জামেয়া ওয়েবসাইট

সোমবার-৮ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৫ হিজরি-২৫শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ-১০ই আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

সংসার সুখী হয় যেভাবে

নাইমা তামান্না

মানুষের জীবনে অন্যতম ও বিশেষ একটি অধ্যায় হচ্ছে বৈবাহিক জীবন। যেখানে ভিন্ন দুটি জীবনে বয়ে চলে একই লক্ষ্য। গড়ে উঠে পারস্পরিক নিঃস্বার্থ সখ্যতা। দুটি প্রবাহ মিলে যায় একই মোহনায়। জীবনে বয়ে আনে পূর্ণতা। সুখে-স্বাচ্ছন্দে ভরে উঠে চারপাশ। যদি এই জীবনে কেউ সফল হতে পারে তাহলে দুনিয়াটা হয়ে যায় তার জন্য স্বর্গ। অন্যথায় জীবনটা নরকের আজাবে পরিণত হয়ে যায়।

সংসার সুখী করার জন্য একে ওপরের সহযোগী সহযোদ্ধা হতে হয়, সেক্রিফাইস করতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষ দিতে হয় অনেক ছাড়। ভাগাভাগি করতে হয় সুখ দুঃখ ভালোলাগা-ভালোবাসা। আর দাম্পত্য সম্পর্কে মান-অভিমান থাকবেই। শরতের মেঘ আর দাম্পত্যে কলহ যেন একই রকম। হাসি-তামাশা, মান-অভিমান নিয়েই এ সম্পর্ক। মাঝেমধ্যে অনেক পরিবারে ছোটখাটো ঝগড়াঝাটি থেকেই ঘটে বিপর্যয়। তিক্ততায় ভরে যায় মধুর সম্পর্কটি। সন্তান, পরিবারের অন্য সদস্যরা হন মানসিক চাপের শিকার। এসব থেকে বেরিয়ে এসে স্বামী-স্ত্রী দুজন যদি একটু সচেতন হন, তবে বিনা কষ্টে দাম্পত্যজীবন হয় মধুময়।

একটু মানিয়ে চলা, দুজন দুজনকে বুঝা, এটুকুই দিতে পারে প্রেমময় দাম্পত্যজীবন। দাম্পত্য সম্পর্কের ধরনটাই এমন, কখনও বৃষ্টি, কখনও রোদ। তবে আজকের দম্পতিরা সত্যি দিশেহারা। ঘরে-বাইরে জীবন ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে। ঘরের কাজকর্ম থেকে শুরু করে বাচ্চাদের লেখাপড়া পর্যন্ত সবকিছুই কঠিন ও অনিশ্চিত। স্বামী-স্ত্রী দুজনই নিজেদের কর্মস্থলে সমস্যার পর সমস্যা মোকাবিলা করে ক্লান্ত। ঘরে ফিরেও দুদ- শান্তির অবকাশ নেই। ব্যক্তিত্ব আর আত্মমর্যাদার সঙ্কট প্রবল। তবে দুজনই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও আন্তরিকতা নিয়ে মানিয়ে চললে সম্পর্কটা সহজ হয়।

জীবনসঙ্গী যদি সংসারের প্রতি ইতিবাচক থাকেন, তবে ত্যাগ-তিতিক্ষা, খিটিমিটি জড়িয়ে সুন্দর দাম্পত্যজীবন পাওয়া যাবে। সবকিছুর মধ্যে ভুল ধরতে যাওয়া, সব ব্যাপার নিয়ে কলহের ভাবনা থেকে দূরে থাকলে সম্পর্কটা জটিল হয় না। সন্তানরাও বেড়ে ওঠে সুন্দর পরিবেশে। দাম্পত্যজীবনে কলহ অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। ভালোবাসা-সমঝোতা-মমতার মতোই মতবিরোধ, মতপার্থক্য দাম্পত্যজীবনের একটা অঙ্গ। কিন্তু দাম্পত্য সম্পর্ক তখনই অস্বাভাবিক রূপ ধারণ করে, যখন এর ফল হয় ভুল বোঝাবুঝি, তিক্ততা, পরস্পরকে হেয়প্রতিপন্ন করার প্রবণতা, অবিশ্বাস ইত্যাদি। বিবাহিত জীবন কেবল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এতে জড়িত পরিবারের অন্যান্য সদস্য, সমাজ-সংস্কৃতি। দু’জন স্বতন্ত্র মানসিকতার, ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা আলাদা মানুষ দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় সাধন করে একটা সমঝোতায় পৌঁছে জীবনযাপন করতে চেষ্টা করেন। এখানে মানিয়ে চলাটা তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্পর্কে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে তর্কে জিততে যাওয়ার প্রবণতা বা নিজের মতকে একগুঁয়েভাবে প্রাধান্য দেয়াটা দাম্পত্য সম্পর্কে কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। দাম্পত্য সম্পর্ক যেসব কারণে তিক্ত হতে পারে তার মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত ব্যস্ততা ও একে অপরকে পর্যাপ্ত সময় দিতে না পারা, সাংসারিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা, মানসিকতার পার্থক্য, তৃতীয় ব্যক্তিকে জড়িয়ে সন্দেহ, মনমেজাজ তিক্ত থাকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি।

দু’জনের একটুখানি মানিয়ে চলাই সম্পর্কটা সুন্দর করে, সুখী করে। মানিয়ে চলা শুধু দাম্পত্য সম্পর্ক নয়, সব সম্পর্কই সহজ সুন্দর করে। স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে বলা যায়, মেনে নেওয়াটা যেন একতরফা না হয়। কারণ, একটা মেয়েকে স্ত্রী-বন্ধু, সুচারু গৃহিণী, মা ইত্যাদি বিভিন্ন ভূমিকা পালন করতে হয়। একই সঙ্গে সংসারের সব ঝক্কিঝামেলাও অনেক সময় এক হাতেই সামলাতে হয়। তাই ত্যাগের ক্ষেত্রে, মানিয়ে চলার ক্ষেত্রটা যেন একজনের ঘাড়ে না চেপে যায়, সেদিকটায় সচেতন হতে হবে। ছোটখাটো কিংবা বড় সমস্যায় সমঝোতার মধ্য দিয়ে যদি দু’জন সুন্দর মানিয়ে চলেন, তবে সম্পর্কটা অনেক সহজ হবে। মধুর হবে দাম্পত্যজীবন। এব্যাপারে যুগ সংস্কারক আল্লামা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) বলেন, আজকাল যুবকদের মুখে নতুন পরিভাষা শোনা যায়, তারা স্ত্রীকে ‘জীবন সঙ্গিনী’ বলে। কিন্তু ওহে ভালো মানুষের দল! তোমরা এ জীবন সঙ্গিনীর সকল হক ঠিকঠাক মতো আদায় করো, না এটা কেবল মুখের শব্দমালা? বাস্তব দেখলে তো মনে হয়, তাদেরকে তোমরা জীবন সঙ্গিনী নয় ‘জীবন বন্দিনী’ বানিয়ে রেখেছ।

থানভী (রহ.) তার পারিবারিক জীবন সম্পর্কে বলেন, উল্লেখ করার কথা নয়, কিন্তু প্রয়োজনের খাতিরে বলছি। আল্লাহর শোকর যে, আমি নিজেও বন্দী হয়ে থাকতে চাইনা এবং কাউকে বন্দী রাখি না। রাজা বাদশাহদের মত আমাদের জীবন চলে। ঘরের অনেক কাজ নিজ হাতে সেরে ফেলি। এতে আমার কি কষ্ট হয়? আমার কোন জরুরি কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়? বরং এটা দেখে যেমন আমি আনন্দ পাই যে, সে আমার খেদমত করে যাচ্ছে তেমনই এতেও আমি আনন্দ পাই যে সে সুখে ও স্বস্তিতে আছে। তিনি নিজের সম্পর্কে আরও বলেন, রাতে আমার কম ঘুম হয় কিন্তু স্ত্রীকে ঘুমুতে দেখে আল্লাহর শোকর আদায় করি যে, তার তো ঘুম হচ্ছে! অন্যথায় দু’টি দুঃখ একত্রিত হত এক তো নিজের ঘুম না হওয়ার কারণ, আর ২য়টি স্ত্রীর ঘুম না হওয়ার কারণ।

অনেক সময় এমন হয়, আমি দেখলাম স্ত্রী কাজে ব্যস্ত, তখন নিজেই খাবার খেয়ে নেই। আমি আমার স্ত্রীর দৈনন্দিন কাজে সাধ্যমত সাহায্য করার চেষ্টা করি। আমার অভ্যাস এই, ঘরে গিয়ে যদি দেখি টাটকা রুটি এখনো তৈরি হয়নি তাহলে বাসি রুটিই খেয়ে নেই। অনেক সময় এমন হয়, আমি দেখলাম স্ত্রী কাজে ব্যস্ত, তখন নিজেই খাবার খেয়ে নেই। আমি আমার স্ত্রীর দৈনন্দিন কাজে সাধ্যমত সাহায্য করার চেষ্টা করি। কলস ভরে পানি এনে দেয়া থেকে অন্যান্য যাবতীয় কার্যাবলি। একজন স্বামীর জন্য এসকল বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরি।

স্ত্রীদের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যদি আল্লাহকে ব্যতিত অন্য কাউকে সেজদা করার অবকাশ থাকতো, তাহলে আমি প্রত্যেক স্ত্রীদের নির্দেশ দিতাম তারা যেন তাদের স্বামীদের সেজদা করে।’ এ হাদীস দ্বারাই বুঝে আসে একজন স্ত্রী তার স্বামীর সাথে কি ধরনের আচরণ করবে। তাকে কীভাবে মর্যাদা দিয়ে চলতে হবে। মোট কথা এভাবেই দু’জনকেই দু’জনের ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল হয়ে, দু’জনের প্রচেষ্টাতেই একটা সংসার সুখী করে তোলা সম্ভব।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ