ক্ষমা ও ঔদার্য
মাহবুবুর রহমান নু’মানী
ইসলাম মানবতার ধর্ম। মানবতার কল্যাণেই এ ধরাপৃষ্ঠে আগমন করেছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বর হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি ছিলেন করুণার আধার। তাঁর হৃদয় ছিল আকাশের মতো উদার। জানের শত্রুকে হাতের মুঠোয় পেয়েও তিনি ক্ষমা ও ঔদার্য প্রদর্শন করে পৃথিবীতে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। নবম হিজরিতে আরবের বনু তাঈ গোত্রের সঙ্গে যুদ্ধ হয় মুসলমানদের। তাঈ সম্প্রদায় পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায় সিরিয়ার দিকে। আর অনেকে বন্দি হয়ে মুসলমানদের হাতে আসে। বন্দিদের মধ্যে পৃথিবীখ্যাত দাতা হাতেম তাঈয়ের মেয়েও ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে ডেকে বললেন, ‘হে তাঈকন্যা! তোমার বাবা ছিলেন ঈমানদারের চরিত্রে উদ্ভাসিত। তিনি ছিলেন অত্যন্ত উদার ও দাতা চরিত্রের মানুষ। যাও, তোমার বাবার খাতিরে তোমাকে মাফ করে দিলাম। তাঈকন্যা বলল, আমি আশা করি, আমার সঙ্গে গোত্রের সব বন্দিকে ছেড়ে দেবেন। নবীজি (সা.) এ মেয়ের মধ্যে মানবিকতার গুণ দেখে মুগ্ধ হলেন। তিনি তার আবেদন মেনে নিয়ে সবাইকে মুক্ত করে দিলেন এবং পথের খরচসহ তাদের সিরিয়ায় পাঠিয়ে দিলেন। শত্রুপক্ষের এক অচেনা নারীর প্রতি এমন উদারতা পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে?
মক্কার কাফেরদের অমানবিক নির্যাতনে অসহ্য হয়ে প্রাণের জন্মভূমি ত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন দু’জাহানের বাদশাহ রাসুলুল্লাহ (সা.)। দীর্ঘ ৮ বছর পর সেই প্রাণের মক্কা তার পদতলে আসে। কাফেররা ভয়ে টতস্থ। আর বুঝি রক্ষা নেই। মুহাম্মদ আমাদের কাছ থেকে বদলা নেবে। কিন্তু রহমতের নবী সবাইকে অবাক করে ঘোষণা করেন, ‘আজ তোমাদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। তোমরা সবাই মুক্ত। আমি তোমাদের কাছ থেকে কোনো প্রতিশোধ নেব না।’ বিশ্বনবী (সা.)-এর এ ক্ষমা ও উদারতাকে ঐতিহাসিক গিবন এভাবে চিত্রিত করেছেন,
In the long history of the world there is no instance of magnamity and forgiveness which can approach those of Muhammad (s.) when all his enemies lay at his feet and he forgave them one and all.
‘হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর পায়ের তলায় অবনত অবস্থায় সব শত্রুকে পেয়েও তাদের প্রতি ক্ষমা করে ঔদার্য ও ক্ষমাশীলতার যে অনুপম আদর্শ প্রদর্শন করেছেন তার দ্বিতীয় কোনো নজির দুনিয়ার সুদীর্ঘ ইতিহাসে নেই।’ রাসুল (সা.) বলেন, ‘দুইটি অভ্যাস আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। আর দুইটি অভ্যাস আছে, যা আল্লাহর কাছে খুবই নিন্দনীয়। যে দুইটি অভ্যাস আল্লাহর কাছে প্রিয়, তা হলো: দান ও উদারতা। আর আল্লাহর কাছে ঘৃণ্য দুইটি অভ্যাস হলো, মন্দ চরিত্র ও কৃপণতা।’ (শুআবুল ঈমান)
দান, উদারতা, দয়া ও ভালোবাসা ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মজ্জাগত স্বভাব। শুধু মানুষের প্রতি নয়, বরং পশু-পাখিদের প্রতিও তার দয়া, ভালোবাসা, সহানুভূতির আচরণ ছিল তুলনাহীন। এক সাহাবি পাখির বাসা থেকে পাখির ছানা ধরে এনেছেন। মা পাখিটি ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে সাহাবির পেছনে পেছনে ছুটে এসেছে। বিষয়টি দৃষ্টি এড়ায়নি নবীজির। তিনি বললেন, কে এই পাখিটিকে কষ্ট দিয়েছে? সাহাবি বাচ্চাগুলো ছেড়ে দিলেন। নবীজি ঘোষণা করেন, ‘সব সৃষ্টিই আল্লাহর পরিবার। সুতরাং যে আল্লাহর পরিবারের প্রতি সদয় হয়, সে-ই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয়।’ বোখারির বর্ণনায় এসেছে, ‘এক ব্যভিচারী মহিলা পথ ধরে হাঁটছিল। সে লক্ষ্য করল, পিপাসায় কাতর একটি কুকুর জিহ্বা দিয়ে মাটি চাটছে। পাশেই ছিল একটি কূপ। মহিলা পায়ের চামড়ার মোজা খুলে কূপ থেকে পানি তুলে কুকুরটিকে পান করতে দেয়। তার এ আচরণে মহান আল্লাহ খুশি হয়ে তাকে মাফ করে দিয়েছেন।’ অন্য একটি হাদিসে নবীজি (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যারা অন্যের প্রতি দয়া করে, দয়াময় আল্লাহও তাদের প্রতি দয়া করেন। তোমরা জগৎবাসীর প্রতি দয়া করো, তাহলে আকাশের অধিপতি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’ (আবু দাউদ)
ইসলামের অনুপম শিক্ষাই হচ্ছে অন্যের প্রতি দয়া করা। মানুষের সুখ, শান্তি ও কল্যাণ কামনা করা। তাই ইসলামের ঘোর শত্রুদের মুখেও ইসলামের প্রশংসাবাণী উচ্চারিত হয়েছে। প্রখ্যাত ভারতীয় বুদ্ধিজীবী Mr. K. L. Gauba Zvi Prophet of the Desert গ্রন্থের ২১৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘ইসলাম একটি শান্তি ও সহিষ্ণুতার ধর্ম। ইসলামের সবচেয়ে বড় দিক হলো পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, যা তার নাম দ্বারাই বোঝা যায়।’
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রাযি.)। তার শাসনামলেই বিজিত হয় ফিলিস্তিন। তিনি সেখানকার ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সঙ্গে এই মর্মে চুক্তি করেন যে, আমরা তোমাদের জানমালের হেফাজত করব, বিনিময়ে তোমরা আমাদের কর দেবে। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি বছর তাদের কাছ থেকে কর আদায় করা হতো। একবার এক জিহাদে সৈন্য প্রেরণের প্রয়োজন দেখা দেয়। ফলে খলিফাতুল মুসলিমিন ফিলিস্তিনে অবস্থানরত সৈন্যবাহিনীকে ডেকে পাঠালেন। সেই সঙ্গে নির্দেশ দিলেন, ‘সেখানকার ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সমবেত করে জানিয়ে দাও, আমরা আমাদের প্রয়োজনে সৈন্যবাহিনী উঠিয়ে নিচ্ছি। তাই তোমাদের জানমালের হেফাজত করতে পারছি না। অতএব এ বছর তোমাদের প্রদেয় কর তোমরা ফেরত নিয়ে যাও।’ পৃথিবীর কোনো দেশ কিংবা জাতি এ ধরনের উপমা তাদের ইতিহাসে দেখাতে পারবে? হযরত ওমর ফারুক (রাযি.) একদিন মসজিদ থেকে বের হচ্ছিলেন। এ সময় লক্ষ্য করলেন, একজন বয়োবৃদ্ধ খ্রিস্টান ভিক্ষা করছে। তিনি তার কাছে গেলেন। কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। এরপর বললেন, এটা আদৌ ইনসাফের কথা নয় যে, তোমার যৌবনকালে আমরা তোমার কাছ থেকে ট্যাক্স নিতাম আর এখন তোমার বৃদ্ধকালে তোমাকে সাহায্য করব না। এরপর তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তাকে আজীবন ভাতা প্রদানের নির্দেশ দিলেন। ইসলামের সুদীর্ঘকালের ইতিহাস একথাই সাক্ষ্য দেয়, পৃথিবীর যেখানেই মুসলিম-অমুসলিমের সহাবস্থান ছিল, সেখানেই মুসলমানরা অমুসলিমদের প্রতি সৌহার্দ ও সম্প্রীতি বজায় রেখেছেন। অমুসলিম নাগরিকদের সার্বিক অধিকার সুনিশ্চিত করেছেন। কারণ, ইসলামের নবীজি বলে গেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো জিম্মিকে (সংখ্যালঘু অমুসলিম) কষ্ট দেয়, কেয়ামতের দিন আমি তার প্রতিপক্ষ হব।’ (কানযুল উম্মাল)
লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া উসমানিয়া দারুল উলুম সাতাইশ, টঙ্গী