মাহফুয আহমদ
প্রথম হাদীস: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَّا نَوَىٰ، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَىٰ دُنْيَا يُصِيبُهَا، أَوْ إِلَىٰ امْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا، فَهِجْرَتُهُ إِلَىٰ مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ.
‘সকল আমল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যা সে নিয়ত করবে। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের দিকে হিজরত করবে তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে হবে। আর যে ব্যক্তি হিজরত করবে দুনিয়ার উদ্দেশ্যে কিংবা কোনো মহিলাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে, তাহলে তার হিজরত হবে সেই দিকে যেদিকে সে হিজরত করল।’
বর্ণনাসূত্র: আল্লামা বদরুদ্দীন আল-আইনী (রহ.)-এর মতে হাদীসটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সাহাবী ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযি.) ছাড়াও সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রাযি.), আলী ইবনে আবু তালিব (রাযি.), আবু সাঈদ আল-খুদরী (রাযি.), আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.)সহ বেশ কয়েকজন সাহাবী বর্ণনা করেছেন।
ইমাম বুখারী (রহ.) এ হাদীসটি তাঁর সহীহ আল-বুখারীর ৭ জায়গায় উল্লেখ করেছেন। যথাক্রমে হাদীস নাম্বার: ১, ৫৪, ২৫২৯, ৩৮৯৮, ৫০৭০, ৬৬৮৯, ৬৯৫৩। তাছাড়া শব্দের মাঝে কিছু ভিন্নতা থাকলেও আরও বহু হাদীসগ্রন্থে এটি বর্ণিত হয়েছে। যেমনÑ মুসনদে আহমদ: ১৬৮, ৩০০, সহীহ মুসলিম: ১৯০৭, সুনানে আবু দাউদ: ২২০১, সুনানে তিরমিযী: ১৬৪৭, সুনানে নাসায়ী: ৭৫, ৩৪৩৭, ৩৭৯৪, সুনানে ইবনে মাজাহ: ৪২২৭, আস-সুনানুল কুবরা লিন নাসায়ী: ৭৮, ৪৭১৭, ৫৬০১, সহীহ ইবনে খুযায়মা: ১৪২, ১৪৩,৪৫৫, ১৯৩৪, সহীহ ইবনে হিব্বান: ৩৮৮, ৩৮৯, ৪৮৬৮, সুনানে দারাকুতনী: ১৩১, আল মু’জামুল আওসাত লিত তাবারানী: ৪০, ৭০৫০, শারহু মুশকিলিল আসার লিত তাহাওয়ী: ৫১০৭,মুসনাদে আবু দাউদ আত তায়ালুসী: ৩৭, মুসনাদে হুমাইদী: ২৮ ও মুসনাদে বাযযার: ২৫৭ প্রভৃতি।
হাদীসের মান: হাদীসটি সহীহ ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে হাদীসবিদ আলিমগণের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বস্তুত ইমাম বুখারী (রহ.) তাঁর সহীহ আল-বুখারীতে খুতবা ও ভূমিকাস্বরূপ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। মুহাদ্দিস আবদুর রাহমান ইবনে মাহদী (রহ.) বলেন, ‘আমি যদি অধ্যায়ে বিন্যস্ত করে কোনো গ্রন্থ রচনা করতাম, তবে প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুতেই ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযি.)-এর এ হাদীসটি উল্লেখ করতাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো গ্রন্থ রচনা করতে যাবেন তিনি যেন এই হাদীস দ্বারা সূচনা করেন।’ ইমাম শাফিয়ী (রহ.) বলেন, ‘এই হাদীসটি জ্ঞানের এক তৃতীয়াংশ এবং ফিকহ শাস্ত্রের ৭০টি বিষয় এর ভিতরে রয়েছে।’ তাছাড়া একাধিক হাদীসবিশেষজ্ঞ এই হাদীসকে ওইসব হাদীসের মধ্যে শামিল করেছেন; যেসবের ওপর ইসলামের মৌল ভিত্তি। এবিষয়ে কিছু উক্তি ১ম পর্বে উদ্ধৃত হয়েছে।
সাহাবী পরিচিতি: এ হাদীসের রাবী বা বর্ণনাকারী সাহাবী হলেন আমিরুল মু’মিনীন হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযি.)। তাঁর উপনাম আবু হাফস। নুবুওয়াতের ষষ্ঠ কিংবা সপ্তম বছর ৪০ জন পুরুষ এবং ১১ জন মহিলার পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা খুবই প্রসিদ্ধ। হকের বিজয় এবং বাতিল নিশ্চিহ্ন করণে তাঁর বিশেষ অবদানের কারণে তাঁকে ‘আল-ফারুক’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সুপ্রসিদ্ধ এ সাহাবী মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় খলিফা ছিলেন। তাঁর অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ১৩ হিজরী সনে তিনি খলীফাতুল মুসলিমীন নিযুক্ত হলেন। প্রায় সাড়ে ১০ বছর পর্যন্ত খেলাফতের মহান দায়িত্ব আদায় করার পর ২৩ হিজরী সালে আবু লু’লু নামক এক অগ্নিপূজকের চুরিকাঘাতে আহত হয়ে শাহাদত বরণ করেন। আল্লামা শিবলী নু’মানী (রহ.) তাঁর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে ‘আল-ফারুক’ নামে গবেষণামূলক একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তা ছাড়া তিনি শুরাভিত্তিক ইজতিহাদের মাধ্যমে যে সকল মাসআলার সমাধান করেছিলেন, শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (রহ.) সেগুলো রিসালায়ে ফিকহে ওমার (রাযি.) নামে সংকলন করেছেন। তালিবুল ইলম ভাইয়েরা এ দুটি দেখে নিলে অনেক নতুন বিষয়ের জ্ঞান অর্জিত হবে ইনশাআল্লাহ।
হাফিয শামসুদ্দীন আয-যাহাবী (রহ.) বলেন,
وهو الذي سن للمحدثين التثبت في النقل.
‘হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণরূপে নিশ্চিত ও আশ্বস্ত হওয়ার সুন্নত বা নীতিটি ওমর (রাযি.)-ই প্রবর্তন করেন।’
উল্লেখ্য যে, সাহাবীদের মাঝে ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযি.) নামে মাত্র একজন সাহাবী। অবশ্য শুধু ওমর নামে আরও কয়েকজন সাহাবী রয়েছেন। তাঁদের সংখ্যা ২৩ বা তারচেয়ে কম-বেশি। তবে সাহাবা পরবর্তী রাবীগণের মাঝে ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযি.) নামে আরও ছয়জন রাবী রয়েছেন।
হাদীস বর্ণনার প্রেক্ষাপট: আল্লামা বদরুদ্দীন আল-আইনী (রহ.) বলেন, এটা প্রসিদ্ধ যে, হাদীসটি বর্ণনার কারণ হলো মুহাজিরে উম্মে কায়সের ঘটনা। ইমাম তাবারানী (রহ.) নির্ভরযোগ্য সূত্রে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমাদের মাঝে জনৈক ব্যক্তি উম্মে কায়স নামে পরিচিত এক মহিলাকে বিয়ের প্রস্তাব দিল। কিন্তু সে হিজরত না করলে মহিলা বিয়েতে রাজি হবে না বলে জানিয়ে দিল। ফলে লোকটি হিজরত করল এবং ওই মহিলার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো। এজন্য আমরা লোকটিকে মুহাজিরে উম্মে কায়স (উম্মে কায়সের জন্য হিজরতকারী) বলে ডাকতাম। বস্তুত এবিষয়ে প্রকৃত বিধান জানিয়ে দিতেই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই হাদীস ইরশাদ করলেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীস বর্ণনার কারণ সংক্রান্ত এই বর্ণনাটি বিশুদ্ধ নয় বলে মন্তব্য করেছেন।
আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.) বলেন, ইমাম ইবনে দাকীকিল ঈদ (রহ.) আফসোস করে বলতেন, ‘হাদীস বর্ণনার শানে উরুদ বা কারণ ও প্রেক্ষাপট স¤পর্কে কেউ কোনো গ্রন্থ রচনা করল না। অবশ্য শুনতে পেয়েছি যে, আবু হাফস আল-উকবারী নাকি এ বিষয়ে কিছু লিখেছেন। হায়! কেউ যদি একাজে এগিয়ে আসত তবে অনেক উপকার হতো।
ব্যাখ্যা: এটি অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ একটি হাদীস। এ হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই শিক্ষা দিয়েছেন যে, প্রত্যেক আমলের সওয়াবের জন্য নিয়ত জরুরি। শুধু আমল নয়; বরং প্রত্যেক মানুষকে তার নিয়তের ওপরই প্রতিদান দেওয়া হবে।
বলা বাহুল্য যে, নিয়তের কারণেই ইবাদত এবং আদত তথা অভ্যাসের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়। যেমনÑ নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের খোর-পোষের ব্যবস্থা করা মানুষের স্বভাবগত অভ্যাস। কিন্তু কেউ যদি তা আল্লাহর আদেশ পালন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের অনুসরণের উদ্দেশ্যে করে, তাহলে তার এই কাজটি ইবাদতে পরিণত হবে এবং সে বক্তি প্রতিদানের অধিকারী হবে। একারণেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যা সে নিয়ত করবে।’ তারপর তিনি একটি উদাহরণ দিয়ে কথাটি বুঝিয়ে বলেছেন যে, ‘আল্লাহ ও রাসূলের দিকে যে ব্যক্তি হিজরত করবে তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে হবে। আর যে ব্যক্তি হিজরত করবে দুনিয়ার উদ্দেশ্যে কিংবা কোনো মহিলাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে, তাহলে তার হিজরত হবে সেই দিকে যেদিকে সে হিজরত করল।’ অর্থাৎ পার্থিব উদ্দেশ্য থাকলে হিজরতের মতো বড় একটি ইবাদতের প্রতিফল থেকেও সে মাহরুম হয়ে যাবে।
হিজরত ইসলামে ৩ প্রকারের ছিল:
১. শিরকের স্থান থেকে ইসলামের স্থানের দিকে হিজরত। যেমন মক্কা শরীফ থেকে মদীনা শরীফের দিকে হিজরত।
২. ভয়ের স্থান থেকে নিরাপদ বা নির্ভয়ের স্থানের দিকে হিজরত। যেমন মক্কা থেকে হাবশার দিকে হিজরত।
৩. আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা ছেড়ে দেওয়া।
প্রথম দুটি বর্তমানে না থাকলেও শেষের বিষয়টি কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
وَالْـمُهَاجِرُ مَنْ هَجَرَ مَا نَهَى اللهُ عَنْهُ.
‘মুহাজির সেই ব্যক্তি যে আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ বিষয়াদি ছেড়ে দেয়।’
হিজরতের আরও একটি স্তর হল, পাপের স্থান ছেড়ে পুণ্যের স্থানে চলে যাওয়া। যদি তা সম্ভব হয়। এরূপ হিজরত করা মুস্তাহাব। কোনো কোনো মুহাদ্দিস আরও কয়েক প্রকার হিজরতের কথা ব্যক্ত করেছেন।
মোটকথা এখনো যারা হিজরত করবে তাদের নিয়ত যদি ভালো হয়, তাহলে ভালো প্রতিদান পাবে। আর যদি নিয়ত খারাপ হয়, তাহলে প্রতিদান থেকে মাহরূম থাকবে।
নিয়ত যদি ভালো হয় তাহলে কখনও কাজ না করতে পারলেও শুধু নিয়তের কারণে সওয়াবের ভাগী হয়। যেমন সাহাবী হযরত আবুদ দারদা রাযি. বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
مَنْ أَتَىٰ فِرَاشَهُ، وَهُوَ يَنْوِيْ أَنْ يَقُوْمَ يُصَلِّيَ مِنَ اللَّيْلِ، فَغَلَبَتْهُ عَيْنُهُ حَتَّىٰ يُصْبِحَ، كُتِبَ لَهُ مَا نَوَىٰ.
‘যে ব্যক্তি ঘুমাতে আসে এবং নিয়ত করে যে, সে জাগ্রত হয়ে তাহাজ্জুদ পড়বে। কিন্তু তার চোখ লেগে যায় এবং ফজর পর্যন্ত সে আর জাগ্রত হয় না, তাহলে সে যা নিয়ত করেছিল তার পরিপূর্ণ সওয়াব তাকে দেওয়া হয়।’
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
فَمَنْ هَمَّ بِحَسَنَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كَتَبَهَا اللهُ لَهُ عِنْدَهُ حَسَنَةً كَامِلَةً.
‘যে ব্যক্তি কোনো ভালো কাজের নিয়ত করে অথচ এখনো করেনি, তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে পূর্ণ এক নেকী দান করেন।’
হযরত সাহল ইবনে হুনাইফ (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
مَنْ سَأَلَ اللهَ الشَّهَادَةَ بِصِدْقٍ، بَلَّغَهُ اللهُ مَنَازِلَ الشُّهَدَاءِ، وَإِنْ مَاتَ عَلَىٰ فِرَاشِهِ.
‘যে ব্যক্তি খালিস নিয়তে আল্লাহর কাছে শাহাদতের মৃত্যুর আশা করবে সে নিজের বিছানায় মারা গেলেও আল্লাহ তায়ালা তাকে শহীদগণের মর্যাদায় পৌঁছিয়ে দেবেন।’
আরেকটি হাদীসে তাবুক যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত সাহাবীদেরকে উদ্দেশ করে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
إِنَّ بِالْـمَدِيْنَةِ لَرِجَالًا مَا سِرْتُمْ مَسِيْرًا، وَلَا قَطَعْتُمْ وَادِيًا، إِلَّا كَانُوْا مَعَكُمْ، حَبَسَهُمُ الْـمَرَضُ.
‘নিশ্চয়ই মদীনায় এমন কিছু মানুষ রয়েছে, (তাবুক পর্যন্ত) প্রতিটি পথে প্রান্তরে; প্রতিটিটিলা-টক্করে যারা তোমাদের সাথেই ছিল। তারাও তোমাদের মতো জিহাদের সওয়াব লাভ করবে। কারণ পূর্ণ নিয়ত থাকা সত্ত্বেও অসুস্থতা বা অন্য কোনো ওযর তাদের জিহাদে অংশগ্রহণে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
অতএব যে কোনো উত্তম ও কল্যাণমূলক কাজের জন্য ইখলাসের সাথে বেশি বেশি নিয়ত করা উচিত। সাথে সাথে বেঁচে থাকা উচিত ভ্রষ্ট নিয়ত এবং ভ্রান্ত লক্ষ্য মনে পোষণ করা থেকে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
إِنَّ أَوَّلَ النَّاسِ يُقْضَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَيْهِ رَجُلٌ اسْتُشْهِدَ، فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ: قَاتَلْتُ فِيْكَ حَتَّىٰ اسْتُشْهِدْتُ، قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ قَاتَلْتَ لِأَنْ يُقَالَ: جَرِيءٌ، فَقَدْ قِيْلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَىٰ وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ، وَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ، وَعَلَّمَهُ وَقَرَأَ الْقُرْآنَ، فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ: تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ، وَعَلَّمْتُهُ وَقَرَأْتُ فِيكَ الْقُرْآنَ، قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ: عَالِـمٌ، وَقَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ: هُوَ قَارِئٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ، وَرَجُلٌ وَسَّعَ اللهُ عَلَيْهِ، وَأَعْطَاهُ مِنْ أَصْنَافِ الْـمَالِ كُلِّهِ، فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ: مَا تَرَكْتُ مِنْ سَبِيلٍ تُحِبُّ أَنْ يُنْفَقَ فِيهَا إِلَّا أَنْفَقْتُ فِيهَا لَكَ، قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ فَعَلْتَ لِيُقَالَ: هُوَ جَوَادٌ، فَقَدْ قِيْلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَىٰ وَجْهِهِ، ثُمَّ أُلْقِيَ فِي النَّارِ.
‘কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম একজন শহীদকে ডাকা হবে এবং তার উপর আল্লাহর দেওয়া নেয়ামতগুলো একে একে স্মরণ করানো হবে। অতঃপর জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি কি এসব নেয়ামত ভোগ করেছিলে? সে স্বীকার করে নিবে। বলবে, হ্যাঁ, এসব নেয়ামত আমি ভোগ করেছি। তখন আল্লাহ বলবেন, ওইসব নেয়ামতের শুকরিয়ায় তুমি কী আমল করেছ? সে বলবে, আমি আপনার রাস্তায় লড়াই করে শাহাদাত বরণ করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ; তুমি তো এই জন্য লড়াই করেছ, যেন তোমাকে বীর উপাধি দেওয়া হয়। তা তো দেওয়া হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এরপর দ্বিতীয় ব্যক্তিকে আনা হবে, যে নিজে ইলম শিখেছে, কোরআন পড়েছে এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছে। তাকেও পূর্ববর্তী ব্যক্তির মতো আল্লাহ তায়ালার নেয়ামতগুলো স্মরণ করানো হবে এবং সে তা স্বীকার করে নেবে। আল্লাহ তায়ালা প্রশ্ন করবেন, এর প্রতিদানে তুমি কী আমল করেছ? সে বলবে, আমি তোমার জন্য ইলম শিখেছি, কুরআন পড়েছি এবং অপরকে শিখিয়েছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ; বরং তুমি তো এই জন্য ইলম শিখেছ যাতে লোকে তোমাকে আলেম বলে। তা তো বলা হয়েছে। অতঃপর তাকে আল্লাহর নির্দেশে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তৃতীয় আরেক ব্যক্তিকে হাজির করা হবে যে ছিল বিত্তশালী; যাকে আল্লাহ তায়ালা প্রচুর স¤পদ ও ঐশ্বর্য দান করেছিলেন। পূর্বোক্ত দুই ব্যক্তির মতো তাকেও আল্লাহর নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে প্রশ্ন করা হবে যে, তুমি কী আমল করেছ? সে বলবে, মাওলা! ব্যয়ের জন্য তোমার পছন্দনীয় এমন কোনো খাত বাদ যায়নি, যে খাতে তোমারই সন্তুষ্টির জন্য আমি দান করিনি। আল্লাহ তায়ালা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। বরং তুমি তা করেছ শুধু এ জন্যই যাতে লোকেরা তোমাকে দানবীর উপাধি দেয়। তা তো দেওয়া হয়েছে। অতঃপর আল্লাহর নির্দেশে তাকেও জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’
এই হাদীস থেকে বোঝা যায় যে, সৎ কাজ করার পরও শুধু নিয়ত বিশুদ্ধ না থাকায় কী নির্মম ও করুণ পরিণতি!
একবার রঈসুল আহরার মাওলানা হাবীবুর রাহমান শায়খুল হাদীস আল্লামা যাকারিয়্যা (রহ.)-এর খেদমতে হাজির হন। তবে তার সফর ছিল অন্য কোথাও। সেজন্য তাড়াহুড়া করে বললেন, শায়খুল হাদীস সাহেব! আমি আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই। আপনি এখনি তার উত্তর দিতে হবে না। সফর থেকে ফেরার পথে আবারও আপনার সঙ্গে দেখা করব এবং প্রশ্নের উত্তর শুনে যাব। শায়খুল হাদীস (রহ.) বললেন, আচ্ছা আপনার কী প্রশ্ন? রঈসুল আহরার বললেন, এ তাসাউফ আবার কী? শায়খুল হাদীস (রহ.) তখনই বিদায়ী মুসাফাহা করতে করতে উত্তর দিয়ে দিলেন যে, তাসাওউফের সূচনা: إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ (সকল আমল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল) থেকে আর সমাপ্তি হলো হাদীসে জিবরীল তথা أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ (এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে যেন আল্লাহকে চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছ)। [আপ বীতী, ১/৪৯]
আল্লামা ইবনুল হাজ্জ (রহ.) বলেন, প্রত্যেক কাজে নিয়ত যেন সামনে থাকে। এমনকি সম্ভাব্য ক্ষেত্রে একই আমলের জন্য একাধিক নিয়ত করবে।
আল্লামা কুরতুবী (রহ.)ও তাঁর তাফসীরে এমন কথা বলেছেন। শায়খুল হাদীস আল্লামা যাকারিয়া (রহ.) একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, যেমন দেখুন! আপনি নামায আদায়ের নিয়তে মসজিদে রওয়ানা দিলেন। তো এখানে আপনি আরও কয়েকটি ভালো কাজের নিয়ত করতে পারেন। যেমন চোখের হেফাজত, কানের হেফাজত, জবানের হেফাজত, ই’তিকাফ, কোরআন তেলাওয়াত, মুসলমান ভাইদের খোঁজ-খবর নেওয়া ইত্যাদি।
শায়খুল ইসলাম আল্লামা তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহ আসান নেকিয়াঁ নামক তাঁর বইয়ে নিয়ত বিষয়ে খুব চমৎকার আলোচনা করেছেন। দৈনন্দিন জীবনের বৈধ কাজগুলোকে কীভাবে সওয়াবের কাজ বানানো যায়- সে বিষয়ে বেশ কিছু দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। ঊধংু মড়ড়ফ ফববফং নামে তাঁর এ বইটির ইংলিশ অনুবাদ ইংল্যান্ড থেকে গতবছর প্রকাশিত হয়েছে।
শিক্ষা: সকল কাজে নিয়ত বিশুদ্ধ রাখা রুরি। ইখলাসের সাথে কোনো সৎ কাজের জন্য পরিশুদ্ধ নিয়ত করলে কোনো কারণে এ কাজটি করতে না পারলেও শুধু নিয়তের কারণে ওই কাজের ওপর আমল করার সওয়াব পাওয়া যাবে। আবার ভ্রষ্ট নিয়তের কারণে বড় ধরনের উত্তম ও নেক আমলেরও সামান্য মূল্য থাকবে না। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সকল নেক আমলের জন্য ইখলাসপূর্ণ ও বিশুদ্ধ নিয়তের তাওফীক দান করুন। আমীন।
————————————————————————————————————————————————————————————————————————
আয-যাহাবী, তাযকিরাতুল হুফ্ফায = তাবকাতুল হুফ্ফায, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪১৯ হি. = ১৯৯৮ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ১১
বদরুদ্দীন আল-আইনী, উমদাতুল কারী শরহু সহীহিল বুখারী, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২১ হি. = ২০০১ খ্রি.), ক. ১, পৃ. ৬১
কাশ্মীরী, ফয়যুল বারী শরহু সহীহ আল-বুখারী, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, বয়রুত, লেবনান (১৪২৬ হি. = ২০০৫ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ৮০
(ক) আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ১১, হাদীস: ১০; (খ) মুসলিম, আস-সহীহ, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরবী, বয়রুত, লেবনান, খ. ১, পৃ. ৬৫, হাদীস: ৪০
(ক) আন-নাসায়ী, আল-মুজতাবা মিনাস-সুনান = আস-সুনানুস সুগরা, মাকতাবুল মতবুআত আল-ইসলামিয়া, হলব, সিরিয়া, খ. ৩, পৃ. ২৮৫, হাদীস: ১৭৮৭; (খ) ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, দারু ইয়াহইয়ায়িল কুতুব আল-আরাবিয়া, বয়রুত, লেবনান, খ. ১, পৃ. ৪২৬, হাদীস: ১৩৪৪; (গ) ইবনে খুযায়মা, আস-সহীহ, আল-মাকতাবুল ইসলামী, বয়রুত, লেবনান (দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০৩ খ্রি.), খ. ২, পৃ. ১৯৫, হাদীস: ১১৭২
(ক) আল-বুখারী, আস-সহীহ, খ. ৮, পৃ. ১০৩, হাদীস: ৬৪৯১; (খ) মুসলিম, আস-সহীহ, খ. ১, পৃ. ১১৮, হাদীস: ১৩১
মুসলিম, আস-সহীহ, খ. ৩, পৃ. ১৫১৭, হাদীস: ১৯০৯
মুসলিম, আস-সহীহ, খ. ৩, পৃ. ১৫১৮, হাদীস: ১৯১১
মুসলিম, আস-সহীহ, খ. ৩, পৃ. ১৫১৩, হাদীস: ১৯০৫
ইবনুল হাজ্জ, আল-মাদখাল, আল-মাকতাবাতুল আসরিয়া, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৩৪৩ হি.= ২০১৩ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ১৭