‘মিশকাত শরীফ’ পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা…
হোছাইন মুহাম্মদ নাঈমুল হক
মিশকাত শরীফ। পৃথিবীখ্যাত হাদীস সংকলনগুলোর একটি। কিতাবটি মূলত ইমাম আবু মুহাম্মদ আল-হুসাইন ইবনে মাসউদ আল-বাগাওয়ী (মৃত্যু: ৫১৬ হি.) লিখিত মাসাবীহুস সুন্নাহ কিতাবের সংযোজিত সংকলন। যা ইমাম ওলি উদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ আল-খতীব আত-তিবরীযী (মৃত্যু: ৭৪১ হি.) রচনা করেন।
ইমাম বাগাওয়ী (রহ.) তাঁর কিতাবটি প্রসিদ্ধ হাদীস সংকলন, যথা- সহীহ আল-বুখারী, মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, জামে তিরমিযী ইত্যাদি গ্রন্থ থেকে সংকলন করেন। কিতাবটি লেখার ক্ষেত্রে ইমাম একটি বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করেন। এ বিষয়ে তিনি ভূমিকায় লিখেন,
وتجد أحاديث كل باب منها تنقسم إلىٰ صحاح وحسان، أعني بـ «الصّحاح» ما أخرجه الشيخان: أبو عبد الله محمد بن إسمعيل الجعفي البخاري، وأبو الحسين مسلم بن الحجاج القشيري النيسابوري ، في جامعهما، أو أحدهما.
وأعني بـ «الحِسان» ما أورده أبو داود سليمان بن الأشعث السجستاني وأبو عيسى محمد بن عيسى بن سورة الترمذي وغيرهما.
‘(পাঠক!) আপনি লক্ষ্য করে থাকবেন, কিতাবটির প্রত্যেক অধ্যায়ের হাদীসগুলো ‘সহীহ ও হাসান’ দু’ভাগে বিভক্ত। ‘সহীহ’ বলতে আমি সেসব হাদীস বুঝিয়েছি যা ইমাম … বুখারী ও ইমাম… মুসলিম উভয়ে অথবা উভয়ের কোন একজন তাঁদের কিতাবে উল্লেখ করেছেন। আর ‘হাসান’ বলে উদ্দেশ্য হলো, যেসব হাদীস ইমাম আবু দাউদ…, ইমাম তিরমিযী… ও অন্যান্যরা উল্লেখ করেছেন…।’
উলুমুল হাদীসের সাথে পরিচিত জনরা জানেন, কেবল বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীসের ক্ষেত্রে ‘সহীহ’ ও বাকি কিতাবের হাদীসের ক্ষেত্রে ‘হাসান’ পরিভাষার প্রয়োগ মুহাদ্দিসগণের পরিচিত পরিভাষা নয়। কারণ বুখারী ও মুসলিম শরীফের সব হাদীস সহীহ হলেও সুনানে আবু দাউদসহ অন্যান্য কিতাবগুলোতে সহীহ, হাসান, যয়ীফ, মুনকার এমনকি কোন কোন কিতাবে মওযু হাদীসও রয়েছে। তাই ইমাম ইবনুস সালাহ (রহ.) তাঁর উলুমুল হাদীস বিষয়ক প্রসিদ্ধ আল-মুকাদ্দিমায় ইমাম বাগাওয়ী (রহ.)-এর পদ্ধতি সম্পর্কে মন্তব্য করে লিখেন,
مَا صَارَ إِلَيْهِ صَاحِبُ «الْـمَصَابِيْحِ r مِنْ تَقْسِيْمِ أَحَادِيْثِهِ إِلَىٰ نَوْعَيْنِ: الصِّحَاحِ وَالْـحِسَانِ، مُرِيْدًا بِالصِّحَاحِ مَا وَرَدَ فِيْ أَحَدِ الصَّحِيْحَيْنِ أَوْ فِيْهِمَا، وَبِالْـحِسَانِ مَا أَوْرَدَهُ أَبُوْ دَاوُدَ وَالتِّرْمِذِيُّ وَأَشْبَاهُهُمَا فِيْ تَصَانِيْفِهِمْ. فَهَذَا اصْطِلَاحٌ لَا يُعْرَفُ، وَلَيْسَ الْـحَسَنُ عِنْدَ أَهْلِ الْـحَدِيْثِ عِبَارَةً عَنْ ذَلِكَ. وَهَذِهِ الْكُتُبُ تَشْتَمِلُ عَلَىٰ حَسَنٍ وَغَيْرِ حَسَنٍ.
‘আল-মাসাবিহের লেখক (রহ.) তাঁর কিতাবের হাদীসকে ‘সহীহ ও হাসান’ দু’ভাগে বিভক্ত করে, সহীহ বলতে যেসব হাদীস বুখারী ও মুসলিমে বা উভয়টির কোন একটিতে এসেছে, হাসান বলতে যা আবু দাউদ, তিরমিযী ও অন্যান্যরা তাদের কিতাবে এনেছেন, তা অপরিচিত পরিভাষা। মুহাদ্দিসগণের কাছে হাসান বলতে এসব কিতাবের হাদীস বুঝায় না। কারণ এসব কিতাবে হাসান হাদীস যেমন রয়েছে, অন্যান্য হাদীসও (যেমন- সহীহ, যয়ীফ ও মুনকার) আছে।’
ইমাম নাওয়াওয়ী (রহ.) তাঁর তাকরীবুন নাওয়াওয়ী কিতাবে লিখেন,
وَأَمَّا تَقْسِيمُ الْبَغَوِيِّ أَحَادِيثَ «الْـمَصَابِيْحِ» إِلَى حِسَانٍ وَصِحَاحٍ مُرِيْدًا بِالصِّحَاحِ مَا فِي الصَّحِيْحَيْنِ، وَبِالْـحِسَانِ مَا فِي السُّنَنِ فَلَيْسَ بِصَوَابٍ؛ لِأَنَّ فِي السُّنَنِ الصَّحِيْحَ، وَالْـحَسَنَ، وَالضَّعِيْفَ، وَالْـمُنْكَرَ.
‘আল-বাগাওয়ী আল-মাসাবীহের হাদীসগুলোকে ‘হাসান ও সহীহ’ হিসেবে ভাগ করে, সহীহ বলতে যা বুখারী ও মুসলিম এ এসেছে এবং হাসান বলতে যা সুনানে এসেছে, এই বিভক্তি সঠিক নয়। কারণ সুনানে সহীহ, হাসান, যয়ীফ ও মুনকার হাদীসও রয়েছে।’
এতো গেল মিশকাতুল মাসাবীহ-এর মূল কিতাব মাসাবীহুস সুন্নাহ সম্পর্কিত আলোচনা। এবার আসা যাক মিশকাত শরীফের আলোচনায়।
মিশকাত শরীফ লেখার ক্ষেত্রে খতীব তিবরীযী (রহ.) কোন কোন বিষয়ে ইমাম বাগাওয়ী (রহ.)-কে অনুসরণ করেছেন নিম্নলিখিত বিষয়গুলোতে তা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়:
১. মিশকাত শরীফের অধ্যায় ও পরিচ্ছেদগুলো বিন্যাসের ক্ষেত্রে খতীব তিবরীযী (রহ.) পূর্ণভাবে ইমাম বাগাওয়ী (রহ.)-এর পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন।
২. খতীব তিবরীযী (রহ.) ইমাম বাগাওয়ী (রহ.)-এর ‘সহীহ ও হাসান’ সম্পর্কিত পরিভাষা বহাল রেখেই প্রত্যেক পরিচ্ছেদের হাদীস বিন্যাস করেছেন।
অন্যদিকে কিতাব দুটির মাঝে বেশ কিছু পার্থক্যও রয়েছে। পার্থক্যগুলো হলো:
১. ইমাম বাগাওয়ী (রহ.) কোনো একটি হাদীস উল্লেখ করার পর হাদীসটি তিনি কোন কিতাব থেকে সংগ্রহ করেছেন তা উল্লেখ করেননি। আবার বহু হাদীসের বর্ণনাকারীর নামও উল্লেখ করেন নি। পক্ষান্তরে খতীব তিবরীযী (রহ.) প্রত্যেক হাদীসের বর্ণনাকারী ও হাদীসটি কোন কিতাবে উল্লেখিত হয়েছে সে কিতাবের নাম উল্লেখ করেছেন।
২. খতীব তিবরীযী (রহ.) প্রত্যেক অধ্যায়কে তিনটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত করেছেন:
প্রথম পরিচ্ছেদে, ইমাম বাগাওয়ী কর্তৃক উল্লেখিত ‘সহীহ হাদীস’ তথা বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীসগুলো উল্লেখ করেছেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে, ইমাম বাগাওয়ী কর্তৃক উল্লেখিত ‘হাসান হাদীস’ তথা বুখারী ও মুসলিম শরীফ ব্যতীত বাকী কিতাবের হাদীসগুলো উল্লেখ করেছেন।
তৃতীয় পরিচ্ছেদে, নিজের পক্ষ থেকে আরো কিছু হাদীস যোগ করেছেন। যা বুখারী শরীফসহ অন্যান্য কিতাব থেকে তিনি নিজে সংগ্রহ করেছেন। [তিবরীযী, মিশকাত, খ. ১, পৃ. ৬Ñ৭]
৩. ইমাম বাগাওয়ী (রহ.) তাঁর মাসাবীহুস সুন্নাহ কিতাবে শুধু মুসনাদ হাদীস (নবীজী সা. থেকে বর্ণিত হাদীস) উল্লেখ করেছেন। পক্ষান্তরে খতীব তিবরীযী মিশকাত শরীফের প্রত্যেক বাবের তৃতীয় পরিচ্ছেদে মুসনাদ, মাওকূফ (সাহাবাদের থেকে বর্ণিত হাদীস) মাকতূ’ (তাবেয়ীদের মতামত) এমনকি পরবর্তীদের কথাও সংযোজন করেছেন।
৪. ইমাম বাগাওয়ী (রহ.) তাঁর কিতাবে কোন কোন হাদীস মূল শব্দে উল্লেখ করেননি। ক্ষেত্র বিশেষে মূল হাদীসের কোন কোন শব্দ পরিবর্তনও করেছেন। খতীব তিবরীযী (রহ.) হাদীস উল্লেখ করার ক্ষেত্রে (ইমাম বাগাওয়ী কর্তৃক উল্লেখিত হাদীসগুলোতেও) হাদীসের মূল শব্দ উল্লেখ করার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। ইমাম ইবনুস সালাহ আল-মুকাদ্দিমায় লিখেন
مَا أَخْرَجَهُ الْـمُؤَلِّفُوْنَ فِيْ تَصَانِيْفِهِمُ الْـمُسْتَقِلَّةِ كَالسُّنَنِ الْكَبِيْرِ لِلْبَيْهَقِيِّ، وَشَرْحِ السُّنَّةِ لِأَبِيْ مُحَمَّدٍ الْبَغَوِيِّ، وَغَيْرِهِمَا مِمَّا قَالُوا فِيهِ: «أَخْرَجَهُ الْبُخَارِيُّ أَوْ مُسْلِمٌ»، فَلَا يُسْتَفَادُ بِذَلِكَ أَكْثَرُ مِنْ أَنَّ الْبُخَارِيَّ أَوْ مُسْلِمًا أَخْرَجَ أَصْلَ ذَلِكَ الْـحَدِيْثِ مَعَ احْتِمَالِ أَنْ يَكُوْنَ بَيْنَهُمَا تَفَاوُتٌ فِي اللَّفْظِ، وَرُبَّمَا كَانَ تَفَاوُتًا فِي بَعْضِ الْـمَعْنَىٰ، فَقَدْ وَجَدْتُ فِي ذَلِكَ مَا فِيهِ بَعْضُ التَّفَاوُتِ مِنْ حَيْثُ الْـمَعْنَىٰ.
وَإِذَا كَانَ الْأَمْرُ فِيْ ذَلِكَ عَلَىٰ هَذَا فَلَيْسَ لَكَ أَنْ تَنْقُلَ حَدِيثًا مِنْهَا وَتَقُولَ: هُوَ عَلَىٰ هَذَا الْوَجْهِ فِي كِتَابِ الْبُخَارِيِّ أَوْ كِتَابِ مُسْلِمٍ، إِلَّا أَنْ تُقَابِلَ لَفْظَهُ، أَوْ يَكُونَ الَّذِيْ خَرَّجَهُ قَدْ قَالَ أَخْرَجَهُ الْبُخَارِيُّ بِهَذَا اللَّفْظِ.
‘যেসব লেখক হাদীসের আলাদা কিতাব লিখেছেন, যেমন- ইমাম বায়হাকীর আস-সুনান আল-কুবরা, আবু মুহাম্মদ আল-বাগাওয়ীর শরহুস সুন্নাহ এবং অন্যান্য কিতাব, তারা যদি নিজেদের কিতাবে কোন একটি হাদীস সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘হাদীসটি বুখারী বা মুসলিম উল্লেখ করেছেন’ তার অর্থ হচ্ছে হাদীসটির মূল অর্থ বুখারী বা মুসলিমে এসেছে। কিন্তু তার মাঝে শব্দগত পার্থক্য থাকতে পারে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থগত পার্থক্যও থাকতে পারে। আমি এরূপ অর্থগত পার্থক্যযুক্ত কিছু হাদীসও এসব কিতাবে পেয়েছি।
বিষয়টি যদি এমন হয়ে থাকে, তাহলে এসব কিতাব থেকে কোন হাদীস উল্লেখ করে, যাচাই বাচাই ছাড়া, তা বুখারী বা মুসলিমের কিতাবে এসেছে, বলা যাবে না। তবে যদি আপনি হাদীসটি বুখারী বা মুসলিমে এ শব্দে পেয়ে থাকেন বা লেখক নিজেই বলেছেন যে হাদীসটি বুখারীতে এ শব্দে উল্লিখিত হয়েছে তা ভিন্ন কথা।’
কিন্তু খতীব তিবরীযী (রহ.) হাদীস উল্লেখ করার ক্ষেত্রে মাসাবিহুস সুন্নাহের হাদীসগুলো, বিশেষত ইমাম বাগাওয়ী যেসব হাদীস বুখারী ও মুসলিম থেকে উল্লেখ করেছেন তা মূল কিতাবের শব্দসহ উল্লেখ করার চেষ্টা করেছেন। মিশকাতের ভূমিকায় তিনি লিখেন,
وَإِنْ عَثَرْتَ عَلَىٰ اخْتِلَافٍ فِي الْفَصْلَيْنِ مِنْ ذِكْرِ غَيْرِ الشَّيْخَيْنِ فِي الْأَوَّلِ، وَذِكْرِهِمَا فِي الثَّانِيْ، فَاعْلَمْ أَنِّيْ بَعْدَ تَتَبُّعِيْ كِتَابَيْ: «الْـجَمْعَ بَيْنَ الصَّحِيحَيْنِ» لِلْحُمَيْدِيِّ، وَ «جَامِعَ الْأُصُوْلِ» اعْتَمَدْتُ عَلَىٰ صَحِيْحَيِ الشَّيْخَيْنِ، وَمَتْنَيْهِمَا.
‘(পাঠক!) আপনি যদি কোথাও প্রথম ও দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের হাদীসের মাঝে ভিন্নতা লক্ষ্য করেন। যেমন প্রথম পরিচ্ছেদে বুখারী ও মুসলিম ছাড়া অন্য কোন কিতাবের হাদীস (অথচ ইমাম বাগাওয়ীর অনুসরণে তাঁর নীতি হলো, প্রথম পরিচ্ছেদে শুধু বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীস উল্লেখ করা) এবং দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বুখারী ও মুসলিমের হাদীস পেয়ে থাকেন। তবে জেনে রাখুন, আমি (বুখারী ও মুসলিমের হাদীস উল্লেখ করার ক্ষেত্রে) আল-হুমাইদীর আল-জামউ বাইনাস সাহীহাইন ও (ইবনুল জাযারীর) জামিউল উসূল কিতাবের পর সরাসরি বুখারী ও মুসলিমের কিতাবদ্বয়ের ওপর নির্ভর করেছি।’
খতীবের এ কথার উদ্দেশ্যে হল, কোনো হাদীস তিনি আল-হুমাইদী, ইবনুল জাযরী, বুখারী ও মুসলিম শরীফের কোথাও না পাওয়ার দরুণ তা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে উল্লেখ করেছেন। তবে পাণ্ডুলিপির ভিন্নতার কারণে অন্য কেউ হয়তো সে হাদীস বুখারী ও মুসলিম শরীফে পেয়ে থাকতে পারেন। তাই উল্লেখিত অংশের শেষে খতীব তিবরীযী (রহ.) লিখেন,
فَإِذَا وَقَفْتَ عَلَيْهِ فَانْسِبِ الْقُصُوْرَ إِلَيَّ لِقِلَّةِ الدِّرَايَةِ، لَا إِلَىٰ جَنَابِ الشَّيْخِ.
‘(বিজ্ঞ পাঠক!) এরূপ কোন (ভুল) যদি আপনার দৃষ্টিগোচর হয় তবে সে ‘কসুর’ ও কমতির নিসবত আমার প্রতি করুন। কারণ, তা আমার জ্ঞানের স্বল্পতার ফল। শায়খ (ইমাম বাগাওয়ী)-এর প্রতি নয়।’
এ তো গেল ইমাম বাগাওয়ী (রহ.) ও খতীব তিবরীযী (রহ.)-এর কিতাবদ্বয়ের তুলনামূলক আলোচনা। এবার আমরা কিতাবটির হাদীসগত গ্রহনযোগ্যতার আলোচনা করব। ইমাম বাগাওয়ী (রহ.) লিখিত মাসাবীহুস সুন্নাহ ও খতীব তিবরীযী (রহ.) লিখিত মিশকাতুল মাসাবীহ কিতাব দুটি প্রথম থেকেই মুহাদ্দিসগণ থেকে শুরু করে সর্বসাধারণ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এ দাবির স্বপক্ষে শুধু এটুকু উল্লেখ করা যথেষ্ট যে, ইমাম বাগাওয়ী (রহ.)-এর মাসাবীহুস সুন্নাহের ব্যাখ্যা গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি!! (দেখুন: মাসাবীহুস সুন্নাহ (মুহাক্কিকের ভূমিকা), ১/৬৪-৭২) আর মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থের সংখ্যাও পঁচিশের ঊর্ধ্বে! তার মধ্যে হিন্দুস্থানী আলিমগণের প্রায় ১৫টির ওপর ব্যাখ্যাগ্রন্থ রয়েছে! (দেখুন: আবদুল হাই লখনভী, আস-সাকাফাল ইসলামিয়া ফিল হিন্দ, পৃ. ১৫৪-১৫৫)
আশ্চর্যজনক বিষয় হল, মিশকাত শরীফের প্রথম ব্যাখ্যা লিখেছেন লেখকের শিক্ষক ইমাম শরফুদ্দীন আত-তীবী (রহ.)! একজন ছাত্রের জন্য এরচেয়ে সম্মানের বিষয় আর কী হতে পারে যে, খোদ তাঁর শিক্ষক ছাত্রের লিখিত কিতাবের ব্যাখ্যা গ্রন্থ রচনা করবেন!!
মিশকাত শরীফের ওপর লিখিত প্রায় ২৫টি ব্যাখ্যাগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
এক. আল-কাশিফ আন হাকায়িকিস সুনান (الكاشف عن حقائق السنن المعروف بشرح الطيبي علىٰ مشكاة المصابيح): কিতাবটি খতীব তিবরীযীর উস্তায ইমাম শরফুদ্দীন আল-হুসাইন ইবনে মুহাম্মদ আত-তীবী (মৃত্যু: ৭৪৩ হি.) রচনা করেন। তিবরীযী মূলত তাঁর এ ওস্তাজের পরামর্শে মিশকাত শরীফ রচনা করেছেন। আল-কাশিফের ভূমিকায় ইমাম তীবী (রহ.) লিখেন,
كنت قبل قد استشرت الأخ في الدين المساهم في اليقين بقية الأولياء قطب الصلحاء شرف الزهاد والعباد في الدين محمد بن عبد الله الخطيب بجمع أصل من الأحاديث المصطفوية، فاتفق رأينا علىٰ تكملة المصابيح وتهذيبه وتشذيبه وتعيين روايته ونسبة الأحاديث إلى الأئمة المتقنين، فما قصر فيما أشرت إليه من جمعه، فبذل وسعه واستفرغ طاقته فيما رمت منه، فلما فرغ من إتمامه شمرت عن ساق الجد في شرح معضله وحل مشكله وتلخيص عويصه وإبراز نكاته ولطائفه على ما يستدعيه غرائب اللغة والنحو ويقتضيه علم المعاني والبيان….
‘আমি আমার দীনী ভাই …. মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ আল-খতীবের সঙ্গে নবী (সা.)-এর হাদীসগুলোর একটি সংকলনের বিষয়ে পরামর্শ করেছি। শেষে আমরা আল-মাসাবীহ কিতাবটি তাকমিলা করা, বিন্যাস করা, সাজানো, রাবীদের নাম উল্লেখ করা, হাদীসগুলোর মূল কিতাবগুলোর নাম উল্লেখ করা ইত্যাদি বিষয়ে একমত হলাম। তিনি আমার পরামর্শ পালনের ক্ষেত্রে কোনরূপ কমতি করেন নি। বরং আমি যা চেয়েছিলাম তা পালন করতে পূর্ণ শক্তি ব্যায় করেছেন। যখন তিনি কিতাবটি সংকলনের কাজ শেষ করেন, আমি কিতাবের কঠিন বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা, জটিল বিষয়গুলোর সমাধান, কঠিনস্থানগুলোর সারসংক্ষেপ, কিতাবটির সূক্ষ্যাতিসূক্ষ্য বিষয়াদি … নাহু, ও বালাগাত শাস্ত্রের চাহিদা অনুসারে বর্ণনা করতে মনোনিবেশ করলাম।’
এ ব্যাখ্যাগ্রন্থটির মূল বৈশিষ্ট্য হল, হাদীসের ব্যাখ্যা গ্রন্থগুলোর মধ্যে বলতে গেলে মূলত এ কিতাবটিতে ‘জবানে নববী’ তথা নবীজী (সা.)-এর ভাষার অলংকারগত বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। হাদীসের শত শত ব্যাখ্যা গ্রন্থের মাঝে অলংকারগত দিকটি নিয়ে আর কোন গ্রন্থের লেখক ইমাম তীবীর মত গুরুত্বসহকারে আলোচনা করেননি। তাই যুগে যুগে নবী-প্রেমীক ও আরবী ভাষাপ্রেমীগণ এ কিতাবটি সংগ্রহ ও পাঠের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। কিতাবটি ‘মাকতাবা নিজার আল-বায’ থেকে ড. আবদুল হামীদ হিনদাভীর তাহকীকসহ প্রকাশিত হয়েছ।
(বলে রাখা ভাল, ড. আবদুল হামীদ হিনদাভী বহু কিতাবের তাহকীক করেছেন। তাঁর তাহকীকের গুণগত মান খুব উচ্চাঙ্গের নয়। তাই কিতাবে মূদ্রণপ্রমাদসহ বহুবিদ ভুল থেকে যাওয়া দুস্কর নয়)।
দুই. হিদায়াতুর রুয়াত ইলা তাখরীজি আহাদীসিল মাসাবীহ ওয়াল মিশকাত هداية الرواة إلىٰ تخريج أحاديث المصابيح والمشكاة): কিতাবটির লেখক হাফেজ ইবনে হাজার আল-আসকালানী (মৃত্যু: ৮৫২ হি.)। এটি গতানুগতিক কোনো ব্যাখ্যাগ্রন্থ নয়। বরং মিশকাত ও মাসাবীহে উল্লেখিত হাদীসগুলোর সনদগত বিষয়ে-ই এ কিতাবে আলোচনা করা হয়েছে।
আগেই বলা হয়েছে, মিশকাত শরীফে ‘সহীহ ও হাসান’ হাদীসের পাশাপাশি কিছু যয়ীফ ও মুনকার হাদীসও স্থান পেয়েছে। এসব হাদীসের সনদগত মান জানার জন্য এ কিতাবটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষত এ কিতাবের যে সংস্করণ শায়খ আল-আলবানী (রহ.)-এর তাহকীকসহ প্রকাশিত হয়েছে তা খুবই উপকারী।
তিন. মিরকাতুল মাফাতীহ শরহু মিশকাতিল মাসাবীহ (مرقاة المفاتيح شرح مشكاة المصابيح): এটি আল্লামা মোল্লা আলী কারী (মৃত্যু: ১০১৪ হি.) লিখিত মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ। এ কিতাবটির মূল বৈশিষ্ট্য হলো, হাদীসের প্রাসঙ্গিক মাসায়িলগুলোর পাশাপাশি শাব্দিক তাহকীকের প্রতি মোল্লা আলী কারী (রহ.) বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন।
চার. মিরআতুল মাফাতীহ শরহু মিশকাতিল মাসাবীহ (مرعاة المفاتيح شرح مشكاة المصابيح): এ ব্যাখ্যাটির লেখক আল্লামা ওবাইদুল্লাহ বিন আবদুস সালাম আল-মুবারকপুরী। এ ব্যাখ্যাটিও খুবই গুরুত্বের দাবিদার। তবে লেখক তা পূর্ণ করতে পারেননি। কিতাবটি কিতাবুল মানাসিক পর্যন্ত লেখা হয়েছে।
পাঁচ. আত-তা’লীক আস-সাবীহ আলা মিশকাতিল মাসাবীহ (التعليق الصبيح علىٰ مشكاه المصابيح): এটি আল্লামা মুহাম্মদ ইদরীস কান্দলভী (মৃত্যু: ১৩৯৪ হি.) কর্তৃক রচিত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যাগ্রন্থ। কিতাবটি বৈরুতের প্রসিদ্ধ প্রকাশনা সংস্থা দারুল বাশায়ির আল-ইসলামিয়া থেকে ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে। পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান থেকেও এর বেশ ক’টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।
ছয়. তানযীমুল আশতাত: কিতাবটির লেখক আল্লামা মুহাম্মদ আবুল হাসান বাবুনগরী (মৃত্যু: ১৯৯২ খ্রি.)। তিনি আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরীর শ্রদ্ধেয় পিতা।
এ কিতাবের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, এতে লেখক প্রত্যেকটি অধ্যায়ের হাদীসগুলোর সারসংক্ষেপকে সামনে রেখে আলোচনা করেছেন। ফলে পাঠকের সামনে হাদীসগুলোর মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। পাশাপাশি কিতাবটিকে উপমহাদেশীয় আলিমদের বহু ব্যাখ্যাগ্রন্থের সারসংক্ষেপ বলা যায়। বিশেষত মোল্লা আলী কারীর মিরকাত (আরবী), আল্লামা আবদুল হক দেহলভীর আশিআতুল লুমুয়াত (ফারসি) এবং আল্লামা ইদরীস কান্দলভীর আত-তা’লীকুস সাবীহের অনেক আলোচনা এ কিতাবে চলে এসেছে। কিতাবটি থেকে ভারত উপমহাদেশসহ পৃথীবির বিভিন্ন প্রান্তের আলেম, ছাত্র ও উর্দুভাষী পাঠক উপকৃত হয়েছেন ও হচ্ছেন।
মিশকাত শরীফে প্রায় ৬৩০০টির মতো হাদীস আছে। তাতে বুখারী, মুসলিম, মুয়াত্তা মালিক, মুসনদে আহমদ, মুসনাদে শাফিয়ী, সুনানে আবু দাউদ, জামে তিরমিযী, সুনানে নাসায়, সুনানে ইবনে মাজাহ, সুনানে দারিমী, সুনানে দার-কুতনী, আস-সুনানুল কুবরা লিল-বায়হাকী ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ হাদীস সংকলনগুলোর বহু হাদীস এসে গেছে। (তিবরীযী, মিশকাত, ১/৪-৬)
একজন তালিবে ইলম যদি মিশকাতুল মাসাবীহে উল্লেখিত হাদীসগুলো শাব্দিক, অর্থগত, ব্যাখ্যাগত ও মাসািেয়লগত বিষয়গুলো গুরুত্ব-সহকারে পাঠ করেন তাহলে হাদীসের সংকলনগুলোর ওপর ভাল দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হবেন আশা রাখি। সম্ভব হলে, মিশকাত শরীফের প্রত্যেক অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদের হাদীসগুলো মুখস্ত করে নেওয়া ভাল। যেন প্রতিটি বিষয়ে কিছু কিছু হাদীস নিজের মাহফুযাতে চলে আসে। একজন তালিবে ইলমের জন্য তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী।
আল্লাহ তাআলা ইমাম বাগাওয়ী (রহ.) ও খতীব তিবরীযী (রহ.)-কে উম্মতের পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। আমাদের সকলকে এই গুরুত্বপূর্ণ হাদীস সংকলন থেকে উপকৃত হওয়ার তওফীক দান করুন। কিতাবটির লেখক, ব্যাখ্যাকারক, প্রকাশক, পাঠকসহ সকলকে কবুল ও মকবুল করে নিন। আমীন।
সূত্র….
আল-বাগাওয়ী, মাসাবীহুস সুন্নাহ, দারুল মা’রিফা, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪০৭ হি. = ১৯৮৭ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ১১০
ইবনুস সালাহ, মা’রিফাতু আনওয়ায়ি উলূমিল হাদীস = মুকাদ্দামাতু ইবনিস সালাহ, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২৩ হি. = ২০০২ খ্রি.), পৃ. ১০৭
আন-নাওয়াওয়ী, আত-তাকরীব ওয়াত তায়সীর লি-মা’রিফাতি সুনানিল বশীর আন-নাযীর ফী উসুলিল হাদীস, দারুল কিতাব আল-আরাবী, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪০৫ হি. = ১৯৮৫ খ্রি.), পৃ. ৩০
ইবনুস সালাহ, মা’রিফাতু আনওয়ায়ি উলূমিল হাদীস = মুকাদ্দামাতু ইবনিস সালাহ, পৃ. ১৬৬
আত-তাবরীযী, মিশকাতুল মাসাবীহ, আল-মাকতাবুল ইসলামী, বয়রুত, লেবনান (তৃতীয় প্রকাশ: ১৪০৫ হি. = ১৯৮৫ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ৭
আত-তাবরীযী, মিশকাতুল মাসাবীহ, খ. ১, পৃ. ৭
আবদুল্লাহ মুবারকপুরী, মিরআতুল মাফাতীহ শরহু মিশকাতিল মাসাবীহ, ইদারাতুল বুহুস আল-ইলমিয়া ওয়াদ দাওয়া ওয়াল ইফতা, জামিয়া সালাফিয়া বেনারস, ভারত (তৃতীয় সংস্করণ: ১৪০৪ হি. = ১৯৮৪ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ৩০