মাওলানা ফেরদৌসির শাহনামা: মহাকালের মহাকথন
শাকির সবুর
অনেকের ধারণা, পারস্যে মাওলানা আবুল কাসিম ফেরদৌসিই প্রথম শাহনামা রচনায় হাত দেন। আবার অনেকে মনে করেন গজনীর সুলতান মাহমুদের ফরমায়েশেই ফেরদৌসি শাহনামা রচনা শুরু করেন। এ দুটির কোনোটিই সম্পূর্ণ সঠিক নয়। পারস্য সাহিত্যে শাহনামা বেশ প্রাচীন গ্রন্থ। তবে সংস্কারের পূর্বে এর নাম ছিল সিরাজুলমুলক অথবা রোস্তমনামা। যারা সর্বপ্রথম এর সংস্কার সাধনে আত্মনিয়োগ করেন তাদের মধ্যে মারভের সুলতান মাসুদী এবং বলখের সুলতান আবুল মুআঈদ ও আবুল আলী ছিলেন অন্যতম। এ সংস্কার হয় খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর প্রথম দিকে। এ শতাব্দীর শেষার্ধে ৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে তুসের শাসনকর্তা আবু মনসুর শাহনামা রচনার জন্য একদল যারতুস্তি বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিতদের নিযুক্ত করেন। পণ্ডিতদল দীর্ঘ সাধনার পর এর রচনা সমাপ্ত করেন। তাদের সঙ্কলিত পাণ্ডুলিপি পরবর্তী সময়ে একজন মুসলিম পণ্ডিত কর্তৃক সংশোধন ও সম্পাদনা করা হয় এবং এই শতকের শ্রেষ্ঠ কবি দাকিকী তুসীর ওপর এর কাব্যরূপ দেবার ভার ন্যস্ত করা হয়। দাকিকী ২ হাজার পঙ্ক্তি সমাপ্ত করার পর স্বীয় কৃতদাসের হাতে নিহত হন। এটি হিজরি ৩৬৭-৩৭০-এর সময়কার ঘটনা। এ সময় তুসের গভর্নর ছিলেন আবু মনসুর। এ সময় ফেরদৌসির বয়স ছিল ৩৫ কী ৩৭ বছর। কারণ অধিকাংশ জীবনীকারের মতে ফেরদৌসির জন্ম হয় ৩২৯ অথবা ৩৩০ হিজরিতে। দাকিকীর মৃত্যুর পর তুসের অধিবাসী কবি ফেরদৌসি স্বউদ্যোগেই কবি দাকিকীর অসমাপ্ত শাহনামা সমাপ্ত করার কাজ শুরু করেন। অন্যদিকে গজনীর অধিপতি সুলতান মাহমুদও শাহনামা রচনার জন্য তার দরবারের প্রধান কবি উনসুরীকে নিযুক্ত করেন।
তুসের গর্ভনর আবু মনসুরের মৃত্যুর পর গর্ভনর হয়ে আসেন সালান খাঁ। তিনিই ফেরদৌসির প্রতিভার কথা জানতে পেরে সুলতান মাহমুদকে অবহিত করে লিখে পাঠান: তিনি গজনীতে যে শাহনামা রচনার জন্য কবি উনসুরীকে নিযুক্ত করেছেন প্রকৃতপক্ষে এ কাজের যোগ্যতম ব্যক্তি হচ্ছেন কবি আবুল কাসেম মোহাম্মদ ফেরদৌসি। মূলত সুলতান মাহমুদ সালান খাঁর পত্রের মাধ্যমে ফেরদৌসির প্রতিভা সম্পর্কে অবহিত হয়েই ফেরদৌসিকে গজনী আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে তার মীর মুনশি (মুখ্য সচিব) বদীউদ্দীনকে একটি পত্র লেখার নির্দেশ দেন। সেই মোতাবেক বদীউদ্দীন সুলতান মাহমুদের অভিপ্রায় জানিয়ে তুসের গভর্নরের মাধ্যমে ফেরদৌসিকে গজনী আগমনের আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি পত্র প্রেরণ করেন। এই আমন্ত্রণের ভিত্তিতেই ফেরদৌসি তুস থেকে গজনী অভিমুখে রওনা করেন। ইতোমধ্যে এই সংবাদ জানতে পেরে কবি উনসুরী মীর মুনশির সঙ্গে যোগসাজশে ফেরদৌসিকে তুসে ফেরত যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে অন্য এক মুনশি আখোরীকে ফেরদৌসিকে এই মর্মে একটি পত্র প্রেরণের নির্দেশ দেন যে, সুলতান মাহমুদ তার পরিকল্পনা পরিবর্তন করেছেন। সুতরাং ফেরদৌসি যেন তুসে ফিরে যান।
এই পত্র যখন ফেরদৌসির হাতে পৌঁছে তিনি তখন হেরাতে পৌঁছেছেন। এরই মধ্যে মীর মুনশি বদিউদ্দীন ও উনসুরীর মধ্যে কোনো এক বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য ঘটে। তখন বদিউদ্দীন প্রকৃত ঘটনা জানিয়ে ফেরদৌসিকে লেখেন যে, পূর্বের পত্রটি মূলত সুলতান মাহমুদের নির্দেশে লেখা হয়নি, সেটি লেখা হয়েছিল উনসুরীর পরামর্শে। তিনি যেন অতিসত্বর গজনীতে চলে আসেন। এই পত্র পাওয়ার পরই ফেরদৌসি পুনঃযাত্রা করে হেরাত থেকে গজনী এসে পৌঁছেন। বদিউদ্দীনের এই পত্র প্রেরণ এবং ফেরদৌসির গজনী আগমন সম্পর্কে উনসুরী কিছুই জানতেন না। তাই ফেরদৌসি যখন গজনী এসে পৌঁছেন তখন এক মজার ঘটনা ঘটে।
ফেরদৌসী পারস্যের (বর্তমান ইরান) একজন বিখ্যাত কবি। মহাকাব্য শাহনামার রচয়িতা। শাহনামা একইসাথে ইরানের ও সারা বিশ্বের ফার্সি ভাষাভাষী লোকজনের জাতীয় মহাকাব্য। ফেরদৌসী ৯৭৭ থেকে ১০১০ সালের মধ্যে ৩০ বছরের অধিক সময় ধরে এই মহাকাব্য রচনা করেন।
শাহনামা হচ্ছে প্রাচীন ইরানের ইতিহাস, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি নিয়ে বিভিন্ন কাব্যগাথা। এতে আছে ৯৯০টি অধ্যায়, ৬২টি কাহিনি। পুরো মহাকাব্যে ৬০ হাজার বার আছে অন্ত্যমিল। এটি হোমারের ইলিয়ড-এর চেয়ে সাত গুণ ও জার্মান মহাকাব্য নিবেলুঙগেনলিয়েড-এর (Nibelungenlied) চেয়ে ১২ গুণ বড়। শাহনামা একটি নির্দিষ্ট ভূগোলের ভৌগোলিক প্রতিবেশের মানুষের বহুবিচিত্র কাহিনি নিয়ে সৃষ্টি। মহাকাব্য হয়ে উঠেছে নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থান বিশেষ করে ইরানের কিংবদন্তি থেকে, পুরাণ থেকে ইতিহাস গ্রহণ করে। যে-ইতিহাস তার শৌর্য-বীর্য থেকে সৌন্দর্যপিয়াসী মানব-হিতৈষণার পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে ইরানের জাতিসত্তার বিপুল জাগরণে সাহায্য করেছিল। শাহনামা বাংলায় অনুবাদ করেন মনিরউদ্দীন ইউসুফ। বাংলা একাডেমি, ঢাকা হতে এটি ৬ খণ্ডে প্রকাশিত হয়।
ফেরদৌসী পারস্যের (বর্তমান ইরান) একজন বিখ্যাত কবি। মহাকাব্য শাহনামার রচয়িতা। শাহনামা একইসাথে ইরানের ও সারা বিশ্বের ফার্সি ভাষাভাষী লোকজনের জাতীয় মহাকাব্য। ফেরদৌসী ৯৭৭ থেকে ১০১০ সালের মধ্যে ৩০ বছরের অধিক সময় ধরে এই মহাকাব্য রচনা করেন।
শাহনামা হচ্ছে প্রাচীন ইরানের ইতিহাস, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি নিয়ে বিভিন্ন কাব্যগাথা। এতে আছে ৯৯০টি অধ্যায়, ৬২টি কাহিনি। পুরো মহাকাব্যে ৬০ হাজার বার আছে অন্ত্যমিল। এটি হোমারের ইলিয়ড-এর চেয়ে সাত গুণ ও জার্মান মহাকাব্য নিবেলুঙগেনলিয়েড-এর(Nibelungenlied) চেয়ে ১২ গুণ বড়। শাহনামা একটি নির্দিষ্ট ভূগোলের ভৌগোলিক প্রতিবেশের মানুষের বহুবিচিত্র কাহিনি নিয়ে সৃষ্টি। মহাকাব্য হয়ে উঠেছে নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থান বিশেষ করে ইরানের কিংবদন্তি থেকে, পুরাণ থেকে ইতিহাস গ্রহণ করে। যে-ইতিহাস তার শৌর্য-বীর্য থেকে সৌন্দর্যপিয়াসী মানব-হিতৈষণার পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে ইরানের জাতিসত্তার বিপুল জাগরণে সাহায্য করেছিল। শাহনামা বাংলায় অনুবাদ করেন মনিরউদ্দীন ইউসুফ। বাংলা একাডেমি, ঢাকা হতে এটি ৬ খণ্ডে প্রকাশিত হয়।
ফেরদৌসি যখন গজনী এসে পৌঁছেন ঘটনাক্রমে উনসুরী তখন তার কবি বন্ধু ফররুখী এবং আসজাদীকে নিয়ে বাগানে আড্ডা দিচ্ছিলেন। ফেরদৌসি তখন রাজদরবারের পথ খুঁজতে খুঁজতে তাদের আড্ডায় গিয়ে হাজির হন। কবিরা বিরক্ত হয়ে বলেন, কবিদের আড্ডায় তুমি অকবি তো অভাজনই বটে। জবাবে ফেরদৌসি বলেন আমিও একজন নগণ্য কবি। কবিরা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে, আচ্ছা তাই নাকি? তো হয়ে যাক কবিতার লড়াই। আমরা তিনজনে তিনটি চরণ বলবো। চতুর্থ চরণটি বলতে হবে তোমাকেই। বলেই উনসুরী শুরু করলেন,
চুন আরেজে তো মাহ নাবাশাদ রওশান
(যেহেতু তোমার আগমনে চাঁদ হয় না আলোকিত)
ফররুখী বললেন,
মানান্দে দেরাখতে গোল দার গোলশান
(ফুলবাগানে ফুলের গাছ যেমন)
আসজাদী বললেন,
মোজ্বেগানে তো হামি গোজার কোনাদ জওশান
(তোমার চোখের পাপড়িগুলো শুধুই ভেদ করে যায় লৌহবর্ম)
এদের ধারণা ছিল ফারসি ভাষায় ‘শান’ অন্তঃ দিয়ে এই তিনটি ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। সুতরাং আগন্তুক নিশ্চিত আটকে যাবেন এবং তাদের কাছে তার কাব্যপ্রতিভার প্রমাণ দিতে না পেরে লজ্জিত হবেন। কিন্তু ফেরদৌসি বললেন,
মানান্দে সেনানে গিয়ু দার জাঙ্গে পেশান
(পেশানের যুদ্ধে গিয়ুর বর্শার ফলার মতো)
তখন তারা তিনজনই বিস্মিত হয়ে পেশানের যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধের বীর গিয়ু সম্পর্কে জানতে চাইলেন। ফেরদৌসি তাদের পেশানের যুদ্ধ-ইতিহাস শোনালে তারা শুধু ফেরদৌসির কাব্যপ্রতিভায়ই মুগ্ধ হন না, তার ইতিহাস-জ্ঞান দেখেও বিস্মিত হন। পরবর্তী সময়ে ফেরদৌসি সুলতান মাহমুদের রাজদরারের ভার মহকের মাধ্যমে দরবারে এলে সুলতান মাহমুদ ফেরদৌসির পরিচয় ও প্রতিভা নিশ্চিৎ হয়েই উনসুরীর পরিবর্তে তার ওপর শাহনামা রচনার দায়িত্ব অর্পণ করেন; যে কাজ ফেরদৌসি ইতোপূর্বে তুসে অবস্থানকালেই শুরু করেছিলেন সুলতান মাহমুদের পৃষ্ঠপোষকতায় দীর্ঘ ত্রিশ বছরে গজনীতে এসে তিনি তা সমাপ্ত করেন। এবং এর মাধ্যমে তিনি বিলুপ্তপ্রায় ফারসি ভাষাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। কারণ ইতোমধ্যে আরব মুসলিমগণ পারস্য বিজয় করে ফেলেছিল এবং ইসলাম-উত্তর পারস্য-পণ্ডিতগণ তাদের মাতৃভাষা ফারসির পরিবর্তে আরবিতে জ্ঞানচর্চা এবং গ্রন্থ রচনা করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এ সম্পর্কে ফেরদৌসি তার শাহনামাতেই উল্লেখ করেছেন,
বাসি রান্জ বোরদাম দার ইন সালে সি
আজাম জেন্দে কারদাম বেদিন পারেসি
(এই ত্রিশ বছর অনেক কষ্ট করেছি
এই ফারসির মাধ্যমে পারস্যকে পুনরুজ্জীবিত করেছি)
গজনীতে ফেরদৌসি শাহনামা শুরু করেছিলেন ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে আর শেষ করলেন ১০১০ খ্রিস্টাব্দে, ষাট হাজার শ্লোকে। কিন্তু নিয়তির কী নির্মম পরিহাস। শাহনামা রচনার সূচনাকালেই ফেরদৌসি যে ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে আটকা পড়ে গিয়েছিলেন তা থেকে আর বেরুতে পারলেন না। রচনা সমাপ্ত করে ফেরদৌসি যখন সুলতান মাহমুদের হস্তে এই উপঢৌকন তুলে দিলেন এবং রাজদরবারে এটি পাঠ করা হলো তখন নিন্দুকেরা এর কাহিনী শুনে বলতে লাগল জাহাপনা একি করেছে ফেরদৌসি? আপনার ফরমায়েশে লেখা শাহনামায় আপনার গুণকীর্তন খুব অল্প জায়গাজুড়ে রয়েছে, সমস্ত জায়গাজুড়ে দেখছি অন্যান্য রাজ-রাজড়াদের কাহিনী-কীর্তন। নিন্দুকদের কথা সত্যি হলেও এর উদ্দেশ্য যে মহত নয় সেটি সুলতান বুঝতে পারলেন না। এটি তো খুবই স্বাভাবিক যে, চার হাজার বছরের ইরানের কথা-কিংবদন্তি, লোকবিশ্বাস আর পারস্যের প্রাগৈতিহাসিক বাদশাহ কিয়ুমার্সসহ উনচল্লিশ জন রাজরাজড়া ও শতাধিক মহৎ বীরের শৌর্যগাথা বিবৃত হওয়া ষাট হাজার শ্লোকে সুলতান মাহমুদের মাত্র ত্রিশ বছর শাসনকালের বর্ণনা এরচে’ বেশি জায়গাজুড়ে স্থান দেওয়া কি যুক্তিযুক্ত ছিল?
কিন্তু সুলতান সেই যুক্তি-বিচারে না গিয়ে নিন্দুকদের কথায়ই কান ভারি করলেন। নিজের প্রতিশ্রুত প্রতিটি পঙ্ক্তির বদলে একটি করে স্বর্ণমুদ্রা না দিয়ে কবিকে ষাট হাজার রৌপ্য মুদ্রা প্রদানের নির্দেশ করলেন। সুলতানের এই অবিচক্ষণতা ও অবিবেচনা দেখে ফেরদৌসি বিস্মিতই শুধু হলেন না, ভীষণ রকম মর্মাহতও হলেন। সুলতানের পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে পরদিন ভোরে কাউকে কিছু না বলেই গজনী ত্যাগ করে স্বীয় জন্মভূমি তুসে চলে গেলেন কবি। তবে যাবার আগে সুলতানের এহেন আচরণের জবাবে একটি নিন্দাসূচক কবিতা রচনা করে তার একটি কপি রাজকীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত শাহনামার একটি কপির শেষে সংযুক্ত করে গেলেন। আর একটি কপি টাঙিয়ে দিয়ে গেলেন গজনীর শাহি মসজিদের দেয়ালে। যেখানে অভিমানি কবি সুলতানের বংশ পরিচয় নিয়ে এভাবেই প্রশ্ন তুলেছেন,
সুলতান যদি (স্বভাবে) দরিদ্র না হতেন,
তবে আমাকে আজ সিংহাসনে বসানো হতো।
কাজেই আশা করবো, কোনো নরপতির মধ্যে যেন দীনতার অস্তিত্ব মাত্র না থাকে,
পৌরুষের সঙ্গে যেন দারিদ্র্যের সহ-অবস্থান না ঘটে।
প্রজ্ঞার উপর সুলতানের ছিল না কোনো অধিকার,
থাকলে তিনি আমাকে আজ নিশ্চিতই সিংহাসনে বসাতেন।
সিংহাসনের অধিকারী যদি অভিজাত না হয়,
তবে সিংহাসনধারীগণের স্মৃতি তার মনে উদিত হতে পারে না।
সুলতানের পিতা যদি সুলতান হতেন,
তবে আমার শিরে আজ রক্ষিত হতো স্বর্ণ-মুকুট
যদি সুলতানের মাতা কোনো রাজপরিবারের কন্যা হতেন,
তবে আমাকে জঙ্ঘাদেশ পর্যন্ত প্রোথিত করা হতো স্বর্ণ-রৌপ্যের স্তূপের মধ্যে।
যদি বংশমধ্যে মাহাত্ম্য না থাকে,
তবে মহত্ত্বের লক্ষণ সেখানে কেমন করে প্রকাশ পাবে?
হে উঁচুবংশীয় নরপতি মাহমুদ, তোমার মুখে থুথু!
এই নিন্দাকবিতাটি বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে এত বেশি পরিচিত যে, শাহনামার অপর কোনো একটি পঙ্ক্তিও যাদের জানা নেই তারাও এই অপবাদ-সূচক কবিতাটির দু’চার পঙ্ক্তির উদ্ধৃতি দিতে পারেন। ফেরদৌসি এতে যে শুধু সুলতান মাহমুদের নিন্দাই করেছেন তাই-ই নয়, বরং এই নিন্দা-কবিতায় তিনি তার কাব্যপ্রতিভা ও শাহনামার স্থায়িত্ব নিয়ে তার যে আত্মবিশ্বাসমূলক উক্তি করেছেন কালের বিবর্তনে তা আজ মহাসত্যে পরিণত হয়েছে। এতে ফেরদৌসি আরও বলেছিলেন,
বহু অর্থময় বাণীর মুক্তা আমি এতে গ্রথিত করেছি।
যদি পৃথিবীতে ফেরদৌসির জন্ম না হতো,
তবে তরুতে উদ্গত হতো না বদান্যতার কিশলয়।
যদি এই কাহিনীর দিকে আমি দৃষ্টিপাত না করতাম,
তবে তা মিথ্যাবাদীদের দ্বারা অন্যপথে পরিচালিত হতো।
যারা আমার এই কবিতাকে তুচ্ছজ্ঞান করবে,
আবর্তমান আকাশ তাদেরকে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যাবে না।
আমি এই কাব্যে প্রাচীন সম্রাটদের কাহিনীর মাধ্যমে
নিজেদেরই কথা সূক্ষ্মভাবে বর্ণনা করেছি।
বাণীর মাধ্যমে ধরিত্রীকে আমি ফুলবনের অনুরূপ করে সাজিয়েছি,
আমার পূর্বে বাণীর এমন বীজ কেউ আর বপন করতে পারেনি।
অগণিত কবি জন্মেছেন এই পৃথিবীতে,
তারা সংখ্যায় অনেক ছিলো তাও স্বীকার করি,
কিন্তু একথা নিশ্চিত যে, এমন করে কেউ আর বলতে পারেননি।
দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে পরিশ্রমের পর
এই পারসি দ্বারা ইরানকে আমি পুনরুজ্জীবিত করে গেলাম।
সুলতান মাহমুদের আচরণে বিস্মিত হয়ে লেখা নিন্দাসূচক এই দীর্ঘ কবিতায় ফেরদৌসি সুলতান মাহমুদের নিন্দার পাশাপাশি সংক্ষেপে এর বিষয়বস্তুর প্রতিও এভাবে আলোকপাত করেছেন,
এই কাহিনীতে আমি ত্রিশ হাজার শ্লোকের পানপাত্র আবর্তিত করেছি,
তাতে কীর্তিত হয়েছে রণক্ষেত্রের রীতি-নীতি;
আমি এতে বর্ণনা করেছি তীরধনুক ও পাশের কথা,
প্রহরণ ও তরবারির কার্যকারিতার কথা এতে ব্যক্ত হয়েছে।
এতে আছে বর্ম, তনুত্রাণ ও শিরস্ত্রাণ,
আছে অরণ্য ও সমুদ্র, আছে মরুভূমি ও বহতা নদী;
নেকড়ে, সিংহ, হস্তী ও ব্যাঘ্রের কথাও এখানে রয়েছে,
দৈত্য, আজদাহা ও নত্রের রূপকথাও স্থান পেয়েছে এতে।
এতে আছে মন্ত্রোচ্চারণকারীদের মন্ত্র ও দৈত্যদের ইন্দ্রজাল,
যাদের গর্জন বায়ুরাশিকে দীর্ণ করেছে।
যুদ্ধের দিনে শক্তিপরীক্ষায় যেসব বীর
তাদের বীরত্ব ও ঔদ্ধত্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন,
সেই সব খ্যাতনামা ও পরম সম্মানিত পুরুষের কাহিনীও বর্ণিত হয়েছে এই কাব্যে;
তাদের মধ্যে রয়েছেন তূর, সুলম্ ও আফ্রাসিয়াবের মতো নরপতি;
রয়েছেন ফারেদুন ও কায়কোবাদের অনুরূপ বাদশাহ,
জোহাকের মতো বিধর্মী, অত্যাচরী ও অসভ্য সম্রাটের কথাও এতে আছে।
আরো আছেন, গার্শাসপ ও নূরীমান-পুত্র সামের মতো বীর-
যারা বিশ্ববিখ্যাত পুরুষদেরকেও পরাভূত করতে সক্ষম হয়েছেন।
হোশাঙ্গ ও দৈত্যদমন তহমূরসের কাহিনীও এতে আছে,
আছে মুনুচেহের ও সমুচ্চ সম্রাট জামশেদের কীর্তিগাথা।
কায়কাউস ও কায়খসরুর মতো মুকুটধারী সম্রাট
এবং রুস্তম ও ইসফান্দিয়ারের অনুরূপ সেনাপতিদের কাহিনীও
বর্ণিত হয়েছে এই ‘নামায়’।
জীবন ও জগৎ ব্যাপকাকারে চিত্রিত হলেও, হোমারের ইলিয়ড-ওডিসি কিংবা ভারতবর্ষের রামায়ণ-মহাভারত কিংবা প্রাচীন মিসরের গিলগামেশ যে ধরনের মহাকাব্য, শাহনামা সে ধরনের মহাকাব্য নয়। ইলিয়ড-ওডিসি, রামায়ণ-মহাভারত ও গিলগামেশ-এর নিয়ামক শক্তি কাল নয় স্থান। সেখানে গ্রিস ও ট্রয়, অযোধ্যা ও লঙ্কা, হস্তিনাপুর ও কুরুক্ষেত্র এবং প্রাচীন মিসরকে কেন্দ্র করেই ঘটনা আবর্তিত হয়েছে; একের পতনে অন্যের মহিমা সেখানে ভাস্বর। অন্যপক্ষে ফেরদৌসির শাহনামাকে নিয়ন্ত্রিত করেছে মহাকাল। যে কালের বহমান স্রোতে ঘটনা ও স্থান মুহূর্তের জন্য উদ্ভাসিত হয়ে বিলীন হয়ে যায়, সেখানে রাজা ও রাজবংশের উত্থান-পতনে, বীরদের শৌর্যে ও সম্রাটদের মহানুভবতায় এক মূল্যবোধের উদ্ভব ঘটেছে, এবং শেষ পর্যন্ত তা মানুষের হাতে আসছে উত্তরাধিকার সূত্রে ইতিহাসেরই শিক্ষা হয়ে। তবে তাই বলে শাহনামা ইতিহাস গ্রন্থ হয়ে ওঠেনি। শাহনামা হয়ে উঠেছে মহাকালের মহাকথন। ইতিহাসের অস্থিসংস্থান অতিক্রম করে সেখানে দেদীপ্যমান হয়ে উঠেছে কবির কল্পনা। জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সহায়তায় জীবনের এমন এক প্রবহমানরূপ সেখানে ফুটে উঠেছে, যার পটভূমিতে কখনও সমতলভূমি, কখনও পর্বত, কখনও নদী-উপত্যকা, কখনও মরুভূমি, কখনও দীপাবলী সজ্জিত সমুন্নত নগরী। এই পটভূমি ইরান-তুরান, চীন-ভারত যাই হোক না কেন, কবি তা অবলীলায় অতিক্রম করে চলেছেন। কালাশ্রিত হয়েও কালাতীত তেমন মূল্যবোধের ওপরই স্থাপিত হয়েছে শাহনামার সৌধ। সত্যের জয় ও মিথ্যার পরাজয়ের ওপরই চিরদিন মহৎ কাব্যের বিষয়বস্তু সংস্থিত হলেও শাহনামায় তা মানবীয় প্রজ্ঞার কেন্দ্রস্থলে বিরাজ করে প্রত্যেকটি ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করছে; বলকে উজ্জীবিত করছে বীর্যে।
ফেরদৌসীর শাহনামার ইতিহাস পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে শুরু করে সপ্তম শতাব্দীতে পারস্যে ইসলামের বিজয় পর্যন্ত সম্প্রসারিত। এতে তিনি অন্তর্ভুক্ত করেছেন ৬২টি আখ্যান, ৯৯০টি অধ্যায় এবং ৬০ হাজার পঙ্ক্তি। এ এক বিস্ময়কর শক্তির পরিচায়ক। প্রাচীন ইতিহাসনির্ভর মহাকাব্যে মৌখিক এবং লিখিত সাহিত্যের যে পরস্পর প্রবিষ্ট সাহিত্যশৈলী লক্ষ্য করা যায় শাহনামাতেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। এটি প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশধারা সংক্রান্ত এক অতুলনীয় আকর গ্রন্থ। এতে যেমন প্রাক-ইতিহাস, ইরান ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের সভ্যতা বিকাশের নানা উপাদান যেমন- আগুনের ব্যবহার, রান্নাবান্না, আইন-কানুন ও সামাজিক বিধিবিধানসহ বহু বিষয় যুক্ত হয়েছে, তেমনি সহস্রাধিক বছরের কালক্রমিক ইতিহাস ও মানব সমাজের ইতিহাসের ধারায় পথচলার নানা মূল্যবান বিবরণও এতে পাওয়া যায়। এসব বর্ণনায় তিনি যে বিষয়টির ওপর জোর দিয়েছিলেন তা হলো এই পৃথিবী চলমান এবং এই পৃথিবীতে মানুষ ইতিহাসের পথে যুগযুগান্তের পথপরিক্রমায় আসে আর যায়। সে–
“যদি পৃথিবীতে ফেরদৌসির জন্ম না হতো, তবে তরুতে উদ্গত হতো না বদান্যতার কিশলয়। যদি এই কাহিনীর দিকে আমি দৃষ্টিপাত না করতাম, তবে তা মিথ্যাবাদীদের দ্বারা অন্যপথে পরিচালিত হতো। যারা আমার এই কবিতাকে তুচ্ছজ্ঞান করবে, আবর্তমান আকাশ তাদেরকে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যাবে না। আমি এই কাব্যে প্রাচীন সম্রাটদের কাহিনীর মাধ্যমে নিজেদেরই কথা সূক্ষ্মভাবে বর্ণনা করেছি। বাণীর মাধ্যমে ধরিত্রীকে আমি ফুলবনের অনুরূপ করে সাজিয়েছি, আমার পূর্বে বাণীর এমন বীজ কেউ আর বপন করতে পারেনি। অগণিত কবি জন্মেছেন এই পৃথিবীতে, তারা সংখ্যায় অনেক ছিলো তাও স্বীকার করি।”
বিরাজ করে প্রত্যেকটি ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করছে; বলকে উজ্জীবিত করছে বীর্যে।
ফেরদৌসীর শাহনামার ইতিহাস পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে শুরু করে সপ্তম শতাব্দীতে পারস্যে ইসলামের বিজয় পর্যন্ত সম্প্রসারিত। এতে তিনি অন্তর্ভুক্ত করেছেন ৬২টি আখ্যান, ৯৯০টি অধ্যায় এবং ৬০ হাজার পঙ্ক্তি। এ এক বিস্ময়কর শক্তির পরিচায়ক। প্রাচীন ইতিহাসনির্ভর মহাকাব্যে মৌখিক এবং লিখিত সাহিত্যের যে পরস্পর প্রবিষ্ট সাহিত্যশৈলী লক্ষ্য করা যায় শাহনামাতেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। এটি প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশধারা সংক্রান্ত এক অতুলনীয় আকর গ্রন্থ। এতে যেমন প্রাক-ইতিহাস, ইরান ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের সভ্যতা বিকাশের নানা উপাদান যেমন- আগুনের ব্যবহার, রান্নাবান্না, আইন-কানুন ও সামাজিক বিধিবিধানসহ বহু বিষয় যুক্ত হয়েছে, তেমনি সহস্রাধিক বছরের কালক্রমিক ইতিহাস ও মানব সমাজের ইতিহাসের ধারায় পথচলার নানা মূল্যবান বিবরণও এতে পাওয়া যায়। এসব বর্ণনায় তিনি যে বিষয়টির ওপর জোর দিয়েছিলেন তা হলো এই পৃথিবী চলমান এবং এই পৃথিবীতে মানুষ ইতিহাসের পথে যুগযুগান্তের পথপরিক্রমায় আসে আর যায়। সে জন্যই তাদের বিজ্ঞতার সঙ্গে নিষ্ঠুরতা, মিথ্যাচার এবং সব অশুভ কল্পনা বর্জন করে সুবিচার, সত্য, ন্যায়, শৃঙ্খলা এবং অন্যান্য গুণ অর্জন করে বিশ্বসভ্যতায় তার ছাপ রেখে যাবে।
ফেরদৌসী তার শাহনামা রচনা সমাপ্ত করেন ১০১০ খ্রিস্টাব্দে। ২০১০ খ্রিস্টাব্দে এ গ্রন্থের সহস্রবর্ষ পূর্ণ হলেও সারাবিশ্বে এর আবেদন এখনও একটুও কমেনি। এ যেন শাহনামার অন্তে যুক্ত সুলতান মাহমুদকে ভর্ৎসনা করে রচিত নিন্দাকাব্যে ফেরদৌসি যে আত্মবিশ্বাস ব্যক্ত করেছিলেন তারই কালোত্তীর্ণ জাজ্বল্য প্রমাণ। শাহনামা ইরান-তুরানের রাজরাজড়া ও বীরদের কাহিনী হওয়া সত্ত্বেও আজ তা বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছে। দীর্ঘ সহস্র বছরেও শাহনামার জ্ঞান-প্রভা একটুও মøান না হয়ে বরং দিন দিন আরও উজ্জ্বলতর হয়েছে। বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়ে পঠিত ও সমাদ্রিত হয়েছে ফেরদৌসির শাহনামা। এর অন্যতম আখ্যান সোহরাব-রুস্তম আজ আর ইরান-তুরানের কাহিনী নয়। বাংলাদেশের জনমানুষের সঙ্গে এর কাহিনী অবিচ্ছেদ্য সূত্রে জড়িয়ে আছে। আমাদের যাত্রায়, নাটকে, লোককথায় এ কাহিনী এমনভাবে সম্প্রচার লাভ করেছে যে, আজ আর একে বিদেশি বলে চেনার উপায় নেই। এ যেন আমাদের ঐতিহ্যেরই অংশ। এই গুরুত্বের দিকে লক্ষ্য করেই পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার মতো বাংলা ভাষায়ও শাহনামার পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেন কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফ এবং বাংলা একাডেমী সেটি প্রকাশও করে।
কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফকে বাংলা একাডেমী শাহনামার বঙ্গানুবাদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে। অনুবাদের শেষ কিস্তি পাণ্ডুলিপি তিনি দেন ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে। এ হিসাব মতে শাহনামা রচনা শেষ করতে ফেরদৌসির যেখানে সময় লেগেছিল ত্রিশ বছর তার অনুবাদ শেষ করতে কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফের সময় লাগে সতেরো বছর। তবে ফেরদৌসির মতো মনিরউদ্দীনকেও বরণ করতে হয় একই বঞ্চনার ভাগ্য। ফেরদৌসি তার জীবৎকালে ষাট হাজার স্বর্ণ মুদ্রা পাননি। সুলতান মাহমুদের স্বর্ণ মুদ্রা যখন ফেরদৌসির বাড়ির দরজায় পৌঁছে তখন আরেক দরজা দিয়ে ফেরদৌসির শবযাত্রা বের হচ্ছে। বাংলা একাডেমীও মনিরউদ্দীন ইউসুফের জীবদ্দশায় এর পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ প্রকাশ করতে পারেনি। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বময় শাহনামা রচনার সহস্রবার্ষিকী উৎসব উপলক্ষে বাংলা একাডেমী অনুবাদকের পরিকল্পনা অনুসারে ছয় খণ্ডে সমগ্র শাহনামার বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করে। যদিও এর প্রথম কিয়দংশ দুটি খণ্ডে, যথাক্রমে ১৯৭৭ ও ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমী প্রকাশ করেছিল।
তবে ভারতীয় উপমহাদেশে শাহনামার একটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ সংকলন প্রকাশিত হয় আরও অনেক আগে, ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে। এটি সঙ্কলন ও সম্পাদনা করেন টি. ম্যাকান। সতেরটি পাণ্ডুলিপির তুলনামূলক যৌগিত সম্পাদনার মাধ্যমে এটি প্রস্তুত করা হয়। ফ্রান্স, রাশিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে শাহনামার বেশ ক’টি গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কলন প্রকাশিত হলেও ভারতবর্ষের অন্য কোনো অঞ্চলে ম্যাকানের সঙ্কলনের আগে এর পূর্ণাঙ্গ, সুসম্পাদিত
সঙ্কলনের খবর আমরা পাই না। তবে মুঘল সম্রাটরা যে এ গ্রন্থটি গুরুত্বের সঙ্গে পাঠ করতেন তার প্রমাণ আছে বাবর, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান প্রমুখের শাহনামার সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে। কারণ প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর শাহনামা থেকে কিছু পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করেছিলেন। বাংলার নবাব আলীবর্দী খাঁও শাহনামা পাঠ করে উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন এমন সংবাদ জানা যায়।
ইতোপূর্বে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে শাহনামা বিষয়ে কোনো কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও এই গ্রন্থের কোনো সম্পূর্ণ সঙ্কলন ইতোপূর্বে প্রকাশিত হয়নি। বাংলা একাডেমীর প্রথম শাহনামার পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন। প্রকাশের পর থেকেই এটি ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায়। তাই অল্প ক’বছরেই এর সব কপি নিঃশেষ হয়ে যায়। বাংলা ভাষাভাষী বেশির ভাগ পাঠকই অতৃপ্ত থেকে যান এই মহাকথন পাঠ করতে না পেরে। তাদের এই অতৃপ্তির কথা ভেবেই দীর্ঘদিন পর হলেও ২০১২ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমী এর দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশ করেছে। বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের প্রতি এই সম্মান প্রদর্শনের জন্য বাংলা একাডেমী নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ প্রাপ্ত।
বলাবাহুল্য শাহনামার বাংলা অনুবাদের প্রথম মুদ্রণে অর্থায়ন করেছিল ইরান সরকার। দ্বিতীয় সংস্করণ সম্পূর্ণ বাংলা একাডেমীর অর্থায়নেই প্রকাশিত হয়েছে। সে জন্য শাহনামা পাঠকদের পক্ষ থেকে বাংলা একাডেমীর প্রতি রইল আরও একটি বিশেষ ধন্যবাদ। আর পাঠকদের আমন্ত্রণ রইলো এই মহাকাব্য অধ্যয়নের।