স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ইসলাম
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
স্বাধীনতা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো জনগোষ্ঠীর জন্য এক বিশেষ নিয়ামত। প্রকৃতিগতভাবে মানুষ স্বাধীন। প্রত্যেক মানুষ মার্তৃগর্ভ থেকে স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করে। এটাই মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে সহজাত এমন প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন যে, সে নিরঙ্কুশ কোনো সত্তার কাছে ছাড়া অন্য কারো কাছে নতি স্বীকার করতে চায় না। ধর্মপ্রাণ মানুষ এমন এক মহান সত্তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে চায়, যিনি সর্বশক্তিমান ও সকল ক্ষমতার উৎস। সেই পরম সত্তা হলেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। তিনি মানবজাতিকে প্রকৃতির অনুসরণের আহ্বান জানিয়ে ইরশাদ করেছেন,
فَاَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّيْنِ حَنِيْفًا١ؕ فِطْرَتَ اللّٰهِ الَّتِيْ فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا١ؕ لَا تَبْدِيْلَ لِخَلْقِ اللّٰهِؕ ۰۰۳۰
‘আল্লাহর প্রকৃতির অনুসরণ কর, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন; আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই।’
ইসলাম মানবজীবনে স্বাধীনতাকে ইতিবাচক ও সুস্পষ্টভাবে উৎসাহিত করেছে। আল্লাহ তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্টির সেরা জীবরূপে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়ে মানবজাতিকে অত্যন্ত সম্মানিত করেছেন। তাই মানুষ স্বাভাবিকভাবে এবং সঙ্গত কারণে বহুলাংশে স্বাধীনচেতা। সহজে কোনো প্রকার দাসত্ব মেনে নিতে চায় না। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভৃতি সব ধরনের পরাধীনতা ইসলামে সমর্থনীয় নয়। মানুষকে কোনো প্রকার দাসত্ব বা পরাক্রমশালী শত্রুর অত্যাচার ও পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা যাবে না-পবিত্র কুরআনের আয়াত থেকে এ চেতনা লাভ করা যায়। ইরশাদ হয়েছে,
وَيَضَعُ عَنْهُمْ اِصْرَهُمْ وَالْاَغْلٰلَ الَّتِيْ كَانَتْ عَلَيْهِمْ١ؕ فَالَّذِيْنَ اٰمَنُوْا بِهٖ وَعَزَّرُوْهُ وَ نَصَرُوْهُ وَاتَّبَعُوا النُّوْرَ الَّذِيْۤ اُنْزِلَ مَعَهٗۤ١ۙ اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَؒ۰۰۱۵۷
‘যে মুক্ত করে তাদেরকে তাদের গুরুভার হতে ও শৃঙ্খল হতে যা তাদের ওপর ছিল। সুতরাং যারা তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তাঁকে সম্মান করে, তাঁকে সাহায্য করে এবং যে নূর তাঁর সাথে অবতীর্ণ হয়েছে এর অনুসরণ করে তারাই সফলকাম।’
ইসলামে স্বাধীনতার লক্ষ্য হলো মহান আল্লাহর দেওয়া জীবনবিধানের অনুগমন ও সর্বত্র এর প্রতিফলন। ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) একটি স্বাধীন ভূখণ্ড লাভের কঠোর সাধনা করেছিলেন। পৃথিবীতে চিরসত্য, ন্যায় ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আল্লাহর আনুগত্যে সামষ্টিকভাবে সমর্পিত হওয়ার জন্য অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পর তিনি ও তাঁর সাহাবীরা মদীনায় হিজরতের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জন করেছিলেন এবং মক্কাবিজয়ের মাধ্যমে সে স্বাধীনতার বিস্তৃতি ও পূর্ণতা অর্জিত হয়েছিল। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করে চিন্তা ও মত প্রকাশের পূর্ণ সুযোগ প্রদান করে নবী করীম (সা.) ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বতোরূপে প্রতিষ্ঠা করেন। সে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সবাই শান্তি-শৃঙ্খলার এক অপূর্ব মেলবন্ধন লাভ করেছিল। মহানবী (সা.)-এর কল্যাণমূলক আরব রাষ্ট্র সারা পৃথিবীর ইতিহাসে একটি চিরন্তন আদর্শের নমুনা হয়ে আছে।
ইসলাম মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার জোরালো তাগিদ দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) হিজরত করার পর মদীনাকে নিজের মাতৃভূমি হিসেবে গণ্য করেন এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তাঁর জীবনের অনেক প্রতিরোধ যুদ্ধ ছিল মদীনা রাষ্ট্রের সুরক্ষার জন্য। মদীনায় হিজরতের পরেও কিছুসংখ্যক মুসলিম নারী ও শিশু মক্কায় অবস্থান করতে বাধ্য হন, যাদের হিজরত বা দেশত্যাগ করার কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। তারা মূলত মক্কায় পরাধীন অবস্থায় নির্যাতিত জীবন যাপন করছিলেন। তখন তারা এ মর্মে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছিলেন,
رَبَّنَاۤ اَخْرِجْنَا مِنْ هٰذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ اَهْلُهَا١ۚ وَاجْعَلْ لَّنَا مِنْ لَّدُنْكَ وَلِيًّا١ۙۚ وَّاجْعَلْ لَّنَا مِنْ لَّدُنْكَ نَصِيْرًاؕ۰۰۷۵
‘হে আমাদের প্রতিপালক! এই জনপদ; যার অধিবাসী জালিম, তা হতে আমাদেরকে অন্যত্র নিয়ে যাও; তোমার পক্ষ থেকে কাউকে আমাদের অভিভাবক কর এবং তোমার পক্ষ থেকে কাউকে আমাদের সহায় কর।’
অতঃপর ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে মক্কাবিজয় হয়। স্বাধীনতাকামী মজলুমদের আকুল প্রার্থনা মক্কাবিজয়ের মধ্য দিয়ে পূর্ণ করা হয়েছিল।
স্বাধীনতা মানুষের মধ্যে সত্য-সুন্দরের বোধ তৈরি করে এবং তাদেরকে মহান সৃষ্টিকর্তার আনুগত্যে সমর্পিত হওয়ার প্রেরণা দেয়। ইসলাম স্বাধীনতার প্রতি শুধু উদ্বুদ্ধই করে না, বরং স্বাধীনতা অর্জন ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জীবনদানকে শাহাদাতের মর্যাদা প্রদান করে। ইসলামে এমন স্বাধীনতার মর্যাদা স¤পর্কে নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেছেন,
رِبَاطُ يَوْمٍ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ خَيْرٌ مِّنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيْهَا
‘একদিন ইসলামি রাষ্ট্রের সীমান্ত পাহারা দেওয়া পৃথিবী ও তার অন্তর্গত সবকিছুর চেয়ে উত্তম।’
প্রকৃতপক্ষে মানবসমাজ থেকে অন্যায়ের মূল্যেৎপাটন করা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ আহ্বান। সকল প্রকার শোষণ, নির্যাতন, অন্যায় ও অবিচারের মূলে রয়েছে জুলুম। পরাক্রমশালী শত্রুর অত্যাচার ও পরাধীনতার শৃঙ্খল অন্যায়ের দ্বারা ব্যক্তির স্বাধিকার হরণ করা হয়। পরাধীনতা জুলুমের ক্ষেত্র প্রসারিত করতে সাহায্য করে। অথচ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং জুলুমের অবসান ঘটানো ইসলামের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তাই মানবজীবনে সার্বভৌম রাষ্ট্র অতীব প্রয়োজনীয়। স্বাধীন রাষ্ট্র ছাড়া সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত সমাজ বা জনগোষ্ঠী তৈরি করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ইতিহাসে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ মুক্তিসংগ্রাম, গণআন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধ বা কঠিনতম কর্মের মধ্যে আত্মদানকারী অসংখ্য দেশপ্রেমিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মহান নেতাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। আমাদের দেশ ও মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য যাঁরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁদের মর্যাদা অতি মহান, অতি উচ্চে। তাঁরা দেশ ও জাতির গৌরব। ইসলামের দৃষ্টিতে তাঁরা শহীদ, শাহাদতের সর্বোচ্চ মর্যাদায় ভূষিত। দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মাতৃভূমি রক্ষার জন্য যাঁরা আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করেন, তাঁদের স¤পর্কে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
وَلَا تَقُوْلُوْا لِمَنْ يُّقْتَلُ فِيْ سَبِيْلِ اللّٰهِ اَمْوَاتٌ١ؕ بَلْ اَحْيَآءٌ وَّلٰكِنْ لَّا تَشْعُرُوْنَ۰۰۱۵۴
‘আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে তোমরা মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত; কিন্তু তোমরা তা উপলদ্ধি করতে পারো না।’
বস্তুত মানবজীবনে স্বাধীনতা মহান আল্লাহর অপূর্ব দান। স্বাধীনতার জন্য শোকর আদায় করে শেষ করা যায় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে সুসংহত করা ও সুরক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। ১৯৭১ সালে যারা আমাদের এ অমূল্য স্বাধীনতা অর্জনে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ অবদান রেখেছেন সেসব শহীদ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। সমগ্র জাতি তাদের কাছে চিরঋণী। সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে আমাদের সবারই স্বাধীনতা রক্ষায় ও ফলপ্রসূকরণে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে। যে কোনো দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ যত না গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়েও বেশি গুরুত্ব রাখে দেশগঠনে অংশীদারি। এক্ষেত্রে জনগণের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। তারা নিজেদের অবস্থান থেকে দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য সাধ্যানুযায়ী ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। জাতির প্রয়োজনে তাদের আরো সক্রিয় ভূমিকা সময়ের অনিবার্য দাবি। স্বাধীন দেশের ক্রান্তিলগ্নে সব ভেদাভেদ ভুলে দলমত সবার ঐক্য প্রয়োজন। আমাদের স্ব^াধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষা করতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার এগিয়ে আসা উচিত। তাই আসুন, সবাই মিলে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি একে অর্থবহ করতে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিমুক্ত দেশগড়ার স্বপ্ন নিয়ে নতুন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ি।