জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আরাকানে গণহত্যার কবলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী

ড. হাবিব সিদ্দিকী

মিয়ানমারের পশ্চিমা প্রদেশ আরাকান (রাখাইন) আবার জ্বলছে। স্বাধীন আরাকান রাজ্যের পুরোনো রাজধানী ম্রাউক-উ-তে চলছে বৌদ্ধ রাখাইনদের মিছিল। মিছিল চলছে জীপগাড়ি, মোটরসাইকেল, রিক্সা, টুক-টুক কিংবা সাইকেলে চড়ে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি লোক চলছে পায়ে হেঁটেই। তাদের সাথে আছে বর্শা, তরবারি, ধামা, বাঁশ, গুলতি, তীর-ধনুক এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে পেট্রোল বোমাও। তাদের লক্ষ্য নিরস্ত্র রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী। ওইসব মিছিলেই জনৈক বৌদ্ধ সন্ত্রাসীকে গলা-কাটার মতো ভয়াবহ ইশারা-ইঙ্গিত করতে দেখা যায়।

দুঃখের বিষয় এই যে, ম্রাউক-উ-ই একমাত্র শহর নয় যেখানে রোহিঙ্গা মুসলিমরা পরিকল্পিত গণহত্যার মুখোমুখি। মিয়ানমারের ভেতর থেকে পাওয়া খবর থেকে জানা যাচ্ছে যে, স্থানীয় সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার, পুলিশ ও নিরাপত্তা রক্ষীবাহিনীর মদদে রাখাইন বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা পরিকল্পিতভাবে প্রতিটি রোহিঙ্গাকে বার্মা (মিয়ানমার) থেকে বের করে দেওয়ার অভিপ্রায়ে গণহত্যার উন্মাদনায় মেতে উঠেছে। এ নির্মূলাভিযান এমনই ভয়াবহ ও নৃশংস যে, পরিকল্পিত হিংস্রতা লুকিয়ে রাখার স্বগত প্রবণতা থাকা বর্মী রাষ্ট্রপতিও ২৬ অক্টোবর’১৬ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, ৮টি মসজিদসহ ২০০০ রোহিঙ্গার ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে (সূত্র: বার্মিজ সরকারপন্থি পত্রিকা, ঃযব ঘবি খরমযঃ ড়ভ গুধহসধৎ)। এ সপ্তাহে তার মুখপাত্র বিবিসিকে বলেছেন, ‘রাখাইন প্রদেশে পুরো গ্রাম কিংবা আংশিক নগর পুড়ে ভস্মীভূত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে।’ বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আসল সংখ্যা ও বাস্তবতা আরও অনেক ভয়াবহ।

আশংকা করা হচ্ছে যে, অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ৫০০০ রোহিঙ্গার বসতি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। উপগ্রহ (স্যাটেলাইট) থেকে তোলা ছবিতে সমুদ্র উপকূলবর্তী শহর চিয়াউকফুর (কুধঁশঢ়যুঁ) মুসলিম অধ্যুষিত অংশে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ছাপ দেখা যায়। এ শহর থেকেই তেল ও গ্যাসের পাইপ-লাইন বার্মা থেকে চীনে যাবার কথা। সাম্প্রতিক এ গণহত্যার আগ্রাসনের সময় মুসলিম অধ্যুষিত গ্রাম ও শহরাংশে তাদের আঁটকে রেখে আগুনের গোলা ছোঁড়া হয়। মৃত্যু আতংকে পালাতে চেষ্টা করা মুসলিমদের ওপর রাখাইন বৌদ্ধ সন্ত্রাসী ও সরকারের মধ্যে তাদের পৃষ্ঠপোষকরা চালায় নির্বিচার গুলিবর্ষণ। বর্ণবাদী রাখাইন রাজনীতিবিদ ও ভিক্ষুরা দিনে দিনে সেখানে গড়ে তুলছে বর্ণ ও ধর্মের ঘৃণার পরিবেশ, যাতে নিরস্ত্র রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সব ধরণের সহিংসতাকে অনুমোদন দেয়া যায়।

অনেক রোহিঙ্গা তাই প্রাণভয়ে পালাচ্ছে সাগরে কিংবা জঙ্গলে। কিন্তু হায়! সেখানেও রক্ষা নেই। সম্প্রতি শতাধিক রোহিঙ্গার সলিল সমাধি হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। অনেকে বাধ্য হয়ে পালিয়ে গেছেন বাংলাদেশে। ধরা পড়ে অনেককেই যেতে হচ্ছে সিত্তেওয়ের মানবতের জঘণ্য ক্যাম্পগুলোতে, যেখানে জুন মাস থেকেই আটকে আছে আরও অনেক রোহিঙ্গা ভুক্তভোগী। ঐদিকে রাখাইন সন্ত্রাসীরা আবার ডজন ডজন রোহিঙ্গা মেয়েদের তুলে নিয়ে করছে ধর্ষণ আর সেইসাথে চারিদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে যুদ্ধের বিভীষিকা।

এটা মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সম্পূর্ণ নির্মূল করে দেওয়ারই তৎপরতা। ২৫ অক্টবরের এক ইস্তেহারে মিয়ানমারে অবস্থিত জাতিসংঘের কর্মকর্তা অশোক নিগম বলেন, ‘জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের নির্বাসন ও ধংসযজ্ঞের ব্যাপারে শংকিত।’ তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত সকল জনগোষ্ঠীর কাছে নিরাপদ প্রবেশাধিকার অপরিহার্য এবং সে লক্ষ্যে তিনি সরকারের প্রতি ক্ষতিগ্রস্ত সবার কাছে দ্রুত ও শর্তহীনভাবে পৌঁছানোর মানবিক আবেদন জানান।

আমার আগের নানা লেখা ও বক্তব্যে আমি উল্লেখ করেছিলাম যে, মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে করা জঘন্য অপরাধগুলো লুকিয়ে রাখতে চায়, সেজন্যে তারা আন্তর্জাতিক মিডিয়া, এনজিও, সাহায্যসংস্থা এমনকি জাতিসংঘকেও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাতে প্রবেশাধিকার দেয় নাএ পাছে তারা বর্বরতার মাত্রা বুঝে ফেলে। আর যেহেতু রোহিঙ্গাদের সার্বিক নির্মূল রাষ্ট্রীয় নীতিরই অংশ, তাই মুসলিম ভুক্তভোগীদের জন্যে মিয়ানমারের সরকারি সংস্থাগুলো থেকে কোনো সাহায্যই পৌঁছে না। আরও জঘন্য বিষয় হচ্ছে এই যে, ওআইসি কিংবা ইসলামিক রিলিফ থেকে পাঠানো ত্রাণসামগ্রীও প্রাপক রোহিঙ্গা ভুক্তভোগীদের কাছে পৌঁছেনি। হিসেবে দেখা গেছে, পাঠানো ত্রাণসামগ্রীর ১০ শতাংশেরও কম ভুক্তভোগীদের কাছে পৌঁছেছে। রাষ্ট্র-আয়োজিত অক্টোবরের রাখাইন সন্ত্রাসী ও ভিক্ষুদের প্রতিবাদ সভাকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। কেননা সেই অযুহাত দেখিয়েই মিয়ানমার সরকার ওআইসিসহ অন্যান্য মুসলিম সাহায্য সংস্থাকে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের সাহায্যার্থে ত্রাণ কার্যালয় খুলতে দেয়নি।

মুসলিমদের ভয়াবহ হত্যার জন্যে একজন বৌদ্ধ সন্ত্রাসীকেও শাস্তি দেওয়া হয়নি। থেইন সেইনের সরকার থেকে আমরা কেবল সহিংসতার হোতাদের চিহ্নিত করা ও তাদের বিচারের আওতায় আনার ফাঁকা বুলি শুনেছি। কিন্তু এসব প্রতিজ্ঞা কখনো ন্যায়বিচারে পর্যবসিত হয় না, যেমনটা আমরা দেখেছি ৩ জুনে ১০ বর্মী মুসলিমদের বিনা বিচারে মেরে ফেলার ঘটনায়। এই যখন বাস্তবতা তখন সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের জান-মাল রক্ষার কথা না হয় বাদই দিলাম।

বুঝতে কষ্ট হয় না যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে থেইন সেইনের সরকার ইঁদুর-বিড়াল খেলা খেলছে। একদিকে যেমন উপগ্রহ থেকে তোলা ছবি থেকে অপরাধগুলোকে আর লুকিয়ে রাখা যায় না তখন তারা সবাইকে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে শান্ত করে আর অন্যদিকে যখন বহির্শক্তির চাপ কিছুটা কমে আসে, সাথে সাথেই বেড়ে যায় জঘন্য অপরাধগুলোর মাত্রা। তাই ৩ জুনে শুরু হওয়া সংঘবদ্ধ হত্যা ও নির্যাতনের ফলে সৃষ্ট এক লক্ষ আভ্যন্তরীন শরণার্থীর সাথে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসের ফলে আরো কয়েক অযুত বাস্তুহারা শরণার্থী যোগ দিলে সার্বিক অবস্থার অবনতি ঘটে অনেকখানি। এক সময়ের সমৃদ্ধ মুসলিম জনপদ এখন যেন বোমার আঘাতে ধ্বংস হওয়া অঞ্চল!

কোনো রোহিঙ্গাকেই তাদের এলাকাতে ফিরে গিয়ে নিজেদের ঘরবাড়ি পূনর্গঠন করতে দেওয়া হয়নি। নাৎসি কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পের আদলে গড়ে ওঠা ক্যাম্পে তাদের আটকে রাখা হয়েছে। ওই বীভৎস ছাউনিগুলো থেকে বের হয়ে জীবিকা আহরণের চেষ্টা করলে রাখাইন বৌদ্ধ নিরাপত্তা রক্ষীদের হাতে গুলিবিদ্ধ হওয়ার সমূহ ঝুঁকি থাকে। ওই ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের রাখা হয়েছে যাতে তারা ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

নিরস্ত্র রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ভীত-সন্ত্রস্ত রাখা যেন রাখাইনদের জাতীয় চেতনাতে পরিণত হয়েছে। সীমান্তরক্ষীরা (ঘঅঝঅকঅ) বারংবার স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আরাকান হচ্ছে রাখাইন রাজ্য যেখানে রোহিঙ্গা মুসলিমদের কোনো স্থান নেই। রোহিঙ্গাদের বলা হয়, তারা যেন আরাকান থেকে চলে যায়, না হলে তাদের মেরে ফেলা হবে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে নির্মূল করার তালিকায় একে একে যুক্ত হচ্ছে মুসলিম অধ্যুষিত জনপদগুলো। পাঁচের বেশি লোকের সমাবেশ ঘটানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা ১৪৪ ধারা কেবল রোহিঙ্গাদের ওপরই প্রয়োগ করা হয়। নিরাপত্তারক্ষীদের আশীর্বাদ পওয়া রাখাইন সন্ত্রাসীদের হাতে ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট, মসজিদ, স্কুল কিংবা গ্রাম লুট হওয়া অগ্নিদগ্ধ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতেও বাইরে যেতে পারেনা রোহিঙ্গারা।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী রাখাইনরা সরকারের সহযোগিতা পায়। চিয়াউকফু শহরের ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে যে, বৌদ্ধ অগ্নি-নির্বাপক দল পানির বদলে আগুনের ওপর জ্বালানী ছিটিয়েছে, যাতে ধ্বংসলীলা সম্পূর্ণ হয়! পিট প্যাটিসন নামের একজন স্থানীয় শিক্ষক, যিনি যুক্তরাজ্যের ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার জন্যেও কাজ করে থাকেন বলেন, দমকলের বাহিনীর লোকজন আগুনের ওপর আদতে ঢেলেছে পেট্রোল, কিন্তু ভান দেখাচ্ছে যেন তারা পানি ছিটাচ্ছে! কর্তৃপক্ষ আসলেই একপেশে। আমরা তাদের বিশ্বাস করতে পারি না।

চিয়াউকফু শহরের তাবৎ মুসলিম জনগোষ্ঠী হত্যা কিংবা জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা পড়ার হাত থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্যে অন্যদের মতো মাছ ধরার নৌকাতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। পাউক-ত শহরের প্রাক্তন মুসলিম অধিবাসীরা ইন্ডিপেন্ডেন্টকে জানান যে, সরকারি এক ফেরীযান সাগরে পালিয়ে আসা লোকদের মাছ ধরার নৌকাতে ধাক্কা মারে। ফলে ডুবে মারা যায় কয়েক ডজন লোক। আর যারা সেই যাত্রা বেঁচে গিয়ে কোনোমতে উপকূলে আসতে পেরেছে, তাদের সরকারি কর্তৃপক্ষ আর মাটিতে নামতে দেয়নি।

সপ্তাহান্তে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কর্তৃক প্রকাশিত উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে চিয়াউকফু ও পার্শ্ববর্তী উপকূল অঞ্চলের ধ্বংসের চিহ্ন স্পষ্ট। অজস্র ঘর-বাড়ি আর অসংখ্য নোঙ্গর করা বজরা আর নৌকার শহর আজ যেন পোড়ো ধ্বংসস্তুপ যার মধ্যে আছে পুরোপুরি ধ্বংস হওয়া ৮১১টি বাড়িসহ অন্যান্য স্থাপনা।

যদিও সাম্প্রতিক ঘটনাতেগুলোতে মুসলিমরা একতরফা ভুক্তভোগী থেইন সেইন সরকার একে রাখাইন রাজ্যের আন্তঃগোত্রীয় দাঙ্গা বলে চিত্রায়িত করতে সচেষ্ট। সাদামাটা অর্থে যা হচ্ছে তা হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ রাখাইনদের দ্বারা হত্যা-সহ ভয় ভীতির উদ্রেক করে মুসলিম রোহিঙ্গাদের বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকে উৎখাতের উদ্দেশ্যমূলক সরকারি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুসারে এ কাজগুলোকেই বলে নৃতাত্ত্বিক বিনাশ (ethnic cleansing)| রক্তপিপাসু এ সরকার কিংবা ঘরে ও বাইরে সরকারের কোনো সমর্থকই ছল-চাতুরী করে এমন ভয়াবহ অপরাধ লুকিয়ে রাখতে পারবে না।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ