জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আদর্শ পরিবার গঠনে পিতার অবদান

আদর্শ পরিবার গঠনে পিতার অবদান

আদর্শ পরিবার গঠনে পিতার অবদান

আবিদুর রহমান তালুকদার

আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।

বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

কবি নজরুল নারী-পুরুষের অধিকার ও সাম্যের দিকটি চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন তার ‘নারী’ কবিতায়। নারী-পুরুষ কারো অবদানকেই ইসলাম খাটো করে দেখেনি। আদর্শ পরিবার গঠনের ক্ষেত্রেও কবির উক্তিটি যথার্থ। যা অনেকটা ইসলামি ভাবধারার প্রতিধ্বনি।

পরিবার গঠনে মাতাপিতার অবদান পরিপূরক

একটি আদর্শ পরিবার গঠনে মাতাপিতার অবদান পরিপূরক। উভয়ের মধ্যে কারো অবদান সন্তানের ওপর কম নয়। দুজন নারী-পুরুষের ধর্মীয় ও সামাজিক বন্ধনের মাধ্যমে একটি পরিবারের যে অসম্পূর্ণ যাত্রা সূচিত হয়, কালের পরিক্রমায় একদিন তারা পিতামাতায় পূর্ণতা লাভ করে। পিতা হয় সে পরিবারের আদর্শিক ভিত্তি। মা হলো তার সর্বশেষ ও সুশীতল আশ্রয়। পিতার সাময়িক কঠোরতা ও মাতার অতুলনীয় মমত্ববোধ সন্তানের পরিচর্যায় ভারমাম্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি পরিবারে মাতা হয় স্নেহ-মমতার মূল আধার। আর পিতা হলো সন্তানের ভবিষ্যতের স্বপ্ন-সৌধ নির্মাণের মূল কারিগর। মাতা হলো একটি গৃহের জীবনীশক্তি ও প্রাণ-স্পন্দন। আর পিতা হলো সে পরিবারের উন্নতি ও সমৃদ্ধির প্রধান উপলক্ষ। মাতা হলো একটি পরিবারে প্রতিষ্ঠানিক ভিত্তি। আর পিতা হলো সে প্রতিষ্ঠানের মূল চালক। নারী পুরুষ-জাতির মাতা হবার কারণে গৌরবান্বিত হলে, পুরুষ নারী-জাতির পিতার আসনে মহিমান্বিত। মায়ের গর্ভে পুরুষের জন্ম হলে, নারী-জাতির জন্ম হলো পিতৃ-পুরুষ আদম (আ.) এর ঔরসে।

অধিক সদাচরণ লাভের কে বেশি উপযুক্ত?

মাতাপিতার মর্যাদা…। তাদের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য…। কার বেশি? অধিক সদাচরণ লাভের কে বেশি উপযুক্ত? এ প্রশ্নের সাদামাটা উত্তর একটিই। মা…। সহিহ বুখারি ও মুসলিম শরিফের হাদিস দ্বারা সাধারণত মাতার অধিকার ও মর্যাদা বেশি, এ কথার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে, মাতার পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।

উপর্যুক্ত হাদিস দুটির আলোকে মাতার অধিকার সম্পর্কে আমরা দীর্ঘ আলোকপাত করি। আর ইসলাম পিতাকে কী মর্যাদা দিয়েছে, সে বিষয়ে আমাদের আলোচনা হয় খুবই সংক্ষিপ্ত। আল কুরআন ও সুন্নাহর বিষদ বর্ণনায় পিতা স্বতন্ত্রভাবে মর্যাদার উচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত। পুরুষ ও পিতা হওয়া সত্ত্বেও যা অনেকের অগোচরে। কবির ভাষায় বলতে গেলে:

قیمت هر کاله می‌دانی که چیست

قیمت خود را ندانی احمقیست

‘পৃথিবীর সব কিছুর মূল্য-মান ভালোভাবে জেনে নিলে। আর নিজের মূল্য কতো বেশি, তা জানতে পারলে না। তুমি একজন আস্ত বোকা।’

মাতাপিতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার সম্পর্কীয় হাদিসসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যে সকল হাদিস দ্বারা মাতার অবদান বেশি বলে প্রতীয়মান হয়, অন্য হাদিস দ্বারা সে ক্ষেত্রে পিতার অবদান ও অধিকার সাব্যস্ত হয়।

الْـجَنَّةُ تَحْتَ أَقْدَامِ الْأُمَّهَاتِ.

‘মাতার পায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’

কুযায়ি ও খতিব বাগদাদি বর্ণিত এই হাদিসটি নাসায়ি, দারাকুতনি, ইবনু হিব্বানসহ অনেকেই যয়ীফ বলে মন্তব্য করেছেন। তবে আবু দাউদ, নাসায়ি, আহমদ, তাবরানি, বায়হাকি, হাকিম ও দারা কুতনি বর্ণিত হাদিসে ‘মাতাপিতা উভয়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত’ একথা বর্ণিত হয়েছে। মুহাদ্দিনগণ এ হাদিসকে ‘সহিহ ও হাসান’ বলেও অভিহিত করেছেন।

عَنْ مُعَاوِيَةَ بْنِ جَاهِمَةَ، عَنْ أَبِيْهِ قَالَ: أَتَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ أَسْتَشِيْرُهُ فِي الْـجِهَادِ، فَقَالَ النَّبِيُّ ﷺ: أَلَكَ وَالِدَانِ؟ قُلْتُ: نَعَمْ، قَالَ: الْزَمْهُمَا فَإِنَّ الْـجَنَّةَ تَحْتَ أَرْجُلِهِمَا.

‘মুআবিয়া ইবনু জাহিমা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি রসূল (সা.)-এর নিকট জিহাদে যাবার ব্যাপারে পরামর্শ চাইলাম। রসূল (সা.) বললেন, ‘তোমার পিতামাতা কি জীবিত আছে?’ আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, ‘তাদের বেশি বেশি সেবা করো। কেননা জান্নাত তাদের পায়ের নিচে।’’

মায়ের প্রতি অধিক সদাচরণের কারণ

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ، قَالَ: جَاءَ رَجُلٌ إِلَىٰ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ، فَقَالَ: مَنْ أَحَقُّ النَّاسِ بِحُسْنِ صَحَابَتِيْ؟ قَالَ: أُمُّكَ قَالَ: ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ: ثُمَّ أُمُّكَ قَالَ: ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ: ثُمَّ أُمُّكَ قَالَ: ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ: ثُمَّ أَبُوكَ.

‘হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, একজন লোক রসূল (সা.)-এর নিকট এসে বলল, আমার সদাচরণ পাবার সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত কে? রসূল (সা.) বলেলন, ‘তোমার মা।’ লোকটি বলল, তার পর কে? রসূল (সা.) জবার দিলেন, ‘তোমার মা।’ আবার প্রশ্ন করল, তারপর কে, তিনি বললেন, ‘তোমার মা।’ লোকটি আবার প্রশ্ন করলো, তার পর কে? রসূল (সা.) বললেন, ‘তোমার পিতা।’’

উপর্যুক্ত হাদিসে মাতার সঙ্গে তিন বার সদাচরণের কথা বলা হয়েছে এবং চতুর্থ বারে পিতার কথা উল্লেখ রয়েছে, মুহাদ্দিসগণ তার বিভিন্ন কারণ বর্ণনা করেছেন।

প্রথমত সন্তানের জন্য মাতা এমন তিনটি কষ্ট ভোগ করে, যাতে একমাত্র অংশিদারিত্ব হলো মায়ের। এখানে পিতার কোনো দখল নেই।

ক. সন্তান গর্ভে ধারণ খ. সন্তান প্রসব গ. দুগ্ধদান।

এই তিনটি কষ্টের স্বীকৃতিস্বরূপ মায়ের প্রতি তিনবার সদাচরণের কথা বলা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত সন্তানের জন্য মাতা বেশি ঘনিষ্ট হবার কারণে অনেক ক্ষেত্রে তার প্রতি সদাচরণে সন্তানেরা অবহেলা করে থাকে। এ অবহেলা প্রতিরোধে মায়ের প্রতি অধিক ভালো ব্যবহার করার প্রতি তাগাদা দেয়া হয়েছে।

তৃতীয়ত জাহিলি যুগে নারীরা ছিল অধিকারের ক্ষেত্রে পশ্চাদপদ। ইসলামে নারীর মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষে মায়ের সঙ্গে অধিক সদাচরণের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।

চতুর্থত, আবহমানকাল থেকে আধুনিক সভ্যতার উৎকর্ষতার যুগ পর্যন্ত মানব সমাজ পুরুষ-শাসিত। পুরুষ প্রভাবিত সমাজে নারীর মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষে মায়ের প্রতি তিনবার সদাচরণের কথা বলা হয়েছে।

পরিবারের জন্য পিতার অবদান

পরিবারের জন্য পিতার এমন অনেক অবদান রয়েছে, যাতে মাতার কোনো অংশিদারিত্ব নেই। একমাত্র পিতাই সে দায়িত্ব পালন করে। যুক্তির নিরিখে পিতার জন্যও শরিয়ত প্রণেতার পক্ষ থেকে বিশেষ কোনো পুরস্কারের ঘোষণা থাকা বাঞ্চনীয়। ইসলাম যেভাবে মাতার সঙ্গে অধিক সদাচারের শিক্ষা দিয়েছে, তেমনিভাবে পিতার একক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বেহেশতের সর্বোত্তম দরজা বলে অভিহিত করা হয়েছে।

عَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ، أَنَّ رَجُلًا أَتَاهُ فَقَالَ: إِنَّ لِيَ امْرَأَةً وَإِنَّ أُمِّي تَأْمُرُنِي بِطَلَاقِهَا، قَالَ أَبُو الدَّرْدَاءِ: سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ يَقُوْلُ: الْوَالِدُ أَوْسَطُ أَبْوَابِ الْـجَنَّةِ، فَإِنْ شِئْتَ فَأَضِعْ ذَلِكَ الْبَابَ أَوْ احْفَظْهُ، قَالَ: وَقَالَ ابْنُ أَبِيْ عُمَرَ: رُبَّمَا قَالَ سُفْيَانُ: إِنَّ أُمِّيْ وَرُبَّمَا قَالَ: أَبِيْ، وَهَذَا حَدِيْثٌ صَحِيْحٌ.

‘হযরত আবু দারদা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি রসূল (সা.)-এর নিকট এসে বললেন, আমার এক স্ত্রী আছে। আমার মা তাকে তালাক দিতে বলে। আবু দারদা (রাযি.) বললেন, আমি রসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি। পিতা হলো বেহেশতের দরজাসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম দরযা। তুমি চাইলে এই দরযা ধ্বংসও করতে পারো, আবার রক্ষাও করতে পারো।’

হাদিস বর্ণনাকারী ইবনু আবি ওমর বলেন, সুফিয়ান ইবনু উয়াইনা কখনো মায়ের কথা বলেছেন আবার কখনো পিতার কথা বলেছেন, এটি একটি সহিহ হাদিস।

পিতার মর্যাদা সামগ্রিক, মায়ের মর্যাদার আঙ্গিক

সন্তানের সদাচরণ লাভের ক্ষেত্রে মাতাপিতা উভয়ে সমান, নাকি এতে কোনো তারতম্য আছে। এ বিষয়ে অনেকেই মাতার অধিকারকে গুরুত্ব দিলেও ইমাম মালিক ও কাযি আয়ায বলেন, ভালো ব্যবহারের ক্ষেত্রে মাতাপিতা উভয়েই সমান। কারো অধিকার বেশ বা কম নয়। পিতার মর্যাদা সম্পর্কীয় আল কুরআন এর আয়াত, হাদিসসমূহ এবং মৌলিক মানবাধিকারের বিয়ষয়টি সামনে রাখলে বোঝা যায়, মায়ের অধিক মর্যাদার বিষয়টি আঙ্গিক ও শাখাগত। কিন্তু পুরুষ হবার সুবাদে পিতার মর্যাদা সামগ্রিক ও জাতিগত। আল্লাহ তায়ালা দুটি কারণে পুরুষকে নারীর ওপর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব দান করে সম্মানিত করেছেন। যার প্রথমটি হলো, আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও দান। যা নারীকে দান করেননি। যাকে আল্লাহ বিশেষ অনুগ্রহ দ্বারা মর্যাদা দান করেন, নিজের কর্মপ্রচেষ্টায় কেউ তাতে পৌঁছতে সক্ষম হয় না। দ্বিতীয়টি হলো, পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব। এই দুটি কারণে নারী জাতির ওপর পুরুষ মৌলিকভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডি-ত। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

اَلرِّجَالُ قَوّٰمُوْنَ عَلَى النِّسَآءِ بِمَا فَضَّلَ اللّٰهُ بَعْضَهُمْ عَلٰى بَعْضٍ وَّ بِمَاۤ اَنْفَقُوْا مِنْ اَمْوَالِهِمْؕ ۰۰۳۴

‘পুরুষগণ নারীজাতির তত্ত্বাবধায়ক। কেননা আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে অন্যদের ওপর বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন। আর তারা পরিবারের জন্য অর্থব্যয় করে।’

আল-কুরআনে বর্ণিত পুরুষের এ মৌলিক মর্যাদা হাদিসের বিশেষ কোনো বর্ণনা দ্বারা কখনো খণ্ডিত বা সাংঘর্ষিক হতে পারে না। যা ‘উসূল’ এর নীতিমালারও পরিপন্থি।

সন্তান ও তার যাবতীয় সম্পদের মালিক পিতা

পিতার অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে বর্ণিত আর একটি হাদিস হলো, জনৈক সন্তান তার পিতার বিরুদ্ধে রসূল (সা.) এর দরবারে অভিযোগ করে। পিতার বিরুদ্ধে সন্তানের নালিশের সমাধান পূর্বক তিনি বলেন,

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ, أَنَّ رَجُلًا, جَاءَ إلَىٰ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ، فَقَالَ: إنَّ لِيْ مَالًا وَعِيَالًا، وَإِنَّ لِأَبِيْ مَالًا وَعِيَالًا، وَإِنَّهُ يُرِيْدُ أَنْ يَأْخُذَ مَالِيْ إلَىٰ مَالِهِ, فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: أَنْتَ وَمَالُكَ لِأَبِيْكَ.

‘হযরত জাবির ইবনু আবদিল্লাহ থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি রসূল (সা.)-এর দরবারে এসে বললেন, আমার কিছু সম্পদ আছে এবং আমার পরিবার-পরিজন আছে। আমার পিতারও অনুরূপ সম্পদ ও পরিবার-পরিজন আছে। অথচ তিনি আমার সম্পদ কেড়ে নিতে চায়। রসূল (সা.) বললেন, ‘তুমি এবং তোমার সম্পদ দুটোই তোমার পিতার।’’

পিতার মর্যাদা বিষয়ে আর একটি হাদিস হলো,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ، أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ، قَالَ: أَبَرُّ الْبِرِّ أَنْ يَصِلَ الرَّجُلُ وُدَّ أَبِيْهِ.

‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রসূল (সা.) ইরশাদ করেন, পিতার প্রতি সর্বাধিক সদাবচরণ হলো, তার বন্ধুদের সঙ্গে সদাচরণ করা।’’

পিতার অসন্তুষ্টির কারণে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হয়

সর্বসাধারণে মাতার অসন্তুষ্টির কারণে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হয়, এমন ধারণা প্রচলিত আছে। কিন্তু তিরমিযি শরিফ এর হাদিসে বর্ণিত আছে, পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়। পিতার অসন্তুষ্টির কারণে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হয়। হাদিসটি নিম্নরূপ:

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو، عَنِ النَّبِيِّ ﷺ قَالَ: رِضَى الرَّبِّ فِيْ رِضَى الْوَالِدِ، وَسَخَطُ الرَّبِّ فِيْ سَخَطِ الْوَالِدِ.

‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়। পিতার অসন্তুষ্টির কারণে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হয়।’’

এতিমের মর্যাদা পিতার মৃত্যুর কারণে

পিতার মৃত্যুর কারণে একজন শিশু গৌরবান্বিত হয়। সে এতিম বা অনাথ হিসেবে সমাজে পরিচিতি লাভ করে। কুরআন ও হাদিসে এতিমের রয়েছে অনেক ফজিলত ও মর্যাদা। মাতার মৃত্যুর কারণে কোনো শিশু এ সম্মানে ভূষিত হয় না। এতিমের মর্যাদার মূল কারণ হলো, পিতার মৃত্যুজনিত কারণে সন্তান জ্ঞান-বিজ্ঞান শেখার সুযোগ হারিয়ে ফেলে। সন্তানের লেখা-পড়া ও শিষ্টাচার শেখানোর এ দায়িত্ব একমাত্র পিতার দায়িত্বে ন্যাস্ত। মাতার স্নেহ-মমতা সন্তানের আদর্শিক উৎকর্ষতায় বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারে না। যা পারে পিতার যৌক্তিক শাসন ও মৃদু কঠোরতায়। এ জন্য আলি (রাযি.) বলেন,

لَيْسَ الْيَتِيمُ الَّذِي قَدْ مَاتَ وَالِدُهُ

إنَّ الْيَتِيمَ يَتِيمُ الْعِلْمِ وَالْأَدَبِ

‘যে সন্তানের পিতা মৃত্যুবরণ করেছে, সে প্রকৃতপক্ষে এতিম নয়। বাস্তবে এতিম হলো ওই ব্যক্তি, যে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিষ্টাচার শেখার সুযোগ-বঞ্চিত হয়েছে।’

স্বামীর মৃত্যুর কারণে স্ত্রী মর্যাদাবান হয়

পিতার মৃত্যুর কারণে শুধুমাত্র সন্তান মর্যাদাবান হয় তাই নয়, স্বামীর মৃত্যুর কারণে স্ত্রী নিজেও অনেক মর্যাদার অধিকারী হয়। হাদিস শরিফে বিধবা নারীর অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যুর কারণে স্বামীর মর্যাদা বৃদ্ধি পায় না। বিধবা নারীকে সাহায্যের ব্যাপারে রসূল (সা.) ইরশাদ করেন,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ ﷺ: السَّاعِي عَلَى الْأَرْمَلَةِ وَالْـمِسْكِيْنِ، كَالْـمُجَاهِدِ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ، أَوِ الْقَائِمِ اللَّيْلَ الصَّائِمِ النَّهَارَ.

‘হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, ‘বিধবা নারী ও অসহায় ব্যক্তির সাহায্যকারী আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর ন্যায়।’’

অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে, ‘বিধবা নারীকে সাহায্যকারী অনবরত নামায-রোযা পালনকারী ব্যক্তির মতো মর্যাদা লাভ করবে।’

বিধবা নারীর মর্যাদায় অন্য হাদিসে রসূল (সা.) ইরশাদ করেন,

عَنْ عَوْفِ بْنِ مَالِكٍ الْأَشْجَعِيِّ، قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: أَنَا وَامْرَأَةٌ سَفْعَاءُ الْـخَدَّيْنِ كَهَاتَيْنِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَأَوْمَأَ يَزِيْدُ بِالْوُسْطَىٰ وَالسَّبَّابَةِ امْرَأَةٌ آمَتْ مِنْ زَوْجِهَا ذَاتُ مَنْصِبٍ، وَجَمَالٍ، حَبَسَتْ نَفْسَهَا عَلَى يَتَامَاهَا حَتَّىٰ بَانُوْا أَوْ مَاتُوْا.

‘হযরত আউফ ইবনু মালিক (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে বিধবা নারী তার সন্তানের লালন-পালনে কঠোর সাধনার কারণে নিজের রূপ-লাবণ্য হারিয়ে ফেলেছে, আমি এবং সে কিয়ামতের দিন এভাবে থাকবো। এই বলে ইয়াযিদ (হাদিস বর্ণনাকারী) মধ্যমা ও তর্জনি দ্বারা ইঙ্গিত করেন।’’

স্বামীর মৃত্যুর কারণে স্ত্রী মর্যাদাবান হবার ব্যাপারে নিম্নের হাদিসটি প্রণিধানযোগ্য:

عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ قَالَتْ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: أَيُّمَا امْرَأَةٍ مَاتَتْ وَزَوْجُهَا عَنْهَا رَاضٍ دَخَلَتِ الْـجَنَّةَ: هَذَا حَدِيْثٌ حَسَنٌ غَرِيْبٌ.

‘হযরত উম্মে সালামা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘স্বামীকে সন্তুষ্ট রেখে যে স্ত্রী মারা যায় সে বেহেশতে প্রবেশ করবে।’ এটি একটি হাসান ও গরিব হাদিস।

অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, পিতার সার্বিক তত্ত্বাবধানের অভাবে সন্তান বিপথগামী হয় এবং তার সঠিক পরিচর্যায় সন্তান উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করে। পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, অর্থ-ভৈবভে কিংবা উন্নতির বিভিন্ন সেক্টরে যারাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাদের পেছনে রয়েছে পিতার সযতœ তত্ত্বাবধান। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পারিবারিক আইনের আলোকে পিতাই সন্তানের বৈধ অভিভাবক হিসেবে স্বীকৃত। সন্তানের বংশপরিচয় পিতার মাধ্যমেই সাব্যস্ত হয়। ইত্যাদি অনেক কারণে পিতার মর্যাদা মায়ের তুলনায় কোনো অংশে কম নয়। বরং ক্ষেত্রবিশেষে বেশি।

লেখক: সভাপতি, জাগৃতি লেখক ফোরাম

সূত্র:

আল-কুযায়ী, মুসনদুশ শিহাব, মুআস্সিসাতুর রিসালা, বয়রুত, লেবনান, খ. ১, পৃ. ১০২, হাদীস: ১১৯
আত-তাবারানী, আল-মু’জামুল কবীর, মাকতাবাতু ইবনে তায়মিয়া, কায়রো, মিসর, খ. ২, পৃ. ২৮৯, হাদীস: ২২০২
মুসলিম, আস-সহীহ, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরবী, বয়রুত, লেবনান, খ. ৪, পৃ. ১৯৭৪, হাদীস: ২৫৪৮
আত-তিরমিযী, আল-জামি‘উল কবীর = আস-সুনান, মুস্তফা আলবাবী অ্যান্ড সন্স পাবলিশিং অ্যান্ড প্রিন্টিং গ্রুপ, কায়রো, মিসর, খ. ৪, পৃ. ৩১১, হাদীস: ১৯০০
আল-কুরআনুল করীম, সুরা আন-নিসা, ৪:৩৪
আত-তাহাওয়ী, শরহু মুশকিলি আসার, মুআস্সিসাতুর রিসালা, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪১৫ হি. = ১৯৯৪ খ্রি.), খ. ৪, পৃ. ২৭৮, হাদীস: ১৫৯৮

মুসলিম, আস-সহীহ, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরবী, বয়রুত, লেবনান, খ. ৪, পৃ. ১৯৭৯, হাদীস: ২৫৫২
আত-তিরমিযী, আল-জামি‘উল কবীর = আস-সুনান, মুস্তফা আলবাবী অ্যান্ড সন্স পাবলিশিং অ্যান্ড প্রিন্টিং গ্রুপ, কায়রো, মিসর, খ. ৪, পৃ. ৩১০Ñ৩১১, হাদীস: ১৮৯৯
আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৭, পৃ. ৬২, হাদীস: ৫৩৫৩
আবু দাউদ, আস-সুনান, আল-মাকতাবাতুল আসরিয়া, বয়রুত, লেবনান, খ. ৪, পৃ. ৩৩৮, হাদীস: ৫১৪৯
আত-তিরমিযী, আল-জামি‘উল কবীর = আস-সুনান, মুস্তফা আলবাবী অ্যান্ড সন্স পাবলিশিং অ্যান্ড প্রিন্টিং গ্রুপ, কায়রো, মিসর, খ. ৩, পৃ. ৪৫৮, হাদীস: ১১৬১

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ