সাহাবাযুগের রাজনীতিপ্রবাহ
ইতিহাসের পুনর্পাঠ: খালিচোখে খোলাচোখে
মূল: মুবাশ্শির নাযির
ভাষান্তর: খন্দকার মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ
[পূর্বপ্রকাশিতের পর]
যুদ্ধ-বিষয়ক দস্তাবেজ
‘কুতুবে মাগাযী’
এ শ্রেণীর গ্রন্থে যুদ্ধ-বিষয়ক তথ্যাবলি নিয়ে আলোচনা করা হয়। ‘মাগাযী’-বিষয়ক গ্রন্থ রচয়িতাদের মধ্যে মুহাম্মদ ইবনে ওমর আল-ওয়াকিদীর নাম খ্যাতির শীর্ষে। যিনি যুদ্ধবিষয়ক তথ্যাবলি সংকলন করেছেন। তৃতীয় শতকে বালাযুরী ফুতুহুল বুলদান নামে একটি বৃহৎ কলেবরের ইতিহাসগ্রন্থ রচনা করে যা বিভিন্ন নগরী বিজয়ের বর্ণনার ক্ষেত্রে সমধিক মর্যাদাপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ.(১৬৪-২৪১ হি. = ৭৮০-৮৫৫ থ্রি.) বলেন, ‘মাগাযী, তাফসীর ও যুদ্ধ-বিষয়ক গ্রন্থগুলোর তেমন কোনো ভিত্তি নেই।’ আমি এই গ্রন্থে যে অনুসন্ধানের কাজ করছি তাতে কুতুবে মাগাযী খুব বেশি গুরুত্ব নেই।
ইতিহাসগ্রন্থ কুতুবে তারীখ
এই ধাঁচের গ্রন্থগুলোতে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা (ঈযড়ৎড়হড়ষড়মরপধষ ঙৎফবৎ) অনুসারে তথ্য সন্নিবেশ করা হয়। এ শ্রেণীর গ্রন্থাবলির মধ্যে ইবনে জারীর তাবারি (২২৪-৩১০ হি. = ৮৩৮-৯২২ খ্রি.)-এর তারীখুল উমাম ওয়াল মুলুক সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। সংক্ষেপে এটা তারীখে তাবারী নামে পরিচিত এবং এটা পরবর্তী ইতিহাসগ্রন্থসমুহের জন্য রেফারেন্স বুক এর অবস্থানে আছে। তাবারিকে ইতিহাসশাস্ত্রের নতুন আঙ্গিকের প্রবর্তক (ঞৎধহফ ংবঃঃবৎ) মনে করা হয়। তারিখে তাবারীর পরে লিখিত গ্রন্থসমূহের প্রায় সবগুলোর উৎসই হয়তো তারিখে তাবারী নয়তো বংশধারা ও তাবাকাত বিষয়ক গ্রন্থাবলি। কাজেই পরবর্তীকালে রচিত গ্রন্থসমূহ তারিখে তাবারীর অবস্থানে পৌঁছুতে পারেনি। তাবারীর আগে খলিফা ইবনে খাইয়্যাত (১৬০-২৪০ হি. = ৭৭৭-৮৫৪ খ্রি.) এই আঙ্গিকের গ্রন্থ রচনা করেছিলেন বটে তবে তিনি তাবারীর মতো গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি।
হিজরি তৃতীয় শতকের
যত বিখ্যাত ইতিহাসবিদ
হিজরি তৃতীয় শতকের বিখ্যাত ইতিহাসবিদের মধ্যে যারা রয়েছেন :
১. মুহাম্মদ ইবনে সাআদ কাতেব আল-ওয়াকিদী (১৬৪-২৩০ হি. = ৭৮৪-৮৪৫ খ্রি.) তাবাকাত ইবনে সাআদের গ্রন্থকার। তিনি ওয়াকিদীর শিষ্য ও সচিব ছিলেন। তার গ্রন্থে তার শিক্ষক ওয়াকিদীর প্রচুর বর্ণনা লক্ষ করা যায়; যা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সতর্কতার দাবি রাখে।
২. আহমদ ইবনে ইয়াহইয়া আল বালাযুরী (মৃ. ২৭৯-৮৯৩) তিনি আনসাবুল আশরাফ ও ফুতুহুল বুলদান নামের গ্রন্থদুটির রচয়িতা।
৩. ইবনে জারির আত-তাবারী (২২৪-৩১০ হি. = ৮৩৮-৯২২ খ্রি.) তিনি ইতিহাস ও তাফসীরশাস্ত্রের নতুন আঙ্গিকস্রষ্টা। তিনি দীর্ঘ ইতিহাসকে যুগভিত্তিক বিন্যাসে (ঈযৎড়হড়ষড়মরপধষ ঙৎফবৎ) বর্ণনা করেছেন। আমাদের এই গ্রন্থের বুনিয়াদি উৎস উপরিউক্ত তিন গ্রন্থকার। তবে তাদের ছাড়া আরও কিছু উৎসের সহযোগিতাও আমরা নিয়েছি।
তাবারী শিয়া ছিলেন কিনা তা বিশেষজ্ঞদের মাঝে মতবিরোধপূর্ণ বিষয়। এক পক্ষের দাবি, তিনি শিয়া ছিলেন। অন্যপক্ষ বলছে, তিনি শিয়া ছিলেন না; তার নামে আরেকজন ব্যক্তি মুহাম্মদ ইবনে জারির ইবনে রুস্তম তাবারী ছিলেন বলেই উভয়ের পরিচিতির ক্ষেত্রে এই দ্ব্যর্থবোধ ও অস্পষ্টতা তৈরি হয়। শিয়া আলিম কমর বুখারী বলেন, যদিও তাবারী সুন্নি আলিম ছিলেন; তবে জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তিনি শিয়া মতবাদের দিকে খানিকটা ঝুঁকে ছিলেন বলেই প্রতীয়মান হয়।
তাবারীর ইতিহাসগ্রন্থ অধ্যয়ন করলে দেখা যাবে হযরত আবু বকর (রাযি.), হযরত ওমর (রাযি.), হযরত ওসমান (রাযি.) ও হযরত আলী (রাযি.) ব্যাপারে যেখানে সমালোচনামূলক বর্ণনার সমান্তরালে তাঁদের গুণাবলি, মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের কথাও উদ্ধৃত হয়েছে। যেভাবে হযরত আলী (রাযি.) এর প্রশংসাব্যঞ্জক বর্ণনার রয়েছে ঠিক একইভাবে তাদের সমালোচনামূলক কথা স্থান পেয়েছে এই গ্রন্থে। কাজেই আমরা বলবো, তাবারী স্রেফ একজন ইতিহাসবিদ ছিলেনÑযাই পেয়েছেন সংকলন করে নিয়েছেন। সত্যাসত্যের বিচার ও যাচাইয়ের ভার তিনি পরবর্তী প্রজন্মের কাঁধে তুলে দিয়েছেন।
আল-জাহিয
(১৫৯-২৫৫ হি. = ৭৭৬-৮৬৯ খ্রি.)
আল জাহিয যতটুকু ইতিহাসবিদ ছিলেন তার চাইতে বেশি সাহিত্যিক ছিলেন। আমাদের দেশেও অনেক লেখক ইতিহাসাশ্রয়ী উপন্যাস বা ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছেন। ঔপন্যাসিক বা সাহিত্যিকের মূল লক্ষ্য ইতিহাসের তথ্য যাচাই করা নয়। বরং তার ভাবনা হলো, ইতিহাসের যে উপাত্তই পাওয়া যাবে তা গল্পের কাঠামো ও বর্ণনার রঙের তুলিতে সাজিয়ে তুলবেন। এ কারণে গল্প, উপন্যাসকে ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য সূত্র বলে গণ্য করা হয় না। হ্যাঁ সাধারণ মানুষের জন্য এটা থেকে উপকৃত হওয়া অধিতর সহজ। কারণ এগুলো স্বভাবতই পাঠকবান্ধব (জবধফবৎ ভৎরবহফষু) বইয়ের শ্রেণীভুক্ত। তবুও জাহেয সম্পর্কে বলতে হয়, তিনি তার গ্রন্থে ইতিহাসের তথ্যাবলির সত্যতা যাচাই করেছেন। সন্দেহ ও পর্যালোচনাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। ইতিহাসশাস্ত্রের তিনি আলী ইবনে মুহাম্মদ আল-মাদায়েনী (১৩৫-২৫৫ হি. = ৭৫২-৮৪০)-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন এবং তার কর্ম ও অবদান সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রন্থও লিখেছেন। আমরা তার লিখিত এ বিষয়ক অন্যতম গ্রন্থ আল ওসমানিয়া থেকে উপাত্ত সহায়তা নিয়েছি।
ইবনে আবদুল হাকাম
(১৮৭-২৫৭ হি. = ৮০৩-৮৭১ খ্রি.)
তিনি মিসর ও উত্তর আফ্রিকার ইতিহাস লিখেছেন যার সঙ্গে আমাদের এই গ্রন্থের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ নয়।
ইবনে আবিদ দুনিয়া
(২০৮-২৮১ হি. = ৮০৩-৮৭১ হি.)
তিনি অনেক বড় মাপের মুহাদ্দিস (হাদিস বিশারদ)। তিনি ইতিহাসবিষয়ক গ্রন্থও লিখেছেন। তার অধিকাংশ গ্রন্থ আত্মশুদ্ধিবিষয়ক। তার ইতিহাসগ্রন্থ আমাদের যুগ পর্যন্ত পৌঁছেনি।
খলিফা ইবনে খইয়্যাত
(১৬০-২৪০ হি. = ৭৭৭-৮৫৪ খ্রি.)
অত্যন্ত উঁচুমাপের ইতিহাসবিদ। তার লেখা প্রসিদ্ধ ইতিহাসগ্রন্থের নাম তারিখু খলিফা ইবনে খইয়্যাত। এটাই সম্ভবত ইতিহাসশাস্ত্রের সূত্র (ঈযৎড়হড়ষড়মরপধষ ঙৎফবৎ) মেনে রচিত প্রথম গ্রন্থ। তবে এ গ্রন্থ তারিখে তাবারীর মতো গ্রহণযোগ্যতা পায় নি। এর কারণ সম্ভত অতি সংক্ষেপন। তিনি ২৩২ বছরের ইতিহাস মাত্র ৪৫০ পৃষ্ঠার মধ্যে বর্ণনা করে দিয়েছেন। এছাড়াও তিনি ‘তাবাকাত’ বিষয়ক গ্রন্থও লিখেছেন, যেখানে স্তরক্রমানুসারে ব্যক্তিদের জীবন ও কর্মের পাশাপাশি ইতিহাসের ঘটনাবলিও বর্ণনা করা হয়েছে।
ইবনে হিশাম (মৃ. ২১৮ হি. = ৮৩৪ খ্রি.)
তিনি শীর্ষস্থানীয় ইতিহাসবিদদের কাতারে পরিগণিত। তিনি মুহাম্মদ ইবনে ইসহাকের সীরাতে নবভীর (সা.) সংক্ষিপ্তসার লিখেছেন যা সীরাতে ইবনে হিশাম নামে পরিচিত। এবিষয়ক গ্রন্থাবলির মধ্যে এটা প্রাচীনতম। যেহেতু তার গ্রন্থ সীরাতে নবভী-বিষয়ক কাজেই এ গ্রন্থের সঙ্গে এর সরাসরি সম্পর্ক নেই।
আবু আব্বাস ইয়াকুবী
(মৃ. ২৮৪-৮৯৭ খ্রি.)
তিনি বড় ইতিহাস ভূগোলবিদ; যার লেখা বিখ্যাত ইতিহাসগ্রন্থ তারিখে ইয়াকুবী নামে প্রসিদ্ধ। তিনি একজন শিয়া মতাবলম্বী ইতিহাসবিদ ছিলেন।
ওমর ইবনে শাইবা
(১৭৩-২৬২ হি. = ৭৮৯-৮৭৬ খ্রি.)
ওমর একজন বড় আলেম ছিলেন। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার দুর্দান্ত বিচরণ ছিলো। নানা শাস্ত্রে তার লেখা একাধিক গ্রন্থ রয়েছে। ইতিহাসশাস্ত্রে তার রচিত গ্রন্থাবলির মধ্যে আল কুফা, কিতাবুল বসরা, কিতাবু ওমরাউল মাদিনা, কিতাবু উমারাউল মাক্কাহ, কিতাবুস সুলতান, কিতাবু মাকতালি উসমান, কিতাবুত্ তারিখ বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তিনি ইতিহাসশাস্ত্রে নতুন ধারার প্রবর্তক। তার সেই নতুন আঙ্গিক হলো, শহর ও নগরভিত্তিক ইতিহাসগ্রন্থ রচনা। যেখানে সংশ্লিষ্ট নগরীর বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যদিও প্রায় এমন আঙ্গিক তাবাকাতে ইবনে সাআদেও দেখা যায় কিন্ত্ ুওমর ইবনে শাইবার পর প্রত্যেক নগরীর স্বতন্ত্র ইতিহাস রচনার ধারাটি জনপ্রিয়তা ও প্রতিষ্ঠা পায়। তার অনেক গ্রন্থই এখন দুষ্প্রাপ্য। তা সত্ত্বেও তাবারীতে তার বহু বর্ণনা মেলে।
আল-ইমামাতু ওয়াস
সিয়াসার গ্রন্থকার
বিখ্যাত স্কলার, অনেক উঁচুমাপের আলেম ইবনে কুতাইবা দিনুরীকে নেতৃত্ব ও রাজনীতি নামক গ্রন্থের প্রণেতা বলে ধারণা করা হয়। তবে বহুল প্রচারিত এই ধারণাটি সঠিক নয়। গ্রন্থটি অধ্যয়ন করলেই বোঝা যায় এর লেখক একজন উগ্রপন্থী শিয়া। ইবনে কুতাইবা কঠোর শিয়াবিরোধী লোক হিসেবে পরিচিতি ছিলেন। ইবনে নাদীম কর্তৃক সম্পাদিত ফাহরাস্ত (গ্রন্থ তালিকা)-এ তার রচনাবলিতে আল ইমামাতু ওয়াস সিয়াসাহ নামে কোনো গ্রন্থ নেই। অধিকন্তু গ্রন্থটির আঙ্গিক ইবনে কুতাইবার অন্যান্য রচনা-আঙ্গিকের সঙ্গেও মেলে না। কাজেই এটা পরিষ্কার যে, আল-ইমামাতু ওয়াস সিয়াসা ইবনে কুতাইবার গ্রন্থ নয়।
[চলবে]
আসকালানী, লিসানুল মিযান গ্রন্থের ভূমিকা, ১/২০৭
কমর বুখারী, মুআররিখ আবু মুহনিফ পর এক নজর, প্রাগুক্ত