জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

খাঁটি অল্প আমলই নাজাতের জন্যে যথেষ্ট

আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসেম্মলন ২০১৭

আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসেম্মলন ২০১৭

খাঁটি অল্প আমলই নাজাতের জন্যে যথেষ্ট

মাওলানা হাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী সাহেব দা. বা. (কুয়াকাটা)

الْـحَمْدُ للهِ، وَكَفَىٰ وَسَلَامٌ عَلَىٰ عِبَادِهِ الَّذِيْنَ اصْطَفَىٰ، أَمَّا بَعْدُ! فَأَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ، بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ: فَمَنْ كَانَ يَرْجُوْا لِقَآءَ رَبِّهٖ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَّ لَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهٖۤ اَحَدًاؒ۰۰۱۱۰ {الكهف:১১০}

عَنِ الْـحَسَنِ، قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: لَا طَاعَةَ لِـمَخْلُوقٍ فِي مَعْصِيَةِ الْـخَالِقِ رواه ابن أبي شيبة في مصنفه (৬ / ৫৪৫) (رقم: ৩৩৭১৭).

أَخْلِصْ دِيْنَكَ يَكْفِكَ الْعَمَلُ الْقَلِيْلُ رواه الحكام في مستدركه (৪ / ৩৪১) (رقم: ৭৮৪৪).

আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া কর্তৃক আয়োজিত দু’দিন ব্যাপী আন্তর্জাতিক ইসলামি মহাসম্মেলনের প্রথম দিবসের উপস্থিত সম্মানিত সভাপতি, মুয়ায্যায ও মুর্কারম, জাতির মাথার মুকুট, ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া হযরাতে ওলামায়ে কেরাম। দূর-দূরান্ত থেকে আগত আল্লাহ পাকের যাকিরীন, শাকিরীন, মুরব্বীয়ানে ইযাম। কলিজার টুকরা আমার সমবয়সী যুবক বন্ধুগণ ও স্নেহের ছোট ভাইয়েরা। দয়াময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে লাখো কোটি শুকর, যে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই ফেতনার যমানায় কুরআন ও সুন্নার ভিত্তিতে সহীহ তরিকায় কিছু কথা বলার এবং শুনার জন্য কবুল করেছেন এজন্য শুকর আদায় করি আল-হামদুলিল্লাহ। লক্ষ-কোটি দুরূদ আর সালাম নাজিল হোক প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর।

কুরআনে করীমের সুরা আল-কাহাফের শেষ আয়াত আপনাদের সামনে তেলাওয়াত করেছি এবং রাসূলে কারিম (সা.)-এর অজস্র মুবারক হাদীস থেকে দুটি হাদীস পড়েছি। তিলাওয়াতকৃত আয়াত এবং হাদিসের আলোকে ইখলাস ও রূহানিয়্যাতের সমন্বয়ে কিছু কথা আল্লাহ আমাকে বলার এবং আপনাদেরকে শোনার তাওফিক দান করুন। আমিন।

আমরা এ দুনিয়াতে কেউ ইচ্ছা করে আসিনি। আল্লাহ তায়ালা দয়া করে আমাদেরকে পাঠিয়েছেন। কেউ কেউ মনে করে আল্লাহ আমাদেরকে অকারণে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। এজন্য দুনিয়ার পেছনে দৌড়ায়। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি তোমাকে অনর্থক সৃষ্টি করিনি। আর এ কথাও ভাবিওনা যে, আর কখনো ফিরে আসতে হবে না। আল্লাহ মানবজাতিকে সৃষ্টি করার প্রথম কারণ হলো তাঁর ইবাদত করা। আল্লাহ বলেন,

وَ مَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْاِنْسَ اِلَّا لِيَعْبُدُوْنِ۰۰۵۶

‘আমি মানুষ এবং জিন জাতিকে একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি।’

আল্লাহ মানবজাতিকে সৃষ্টি করার দ্বিতীয় কারণ হলো ভালো আমল করা। আল্লাহ বলেন,

الَّذِيْ خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيٰوةَ لِيَبْلُوَكُمْ اَيُّكُمْ اَحْسَنُ عَمَلًا١ؕ وَهُوَ الْعَزِيْزُ الْغَفُوْرُۙ۰۰۲

‘যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।’

বেশি আমল করা নয় ভালো আমল করা। অনেকে বেশি আমল করেছে কিন্তু আকিদায় ভেজাল এ আমল দিয়ে নাজাতের দরজা খুলবে না। আমল আরবি শব্দ যার অর্থ হলো কাজ। আমল দুই প্রকার। নেক আমল আর বদ আমল। নেক আমল যেমন ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত, মুস্তাহাব ইত্যাদি। আর বদ আমল যেমন হারাম, মাকরুহ, শিরক, বিদায়াত ইত্যাদি। বদ আমল আবার দুই প্রকার। ফাহশা (অশ্লীল) এবং মুনকার (গর্হিত)। যেমন আল্লাহ বলেন,

اِنَّ الصَّلٰوةَ تَنْهٰى عَنِ الْفَحْشَآءِ وَ الْمُنْكَرِ١ؕ وَلَذِكْرُ اللّٰهِ اَكْبَرُ١ؕ وَاللّٰهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُوْنَ۰۰۴۵

‘নিশ্চয় নামায অশ্লীল ও গর্হিত কার্য থেকে বিরত রাখে। আল্লাহর স্মরণ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তা জানেন তোমরা যা কর।’

আল্লাহ এমন কিছু খারাপ কাজ রেখেছেন যেগুলো বুঝতে কোন দলিল লাগে না। এগুলো হলো ফাহশা। আর যেগুলো দলিলের অপেক্ষা করে তা হলো মুনকার। যেমন মিথ্যা বলা, এটা যে পাপ তা বুঝতে কোন দলিলের প্রয়োজন হয় না। গালি কেউ পছন্দ করে না, আল্লাহও পছন্দ করেন না; দুনিয়ার কোন মানুষও পছন্দ করেন না। কিন্তু আমাদের সমাজে বহু আল্লাহর বান্দা আছে যাদের নামে আওলাদে রাসূল টাইটেল লাগায় অথচ প্রচণ্ড ভাষায় গালি দেয়। আমি আল্লাহর শপথ করে বলি, যার মুখ থেকে গালি বের হয় সে কখনো আওলাদে রাসূল হতে পারে না। রাসুল (সা.) বলেন,

الصدق ينجي والكذب يهلك.

‘সত্য মানুষকে মুক্তি দেয় । আর মিথ্যা মানুষকে ধ্বংস করে।’

অন্য হাদীসে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, তোমরা যদি দুইটা জিনিসের হেফাজতের দায়িত্ব নাও, আমি তোমাদের জান্নাতে নেওয়ার দায়িত্ব নেব। একটি হলো মুখ আরেকটি হলো লজ্জাস্থান।

আজ একদল আল্লাহর বান্দাদের বয়ানের বিষয়বস্তু হলো, গালি আর গালি। হে নবীর উম্মতের দল! গালি দেয়াটা পতনের পূর্বাভাস, গালি না দেয়াটা বিজয়ের পূর্বাভাস। সমালোচনা নয় পর্যালোচনার আলোকে বলছি, যারা তাবলিগ জামাত, ওলামায়ে দেওবন্দের গালি দেয় এদের বয়ানে না কোন কান্নার আওয়াজ আছে, না কোন শালীনতা আছে। এদের বয়ানে না কোন মানুষ আমলঅলা হয়েছে, একটা প্রমাণও পাওয়া যায়নি। বরং যারা গালি দেয় না গালিকে হজম করে, আল্লাহ তাদেরকে দিন দিন উন্নতি দান করেন। যত গালি দিবেন আরো বাড়বে। কওমি মাদরাসার বিরুদ্ধে দেওবন্দিদের বিরুদ্ধে যত মিথ্যাচার, যত অপবাদ আর গালি এর দ্বারা মাদরাসা আরো বাড়ছে। আমার মন বলে, সেদিন বেশি দূরে নয় বাংলাদেশের অবস্থা এমন হবে যে প্রত্যেকটা ঘর হবে একেকটা কওমি মাদরাসা। কারণ জোয়ারের পানিতে বাঁধ দিলে যেমন জোয়ারের পানি বেগ আরো বেড়ে যায়, ঈমানঅলাদের ঈমানে বাঁধা দিলে ঈমানের শক্তিও আরো বেড়ে যায়।

আর কিছু কাজ আছে যেগুলো নিজেকে বুঝে আসে না দলিল প্রমাণের প্রয়োজন হয়। যেমন পীর সাহেবকে সিজদা করা, মাজারে মোমবাতি জ্বালানো। সিজদা করা ভালো কাজ, কিন্তু পীর সাহেবকে সিজদা করা শিরক। কবরে মোমবাতি জ্বালানো একটি গুনাহের কাজ। তারা বলে এটা সওয়াবের কাজ। আমরা বলি এটা কীভাবে মহান কাজ হয়? তোমার পীর বাবার যদি রূহানিয়্যাতের পাওয়ার ভালই থাকে তাহলে বেনামাযী মানুষের হাতে বানানো মোমবাতি দিয়ে কেন আলোকিত করতে হয়? আমার মনে হয় ওই বাবার মারিফাতের আলো ফিওজ হয়ে গেছে। যদি মোম জ্বালালে বরকত পাওয়া যায়, তাহলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মাজার নবীর রওজায় কেন মোমবাতি জ্বালায় না? সুতরাং ফলাফল হলো মদিনায় যা চলবে না তা পৃথিবীর কোন মাজারে চলবে না। আল্লাহ আমাদের হিদায়াত দান করুন।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, নেক আমল কর; বেশি আমল নয়। বেশি আমল করলে আকিদার মধ্যে ভেজাল হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন, আমি মানুষ বানানোর পেছনে কারণ হলো ভালো আমল করা। বেশি আমল করা নয়। কারা ভলো আমল করে কারা খারাপ আমল করে তা পরীক্ষা করার জন্য আমি তোমাদেরকে দুনিয়াতে পাঠালাম। ভালো আমল কর, বেশি আমল নয়। তবে কোন দিনের আমল আল্লাহর কাছে কবুল হবে তা আপনারও জানা নাই আমারও জানা নাই। কোন দিনের নামায, কোন দিনের যিকির, কোন দিনের তসবীহ, কোন দিনের ইবাদত ভালো আমল বলে আল্লাহর কাছে কবুল হবে বলা যায় না। একারণে বান্দা একদিন আমল না দুনিয়ায় আসা থেকে মরণ পর্যন্ত আমল করতে থাক। একদিনের আমল যদি আল্লাহর কাছে কবুল হয়, অল্প আমলও নাজাতের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে। ভালো আমল করলে আল্লাহ জান্নাতের দরজা খুলে দেবেন।

রাসুলের আদরের সাহাবী মুয়াজ ইবনে জাবাল (রাযি.) বলেন, ভালো আমলের জন্য চারটা জিনিসের দরকার। নামায, যিকির, রোযা, আল্লাহঅলাদের খেদমত করা। সব ভালো আমল, মাদরাসা, মসজিদ ও দীনের পথে দান করাও ভালো আমল। তবে সব আমল আল্লাহর কাছে ভাল আমল হিসেবে কবুল হবে না। আল্লাহর কাছে ওই আমলটা ভালো আমল হিসেবে কবুল হবে যে আমলের ভেতরে চারটি জিনিস পাওয়া যাবে।

১. নাম্বার হলো ইলম:

ইলম আসবে আল্লাহঅলাদের সুহবত ও কিতাবাদির মাধ্যমে। ইলমের এত দাম রাসূলের আদরের সাহাবি হযরত আলী (রাযি.) আল্লাহর দরবারে শুকর আদায় করে বলেন, হে আল্লাহ! সম্মানের চেয়ারে যদি বসতে হয়, দুইটা পুঁজির একটা লাগে; সম্পদ বা ইলম। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে সম্পদ না দিয়ে ইলম দান করেছেন এজন্য আপনার দরবারে হাজার শুকর। কারণ টাকাঅলার টাকা আজ আছে কাল নাই কিন্তু ইলমঅলার ইলম সিনায় ঢুকবে আর বিদায় হবে না। আমি ইলম পেয়ে খুশি টাকা পেয়ে খুশি না। কারণ টাকাঅলার টাকা আজ আছে কাল নাই কিন্তু ইলমঅলার ইলম সিনায় ঢুকবে আর বের হবে না। আমি ইলম পেয়ে খুশি কারণ ইলমঅলার ইলম যত বাড়ে বন্ধু তত বাড়ে কিন্তু টাকাঅলার টাকা যত বাড়ে শত্রু তত বাড়ে। টাকাঅলার টাকা যত বাড়ে ঘৃণা তত বাড়ে। আর ইলমঅলার ইলম যত বাড়ে সবার মুহাব্বত তত বাড়ে। টাকাঅলা যখন বুড়া হয়ে যায় ছেলেরাও পছন্দ করে না, বিবিরাও পছন্দ করে না। বাবা যদি মরে যায় বাবার রেখে যাওয়া টাকা দিয়ে মাস্তানি করব, ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনস দিবস পালন করব। সে দিন আমরা মনগড়া চলব, বাবার বাঁধা দেওয়ার সুযোগ নেই। আর একজন ইলমঅলাকে যখন পায় আর সে বুড়া হয়ে গেল। আল্লাহর ওলির মসনদে ইলমের পাহাড় হয়ে বসে আছেন। আমার মত নাম্বার ছাড়া মানুষ নয় বড় বড় মুহাদ্দেসীনদের দিকে তাকায় দেখি তারা জুতা সোজা করার জন্য আল্লাহঅলাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।

২. নাম্বার হলো বিশুদ্ধ নিয়ত:

ভালো আমল যদি করতে চান, তাহলে ভালো নিয়ত লাগবে। আল্লাহর নবী বলেন,

্রإِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِগ্ধ رواه البخاري (১ / ৬ (رقم: ১).

হযরত আদম (আ.) জমিনের মধ্যে পদার্পণ করলেন, জান্নাতের পোষাক শরীরে নেই, কারণ নিষিদ্ধ গাছের কাছে যাওয়ার কারণে পোষাক পড়ে গিয়েছিল। তিনি আল্লাহ পাকের দরবারে বলছিলেন যে, মালিক আমাদের জান্নাতী পোষাক নেই আমি এখন কেমন করে সতর ঢেকে নেব। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তীন নামের একটি গাছ আছে এই গাছের পাতা দিয়ে তোমরা সতর ঢাক। তখন হযরত আদম (আ.) তিনটা পাতা নিয়ে সতর ঢেকে নিলেন। আম্মাজান হাওয়া (আ.) পাঁচটা পাতা দিয়ে সতর ঢেকে নিলেন। এই পাতা পরিহিত অবস্থায় দুনিয়াতে পদার্পণ করলেন। আদম আ. দুনিয়াতে আগমনের খবর পাওয়ার পর জঙ্গলের জীব জন্তুরা সাক্ষাতের জন্য দৌড়ে গেল। আদম (আ.)-এর সাথে সাক্ষাতের পর আদম (আ.) গাছের পাতাগুলো ছিড়ে ছিড়ে হরিণের মুখে মুখে দিয়ে দিল। কারণ তিনি জানতেন বনের জন্তুরা গাছের পাতা খুব পছন্দ করে। আদম (আ.) পাতাগুলো হরিণের মুখে দেয়ার পরে আল্লাহ তায়ালা জান্নাতের পাতার বরকতে হরিণকে তিনটা নেয়ামত দান করেছেন। ১. তাদের চেহারা সুন্দর গয়ে গিয়েছে। ২. হরিণির মাংসের ভেতরে আল্লাহ স্বাদ বাড়াই দিলেন। ৩. হরিণির নাভির ভেতরে কস্তুরির ব্যবস্থা করে দিলেন। একথা শুনে আরেকদল আদম (আ.)-এর কাছে দৌড়ে আসল পাতার জন্য। তাদেরকেও আদম (আ.) পাতা দিলেন। কিন্তু তাদের পাতার মধ্যে সুগন্ধি ছিল না। কারণ তারা নবীকে দেখতে যাননি; বরং তারা পাতার জন্য গিয়েছিল। তাদের নিয়তের মধ্যে ভেজাল ছিল। তাদের নিয়তের কারণে তারা পরিপূর্ণ নেয়ামত পেল না। এজন্য ভালো আমলের জন্য বিশুদ্ধ নিয়ত দরকার। আল্লাহর দরবারে বিশুদ্ধ নিয়তের এত দাম, আল্লাহ তায়ালা বলেন, নেক আমল কর জান্নাতের মেহমানখানা তোমার জন্য রিজার্ভ হবে।

৩. নাম্বার হলো ধৈর্য ধারণ করা

ধৈর্যের এত দাম, আল্লাহ তায়ালা কুরআনে পাকে বলেন, কিয়ামতের ময়দানে ধৈর্য ধারণকারীদের বলা হবে বিনা হিসেবে জান্নাতে চলে যাও।

আজকে আমাদের ভেতরে ধৈর্যর কোন খবর নাই। যদি থাকত তাহলে এক মুমিন আরেক মুমিনকে কাফির বলে গালি দিতে পারত না। গালি কেন দেনরে ভাই। পাঁচ কলি টুপি ও গোল পাঞ্জাবী পরে সময় কাটিয়ে দিয়েছি। আজো পর্যন্ত ভিন্ন পোষাকঅলাদেরকে হিংসাও করলাম না। গালিও দিলাম না। যে মাদরাসায় পড়লে কোন চাকরি নাই সেই মাদরাসায় লেখা-পড়া করেছি। আমরা কওমি মাদরাসায় লেখা-পড়া করেছি চাকরির জন্য নয়; বরং আল্লাহ তায়ালার গোলামির জন্য। আজো আল্লাহর গোলামির পেছনেই দৌড়ায়, দুনিয়ার টাকা-পয়সা আমাদের পেছনে পেছনে দৌড়ায়।

হে নবীর উম্মতের দল! আজকে জামিয়া পটিয়া সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে পরিচিত। সারা দুনিয়ার খবর নিয়ে দেখ কওমি মাদরাসার অবদান অনস্বীকার্য। কারণ সাহারানপুর জেলার একটা জায়গার নাম ছিল দেওবন্দ। এখন শুধু একটা জায়গার নাম দেওবন্দ না। দেওবন্দ শব্দটা মনে হয় যেন বিশাল একটা পতাকার নাম; মানুষ সেই পতাকার নীচে অবস্থান করতেছে। দেওবন্দ শব্দটা একটা এটম বোমার মত। দেওবন্দের নিসবত নিয়ে যারা বের হয়, মনে হয় তারা যেন একটা এটম বোমা বের হয়েছে। দেওবন্দের ইতিহাসের দিকে তাকাও। আজো পর্যন্ত গালির আওয়াজ তাদের যবানে নাই। হিংসার আওয়াজ নাই; বরং তাদের ছোঁয়া যেখানেই লাগলো সেই মাটিও ধন্য সেই এলাকাও ধন্য। হে পটিয়ার যুবকেরা! কত দুষ্কৃতিকারীরা কওমি মাদরাসার গায়ে কাদা লাগাতে চেয়েছে কিন্তু আজো পর্যন্ত পারে নাই। বর্তমানে প্রশাসন পর্যন্ত চিল্লায় বলতে বাধ্য হয়েছে। সরকার পর্যন্ত জানত না কওমি মাদরাসা কী জিনিস। আজ ক্লিয়ারভাবে জেনেছে, কওমি মাদরাসা এক আদর্শ মিশনের নাম। তারা বলেছে এ মাদরাসায় কোন জঙ্গি নাই। হাটহাজারী মাদরাসা থেকে শুরু করে পুরো বাংলাদেশ খোঁজে দেখেন; কওমি মাদরাসার ছাত্ররা পরস্পর অস্ত্র নিয়ে মারামারি করে মাদরাসা বন্ধ হয়ে গেছে এমন কোন দৃষ্টান্ত নাই। কিন্তু বাংলাদেশে হাজার হাজার স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল। আমরাতো একবারো বলি নাই যে, স্কুল বন্ধ করে দাও বা কলেজ বন্ধ করে দাও। এখানে অস্ত্রের মহড়া চলে, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দাও। তারা বলে, মাদরাসা বন্ধ করে দাও কারণ মাদরাসায় বাংলা-অংক ইংরেজি নেই। আমাদের মুরববীরা যতটুকু প্রয়োজন বাংলা, অংক, ইংরেজি সিলেবাসভুক্ত করে দিয়েছেন। আমরা বলিনাই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ কর। আমরা বললাম সব ঠিক আছে থাক। কিছু বন্ধ করতে হবে না। তবে আমাদের দাবি হলো, স্কুল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ক্লাসে কুরআনের আওয়াজ ঢুকিয়ে দাও। হে যুবকেরা! আমি বলছি না তোমরা আমার মত হুযুর হয়ে যাও। নবীর আদর্শের মালাটা মাথায় দাও। পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় কর। দাড়িগুলো লম্বা কর। আল্লাহঅলার বন্ধু হয়ে যাও এবং যবানকে হেফাজত কর। অল্প আমল নিয়েও যদি যাও জান্নাতের দরজা ওপেন হয়ে যাবে। ভালো আমলের জন্য আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে পাঠালেন। আজকে যদি আমাদের ভেতরে ধৈর্য থাকতো, তাহলে কোন মানুষ অপর মানুষের ঘরে আগুন দিতে পারত না। আল্লাহ আমাদের ধৈর্য দান করুন আমীন। আল্লাহ তায়ালা বারবার কুরআনে ধৈর্যের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,

يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اسْتَعِيْنُوْا بِالصَّبْرِ وَ الصَّلٰوةِ١ؕ اِنَّ اللّٰهَ مَعَ الصّٰبِرِيْنَ۰۰۱۵۳

‘হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য এবং সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যধারণকারীদের সাথে আছেন।’

দুনিয়াতে ধৈর্যের দৃষ্টান্ত রেখে গেছে পয়গাম্বর ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আ.)। হযরত ইবরাহীম (আ.) ইসমাঈল (আ.) কে ছুরির নিচে দিয়ে বলে সন্তান তোমার কী মতামত? সন্তান ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে বলেন, হে বাবা! কোন চিন্তা নেই। আমি ধৈর্যধারণকারীদের মধ্যে একজন। আপনি তাড়াতাড়ি জবাই করে দিন। কারণ দেরি হলে যদি আল্লাহ হুকুম অন্যদিকে নিয়ে যায়? তবে কথাটা যদি আব্বা বাড়িতে থাকতে বলতেন, আমি আমার আম্মুকে বিদায়ের সালামটা দিয়ে আসতাম। আমার মা আমাকে কত কষ্ট করে লালন পালন করেছেন। পানি নেই, খাবার নেই, আমার মা খেতেও পারেন না। আমার ক্ষুধা নিবারণের জন্য মায়ের জিহ্বাটা আমার মুখের ভিতর দিয়েছেন। আমার মা তো জানে না যে, আপনি আমাকে জবাই করবেন। আমার মাকে আমি বলতে পারিনি। বিদায় নিতে পারলাম না; আপনি যদি বাড়ি যান, আমার সালাম পৌঁছিয়ে দিবেন। আমার মাকে দোয়া করতে বলবেন। আর জবাই করার সময় চোখ দুইটা কাপড় দিয়ে বেঁধে নেবেন। জবাই করতে গিয়ে আমার দিকে যদি আপনার দৃষ্টি পড়ে মায়া লাগে জবাই করতে পারবেন না। আর আমার হাতে-পায়ে রশি ভালো করে বাঁধেন। কারণ জবাই করার সময় যদি আমার হাত-পা নড়াচড়া করে আর আপনার শরীরে লেগে যায়, বেয়াদবি হয়ে যাবে। আর আমাকে জবাই করে দেন এবং আমার মাকে দোয়া করতে বলবেন। আমাকে না পেয়ে আমার মা কান্নায় ভরে যাবে মায়ের কান্না দেখে বোঝাবেন। বিবি ধৈর্য ধারণ কর কাল কিয়ামতের ময়দানে ইসমাঈলের সাথে মোলাকাত হয়ে যাবে। হে নবীর উম্মতের দল! বাবার ছুরির সামনে বিলিন করে দিলেন। আমি তোমাদের জবাই চাইনি, চেয়েছি দিলের তামান্না। আমি জবাই চাই নাই চেয়েছি অস্ত্র রূপে মুহাব্বত। আমি চেয়েছি তুমি আমাকে কতটুকু মুহাব্বত কর।

তুমি আমার মুহাব্বতের বান্দাকে ছুরির নিচে দিয়ে দিয়েছ। জবাই করতে হবে না। আমার পরীক্ষায় তুমি পাস হয়ে গিয়েছ। আল্লাহ বলেন যাও তুমি ইসমাঈলকে নিয়ে বাড়ি চলে যাও। আর জান্নাতি দুম্বা জবাই হয়ে গেল। আল্লাহ বলেন এটা হাদিয়া নিয়ে যাও। কারণ বড় মানুষের কাছে গেলে হাদিয়া দেয়। তেমনিভাবে দুম্বাটা আল্লাহ হাদিয়া দিলেন।

৪. নাম্বার হলো ইখলাস

আমি ব্যবসা করব আল্লাহর জন্য, বয়ান করব আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, বয়ান শুনব আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। আমার নামাজ, জীবন, মরণ, কুরবানি সবকিছু আল্লাহর জন্য। আল্লাহ বলেন,

وَمَاۤ اُمِرُوْۤا اِلَّا لِيَعْبُدُوا اللّٰهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ١ؕ۰۰۵ {البينة: ৫}

দুই নাম্বার আদেশ হলো আল্লাহর ইবাদত করবা কাউকে অংশিদার বানাবে না। আল্লাহ আমাদের এই দুই কথার উপরে পূর্ণ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

অনুলিখন:

মুহাম্মদ আহসান উল্লাহ

দাওরায়ে হাদীস, জামেয়া পটিয়া ২০১৭

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ