরের দ্বন্ধের খতিয়ান
আবুল হুসাইন আলেগাজী
॥এক॥
তুরস্ক ইসলামের ইতিহাস ও তুর্কিরা মুসলমানদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। একাধিক সহীহ হাদীস মতে নবী নূহের তিনটি ছেলে ছিল। সাম, হাম ও ইয়াফেস [মুনসদে আহমদ (২০১২৬)]। সামের অধঃস্তন পুরুষ আরব উপদ্বীপ ও ইরাক-শামের আরবেরা। হামের অধঃস্তন পুরুষ পূর্ব আফ্রিকার হাবশী, পশ্চিম আফ্রিকার বর্বর ও মিসরের কিবতীরা। ইয়াফেছের বংশধর ইয়াজুজ-মাজুজ, রোমান, তুর্ক ও সাইপ্রেরিরা [ইবনে আসাকিরের তারীখে দিমাশকে (২৬/২৭৮) ইঙ্গিত পাওয়া যায়]।
হাদীস শরীফে রোমান ও তুর্কিদের সাথে আরব মুসলমানদের যুদ্ধের কথা বর্ণিত হয়েছে। কোনো হাদীসে রোমানদের কথা ও কোনো হাদীসে তুর্কিদের কথা এসেছে। সম্ভবত রোমান বলতে পশ্চিম ও দক্ষিণ ইউরোপের মানুষকেই বোঝানো হয়। তুর্কি বলতে পূর্ব ইউরোপ, ককেশাস ও মোঙ্গল-চীনের লোকদেরকে বোঝানো হয়। খ্রিস্টান রোমানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সবসময় ক্রুসেডসহ বিভিন্ন যুদ্ধ করে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। অনুরূপভাবে চেঙ্গিস ও হালাকু খানের নেতৃত্বে তুর্কিরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে খোরাসান ও বাগদাদে। পরে চেঙ্গিসের বংশধরসহ তুর্কিদের একটি বিশাল অংশ ইসলাম গ্রহণ করে। তবে তাদের রক্ত-মাংস থেকে যুদ্ধ ও দেশ দখল-শাসনের নেশা কখনো দূর হয়নি। ফলে তারা তুরস্ক, ইরান ও আফগানসহ মধ্য এশিয়া ও ভারতীয় উপমহাদেশে শত শত বছর মুসলিম জনগোষ্ঠীগুলোকে শাসন করতে সক্ষম হয়।
সহীহ আল-বুখারী ও সহীহ মুসলিসহ সিহাহ সিত্তার হাদীসে রোমান ও তুর্কিদের অবয়বের যে বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে, তা হলো তারা লাল বর্ণের চেহারা, চ্যাপ্টা মুখ ও ছোট চোখওয়ালা হবে এবং তারা পশমের জুতা পরবে। অন্য হাদীসে ইয়াজুজ-মাজুজের বৈশিষ্ট্যও এরকম বলে বর্ণিত হয়েছে। কিছু হাদীসে রোমান (الروم) ও তুর্কি (الترك)- এর পরিবর্তে তাদের ক্ষেত্রে বনু কনতুরা (بنو قنطوراء), বনুল আসফার (بنو الأصفر), করমান (كرمان), খোজা (خوزا) ইত্যাদি শব্দ এসেছে। আমার মনে হচ্ছে, পূর্ব ইউরোপ, রাশিয়া, মধ্যএশিয়া ও চীন প্রভৃতির লোকেরা ইয়াফেসের বংশধর রোমান তথা তুর্কি ও সাইপেরিদের মিশ্রণ। আর আমারা ভারত উপমহাদেশের লোকেরা সাম, হাম ও ইয়াফেস তিনজনের বংশধরের মিশ্রণ। তুর্কিদের একটি শাখা হলো কুর্দি।
যা হোক, হাদীস শরীফে ফারেসী (ইরান ও তার আশ-পাশের অঞ্চলের মানুষ) ও আজমীদের ইসলাম গ্রহণের কথা বর্ণিত হয়েছে। ইমাম আবু হানিফা, ইমাম বুখারী ও ইমাম গাযালী থেকে শুরু করে ইসলামের বড় বড় ফকীহ, মুহাদ্দিস ও র্দাশনিকের ৯৫% এর জন্ম ফারেসে। ফারেসের অনারবেরা ইসলামের তাত্ত্বিক সেবার জন্য নির্বাচিত হলেও এর পার্শ্ববর্তী তুর্কি ও কুর্দিরা ইসলামের পক্ষে কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। নুরুদ্দীন জঙ্গী ও সালাহুদ্দীন আইয়ুবী কুর্দি এবংইস্তাম্বুল বিজেতা মুহাম্মদ আল-ফাতিহসহ পুরো উসমানী বংশ ছিলেন তুর্কি। অনরাবদের ইসলাম গ্রহণের বিষয়ে অনেক হাদীস আছে। এর মধ্যে দুইটি হাদীস নিম্নরূপ:
عَنِ ابْنِ عُمَرَ k، قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ ^: «رَأَيْتُ غَنَمًا كَثِيْرَةً سَوْدَاءَ دَخَلَتْ فِيْهَا غَنْمٌ كَثِيرَةٌ بِيْضٌ» قَالُوْا: فَمَا أَوَّلْتَهُ يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ قَالَ: «الْعَجَمُ يَشْرَكُوْنَكُمْ فِيْ دِيْنِكُمْ وَأَنْسَابِكُمْ» قَالُوْا: الْعَجَمُ يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ قَالَ: «لَوْ كَانَ الْإِيْمَانُ مُعَلَّقًا بِالثُّرَيَّا لَنَالَهُ رِجَالٌ مِنَ الْعَجَمِ وَأَسْعَدَهُمْ بِهِ النَّاسُ»، أخرجه الحاكم (4/437 ، رقم 8194) وقال : «هَذَا حَدِيْثٌ صَحِيْحٌ عَلَىٰ شَرْطِ الْبُخَارِيِّ وَلَـمْ يُخَرِّجَاهُ».
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, স্বপ্নে আমি অনেক কালো ছাগল দেখলাম। তাদের মাঝে অনেক সাদা ছাগলও প্রবেশ করলো।’ উপস্থিত সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রসূলুল্লাহ! আপনি এটির কি তাবীর করেছেন? বললেন, আজমিরা। তারা তোমাদের সাথে দীন ও আত্মীয়তায় অংশীদার হবে। ঈমান যদি সুরাইয়াতেও (কৃত্তিকা নক্ষত্রপুঞ্জ) ঝোলানো থাকে তাহলে আজমের কিছু লোক তা পাবেই। [মুস্তাদরকে হাকেম (৮১৯৪)]
হযরত কয়েস ইবনে সাদ থেকে আরেকটি হাদীসে এসেছে,
«لَوْ كَانَ الْإِيمَانُ مُعَلَّقًا بِالثُّرَيَّا لَنَالَهُ رِجَالٌ مِنْ أَبْنَاءِ فَارِسَ».
ঈমান যদি সুরাইয়াতেও (কৃত্তিকা নক্ষত্রপুঞ্জ) ঝুলানো থাকে তাহলে ফারিসের কিছু লোক তা পাবেই। [মুসনদে আবু ইয়ালা (১৪৩৩) ও মুজমে তবরানী কবীর (১৮/৩৫৩)]
তুর্কিদের সংরক্ষণ ক্ষমতা প্রসঙ্গে খতীবে বাগদাদী কৃপণদের বিরুদ্ধে রচিত তাঁর কিতাব আল-বুখালায় মুহাম্মদ ইবনে মুসলিম থেকে বর্ণিত নীচের হাদীসটি এনেছেন,
«قُسِّمَ الْحِفْظُ عَشَرَةَ أَجْزَاءٍ: فَتِسْعَةٌ فِي التُّرْكِ، وَجُزْءٌ فِي سَائِرِ النَّاسِ، وَقُسِّمَ الْبُخْلُ عَشَرَةَ أَجْزَاءٍ: فَتِسْعَةٌ فِي فَارِسَ، وَجُزْءٌ فِي سَائِرِ النَّاسِ، وَقُسِّمَ السَّخَاءُ عَشَرَةُ أَجْزَاءٍ: فَتِسْعَةٌ فِي السُّودَانِ، وَجُزْءٌ فِي سَائِرِ النَّاسِ، وَقُسِّمَ الْـحَيَاءُ عَشَرَةَ أَجْزَاءٍ: فَتِسْعَةٌ فِي الْعَرَبِ، وَجُزْءٌ فِي سَائِرِ النَّاسِ، وَقُسِّمَ الْكِبْرُ عَشَرَةَ أَجْزَاءٍ: فَتِسْعَةٌ فِي الرُّومِ، وَوَاحِدٌ فِي سَائِرِ النَّاسِ».
সংরক্ষণ ক্ষমতাকে দশভাগ করে নয়ভাগ তুর্কিদের মাঝে এবং একভাগ বাকী সকল মানুষের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। কৃপণতাকে দশভাগ করে নয়ভাগ পারস্যদের মাঝে এবং একভাগ বাকী সকল মানুষের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। দানশীলতাকে দশভাগ করে নয়ভাগ সুদানের (কালো লোক) মাঝে এবং একভাগ বাকী সকল মানুষের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। লজ্জাশীলতাকে দশভাগ করে নয়ভাগ আরবদের মাঝে এবং একভাগ বাকী সকল মানুষের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। অহঙ্কারকে দশভাগ করে নয়ভাগ রোমানদের মাঝে এবং একভাগ বাকী সকল মানুষের মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। [দাইলামীর মুসনদুল ফিরদাউসে (২২২৯) একই মর্মের হাদীস হযরত আনাস (রাযি.) থেকেও বর্ণিত হয়েছে]
॥দুই॥
একজন তুর্কি মুসলিম যোদ্ধা গাজী উসমান ইবনে উরতুগরুল ১২৯৯ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান তুরস্কের সোগুত শহরে তুর্কি ইসলামী সলতনতের গোড়াপত্তন করেন। পরে তার অধঃস্তন পুরুষেরা খ্রিস্টান রোমানদের সাথে যুদ্ধ করে বিশাল উসমানী ইসলামী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ১৩৩৫ সালে তাঁর অধস্তন পুরুষ সুলতান উর খান সোগুত ছেড়ে সাম্রাজ্যের রাজধানী মারমারা সাগরের নিকটবর্তী বিজিত বুরসা শহরে স্থানান্তর করেন। এরপর ১৩৬৩ সালে সুলতান প্রথম মুরাদ সেটির রাজধানী আরেক বিজিত শহর এদর্নে স্থানান্তরিত করেন। এরপর সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের ছেলে দ্বিতীয় মুহাম্মদ (আল-ফাতেহ) নবীজি (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী সত্যায়ন করতে ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক রাজধানী কনস্টাটিনোপল বিজয় করেন এবং উসমানী সলতনতের রাজধানী তাতে স্থানান্তরিত করেন। তিনি সেটির নাম পরিবর্তন করে ইসলামবুল রাখেন (পরবর্তীতে সেটি আস্তানা ও ইস্তাম্বুল নামে পরিচিত হয়)। উসমানী সুলতানরা ষষ্ঠদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সুলাইমান কানুনীর আমলে সার্বিয়া ও বসনিয়াসহ গোটা পূর্ব ইউরোপ খ্রিস্টানদের কাছ থেকে দখল করে নেন। এমনকি সুলতান সুলাইমান কানুনীর নেতৃত্বে তারা মধ্য ইউরোপের হাঙ্গেরিও দখল করেন এবং ভিয়েনা (বর্তমান অস্ট্রিয়ার রাজধানী) অবরোধ করেন। কিন্তু পূর্বদিকে ইরান-ইরাক দখলকারী শিয়া সফাভীদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য তিনি অস্ট্রিয়ার রাজার সাথে সন্ধি করে চলে আসেন এবং ইরাককে শিয়াদের দখল থেকে মুক্ত করেন।
১২৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে উসমানী ইসলামী সলতনত ১৯২৪ সাল পর্যন্ত মোট ৬২৫ সৌরবছর পর্যন্ত টিকে ছিল। এ সময় ক্ষমতা নিয়ে তাদের মাঝে গৃহবিবাদ হলেও ইউরোপের দাম্ভিক খ্রিস্টানদেরকে তারা সুখে থাকতে দেয়নি। লাল চামড়ার দাম্ভিকেরা উসমানীদেরকে শতশত বছর জিযিয়া দিয়েই তাদের অধীনে পূর্ব ইউরোপে বসবাস করছিল। দূরে অবস্থিত হওয়ায় তারা যেমন মুসলিম স্পেন দখল করতে পারেনি, তেমনি সেটিকে রক্ষার জন্য এগিয়েও যেতে পারেনি। বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, আলবেনিয়া ও কসোভো নামের পূর্ব ইউরোপের তিনটি স্বাধীন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ উসমানীদেরই অবদান। উসমানীদেরকে সবচেয়ে বেশি জ্বালিয়েছিল ব্রিটেন নামের ইবলিসদের রাজ্যটি।
উনবিংশ শতাব্দীতে তারা উসমানী সালতানতের পতন ঘটানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। ওই সময় তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ খান পশ্চিমাদের উন্নতি দেখে রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের অনুকরণ করতে শুরু করে। তুর্কিদের বিরুদ্ধে ব্রিটেন কাজে লাগায় আরব খ্রিস্টান ও মুসলিম জাতিয়তাবাদীদেরকে। তারা তুর্কিদের শাসন থেকে মুক্তির জন্য আন্দোলন শুরু করে। একই ভাবে তুর্কি জাতিয়তাবাদীদেরকেও আরবদের বিরুদ্ধে উস্কে দেয়। বিশেষত পশ্চিমা স্টাইলে ঢেলে সাজানো সেনাবাহিনীর মধ্যে বস্তুবাদী উন্নয়ন ও জাতিয়তাবাদের বীজ বপন করা হয়। এক পর্যায়ে সুলতান প্রথম আবদুল মজীদ ও তাঁর ভাই প্রথম আবদুল আযীযের আমলে উসমানী সলতনত খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে। একদিকে শাসন ব্যবস্থার দুর্বলতা, আরেকদিকে সেনাবাহিনীসহ সবক্ষেত্রে তুর্কি জাতিয়তাবাদীদের দাপট, আরেকদিকে পূর্ব ইউরোপের সাথে বিরোধ এবং আরেকদিকে আরব দুনিয়ায় বিদ্রোহ ও দাঙ্গা। পরে ১৮৮৬ সালে ধার্মিক ও বুদ্ধিমান সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামীদ এসেও অবস্থার তেমন উন্নয়ন করতে পারেননি। তিনি সলতনকে রক্ষায় অনেক শক্ত অবস্থান নিয়েও ব্রিটিশ ইবলিস ও তাদের স্থানীয় মিত্র সেক্যুলার জাতিয়তাবাদী সেনাকর্মকতাদের সামনে টিকে থাকতে পারেননি। ১৯০৯ সালে তারা তাঁকে গৃহবন্দী করে তার ভাই পঞ্চম মুহাম্মদকে পদে বসায়। পরে তিনি গৃহবন্দী অবস্থায় ১৯১৮ সালে ইন্তেকাল করেন।
সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামীদের আমলে ফিলিস্তিনে জায়োনিস্টদের আগমন শুরু হয়। সুলতান আবদুল হামীদের কাছে গিয়ে জায়োনিস্টরা ফিলিস্তীনে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ চাইলে তিনি সরাসরি না করে দেন। কিন্তু দুর্নীতিবাজদের আশ্রয়ে জায়োনিস্টরা সেখানে জায়গা কেনা শুরু করে। ১৯১৩ সালে প্যারিসে আরব জাতিয়তাবাদী ও তুর্কি জাতিয়তাবাদীদের মধ্যে এ মর্মে চুক্তি হয় যে, আরবরা তুর্কি সলতনত থেকে স্বাধীন হবে না। তবে স্বায়ত্ত্বশাসন ভোগ করবে। কিন্তু পরের বছর সার্বিয়ার রাজধানী সারায়েভোতে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ নিহত হওয়াকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয়দের মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে স্বীয় স্বার্থ বিবেচনা করে উসমানীরা জার্মান, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও বুলগেরিয়ার পক্ষ নেয়। ওই যুদ্ধে তারা কেন্দ্রীয় শক্তি নামে পরিচিত হয়। অন্যদিকে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, রুমানিয়া, সার্বিয়া রাশিয়া ও জাপান সকলে ছিল আরেক পক্ষে (তাদেরকে মিত্রশক্তি বলা হয়)। যুদ্ধে জার্মান ও উসমানীরা পরাজয় বরণ করে। যুদ্ধকালীন সময়ে ব্রিটিশ ইবলিসরা উসমানীদের সময় শেষ ঘোষণা দিয়ে মক্কার গভর্নর শরীফ হুসাইনসহ সকল আরব নেতাদেরকে উসমানীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উদ্বুদ্ধ করে। ফলে তারা ১৯১৬ সালে উসমানীদের বিরুদ্ধে মহাবিদ্রোহ করে। পরে ব্রিটিশ ইবলিসরা শরীফ হুসাইনের আরব খেলাফতের স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে নজদের তাবেদার বাদশা আবদুল আযীযকে হেজায দখলের জন্য সবুজ সংকেত দেয়। ফলে আবদুল আযীয তার মিত্র ওয়াহাবী সালাফীদের সাথে নিয়ে ১৯২৫ সালে মক্কা দখল করে নেয়। সে আরেক দীর্ঘ ইতিহাস।
উসমানী সুলতান পঞ্চম মুহাম্মদ ১৯১৮ সালের জুলাইয়ে মারা যান। পরে তাঁর ভাই ষষ্ঠ মুহাম্মদ ওয়াহীদুদ্দীন খান পদে বসেন। তিনি ওই ১৯১৮ সালে অক্টোবরে উসমানীরা মিত্রশক্তির প্রধান ব্রিটেনের সাথে গ্রিসে লজ্জাজনক মুডরোস যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে তুরস্ক ছাড়া বাকী সকল স্থান থেকে দাবি ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর ফ্রান্স ও ব্রিটেন মিলে সাইস-বেকো গোপন চুক্তির মাধ্যমে নিকটস্থ আরব দেশগুলোকে ভাগ করে নেয়। ব্রিটেন দখল নেয় মিসর, ফিলিস্তিন, ইরাক, কুয়েত, ইয়েমেন, ওমান, আমিরাত ও কাতার। আর ফ্রান্স দখল করে নেয় সিরিয়া, লেবাবন। পরের মাসে অস্ট্রো হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের সাথে ইতালির ভিলাগস্টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আর এতে করে ভয়ঙ্কর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিস্তেজ হয়ে যায়। এ যুদ্ধে বিভিন্ন দেশের ৯০ লক্ষ সৈন্য ও ৫০ লক্ষ জনসাধারণ নিহত হয়। আহত হয় আরো বেশি। এ যুদ্ধের ফলাফলে উসমানী সাম্রাজ্য ভেঙে তুরস্ক, রুশ সাম্রাজ্য ভেঙে সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মান সাম্রাজ্য ভেঙে গণতন্ত্রবান্ধব জার্মান ও অস্ট্রো হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য ভেঙে গণতন্ত্রবান্ধব অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরির সৃষ্টি হয়।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি ও মার্কিন নৌবাহিনী উসমানী সাম্রাজ্যের রাজধানী ইস্তাম্বুলসহ তুরস্কের বিভিন্ন শহরে সৈন্য প্রবেশ করায়। এতে উসমানীদের সেক্যুলার জাতিয়তাবাদী সেনা কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল তুর্কি জাতিয়তাবাদী জাগরণের ডাক দেয় এবং গ্রিসের সাথে যুদ্ধ করে মিত্রশক্তি সাথে লজ্জাজনক লুজান চুক্তির মাধ্যমে তুরস্ক থেকে বাইরের সেনাদের প্রত্যাহার ও ইস্তাম্বুলসহ উসমানী আমলের পুরো তুর্কি অঞ্চলে একটি জাতীয়তাবাদী সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ পশ্চিমারা মোস্তফা কামালের কঠোর সেক্যুলার চিন্তা ও কর্ম দেখে এতে বাধ সাধা থেকে বিরত থাকে।
ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। মোস্তফা কামালের উত্থান হলে ক্ষমতাহীন সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মদ ওয়াহীদুদ্দীন খান ১৯২২ সালের অক্টোবরে মাল্টায় চলে যান। পরে তাঁর ক্ষমতাহীন পদে বসেন দ্বিতীয় আবদুল মজীদ। পরে ব্রিটিশ ইবলিসদের সাথে মোস্তফা কামালের লুজান চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সে ১৯২৪ সালে তুর্কি ইসলামী সলতনতের (খেলাফত) আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘোষণা করে, আবদুল মজীদসহ সুলতান পরিবারের সদস্যদের তুরস্ক থেকে বাইরে (ফ্রান্সে) চলে যেতে বাধ্য করে, তাদের সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে এবং তুরস্ককে একটি সেক্যুলার স্টেট বলে ঘোষণা করে। ব্রিটিশ ইবলিসরা মোস্তফা কামালের নেতৃত্বাধীন তুরস্ককে স্বীকৃতি দেয় এবং সুসম্পর্ক তৈরি করে। এতে বেঈমান কামাল আনন্দিত হয়ে ব্রিটিশ ইবলিসদের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তুরস্ক থেকে ইসলাম ও উসমানীদের নির্দশন মুছে ফেলতে শুরু করে। সে আরবিতে আযান দেওয়া নিষিদ্ধ করে, আরবি অক্ষর দিয়ে লিখিত হয়ে আসা তুর্কি ভাষাকে ল্যাটিন বর্ণে লিখতে বাধ্য করে, শিশুদের জন্য ইসলামী শিক্ষা নিষিদ্ধ করে, রাজনীতিকদের জন্য প্রকাশ্য ধর্মপালন নিষিদ্ধ করে, হজ নিষিদ্ধ করে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে নারীদের জন্য মাথায় কাপড় দেওয়া নিষিদ্ধ করে এবং আয়া সুফিয়া নামের ইস্তাম্বুলের সুন্দরতম মসজিদটিক জাদুঘরে রূপান্তর করে। কারণ উসমানীদের ইস্তাম্বুল জয়ের আগে এটি নাকি খ্রিস্টানদের গির্জা ছিল। চারিত্রিক দিক থেকে মোস্তফা কামাল নারী ও মদে আসক্ত ছিল। ১৯৩৭ সালে সে লিভারের যন্ত্রণাদায়ক সিরোসিস রোগে আক্রান্ত হয়। ইউরোপের সেরা ডাক্তারদের ওষুধেও সে সুস্থ হতে পারেনি। ১৯৩৮ সালের নভেম্বরে সে তার পাপের পার্থিব লঘু শাস্তি ভোগ করে জাহান্নামের পথে রওনা হয়। শহীদ আবদুল্লাহ আযযামের ভাষায় ‘তুরস্কের লোকেরা হজ করার অনুমতি পায় ১৯৪৬ সালের পর। অর্থাৎ এক সময় মুসলমান থাকা তুর্কিদের অন্তরে ইসলামি অনুভূতি আছে কিনা তা আমেরিকা পরীক্ষা করে দেখার পর।
॥৩॥
মোস্তফা কামালদের ইরতিদাদ সত্ত্বেও তুরস্কের মুসলমানরা ইসলামকে অনেক কষ্ট করে এ পর্যন্ত হেফাজত করেছে। তারা তাদের শিশুদেরকে কুরআন শেখাতো লুকিয়ে ও গোপনে। আজ অনেক পরীক্ষা ও কষ্টের পর তুরস্কের মানুষেরা ইসলাম নিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে সক্ষম হচ্ছে। মুরতাদ তুর্কিদের পাশাপাশি তুরস্কের মুসলিম রাজনীতিকরা আজ প্রকাশ্যে নামাজ পড়ছে, শিশুরা কুরআন শিখছে, মহিলারা সরকারি প্রতিষ্ঠানে হেজাব করে কাজ করতে পারছে। তুরস্ক ইসলাম ও মুসলমানদের সেবায় বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। এসব সম্ভব হচ্ছে তুরস্কের ইসলামী ভাবধারার জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির কল্যাণে। এটির প্রধান প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়েব এরদোগানের জন্ম ১৯৫৪ সালে। তিনি মারমারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়াশোনা করেছেন। ১৯৭০ এর দশকের শেষের দিকে তিনি মরহুম নাজমুদ্দীন আরবাকানের ন্যাশনাল লিবারেশন পার্টিতে যোগ দেন। পরে ১৯৮০ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর তুরস্কে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ হয়। ১৯৮৩ সালে এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে মরহুম আরবাকান আর-রিফা পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৪ সালে এটির পক্ষ থেকে ইস্তাম্বুলের মেয়র পদে নমিনেশন নিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হন রজব তাইয়েব এরদোগান। ১৯৯৮ সালে তিনি ইস্তাম্বুলের একটি মসজিদে বক্তব্য দেওয়ার সময়ও মসজিদগুলো আমাদের অস্ত্রাগার এবং মুছল্লীরা আমাদের সৈন্য মর্মের একটি কবিতার লাইন বলার কারণে তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় উস্কানি সৃষ্টির অভিযোগ এনে মামলা করা হয়। এতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় ও কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আর-রিফা পার্টি পর্যাপ্ত ভোট পেয়ে ক্ষমতায় আসে। প্রধানমন্ত্রী হন মরহুম আরবাকান। কিন্তু সেক্যুলার সেনাবাহিনী ১৯৯৮ সালে তার বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতা লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে গ্রেপ্তার ও তাঁর দলকে আদালতের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করে। মরহুম আরবাকানের অনুসারীরা ১৯৯৮ সালে ভার্চু পাটি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০০ সালে এটিকেও নিষিদ্ধ করা হয়। পরে আরবাকানের শিষ্য রজব তৈয়েব এরদোগান ও আবদুল্লাহ গুল মিলে ২০০১ সালে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০২ সালের নির্বাচনে দলটি বিপুল আসনে বিজয়ী হয়। এরদোগান তখন দণ্ডিত হওয়ায় দলটির গঠন করা সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন তাঁর সহকর্মী আবদুল্লাহ গুল। পরে তিনি এরদোগানের দণ্ড মওকুফের ব্যবস্থা নিলে ২০০৩ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদে বসেন। সে থেকে তাঁর দল বারবার বিজয়ী হয়। ২০১৪ সালে তিনি প্রেসিডেন্টের পদকে শক্তিশালী করে প্রধানমন্ত্রী থেকে প্রেসিডেন্টের পদে চলে আসেন এবং ওই পদে বহাল আছেন।
অন্যদিকে এরদোগানের রাজনৈতিক গুরু মরহুম আরবাকান ২০০৩ সালে সায়াদাত পার্টি গঠন করেন। তবে সেক্যুলাররা আর-রিফা পার্টি পরিচালনায় তিনি দুর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে। এতে তাঁর জেল হয়। জেলে তাঁর স্বাস্থের অবনতি হলে ২০০৮ সালে শিষ্য প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল তাঁর দণ্ড মওকুফ করে তাঁকে মুক্ত করেন। পরে ২০১১ সালে এ মহান ব্যক্তি ৮৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
ইদানিং আমি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করছি, ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা এবং সমাজ ও বিশ্ববাস্তবতা উপলব্ধির অভাবে আমার কিছু ভাই-ভাতিজা তুরস্কের মুসলিম প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগানকে কাফির ও মুরতাদ ফতওয়া দিচ্ছে। তারা তাঁকে কাফির প্রমাণ করার জন্য বিভিন্ন তথ্য ও ভিডিও ক্লিপ নিয়ে একটি ডকুমেন্টারিও তৈরি করেছে। হ্যাঁ! আমার এসব ভাই-ভাতিজাদের ক্ষোভ, আবেগ ও ব্যথার জায়গাটি আমি চিনি ও উপলব্ধি করি। কিন্তু বাস্তবতা অনেক বড় কঠিন। ৮০ বছর ধরে চেপে বসা কঠোর সেক্যুলার সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ করে তুরস্ককে ইসলামী সংবিধান উপহার দেওয়ার পর্যায়ে এরদোগানের দল এখনো পৌঁছেনি এবং পৌঁছার সম্ভাবনাও আছে বলে আমার মনে হয় না। কারণ তারা তুরস্ককে শুধুমাত্র কঠোর সেক্যুলারিজম থেকে উদার সেক্যুলারিজমে নিয়ে আসাতেই ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের সকল ইসলামবিরোধী শক্তি তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এবং অপপ্রচার চালাচ্ছে। ওরা যদি এখন তুরস্কে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করে, তাহলে তাদেরকে তালেবান ও আল-কায়েদার নেতাদের মতো হয়তো বাঙ্কারে লুকিয়ে থাকতে হবে নতুবা মিসরের ইখওয়ান নেতা ড. মুরসী ও ড. বদীর মতো মৃত্যুদণ্ড বা আজীবন কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। তখন পশ্চিমারা তুরস্কে আরেক মোস্তফা কামালকে ক্ষমতায় বসাবে। নিশ্চয় আপনারা তা কখনো চাইবেন না। আর তুরস্কের মুসলমানরা আফগান তালেবানের মত যুদ্ধ সংস্কৃতি ধারণ করে বেড়ে উঠেনি এবং সেখানের পরিস্থিতিও এ মুহূর্তে তালেবান স্টাইলের যুদ্ধের জন্য অনুকূল নয়। তো প্রিয় ভাই-ভাতিজারা আপনাদের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে, তুরস্কের প্রেসিডেন্টের দুর্বলতা ও অক্ষমতাগুলোর সাথে তার ইসলাম ও মুসলমানের পক্ষে যে সামান্য অবদান আছে, সেটি বিবেচনা করে তাঁকে কাফির ও মুরতাদ বানানোর চেষ্টা করা থেকে আপনারা বিরত থাকবেন। সর্বোচ্চ তাঁর ঈমান নিয়ে আপনারা সন্দেহ প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু বিদ্বেষ নিয়ে তাঁকে কাফির বলে গ্যারান্টি দিতে পারেন না। মহান প্রভু আমাদেরকে সহীহ ও পরিপক্ক বুঝ দান করুন।