মিয়ানমারে ইসলাম
অধ্যাপক ডা. ইমতিয়াজ ইউসুফ
অনুবাদ: মাসুক আহমদ সালিম
সম্পাদনা: হোসাইন আহমদ
মিয়ানমার কোন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নয়। এটা একটা বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। থেরাবাদা বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান ধর্ম হল বড় দুটি ধর্ম এবং ইসলাম হল তৃতীয়। বার্মার আদমশুমারি বলে মিয়ানমারের জনসংখ্যার ৮৯.৮% হল বৌদ্ধ, ৬.৩% হল খ্রিস্টান আর ২.৩% মুসলিম।
বার্মিজ মুসলিমসমাজ প্রধানত ব্যবসায়ী এবং আলেমসমাজ নিয়ে গঠিত। যারা আর্থিকভাবে সচ্ছল কিন্তু শিক্ষা, বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিসিন, টেকনোলোজি, ব্যবসায় ব্যাবস্থাপনা সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে মানব সম্পদ উন্নয়নে দারিদ্রসীমার নিচে রয়েছে। তারপরও তাদের মধ্যে অনেক বিখ্যাত আইন বিশেষজ্ঞ বিদ্যমান আছেন।
কঠিন এবং উদ্ভুত পরিস্থিতির দেশ মিয়ানমার নিজ দেশের ঐক্যবদ্ধকারী মুক্তিযোদ্ধা নেতা জেনারেল অং সানের মার্ডারের কাল অধ্যায়ের মধ্যেই স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার কয়েক মাস আগে ১৯ জুলাই ১৯৪৭ সালে যাকে গুপ্ত হত্যা করা হয়। ৪ জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। ঐক্যের ব্যাপারে তার লিগ্যাসী ও তার হত্যাকান্ডের সাথে জড়িয়ে থাকা ভায়োল্যান্স আজো মিয়ানমারকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
মিয়ানমারের স্বাধীনতা পাওয়ার ৬৯ বছর হল তা রাজনৈতিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ট বার্মার বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী কর্তৃক একচ্ছত্রভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে, যারা বার্মার বর্ণবাদী বৌদ্ধিজমের জন্ম দিয়েছে। বার্মার এবং অন্যান্য আরও ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠী আনুষ্ঠানিকভাবে নিচের প্রধান জাতীয় আট জাতিগোষ্ঠীতে শ্রেণীবদ্ধ যেমনÑ ১. বার্মার, ২. চিন, ৩. কাচিন, ৪. কায়িন, ৫. কায়াহ, ৬. মন, ৭. রাখাইন ও ৮. শ্যান। যারা মিয়ানমারের প্রচীন মূল জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত। অন্যান্যদেরকে বহিরাগত অভিবাসী হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে, যেমনটি রোহিঙ্গা মুসলিমদের ক্ষেত্রে হয়েছে। ময়ানমারের মুসলমানরা ৪ ভাগে বিভক্ত:
১. ইন্ডিয়ান মুসলিম: যারা চাওলিয়াস, কাকা এবং পাঠান হিসাবে পরিচিত। যাদেরকে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা তাদের কলোনী ব্যাবস্থাপনার জন্য নিয়ে এসেছিল। তারা উপনিবেশ রাজধানী ইয়াঙ্গুন শহরে বড় পরিসরে বসবাস করেছে, এক সময় যেখানে ৫৬% জনসংখ্যা ছিল ইন্ডিয়ান জনগোষ্ঠী। এদের বেশিরভাগ কারখানা ও জাহাজ শ্রমিক, পাথর ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। অর্থনৈতিকভাবে তারা উন্নতি করেছিল। ইন্ডিয়ান মুসলিমরা উরদু ভাষায় কথা বলে এবং ইন্ডিয়ার মুসলমানদের ধর্মীয় ঐতিহ্যানুসারে দেওবন্দী-বেরেলভী ও তাবলীগী জামায়াতকে অনুসরণ করে থাকে। তারা আলিমদের দ্বারা পরিচালিত এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের ছেলে-মেয়েদেরকে শুধু ইন্ডিয়ান ধাচের মাদরাসা শিক্ষা দিয়ে থাকে। গ্রাজুয়েট পুরুষরা পারিবারিক ব্যবসা দেখাশুনা করে আর মেয়েরা ঘর-সংসারের দায়িত্ব হাতে নেয়।
সেনা অভ্যূথানের মধ্য দিয়ে ১৯৬২ সালে ক্ষমতা দখলের পর জেনারেল নে উইন জাতীয়করণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ৩ লক্ষ ইন্ডিয়ানকে বার্মা থেকে বের করে দেয়। বার্মার বিশিষ্ট মুসলিমদের মধ্যে রয়েছেন:
১.১. বাহাদুর শাহ: ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর সর্বশেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ ব্রিটিশ শাসক কর্তৃক ইয়াঙ্গুনে নির্বাসিত হয়েছিলেন। ইয়াঙ্গুনের ৬ নং থিয়েটার রোডে তাঁর সমাধি রয়েছে। বর্তমানে এটা একটি মাযারে রূপান্তরিত হয়েছে।
১.২. জনাব ইউ রাজ্জাক (১৮৯৮-১৯৪৭)। তিনি ছিলেন তামিল বংশোদ্ভুত একজন বার্মিজ রাজনীতিক। যিনি বার্মাকে খুব বেশি ভালবেসেছিলেন। তিনি বৌদ্ধ-মুসলিম ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন। একজন শিক্ষানুরাগী হিসেবে তিনি পালি ও ত্রিবেদা বৌদ্ধ ধর্ম শিখেছিলেন এবং মান্দালয় কলেজ (যা এখন মান্দালয় ইউনিভার্সিটি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি স্বাধীনতাপূর্ব জেনালেন অং সান এর অন্তর্বর্তী সরকারে শিক্ষা ও জাতীয় পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া তিনি বার্মা মুসলিম কংগ্রেসের চেয়ারম্যানও ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১৯ জুলাই জেনারেল অং সানের সাথে ইউ রাজ্জাককেও গুপ্তভাবে হত্যা করা হয়।
২. পাথি বা জারবাদী: এরা বার্মিজ মুসলমান বংশধর। তারা পারসিয়ান ও ইন্ডিয়ান মুসলিম পুরুষ আর বার্মিজ ও অন্যান্য মহিলার মধ্যে আন্তর্বিবাহের কারণে সৃষ্ট মুসলিম বংশধর। তারা নিজেরা নিজেদেরকে অন্যান্য মুসলিম জনগোষ্ঠী থেকে জাতিগত ও সাংস্কৃতিকভাবে আলাদা হিসেবে দেখে এবং জাতিগত ও সাংস্কৃতিকভাবে নিজেদের তারা বামির্জ বৌদ্ধদের সাথে বেশি কাছাকাছি মনে করে। তারা নিজেদেরকে ইন্ডিয়ান মুসলমাদের নৈকট্য থেকে দূরে রাখে, যাদের ধর্মীয় জীবনাচার ইন্ডিয়ান বেরেলভী ও দেওবন্দী ধর্মতত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত। জারবাদী মুসলিমরা জাতিগতভাবে বার্মিজ মুসলিম সংখ্যালঘুদের মধ্যে সংখ্যালঘু যাদের সাথে বার্মিজ বৌদ্ধরা কিছুটা বর্ণ ও ঐতিহ্যগত পরিচিতি শেয়ার করে থাকে কিন্তু ধর্মীয় পরিচিতি নয়।
৩. চায়নিজ ব্যাকগ্রাউন্ডের পানথায় বা হুই মুসলিম: যারা সংস্কৃতিগতভাবে চীনা। এরা ব্যবসা ও বাণিজ্যিক পেশায় ব্যস্ত। এদের বেশির ভাগ ১৩শত শতকের দিকে দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের ইউনান শহর থেকে মাইগ্রেট হয়ে আসে। এছাড়াও তারা ১৯৪৯ সালের চায়নিজ কমিউনিস্ট নিপীড়ণ থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসে। তারা উত্তরের শহর মান্দালায়ার আশেপাশে বসতি স্থাপন করে।
৪. রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গারা: যাদের সংখ্যা প্রায় দশ লক্ষ, তারা রাখাইন প্রদেশের আদিবাসী যা পূর্বে মূলত আরাকান রাজ্য ছিল। রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশ থেকে আগত অবৈধ বাঙালি অভিবাসী হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয় এবং বৈষম্যমূকভাবে তাদেরকে ‘কালা’ (কালো লোক) বলে গালি দেয়া হয়। রোহিঙ্গা যারা আরাকান মুসলিম হিসেবেও পরিচিত আদি আরাকান রাজ্যের শুরু থেকেই বৌদ্ধদের মতো তাদেরও ঐতিহাসিক উপস্থিতি রয়েছে সেখানে। বর্তমানে যা সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হচ্ছে এবং সেটাকে ইতিহাস থেকে মুছে দেয়া হচ্ছে। আর এভাবে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে দাবির বৈধতাকে দুর্বল করা হচ্ছে।
আজকের মিয়ানমার রাষ্ট্রে আরাকান মুসলিমদের উপস্থিতি প্রাচীন ইতিহাসের গভীরে পোতিত। সে সময় কোন রাষ্ট্রীয় সীমানা বর্ডার ছিল না এবং র্দীঘকাল থেকে বাংলার চট্টগ্রাম ও আরাকানের মধ্যে মুক্তভাবে চলাচল ও যোগাযোগ ছিল। রাজনৈতিকভাবে এটা ম্রাউক-ইউ রাজত্বের সাথে সম্পৃক্ত, যে রাজত্ব ১৪৩০ সাল থেকে ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল এবং আজকের বাংলাদেশ ও বার্মাজুড়ে তাদের শাসন বিস্তৃত ছিল। এ রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা এবং শেষ রাজা ছিলেন রাজা নারামেইখলা মিন সাও মন। তিনি প্রথমে একজন বৌদ্ধ ছিলেন পরে সুলাইমান শাহ হিসেবেও পরিচিত হন। তিনিই ছিলেন আরাকানের ম্রাউক-ইউ রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা এবং আরাকানে ম্রাউক ইউ রাজবংশের সর্বশেষ প্রতিষ্ঠাতা রাজা। তিনি ১৪০৪ সালে রাজা হয়েছিলেন এবং ১৪০৬ সালে তাঁকে রাজার পদ থেকে সরানোও হয়েছিল। তিনি বাংলাদেশে নির্বাসিত হয়ে ২৪ বছর বসবাস করেছিলেন। বাংলার সুলতান জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ শাহের সেনা-সাহায্যে ১৪৩০ সালে তিনি তাঁর সিংহাসন ফিরে পেয়েছিলেন। ১৪৩০ সাল থেকে ১৫৩১ সাল পর্যন্ত ম্রাউক-ইউ বাংলার সালতানাতের নিরাপত্তা সাহায্যে ছিলেন। একটি সামন্ত রাষ্ট্র হিসাবে আরাকানের বৌদ্ধ রাজারা, রাজ্যসভার কর্মকর্তা ও সামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ইসলামিক উপাধি ধারণ করতেন। বাংলার ইসলামিক দিনার স্বর্ণমুদ্রা এ রাজ্যে ছিল স্বীকৃত। রাজা নারমেইখলা তার নিজের মুদ্রায় একপাশে বার্মিজ আর অন্যপাশে ফার্সি লেখা খোদাই করেছিলেন। সতেরশ ও অষ্টদশ শতকে ম্রাউক-ইউ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর; বঙ্গোপসাগর হয়ে যেখানে বড় বড় বাণিজ্যিক জাহাজ এসে পৌঁছতো।
১৭৮৪ সালে বার্মিজ রাজা বোদাপায়া আরাকানে হামলা করে তা দখল করে নেয় এবং নিজ রাজ্যের সাথে তা সংযুক্ত করে নেয়। প্রথম অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধের (১৮২৪-১৮২৬ খ্রি.) পর ১৮২৬ সালে ব্রিটিশরা আরাকানকে অধিভুক্ত করে নেয়। ব্রিটিশ উপনিবেশামলে প্রশাসনিক, ব্যবসায়িক এবং শ্রমিক অঙ্গনে সহযোগিতার জন্য বিশাল সংখ্যার ভারতীয়দের আগমন ঘটে। আজকের মিয়ানমারের অর্থনৈতিক অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে রয়েছে তাদের বংশধররা।
রাখাইন রাজ্যের ত্রিশ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে রোহিঙ্গা প্রায় তের লক্ষ। সমীক্ষায় দেখা গেছে বর্তমানে দশ লক্ষ রোহিঙ্গা মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রয়েছে যাদের মধ্যে এক লক্ষ চল্লিশ হাজার রোহিঙ্গা ২০১২ সালের ধর্মীয় সংঘাতের পর থেকে অভ্যন্তরীণ গৃহহীন হিসেবে ক্যাম্পে বসবাস করে আসছে এবং পনের লক্ষ রোহিঙ্গা নির্বাসিত হয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, সউদি আরব, আরব-আমিরাত, ইন্ডিয়া, মালেয়শিয়া, থাইলেন্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছে।
১৯৪০ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাক্কালে এবং ভারত থেকে দু’পাকিস্তানে পৃথক হওয়ার সময়ে মুজাহিদ গ্রুপ নামে একটি বিদ্রোহী দল ছিল, যাদের ইচ্ছা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া এবং আরাকানের বৌদ্ধ ও বার্মিদের থেকে আলাদা থাকা। তারা পাকিস্তানের স্থপতি মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহর কাছে সাহায্য আবেদন করেছিল। জিন্নাহ বিষয়টি জেনারেল অং সানের সাথে আলোচনা করেন যিনি নতুন বার্মায় তাদের রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং জিন্নাহও বিচ্ছিন্ন হওয়াকে সমর্থন করেননি।
১৯৮৯ সালে অভিবাসন সংযোজন আইন (ধারা ১৫/৮৯) ১৯৮৯ প্রকাশিত হওয়ার পর আরাকান রাজ্যের নাম রাখাইন রাজ্যে পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং তা রাখাইন বৌদ্ধ প্রভাবিত একমাত্র রাজ্য হিসাবে চিহ্নিত হয়।
মিয়ানমার একটি অশান্ত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর দেশ। ধর্মীয়ভাবেও এ দেশকে অশান্ত হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। এ দেশের রয়েছে তিন ধরনের নাগরিকত্ব পরিচিতি। ১. পূর্ণ নাগরিক, ২. এসোসিয়েট নাগরিক, ৩. ন্যাচারালাইজড নাগরিক। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্বের আইন অনুযায়ী ২য় ও ৩য় শ্রেণীর নাগরিকত্ব প্রয়োজনে প্রত্যাহারের অধীন। উপরের তিন ধরণের নাগরিকত্ব থেকেই রোহিঙ্গাদের আইনিভাবে অস্বীকার করা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদেরকে অবৈধ হিসেবে প্রমাণের কাজ শুরু হয় ১৯৭০ সালে জেনারেল নে-উইনের মিলিটারি শাসনামলে। ১৯৭৪ সালের মিয়ানমারের সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে সাংবিধানিক ঘোষণা এবং ১৯৭৪ সালের জরুরি অভিবাসন আইন জাতিগত নাগরিকত্বের জন্য ভিত্তি স্থাপন করে। এটা ১৯৪৭ সালের আইন অনুযায়ী জাতীয় নিবন্ধন সার্টিফিকেটকে বাতিল করে দেয়, রোহিঙ্গারাও যার অর্ন্তগত ছিল। নতুন এই আইন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অবৈধকরনের প্রক্রিয়া শুরু করে। আর তা চূড়ান্ত রূপ পায় ১৯৮২ সালের বার্মিজ নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে। যা চার ধরনের নাগরিকত্ব তৈরি করে: নাগরিক; এসোসিয়েট নাগরিক; ন্যাচারালাইজড নাগরিক ও বিদেশি। এই আইনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদেরকে বিদেশি হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়। রোহিঙ্গাদেরকে একেবারে দেশহীন করার জন্য চুড়ান্ত আঘাতটি হানা হয় ২০১৫ সালে। ২০১২-১৩ সালের সহিংসতা পরবর্তী পরিস্থিতি এবং বার্মিজ বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী ৯৬৯ আন্দোলনের কর্তৃক চাপের কারণে থেইন সেইন সরকার ঘোষণা করে রোহিঙ্গাদের বহনকৃত সকল হোয়াইট কার্ড পরিচয় বাতিল এবং অকার্যকর। রোহিঙ্গাদেরকে বহিরাগত ‘বাঙালি’ হিসেবে ডিক্লেয়ার করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে রোহিঙ্গারাই একমাত্র জাতি যারা দেশহারা (Stateless)।
বার্মিজ সেনাবাহিনী আর রোহিঙ্গাদের মধ্যে ২০১২ সাল থেকে চলে আসা সহিংস সংঘাতের আলোকে, অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ২০১৬ সালে রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘের সাবেক সেক্রেটারি কফি আনানের তত্ত্বাবধানে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে। উদ্দেশ্য ছিল রোহিঙ্গা ইস্যু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ ব্যাপারে সুপারিশ করা। উক্ত কমিশনকে ‘অভিযুক্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিদিষ্ট ঘটনাগুলোর তদন্ত করার অনুমতি দেয়া হয়নি।’ উক্ত কমিশনের ২৪ আগস্ট ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত রিপোর্টে মিয়ানমার সরকারকে নিপীড়িত ক্ষুদ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর চলাচল এবং নাগরিকত্বের ওপর জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার পরামর্শ দেয়া হয়, যাতে করে এই সংঘাত উভয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে রেডিকালাইজেশনের উত্থান ঘটাতে না পারে।
১৯৯৮ সালে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্জানাইজেশন (RSO) ও আরাকান রোহিঙ্গা ইসলামিক ফ্রন্ট (ARIF) যৌথভাবে আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ARNO) এবং তাদের রোহিঙ্গা ন্যাশনাল আর্মি (ARSA) গঠন করে। সাম্প্রতিককালে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (অজঝঅ) নামক একটি দল বার্মিজ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংঘাতে জড়িত হয়েছে।
রাখাইন রাজ্যে তাতমাডাও (মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনী) ছাড়াও আরও আলাদা আলাদা জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ সংঘঠন আছে যারা রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশী মুসলমান মনে করে এবং তাদেরকে মুসলিম হওয়ার কারণে নিজেদের দেশর জন্যে হুমকি মনে করে। এই সমস্ত গ্রুপগুলোর মধ্যে রয়েছে আরাকান ন্যাশনাল পার্টি (এএনপি); আরাকান লিবারেশন পার্টি (এএলপি) ও এর অঙ্গ সংঘঠন আরাকান লিবারেশন আর্মি (এএলএ) এবং ইউনাইটেড লিগ অফ আরাকান (ইউএলএ) ও এর সশস্ত্র অঙ্গ সংঘঠন আরাকান আর্মি (এএ)-কেও সম্পৃক্ত করে।
সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা ইস্যু ছাড়াও মিয়ানমার মা-বা-থা ও ৯৬৯ আন্দোলনের মতো বৌদ্ধ ভিক্ষুদের চরমপন্থী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্থান প্রত্যক্ষ করেছে। ২০১৫ সালে তারা সেনা শাসনের অধীন প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন এর সাবেক সরকারকে বাধ্য করে ‘‘জাতি ও ধর্ম রক্ষার আইন’ পাশ করতে। এর প্রকৃত টার্গেট ছিল দেশের সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী। আইনটি মহিলাদের জন্য বাধ্যতামূলক Birth Spacing, মনোগামী বা এক বিয়েআইন, বৌদ্ধ মহিলা অ-বৌদ্ধ কোন পুরুষকে বিয়ে করতে চাইলে বিয়ের পূর্বে রেজিস্ট্রিকরণ আইন ও ধর্ম পরিবর্তনরোধ আইন ইত্যাদি চাপিয়ে দেয়। ৯৬৯ আন্দোলন মুসলিমদের ভয়ংকর মানুষ হিসেবে দেখে থাকে।
মা-বা-থা বা ৯৬৯ আন্দোলনের নেতা আশিন উইরাথু মুসলিম ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিহত ও বয়কট করার মধ্য দিয়ে উক্ত আন্দোলনটি শুরু করে। আন্দোলনটি বার্মিজ এবং নন অ্যারাবিক সংখ্যায় লিখিত ৯৬৯ সাংকেতি প্রতীক উদ্ভাবন করে যা তিনটি মূল্যবোধ বৌদ্ধ, ধর্ম ও সংঘকে তুলে ধরে। এটা মুসলিমদের ৭৮৬ প্রতীককে প্রতিহত করতে একটা শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভারতীয় বার্মিজ মুসলিমরা কুরআনের আয়াত ‘আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময় ও দয়াবান’-এর উদ্ধৃতি দিয়ে আরবি সংকেতিক ৭৮৬ হিসবে ব্যবহার করে থাকে, যা অনেক সময় মুসলিমদের ব্যবসায় লেনদেন এর টোকেনে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। অশিন উইরাথু ও অন্যান্যরা যুক্তি দেখায় যে, ৭+৮+৬= যোগ করলে ২১ সংখ্যা আসে যা একবিংশ শতাব্দীতে মিয়ানমারকে দখল ও ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিবর্তন করার জন্য মুসলমানদের একটা চক্রান্তের প্রতীক।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেখা গেছে মিয়ানমারের এন্টি-মুসলিম ক্যাম্পেইন বেড়েছে। ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে, ২০১৬ সালের মিয়ানমাররের ইলেকশনকে সামনে রেখে মা-বা-থা ১২ দফা পলেসি স্ট্যাটম্যান্ট ইস্যু করে। এতে তারা সাধারণ ভোটারদের কাছে কথিত হুমকির ব্যাপারে বিবেচনা করা ও ধর্ম ও জাতি রক্ষার সমর্থননে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানায়। এছাড়া দলটি পর্দা (মহিলাদের মায়হায় কাপড় দেয়া) ব্যবহার ও ধর্মীয় রীতি ঈদুল আযহায় পশু যবাই বন্ধ করার ডাক দেয়।
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে স্বাধীন মিয়ানমারের জাতিগত ধর্মীয় সমতা ও বহুমুখিতায় বহুসংস্কৃতির সমাজ অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।
এছাড়া আঞ্চলিক ফ্রন্টে, মিয়ানমারের মা-বা-থা, শ্রীলংকার বধু বালা সেনা (বিবিএস) এবং ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন (আরএসএস)-এর যৌথভাবে মুসলিম বিরোধী বৌদ্ধ-হিন্দু জোট গঠনের খবর মিডিয়ায় এসেছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টির প্রধান রাজনৈতিক ফোর্স হল এ হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস)।
ভৌগলিক-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাউথ এশিয়ায় মুসলিম-বৌদ্ধ Fault Lines এবং বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় জাতিয়তাবাদের উত্থানের কারণে আমি ধারনা করি যে, শীঘ্রই এশিয়ায়ও ইসলামফোবিয়ার প্রসার ঘটবে।
তথ্যসূত্র
Yegar, Moshe The Muslims of Burma; Wiesbaden: O. Harrassowitz, 1972.
Between Integration and Secession : The Muslim Communities of the Southern Philippines, Southern Thailand, and Western Burma/Myanmar. Lanham, Md.: Lexington Books, 2002.
Berlie, J. A. The Burmanization of MyanmarÕs Muslims. Bangkok, Thailand: White Lotus Press, 2008.
Siddiqui, Dr Habib. The Forgotten Rohingya: Their Struggle for Human Rights in Burma, 2008.
Ibrahim, Azeem. The Rohingyas: Inside MyanmarÕs Hidden Genocide. 1 edition. London: Hurst, 2016.
Constantine, Greg. Exiled to Nowhere: BurmaÕs Rohingya. 1ST ed., 2012.
Rogers, Benedict. Burma: A Nation At The Crossroads. Revised edition. Random House UK, 2016.
প্রভাষক ও পরিচালক, সেন্টার ফর বৌদ্ধিষ্ট-মুসলিম আন্ডাস্টেন্ডিং কলেজ অফ রিলিজিয়াস স্টাডিজ, মাহিডল ইউনিভার্সিটি, সালায়া, থাইল্যান্ড