গ্রামোন্নয়ন বনাম নগরায়ণ
খান শরীফুজ্জামান
কেরানীগঞ্জের কলাতিয়ায় আমি থাকি। প্রাচীন বাংলার মতো সমৃদ্ধ এখনো এর প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক সৌন্দর্য। ঢাকা শহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরের এ স্থানটিতে বেড়াতে আসলে আপনি প্রমাণ পাবেন বাংলাদেশের কোনো কোনো স্থান এখনো সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা। কেরানীগঞ্জের পশ্চিম দিক দিয়ে বয়ে গেছে ধলেশ্বরী নদী। স্থানীয়রা একে কালিগঙ্গা বলেও ডাকে। এর পূর্ব দিকে মোহাম্মদপুরের শেষ সীমানা দিয়ে বয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা। বুড়িগঙ্গার পূর্ব পাড়ে মোহাম্মদপুর ও পশ্চিম পাড়ে কেরানীগঞ্জ। মোট ৪২২ গ্রাম ও ১২ টি ইউনিয়ন নিয়ে কেরানীগঞ্জ গঠিত। কেরানীগঞ্জের এই গ্রামগুলোকে যদি আমরা গ্রামোন্নয়ন ও নগরায়ণের কেসস্টাডি হিসেবে বিচার-বিশ্লেষণ করি তাহলে সারা বাংলাদেশের একটি গড় চিত্র আমরা বুঝতে পারব।
নদী-খাল-বিলে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ থাকায় ও মাটির প্রাকৃতিক উর্বরতার কারণে এখানে প্রচুর শাক-সব্জি, ফসল ও ফল-মূল জন্মে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী পালনের রীতিটা এখানে চোখে পড়ার মতো। দেশি মুরগী বা মুরগীর ডিম পেতে চাইলে আপনি চলে আসতে পারেন আটিবাজার, কলাতিয়া, হযরতপুর বা পাড়াগ্রাম বাজারে। এখানে অধিকাংশ মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরক্ষভাবে পেশা এখনো কৃষিকাজ। স্থানীয় নিজস্ব প্রয়োজন মিটিয়ে ঢাকা শহর ও এর পাশ্ববর্তী এলাকার শাক-সব্জির চাহিদার একটি বড় যোগান আসে এই কেরানীগঞ্জ থেকে। নদী-খাল-বিল নিয়ে এটি একটি গ্রামীণ সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এখানে মোট ফসলী জমি আছে ২৫৭৮১ হেক্টর (জাতীয় তথ্য সেবা)।
মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা তাদের সংস্কৃতির আচার-অনুষ্ঠান পারস্পারিক সম্প্রীতির সঙ্গে উদযাপন করে আসছে শত বছর ধরে। এখানে আযানের ধ্বনি ও উলু ধ্বনি দুটোই শোনা যায়। ভাটিয়ালী, মুরশিদী, মারফতী, যাত্রাপালা ও কবি গানের আসর যেমন বসে এখনো, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে বসে বিভিন্ন মেলা অনেক রকম গ্রামীণ বেসাতির পসরা সাজিয়ে। এগুলো এলাকার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিরই সাংস্কৃতিক উপাদান। এখানে কেরানীগজ্ঞের যে চিত্র আমরা দেখতে পাই তা প্রতিটি চিরায়ত সোনার বাংলারই প্রতিচ্ছবি। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্যি যে, একটি ব্যবসায়িক স্বার্থান্বেষী মহলের ললুপ দৃষ্টি পড়েছে রাজধানীর নিকটবর্তী এ স্থানের প্রতি। তারা ধবংস করতে চায় এই সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা কেরানীগঞ্জকে। তারা তাদের সকল প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছে। মোহাম্মদপুর থেকে বসিলা ব্রিজের পর থেকে আটিবাজার ভাওয়াল হয়ে কলাতিয়া পর্যন্ত প্রধান সড়কের দুই পাশের যেসকল কৃষি জমিগুলো ছিল তা কিছু আবাসন বা রিয়েলস্টেট কোম্পানি দখল করে বালি ভারাট করে অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত আবাসন বাণিজ্য বা নগরায়ণ শুরু করেছে। যাতে সরকারি প্রশাসনের কোনো হস্তক্ষেপ ও চোখে পড়ে না। এখানে মোট খাস জমি আছে ৫১৪৭.০১৫১ একর যার অধিকাংশ এসকল ভূমি দস্যুদের দখলে (জাতীয় তথ্য সেবা)। রাজধানী ও সারা দেশের শহর পার্শ্ববর্তী প্রতিটি এলাকার চিত্র প্রায় একই। সবখানেই কৃষিজমি ধবংস ও কৃষিজমিতে আবাসন ও কৃষিকাজের জন্য ক্ষতিকর শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে।
কৃষিজমি ধ্বংসের সাথে সাথে ঝোপ-জঙ্গল, ডোবা-নালা, খাল-বিলগুলো ভারাট করায় ধবংস হচ্ছে এ এলাকার হাজার বছরের জীববৈচিত্র(Biodiversity)। কেরানীগজ্ঞে অনের রকম দেশী ফল-মূল, শাক-সব্জি, পশু-পাখি ও মাছ পাওয়া যায় কিন্তু এই অনিয়ন্ত্রিত আবাসন বাণিজের কারণে সবই আজ ইতিহাসে পরিণত হতে যাচ্ছে। এখানে এখনো রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক, ডোবা-নালাগুলোতে বিলুপ্ত প্রায় ডাহুক, বক, ঘুঘু, হাঁস পাখি, দোয়েল, কাঠকুড়োলির কিঁচির-মিচির শব্দে মুখরিত থাকে সকাল-সন্ধ্যা।
পত্রিকা মারফত জানা যায়, বর্তমান সরকার গতবছর (২০১৭) কেরানীগঞ্জের ১৬টি মৌজাকে অধিগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে। প্রধান উদ্দেশ্য এমপি-মন্ত্রীদের অবকাশ যাপনের আবাসন গড়ে তোলা। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এ এলাকার মানুষেরা বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে। মোহাম্মদপুর থেকে কলাতিয়া পর্যন্ত মানব বন্ধন করেছে হাজার হাজার নারী-পুরুষ। সম্ভবত সামনে নির্বাচন তাই এই মুহুর্তে জমি নিয়ে সরকার মানুষের বিরাগভাজন হতে চায় না। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইন্ডিয়া ও অন্যান্য দেশে কৃষিজমি ও জীববৈচিত্র রক্ষার জন্য সরকার কঠোর নীতিমালা মেনে চলে। বাংলাদেশের উন্নয়ন বা গ্রামগুলোর উন্নয়ন মানে কৃষিভিত্তিক গ্রামগুলোকে সিটিকর্পোরেশনের মধ্যে নিয়ে আসা নয়; কৃষিজমিতে আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার অনুমোদনও নয় বরং আমাদের বিদ্যমান কৃষিনীতির উন্নয়ন করে গ্রামীণ অর্থনীতির অবকাঠামোকে ঠিক রেখে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা। জেলাসদর বা রাজধানীর সঙ্গে গ্রামগুলো উন্নত যোগাযোগ স্থাপন করা; বিদ্যুতায়ন, গ্যাস ও সেচের পানির নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিতকরণ। গ্রামে শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের মান উন্নয়ন করা মানে গ্রামের কৃষিজমিগুলোর অবলুপ্তি নয়। গ্রামের কৃষক, পল্ট্রি ও গবাদিপশুর খামারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, আধুনিক কৃষি উপকরণগুলোর সরবরাহ নিশ্চিতকরণ। সরকার যদি সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়তে চায়, তাহলে সরকারের উচিত দেশের প্রতিটি পৌরসভার, জেলাশহরের কৃষিজমিগুলো চিহ্নিত করে সেখানে সবধরনের আবাসন, আবাসন বাণিজ্য ও শিল্পকারখানা শীঘ্র নিষেধ করা। প্রতিটি জেলা ও শহরের জন্য নির্দিষ্ট শিল্প এলাকা গড়ে তোলা।
এছাড়া যে ডজনখানেক সিটিকর্পোরেশন আমাদের আছে, সেগুলো নাগরিক সেবা মানেরও বেহাল দশা। এগুকে উন্নয়ন না করে গ্রামের কৃষিজমির মধ্যে নতুন নতুন আবাসন গড়তে দেওয়া আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি ও সংস্কৃতির জন্য ভয়াবহ আমরা নগরায়নের বিপক্ষে নই কিন্তু আমাদের সবুজে সাজানো বাংলার বসন কেউ খুলে নিক উন্নয়নের নামে তার পক্ষেও নই। আজ সারা বিশ্বই যেখানে পরিবেশ সুন্দর রাখার আন্দলনে নেমেছে সেখানে আমাদের শ্যামল বাংলার সৌন্দর্যকে আমরা আর কোনোভাবে হারাতে চাই না। নগরের যান্ত্রিকতার দুষণ থেকে মুক্ত থেকে নিতে চাই বুকভরা নিশ্বাস।
জানিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে সিটিকর্পোরেশনের সংখ্যা কত ছিল কিন্তু একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, ৬৮ হাজার গ্রামের সবুজ-শ্যামল আবহমান গ্রামীণ সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে সারাদেশে কাঠপাথরের শহর গড়ে তোলার কোনো ইচ্ছা তার ছিল না। কৃষি অর্থনীতিকে বাঁচালে আমাদের মাদার ইন্ডাস্ট্রিগুলোও বেঁচে থাকে। গ্রামগুলো বেঁচে থাকলে আমাদের নিজস্ব পেশা, ভাষা, পোষাক, ঐতিহ্য, খাদ্যাভাস ও গ্রামীণ অনুষ্ঠানগুলো বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকে সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ। আশা করি সরকার ও রাষ্ট্রপরিচালকেরা এ সত্য আশু অনুধাবন করবেন।
লেখক: পিএইচডি গবেষক (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) ও সহকরী অধ্যাপক, স্কলার্স