বৃহস্পতিবার-২২শে জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি-২২শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

খতীবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.) : হৃদয়ে ও হৃদ্যতায়

খতীবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.) : হৃদয়ে ও হৃদ্যতায়

খতীবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.) : হৃদয়ে ও হৃদ্যতায়

ড. আবু রেজা মুহাম্মাদ নেজামুদ্দীন নদভী (সংসদ সদস্য)

এ দেশের ক্ষণজন্মা মহান মনীষী খতীবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.)-এর স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে আমি যেন স্মৃতির ভারে নুয়ে পড়ছি। করোটির ভেতর স্মৃতির বহু বহর যেন ভিড় করছে। ফলে কোনটা রেখে কোনটা লিখব, বুঝে উঠা ভারি মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ মনীষী ছিলেন সমকালীন ওয়ায ও বক্তৃতার অঙ্গনে তারকা-ব্যক্তিত্ব, যার ফলে, একাধারে তিনি মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ইসলামী আইনবিদ ও ইতিহাসবিদ হলেও, তাঁর সবগুলো গুণ ও চরিত্র চাপিয়ে সর্বাপেক্ষা ভাস্বর হয়ে ওঠল ‘খতীবে আযম’ উপাধিটি। তাছাড়াও সমকালীন সমস্যা ও পরিস্থিতি, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং বিশেষত মুসলিম বিশ্বের হালচাল সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল সাগর-গভীর ও দিগন্ত-বিস্তৃত। তিনি বাংলাদেশের খ্যাতিহান ইসলামী বিদ্যাপীঠগুলোতে সুদীর্ঘ ৫০ বছর হাদীস, তাফসীর, ফিকাহ ও ইসলামী ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে পাঠদান করেন।

তাঁর ওয়ায ও বক্তৃতা ছিল সময়ের এক মোহিনী শিল্প এবং যুগের এক বিরল বিস্ময়। যতদূর তাঁর ওয়াযের আওয়ায পৌঁছুতো শ্রোতৃবর্গ এক অচ্ছেদ্য মনোযোগ দিয়ে তাঁর বক্তৃতা শুনতেন। মনে হতো, যেন তারা কাঠের মতো নিঃসাড় হয়ে আছে, যেন তাদের মাথায় বসে আছে পাখিদের ঝাঁক। তাঁর কথায় শ্রোতার মন যাদুগ্রস্তের মতো প্রভাবিত হতো। অশ্রুসিক্ত হতো তাদের চোখ। বিগলিত হতো হৃদয়। অন্তরে জাগ্রত হতো আল্লাহভীতি। এমনকি কখনো কোনো কোনো শ্রোতার আধ্যাত্মিক অবস্থা ‘মুশাহাদা’ ও ‘মুআয়ানা’র স্তরে উন্নীত হতো।

তাঁর বক্তৃতায় বিরাজ করতো হুজ্জাতুল ইসলাম কাসেম নানুতভী (রহ.) ও আল্লামা শিব্বীর আহমদ উসমানী (রহ.)-এর রঙ ও ঢঙ। আমাদের এক শিক্ষক খতীবে আযম ও মুফতী আজীজুল হক রহ.-এর ওয়ায-বক্তৃতার পার্থক্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, মুফতী সাহেবের বক্তৃতা ছিল আধ্যাত্মিক রুচি ও উপলব্ধিমূলক, আর খতীবে আযমের বক্তৃতা ছিল জ্ঞানগর্ভ, চিন্তাসঞ্জাত ও যুক্তিনির্ভর। খতীবে আযমের বক্তৃতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি কবি ইকবালের কবিতা খুব বেশি আবৃত্তি করতেন। যেহেতু ইকবালের কাব্য ও সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর গভীর ও ব্যাপক জ্ঞান ছিল, সেহেতু তিনি ইকবালের কবিতা থেকে আধ্যাত্মিক ও চৈন্তিক উপাদান আহরণ করতেন। এমনকি ইকবালের কাব্যকে তিনি একটি নির্ভরযোগ্য জ্ঞান-উৎসও বিবেচনা করতেন।

আমার মরহুম পিতা আল্লামা আবুল বারাকাত মুহাম্মাদ ফজলুল্লাহ (রহ.) এবং খতীবে আযম রহ.-এর মাঝে ছিল এক অনন্য-গভীর ঘনিষ্ঠতা। উভয়ের মাঝে প্রচুর দেখা-সাক্ষাৎ হতো। সাক্ষাৎ হলেই শিক্ষা ও রাজনীতি বিষয়ক সমস্যা নিয়ে আলাপ ও মতবিনিময় হতো। তাঁদের উভয়ের মধ্যে ছিল মহানুভবতা, প্রশস্ত হৃদয়, উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও যুগসচেতনা। এ কারণেই হয়তো উভয়ের মাঝে অন্যরকম এক বন্ধুত্ব ছিল। অন্যথায় আমার পিতা তো ছিলেন খতীবে আযমের শিক্ষক, জামিয়া হাটহাজারীর সুদক্ষ পরিচালক আল্লামা আবদুল ওহ্হাব (রহ.)-এর সহপাঠী। আমার পিতার সহপাঠীদের মধ্যে রয়েছেন, শাইখুল হাদীস আল্লামা যাকারিয়া (রহ.), আল্লামা মুফতী মুহাম্মদ শফী (রহ.) হাকীমুল ইসলাম কারী তৈয়ব (রহ.) প্রমুখ। তাঁরা সকলে ভারতের বিখ্যাত ইসলামী বিদ্যাপীঠদ্বয় : দারুল উলূম দেওবন্দ ও সাহারানপুর মোযাহেরুল উলূম মাদরাসায় লেখাপড়া করেছেন।

এ বন্ধুত্ব পরে আত্মীয়তায় পরিণত হয় যখন আমার পিতার মধ্যস্থতায় ড. আ ফ ম খালিদ হোসেনের সঙ্গে খতীবে আযমের এক মেয়ের বিয়ে হয়। আমি যখন চুনতি হাকীমিয়া আলিয়া মাদরাসায় পড়ি, তখন সীরাত মাহফিলের বিশাল মাঠে আমার পিতার পাশে বসে আমি তাঁকে বহুবার দেখেছি। তাঁরা একে অপরের প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল ও বিনয়ী ছিলেন। আহ! শ্রদ্ধার সে কি সম্মোহনী দৃশ্য! যুগ যদি আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিতো সেসব দৃশ্যের ছিটেফোঁটা। আহ! বিনয়ের সে কি শীতল ছায়া! আজ আলিমসমাজ যদি সেখান থেকে কিছুটা হলেও উপদেশ গ্রহণ করতেন।

সাধারণ-বিশেষ সকলেই তাঁর ওয়ায শুনতেন। তাঁর শ্রোতাসমাজে থাকতেন সে যুগের বাঘা-বাঘা সব আলিম ও বুদ্ধিজীবি। মানসিকতা ও অভিরুচির তারতম্য ভেদেও সকলেই তাঁর ওয়ায ও বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হতেন। প্রত্যেকই নিজের যোগ্যতা ও বোধশক্তি অনুপাতে উপকৃত হতেন। তাঁর বলার ঢঙ-ই ছিল আলাদা। বক্তৃতাগুলো যেন সুতোয় গাঁথা মুক্তোর মতো সুবিন্যস্ত ছিল। যে যুগের কোনো কোনো বক্তার মতো তাঁর বক্তৃতাগুলো ছিল না অবাস্তব, সেকেলে, অর্থহীন কাহিনিনির্ভর, কিংবা তুচ্ছ হাসিরসিকতায় ভরপুর। বরং তাঁর প্রতিটি কথা ছিল বাস্তবসম্মত ও কুরআন-হাদীসের প্রমাণনির্ভর। নিজের বক্তব্যকে বোধগম্য করার জন্য যে যৌক্তিক প্রমাণাদির ধারা তিনি সৃষ্টি করতেন, তা ছিল যুগের এক বড় বিস্ময়। কথার ফাঁকে কখনোবা তিনি শ্রোতৃবৃন্দের মাঝে মনোযোগ-চাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনার জন্য হালকা হাসি-রসিকতাও করতেন, তবে তা ছিল নিতান্তই রুচিশোভন, অর্থময় ও শরীয়তসম্মত।

একবার তিনি এক দ্বীনী মাহফিলে হৃদয়স্পর্শী ও আবেগমথিত ভঙ্গিতে আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব ও তাওহীদ সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। মাহফিলের পার্শ্ববর্তী এক কক্ষে তাঁর আলোচনা শুনছিলেন জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রধান পরিচালক আল্লামা মুফতী আজীজুল হক (রহ.)। আলোচনা শুনে আধ্যাত্মিক আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন মুফতী সাহেব হুজুর (রহ.)। তিনি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। চলে আসেন সভাস্থলে। সমবেত জনতার সামনেই তিনি ‘আল্লাহু আকবর’ বলে চিৎকার শুরু করেন।

উপর্যুক্ত মহামনীষীকে নিয়ে ব্যক্তিগত কিছু স্মৃতিচারণ করতে পারছি বলে, এ মুহূর্তে, আমি আনন্দাবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ছি। জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার ছাত্রজীবনে আমি তাঁর ছাত্রত্ব ও সান্নিধ্যের গৌরব অর্জন করেছি। কখনো কখনো কোনো দাওয়াতী সফরে তাঁর সঙ্গী হওয়ারও সুযোগ হতো আমার। তখন তাঁর বিনয়, সরলতা ও সাদাসিধেভাব দেখে আমি ভীষণভাবে অভিভূত হতাম, আলোড়িত হতাম। আমরা উভয়ের মাঝে বয়স ও মর্যাদার পাহাড়-বুলন্দ পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও কখনো কখনো ছাত্র-শিক্ষকের ভেদরেখাটুকু ভুলে বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কে চলে যেতাম। তখন তাঁর সাথে খোলামনে আলাপ হতো নানাভাবে, নানা বিষয়ে। রাজনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক ও শিক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সাথে আলোচনা হতো। কোনো প্রকার সংকোচ ও সঙ্কীর্ণতা ছাড়াই উদার ও মুক্তমনে তিনি আলোচনা করতেন।

যখনই তাঁর সাথে দেখা হতো, আমার পিতার কথা তুলতেন। তাঁর জ্ঞান-গরিমার বন্দনা করতেন। তাঁর কবিতার প্রশংসা করতেন সবচেয়ে বেশি। অনেক সময় তিনি আমার পিতার মেধা, জ্ঞানপ্রাচুর্য ও কাব্যপ্রতিভার প্রতি বিস্ময়বোধের কথা জানাতেন। এমনকি তিনি তাঁকে স্বভাবকবি ও আজন্ম সাহিত্যিক বলেও সম্বোধন করতেন। অন্যদিকে আমাকে উৎসাহ দিতেন তাঁর (আমার পিতার) পদাঙ্ক অনুসরণ করার জন্য। তিনি বলতেন, তুমি সত্যি তোমার পিতার যোগ্য উত্তরসুরি হবার যোগ্যতা রাখ।

আল্লামা ছিদ্দীক আহমদ (রহ.) পাঠদান ও ওয়ায-বক্তৃতার বিশেষ গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ কোনো ব্যক্তি ছিলেন না। বরং তিনি দেশীয় রাজনীতি ও বিশ্ব-রাজনীতির সুবিশাল অঙ্গনেও কার্যকর ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি শাইখুল ইসলাম হযরত আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.) দ্বারা খুবই প্রভাবিত ছিলেন। দেশবিভাগের আগেই তিনি ‘জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ’র সাথে যুক্ত হন। পরে ১৯৪৭ সালে যখন ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্ব লাভ করে, তখন মাওলানা আতহার আলী সিলেটীর ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি যুক্ত হন ‘জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেযামে ইসলাম’-এর সাথে। তিনি পার্টির কেন্দ্রিয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব আদায়ের পাশাপাশি প্রাদেশিক সভাপতিও ছিলেন। ১৯৫৪ এর নির্বাচনে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় সংবিধান পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এর পাশাপাশি তিনি ছয়টি ইসলামি দল নিয়ে গঠিত ‘ইসলামিক ডেমোক্রাটিক লীগ’-এর সভাপতির দায়িত্বও করেন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর তিনি ‘নেযামে ইসলাম পার্টি’কে নতুন করে উজ্জীবিত করার জন্য কর্মতৎপরতা চালিয়ে যান। তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত নেযামে ইসলাম’র সাথে থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করে গেছেন।

তিনি সচেতনভাবে বিশ্বাস করতেন যে, তাঁর ওপর দ্বীনের যেমন কিছু হক রয়েছে, তেমনি মাতৃভূমি ও স্বজাতিরও কিছু হক রয়েছে। মাতৃভূমির প্রতি নিখাদ ভালোবাসা-ই তাঁকে এমন কিছু অঙ্গনে শরীক ও সক্রিয় থাকতে উদ্বুদ্ধ করেছে যেসব অঙ্গনকে তৎকালীন আলিমগণ অপছন্দ করতে এমনকি ঘৃণাও করতেন। কিন্তু তাঁকে আল্লাহপাক দান করেছিলেন প্রজ্ঞা, প্রতিজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও অদম্য সাহসিকতা। আর এসব গুণ ছিল সমকালের জন্য একান্ত অপরিহার্য। ফলে তিনি কখনো রাজনীতি থেকে বিমুখ হন নি। বরং তিনি এর মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলমানদের পরম সমর্থন ও সহযোগিতা করে গেছেন। আমি মনে করি, স্বাধীনতার পরে এ দেশের আলিমসমাজ যদি তাঁর আদর্শকে আঁকড়ে ধরে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করতেন, তা হলে এ দেশে তাদের একটা দৃঢ় অবস্থান সৃষ্টি হতো এবং জাতীয় সংসদে গলা চারিয়ে কথা বলার অধিকার থাকত মুসলিম হক্কানী আলিমদের।

লেখক: সংসদ সদস্য, চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া), প্রফেসর, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ