জামেয়া ওয়েবসাইট

শুক্রবার-২৯শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলায় ইসলাম প্রচারে সুফী দরবেশদের ভূমিকা

বাংলায় ইসলাম প্রচারে সুফী দরবেশদের ভূমিকা

বাংলায় ইসলাম প্রচারে সুফী দরবেশদের ভূমিকা

মীম জহির

মুসলিম বণিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম বাংলাদেশে ইসলামের সূচনা হয় এবং প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠা লাভ করে আলেম ও সুফি সাধকদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও ঐকান্তিক নিষ্ঠার ফলে। আরব, ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, খোরাসান, মধ্য এশিয়া ও উত্তর ভারত থেকে আলেম ও সুফীগণ বাংলায় আগমন করেন। ইসলাম প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে তারা এক অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন। তাঁদের চারিত্রিক মাধুর্যে উজ্জীবিত হয়ে হিন্দু ও অন্যান্য সম্প্রদায় দলে দলে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নেয়।

স্বাভাবিক কারণেই তৎকালীন হিন্দু ও অন্য শাসকবর্গ ইসলাম প্রচারকদের উপর ক্ষেপে উঠেন এবং সুফীদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালাতে থাকেন। কাজেই প্রচার কাজে নিয়োজিত সুফীগণ ও তাদের শিষ্যদের সমভিব্যাহারে সমস্ত রাজাদের বিরুদ্ধে অসি চালনা করতে হয়েছিল। এ ময়দানে অনেকে হয়েছেন শহীদ আবার অনেকে হয়েছেন গাজী।

বাংলায় মুসলিম বিজয়ের পূর্বে যে সকল সুফীগণ ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এদেশে আগমন করেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন:

শাহ মুহাম্মদ সুলতান রুমী: বাঙ্গালার সুবাদার শাহসুজার সনদপত্রে উল্লেখিত হয়েছে যে, শাহ মুহাম্মদ সুলতান রুমী ১০৫৩ সালে তাঁর মুরশিদ সৈয়দ শাহ সুখখুল আনাতিয়াসহ ময়মনসিংহ জেলার মদনপুরে আসেন। মদনপুরেই তাঁর মাযার বিদ্যমান।

শাহ সুলতান বলখী মাহী সাওয়ার: তিনি প্রথমে ঢাকার হরিরামপুর নগর এবং পরে বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ে ইসলাম প্রচার করেন। মৎস্যাকৃতি নৌকায় সমুদ্রপথে বাংলায় আগমন করার কারণে তিনি মাহী সাওয়ার ওলী নামে খ্যাত।

বাবা আদম শহীদ: রাজা বল্লাল সেনের শাসনামলে (১১৫৮-৭৯) তিনি ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার আবদুল্লাহপুর গ্রামে ইসলাম প্রচার করতে আসেন। যুদ্ধে তিনি শহীদ হন এবং এখানেই তাঁর মাযার অবস্থিত।

মাখদুম শাহ দৌলা শহীদ: ইয়ামেনের অধিবাসী মাখদুম শাহ দৌলা এক বোন, তিন ভাগিনা ও বহু শিষ্যসহ পাবনা জেলার শাহজাদপুর অঞ্চলে আগমন করেন। ইসলাম প্রচারের এক পর্যায়ে স্থানীয় হিন্দু রাজার সাথে এ দরবেশের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মাখদুম শাহসহ ২১ জন মুজাহিদ শহীদ হন। এরপর সমগ্র বগুড়া অঞ্চলে ইসলাম দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

শাহ নেয়ামতুল্লাহ বুতশিকন: মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার বহু আগে শাহ নিয়ামতুল্লাহ ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসেন। ঢাকা নগরীর সন্নিহিত এলাকায় তিনি ইসলাম প্রচার করেন। একদা হিন্দুরা তাঁর ইবাদতে বিঘ্ন ঘটালে তিনি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে হিন্দুদের মূর্তির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করতেই মূর্তিগুলো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। এরপর হিন্দুরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে। ঢাকার দিলকুশায় তাঁর মাযার অবস্থিত।

সৈয়দ নাসিরউদ্দীন শাহ আউলিয়া: তিনি দিনাজপুর জেলার প্রাচীনতম ইসলাম প্রচারক। ওই অঞ্চলে তিনি সৈয়দ নেকমদ’বা নেকবাবা বলে পরিচিত।

জালালুদ্দীন তাবরিযী: পারস্যের তাবরিজ নগরে জন্মগ্রহণকারী জালালুদ্দীন তাবরিজী সুলতান গিয়াস উদ্দীন খিলজীর শাসনামলে তৎকালীন বাংলার রাজধানী মালদহ জেলার লাখনৌতি নগরে উপনীত হন এবং রাজধানী থেকে ১৭ মাইল দূরে পান্ডুয়ায় আস্তানা স্থাপন করেন। বাংলার উচ্চশ্রেণীর হিন্দু ও বৌদ্ধসমাজ তাঁর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। মুসলিম বিজয়ের পূর্বে আরো যে সকল সুফী এদেশে আগমন করেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মাখদুম শাহ, গজনবী, বায়েজীদ বোস্তামী, শায়খ ফরিদ উদ্দীন শকরগঞ্জ প্রমুখ।

মুসলিম বিজয়ের পর যে সকল সুফী-আলেমগণ ইসলাম প্রচারের জন্য এদেশে আগমন করেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন:

শেখ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা: বুখারার অধিবাসী সুফী শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা বিহারের মানের হয়ে বাংলার সোনারগাঁও আসেন সুলতান বুগরাখান ও সুলতান রুকনউদ্দীন কায়কাউসের শাসনামলে। তিনিই প্রথম এদেশে বোখারী শরীফ নিয়ে আসেন। সোনারগাঁও-এ তিনি ইসলামী শিক্ষার কেন্দ্র গড়ে তোলেন। ১৩০০ সালে ইন্তেকালের পর সোনারগাঁও-এ তিনি সমাধিস্থ হন।

শরফুদ্দীন এহিয়া মানেরী: বিহারের অধিবাসী মানেরী ১৫ বছর বয়সে শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামার সাথে সোনারগাঁও-এ আসেন। মানেরী ছিলেন সোনারগাঁও শিক্ষা কেন্দ্রের জ্ঞানের নিদর্শন।

মাওলানা আতা: ১৩০০ থেকে ১৩৫০ সালের মধ্যে মাওলানা আতা দিনাজপুরে ইসলাম প্রচার করেন। ১৩৬৩ সালে নির্মিত একটি গৃহের শিলালিপিতে তাঁকে ইসলামের বিশেষ পন্ডিত এবং সত্য ও ধর্মের প্রদীপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

হযরত শাহাজালাল ইয়ামেনী: পূর্ববাংলায় ইসলাম প্রচারের প্রধান পথিকৃত এই সনামধন্য সুফী দরবেশ ১৩০৩ সালে রাজা গৌড়গোবিন্দকে পরাজিত করে সিলেট অধিকার করেন। এই যুদ্ধে তাঁর সিপাহসালার ছিলেন সৈয়দ নাসির উদ্দীন। মুসলিম আনুমানিক ১৩৪৭ সালে সিলেটেই ইন্তেকাল করেন। বিশ্ব পর্যটক ইবনে বতুতা বলেন, বাংলার অধিকাংশ লোক তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। সিলেটে তাঁর মাযার অবস্থিত।

সাইয়েদ আহমদ কল্লা শহীদ: তিনি শাহজালালের অন্যতম শিষ্য ছিলেন। পরগনায় ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে হিন্দু রাজা আচক নারায়ণের সাথে যুদ্ধে শহীদ হন। ভক্তরা তাঁর কর্তিত মস্তকের সন্ধান পেয়ে তা আখাউড়ার খড়মপুর গ্রামে সমাধিস্থ করেন। আর একারণেই তিনি কল্লা শহীদ নামে পরিচিত।

শাহ মাখদুম রূপোশ: বর্তমান রাজশাহী জেলার পূর্বনাম ছিল মহাকাল গড়। ১২২৫ সালে বাগদাদ থেকে ইসলাম প্রচার করতে এসে তিনি মহাকাল গড় জয় করেন এবং এখানে ইসলাম প্রচার করেন। ১৩০৩ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন।

শেখ নূর কুতুবুল আলম: তিনি ছিলেন বাংলার ইলিয়াছশাহী বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের সহপাঠী। তিনি তৎকালীন অবৈধ, কুখ্যাত রাজা গণেশের পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেন।

খাজা খানজাহান আলী: সর্বজনমান্য দরবেশ হিসেবে সুপরিচিত খানজাহান আলীই দক্ষিণ বঙ্গজয়ের কৃতিত্বের অধিকারী। পরবর্তী ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনামলে তিনি দক্ষিণবঙ্গ জয় করেন।

এ দরবেশ শাসনকর্তা বাগেরহাট শহর নির্মাণ করেন, এবং ঐ অঞ্চলের নামকরণ করেন খলিফতাবাদ, বহু রাস্তা, দীঘি, মসজিদ, শিক্ষালয় এবং বাগেরহাটের ষাট গুম্বুজ মসজিদ তিনিই নির্মাণ করেন।

শাহআলী বাগদাদী শাহআলী বাগদাদী বাংলায় আসেন ১৪৮৯ সালে। দিল্লী হয়ে প্রথমে তিনি ফরিদপুর আসেন। পরে তিনি ঢাকার আশে-পাশে ইসলাম প্রচার করেন। ঢাকার মিরপুরে তাঁর মাজার রয়েছে।

মুসলিম বিজয়ের পর আরও যারা ইসলাম প্রচার করেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন,

উলুগ-ই-আজম হুমায়ন জাফরখান বাহরাম: তিনি দিনাজপুরের দেবীকোট অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন। পীর বদরুদ্দীন ইসলাম প্রচার করেন দিনাজপুরের হেমতাবাদ নামক স্থানে।

সৈয়দ জালালুদ্দীন বুখারী: ইসলাম প্রচার করেন রংপুর জেলার মাহীগঞ্জে। ৪০ জন ইসলাম প্রচারকের একটি দল দিনাজপুর অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন, যাদেরকে চিহিল গাজী বলা হতো।

খাজা চিশতী বেহেশতী আকবরের শাসনামলে ঢাকায় ইসলাম প্রচার করতে আসেন। ঢাকার হাইকোর্টের পার্শ্বে তার সমাধি রয়েছেন। এরা ব্যতীত আরো রয়েছেন সায়্যিদ আব্বাস আলী মক্কী, শাহ সুফী শহীদ, শায়খ আবদুল্লাহ কিরমানী, মাওলানা তাকিউদ্দীন আরাবী, শাহতুর্কান শহীদ, পীর বদর আলম, শেখ রোজা বিয়াবানী, আখি সিরাজউদ্দীন উসমান, শেখ আলাউল হক, শাহ আফজল মাহম্মুদ শায়খ জালাল হালবী, শাহ সুলতান আনসারী, শাহ চাঁদ আওলিয়া।

ইংরেজ শাসনামলের সময়ে বাংলায় যারা ইসলাম প্রচার করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন,

হাজী শরীয়াতুল্লাহ (রহ.) ১৭৮০ সালে মাদারীপুর মহকুমার শামাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইংরেজ শাসন ও তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন পরিচালনা করেন। তিনি ইসলামের সংস্কার করেন এবং ভন্ডপীর ও বেদাতীদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। তাঁর পরিচালিত আন্দোলন ফরায়েজী আন্দোলন নামে পরিচিত।

মাওলানা আবুবকর সিদ্দিক (রহ.) ১৮৪১ সালে কলকাতার হুগলী জেলার ফুরফুরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সুফী ফতেহ আলীর নিকট তিনি বয়াত গ্রহণ করেন। মাওলানা আবুবকরের সংস্কার ছিল বহুমুখী ও গঠনমূলক।

মাওলানা নেছার উদ্দীন (রহ.) বরিশালের বর্তমান পিরোজপুর জেলার ছারছীনা গ্রামে তাঁর জন্ম। তিনি ফুরফুরার আবু বকর সিদ্দিকের শিষ্য ছিলেন। বাংলায় ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে তাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি। তিনি হাজার হাজার মসজিদ, মাদরাসা ও খানকা প্রতিষ্ঠা করেন।

মাওলানা সৈয়দ এছহাক (রহ.) বরিশালের চরমোনাইতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চরমোনাইতে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে ইসলাম প্রচার করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত চরমোনাইতে বর্তমানে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইসলামী সম্মেলন অুনষ্ঠিত হয়ে থাকে। এছাড়া বাংলায় ইসলাম প্রচারে আরো যাদের অবদান রয়েছে তাঁদের মধ্যে রয়েছেন, মাওলানা আবদুল্লাহাহিল কাফি (রহ.), মাওলানা সামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.), মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুযুর (রহ.), কিশোরগঞ্জের মাওলানা আতাহার আলী (রহ.), চট্টগ্রামের খতীবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাওলানা তাজুল ইসলাম (রহ.), সিলেটের মাওলানা সৈয়দ আবদুল করিম শায়খে কৌড়িয়া (রহ.) প্রমুখ।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ