জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রোহিঙ্গা মুসলমানদের ব্যাপারে বিশ্ববিবেক নীরব কেন?

রোহিঙ্গা মুসলমানদের ব্যাপারে বিশ্ববিবেক নীরব কেন?

রোহিঙ্গা মুসলমানদের ব্যাপারে বিশ্ববিবেক নীরব কেন?

এম আর মাহমুদ

‘জীব হত্যা মহাপাপ’ এ মর্মবাণীতে বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতম বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করলেও মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী যারা বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী হয়েও তারা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর জঘন্য হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, বসতবাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে যে নির্মম কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে তা দেখলে হয়তো এ ধর্মের প্রবর্তক নিজেই মাথানত করে অনুতপ্ত হতেন। মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী ও সেদেশের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যালঘু মুসলমান নর-নারী শিশুদের নৃশংসভাবে হত্যা ও অসহায় যুবতীদের গণহারে ধর্ষণ করছে। বেশিরভাগ রোহিঙ্গা নর-নারী প্রাণরক্ষা ও ইজ্জত-আব্রো রক্ষার তাগিদে নিজের জন্মস্থান ছেড়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভিনদেশে (বাংলাদেশের ভূখণ্ডে) আশ্রয় নিচ্ছে। প্রথম দিকে বিজিবি সদস্যরা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে প্রবেশে বাধা প্রদান করলেও পরবর্তীতে মানবিক কারণে সরকারের সবুজ সংকেত পেয়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে। ফলে প্রতিদিনেই বানের পানির মতো রোহিঙ্গারা যাযাবরের মতো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুনধুম ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় আশ্রয় নিচ্ছে। খোলা আকাশের নিচে এসব রোহিঙ্গা নর-নারীরা (শরণার্থী) মানবেতর জীবন-যাপন করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্যাতনের যেসব চিত্র ভেসে উঠছে কোনো হৃদয়বান মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। অভিজ্ঞদের অভিমত মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠীর একমাত্র টার্গেট আরাকান রাজ্যকে মুসলমান শূণ্য করা। একসময় এ রাজ্যে বসবাস করা মুসলমানদের সবই ছিল। তারা চাষাবাদ করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করলেও বার বার বর্মী হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে বসতবাড়ি হারিয়েছে। ইতোমধ্যে আরাকানের প্রায় ১১ লক্ষাধিক নাগরিক বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিড়িয়ে বসবাস করছে। যা এদেশের জন্য বড়ই বোঝা।

যেখানে এদেশের মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে না, সেখানে ভিন্নদেশের এ বিশাল জনগোষ্ঠীর চাপ বহন করা দেশের জন্য বড়ই ক্ষতিকর; যা অনেকটা ‘মরার ওপর খাড়ার ঘা’। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর এত নির্যাতন ও নির্মম হত্যাযজ্ঞের পরও বিশ্বের মোড়লেরা নীরব। এছাড়া মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের পক্ষে আরাকানের মুসলমানদের রক্ষায় তেমন কার্যকর ভূমিকাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কথায় আছে রোম যখন পুড়ছিল রোমের সম্রাট নিরো রাজপ্রসাদে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিল। তবে ব্যতিক্রম কিছু করুক আর না করুক ইতোমধ্যে কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্রের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। যেমনÑ তুরস্ক বাংলাদেশ সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছে, সীমান্ত খুলে দিন রোহিঙ্গাদের সমস্ত ব্যয় সে দেশ বহন করবে। অপরদিকে মালদ্বীপ ছোট একটি রাষ্ট্র হলেও মিয়ানমারের মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ডে ধিক্কার জানিয়ে কূটনৈতিক স¤পর্ক ছিন্ন করেছে। শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. ইউনুসসহ ১০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গা মুসলমানদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু মিয়ানমারের বর্তমান কর্ণধার এক সময়ের গণতন্ত্রের মানসকন্যা ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের অতি আপনজন ও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অংসান সূচি এসব পৈশাসিক হত্যাকাণ্ড বন্ধের কোন পদক্ষেপ নেননি। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিবেক আজ নীরব কেন? আরাকান থেকে পালিয়ে আসা বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মাঝে এতদিন ইউএনএইচইআর খাদ্য সরবরাহ করে থাকলেও হঠাৎ করে এখন তাদের খাদ্য সহায়তাও বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে এসব বনি আদমগুলো খেয়ে না খেয়ে বেঁচে রয়েছে। অতীতে মিয়ানমারের হানাদার বাহিনী শুধুমাত্র রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিধন ও তাড়ানোর কাজে ভূমিকা রাখলেও ইদানিং হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনদের ছাড় দিচ্ছে না। বিষয়টি জানার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অংসান সূচির সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য তিনদিনের সফরে মিয়ানমার গেছেন।

বিজ্ঞজনেরা নরেন্দ্র মোদির মিয়ানমার সফরকে সহজভাবে নিলেও অনেকে বিষয়টি রহস্যজনকবলে ভাবছে। কারণ, বিশ্বে মুসলমান নিধনের ক্ষেত্রে সব শিয়ালের একই রাঁ। তবে বার্মার শাসকদের বিশ্বাস করা যায় না। তারা মুসলিম আর হিন্দুকে ওই দেশ থেকে বিতাড়িত করতে পিছপা হবে না। তাদের পিছনে কলকাঠি নাড়ছে বৃহৎ শক্তি চীন। গ্রামের একটি গল্পের অবতারণা না করলে বিষয়টি পরিষ্কার হয় না এক সময় একজন মৌলভী, একজন ব্রাহ্মণ ও একজন ভান্তে দর্শনীয় একটি স্থানে ভ্রমণ করতে যাচ্ছিল। এ সময় তিন ধর্মগুরুর হাতে কোন খাবার মজুদ ছিল না। বাধ্য হয়ে তারা নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে এক মুসলমান কৃষকের ক্ষেত থেকে তরমুজ চুরি করে নিয়ে খেয়ে ফেলে। বিষয়টি তরমুজ ক্ষেতের মালিক দেখে ফন্দি আঁটল তিনজনকে কিভাবে শায়েস্তা করা যায়। কারণ একজন কৃষকের পক্ষে তিনজনকে কুপোকাত করা সম্ভব নয়। তরমুজ ক্ষেতের মালিক এসে মৌলভী ও ব্রাহ্মণকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে বলল, আমি মুসলমান হিসেবে জন্ম ও মৃত্যুতে মৌলভীর প্রয়োজন আর প্রতিবেশী হিসেবে ব্রাহ্মণও কাজে আসে। কিন্তু ভান্তে আমার তরমুজ চুরি করল কেন? এমন খোড়া যুক্তি দিয়ে ভান্তেকে মারধর করে। এ সময় মৌলভী আর ব্রাহ্মণ ছিল অনেকটা নির্বিকার। পরে মৌলভীকে বলল, আমার তো শুধু মৌলভী হলেই চলে। এরপর ব্রাহ্মণ বাবুকেও একই কায়দায় রামধোলায় দেয়। সবশেষে মৌলভীর কাছে জানতে চাইল, পরের ক্ষেতের তরমুজ চুরি করে খাওয়া ধর্মীয়ভাবে নিষেধ এটা জানার পরও কেন খেলেন, একথা বলে মৌলভীকে নির্দয়ভাবে পিঠানো শুরু করলো। তখন ওই মৌলভী বলতে লাগলো, ব্রাহ্মণ ও ভান্তে বাবু এগিয়ে এসে আমাকে উদ্ধার কর, আমি আর মাইর সহ্য করতে পারছি না, তখন ব্রাহ্মণ ও ভান্তে জবাব দিল, আমাদেরকে যখন পিঠিয়েছে তখন তুমি নীরব ছিলে। আমরা দু’জনের পালা শেষ, এখন তোমার পালা। আমাদের করার কিছুই নেই।

অনুরূপভাবে মিয়ানমার সরকার শুধুমাত্র বৌদ্ধ সম্প্রদায় ছাড়া অন্য কোন সম্প্রদায়কে ছাড় দেবে না। এক্ষেত্রে মিয়ানমারের শাসকেরা কৌশলে আরাকানে বসবাসরত মুসলমান শূণ্য করায় তাদের মূল লক্ষ্য। জাতিসংঘ মিয়ানমারের এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড বন্ধের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, চীন মিয়ানমারের পক্ষে ভূমিকা রাখার কারণে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকা কি আনজুমানে মুফিদুল ইসলামের মতো। জাতিসংঘের মহাসচিব বার বার রোহিঙ্গা মুসলমানদের সীমান্ত খুলে দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার বারবার মানবিক কারণ বিবেচনা করে তাদেরকে বাংলাদেশের ভুখণ্ডে আশ্রয় দিচ্ছে। অথচ এ পর্যন্ত রোহিঙ্গা নাগরিকদেরকে স্বদেশে ফেরৎ নেয়ার ব্যাপারে কোন উদ্যেগ জাতিসংঘ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে রোহিঙ্গা মুসলিম নাগরিকেরা। রোহিঙ্গা নির্যাতন ও জন্মভুমি থেকে বিতাড়নের ব্যাপারে উন্নত দেশগুলোসহ আমেরিকার ভূমিকা পরিলক্ষিত হচ্ছে না কেন? শুধুমাত্র বার্মার হানাদারেরা আরকানের মুসলমানদের হত্যা করছে তা নয় তারা হত্যা, ধর্ষণ ও বসতবাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে নিজের জন্মস্থান থেকে তাদেরকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করছে; যা মানবতা বিরোধী অপরাধ।

এক্ষেত্রে শুধুমাত্র মুসলমান নিধন হচ্ছে তা নয়, পুরো মানবতার নিধন হচ্ছে। নাফনদীতে লাশের ভেলা যেন ভাসছে। এদের ধর্ম, জাত পরিচয় সনাক্ত করা দরকার কি। মানুষ হিসেবে বাংলাদেশের লোকজন পুলিশের সহায়তায় এসব মরদেহ উদ্ধার করে দাফন কাফনের ব্যবস্থা করছে। সেক্ষেত্রে মরার আবার জাত কিসের। যারা মরছে ও পৈতৃক বসতবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসছে তাদের বড় পরিচয় মানুষ। এখানে শুধুই ধর্ম ও বর্ণের ব্যবধান থাকতে পারে। কবির ভাষায় বলতে হয় ‘কালো আর ধলো বাহির কেবল, ভিতরে সবার সমান রাঙা’। আমরা চাই রোহিঙ্গা মুসলমানদের রক্তের হোলি খেলা বন্ধ হোক। বিশ্বের সকল মুসলিম রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের বর্মি হানাদারদের কবল থেকে রক্ষা করা যেতে পারে বিজ্ঞজনদের অভিমত।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ