মুনতাসির মাহমুদ
আহকামের শরীয়াতের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সমাধানে যিনি ইসলামের ফিকহের ইতিহাসে সর্বাধিক অবদান রেখেছেন তিনি হলেন ইমাম আবু হানিফা (রহ.)। তিনি ছিলেন একাধারে কুরআন বিশেষজ্ঞ, হাফিযে হাদীস, শ্রেষ্ঠতম মুজতাহিদ, ফকীহ এবং যুগের শ্রেষ্ঠ আলিমে দীন ও কামিল ওলী। ফিকহশাস্ত্রে তার অবদানের জন্য তাকে মুসলিম মনীষীদের উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তার জীবন বৃত্তান্দ নিম্নে দেওয়া হল:
জন্ম ও শৈশব
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) উমাইয়া খলীফা আবদুল মালিকের রাজত্বকালে ৮০ হিজরী সালে কূফা নগরীতে যেই নগরীটি ইসলামী ফিকহের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে, সেখানে জন্মগ্রহণ করেন। তার মূল নাম হল নুমান। তার পুরো নাম হল নুমান ইবনে সাবিত ইবনে যুতী ইবনে মাহ। আবু হানিফা ছিল তার কুনিয়াত বা উপনাম। তাঁর পিতা একজন সনামধন্য ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি বড় হোয়ে তাঁর পিতার ব্যবসা দেখা-শোনা করতেন এবং একজন সৎ ব্যবসা হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
শিক্ষা জীবন
ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর সর্বপ্রথম উস্তাদ হন লেন ইমাম শাবী (রহ.) যিনি হযরত আলী (রাযি.)-এর সাক্ষাৎপ্রাপ্ত একজন তাবিয়ী ছিলেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ১৭ বছর বয়সে হাদীস শিক্ষা অর্জন করেছিলেন। তিনি সেই সময় কালামশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তিনি অল্প সময়ের মধ্যে তাফসীরশাস্ত্রে বিশেষ পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। তিনি একটা সময় চিন্তা করে দেখলেন যে, ফিকহশাস্ত্র হল ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।এটি ছাড়া ইসলাম অচল। এ ইলম অর্জনের দ্বারা মানুষের দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জীবনে সাফল্য লাভ করতে পারে। তিনি ওমর ইবনে আবদুল আযীয (রহ.)-এর খিলাফতকালে ১০০ হিজরীতে ইমাম হাম্মাদ (রহ.)-এর কাছে থেকে ২০ বছর বয়সে তা অর্জন করেছিলেন। হাম্মাদের শিক্ষক ছিলেন ইবরাহীম আন-নাখয়ী (রহ.), তার শিক্ষক ছিলেন আলকামা (রহ.) এবং তিনি ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.)-এর ছাত্র। এরপর তিনি হাদীস শিক্ষা লাভ করেন এবং তিনি বসরা-সিরিয়াসহ অন্যান্য জায়গা থেকে হাদীস শিক্ষা লাভ করেন। তিনি হাদীসের সাথে ফিকহশাস্ত্র এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা-প্রশাখা অর্জন করেছিলেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন, আমি যখন বিদ্যা ইচ্ছা করলাম তখন সমগ্র শিক্ষা আমার নিশানা করলাম আর প্রত্যেকটি বিষয়ে জ্ঞানার্জন করলাম।
তার উস্তাযগণের মধ্যে হাম্মাদ (রহ.), আমির ইবনে শুরাহবীল (রহ.), আলকামা ইবনে মারসাদ (রহ.), সালিম ইবনে আবদুল্লাহ (রহ.), হামাক ইবনে কুতাইবা (রহ.) প্রমুখ উস্তাযগণ ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ।
অবদান
১২০ হিজরীতে ইমাম হাম্মাদ (রহ.)-এর ইন্তিকালের পর তিনি তার স্বীয় শিক্ষকের স্থালাভিষিক্ত হলেন এবং যথারীতি পাঠদান পর ফতওয়া প্রদানের কাজ করতে লাগলেন। দূর-দূরান্তে থেকে অর্থাৎ মক্কা, মদীনা, বাহরাইন, ইয়ামান, বাগদাদ, বুখারা, সমরখন্দ, বলখ ও তিরমীয প্রভৃতি অঞ্চল থেকে তাঁর কাছে থেকে এসে সকলে শিক্ষা-দীক্ষা লাভ করতে লাগল। তিনি তার জীবদ্দশায় এরকম করে প্রায় সহস্রাধিক বিষয়ের মাসআলা প্রদান করেন যার ব্যাপারে সমাধান কোনো হাদীস কিংবা সাহাবাদের দ্বারা উল্লেখ ছিল না। তিনি অত্যন্ত পর্যালোচনামূলকভাবে ছাত্রদের ইলম পাঠ দিতেন। প্রত্যেক ছাত্রের নিজ নিজ মতামত ও দলীল পেশ করার অধিকার ছিল। অতঃপর ব্যাপকভাবে তর্ক-বিতর্ক অনুষ্ঠিত হত। অতঃপর তিনি সবার মতামত সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে সঠিক রায় প্রদান করতেন। যা ফলাফল হত তা সন্তোষজনক ছিল এবং তা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হত। তিনি কুরআন, হাদীস, ইজমা, কিয়াসের আলোকে সমাধান দিতেন। ইসলামী আইনের উসূলে ফিকহে তিনি ছিলেন প্রবর্তক। সেজন্য তাঁকে আহলুর রায় বলা হয়। তিনি একটি সুবিশাল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর কাছে থেকে দুরা-দুরান্ত থেকে অসংখ্য ছাত্র তার কাছে থেকে শিক্ষা লাভ করতেন।তিনি ছাত্রদের সাথে অত্যন্ত নম্র, ভদ্র ও সুন্দর আচরণ করতেন। আবুল মাহসিন ইমাম সাহেবের প্রায় ৯১৮ জনের একটি দীর্ঘ তালিকা প্রণয়ন করেছেন যার মধ্যে প্রায় ৮৮০ জন ছাত্র ফকীহ হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে। ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.), মুহাম্মদ (রহ.), হাম্মাদ (রহ.), হাসান ইবনে যিয়াদ (রহ.), হাম্মাদ ইবনে আবু হানিফা (রহ.), আসাদ ইবনে ওমর (রহ.), ইয়াযীদ ইবনে হারুন (রহ.), হাব্বান ইবনে আলী (রহ.), ইয়াযীদ ইবনে রাফি (রহ.) প্রমুখ ছিলেন তাঁর বিখ্যাত ছাত্র।
ফিকহ সংকলন
ইসলামের ইতিহাসে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) সর্বপ্রথম আলাদাভাবে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ফিকহ সংকলন করেছিলেন। তিনি ফিকহকে কুরআন-সুন্নাহের আলোকে সাজাতে আরম্ভ শুরু করলেন।
তাঁর ৪০ জন ছাত্রকে নিয়ে তিনি একটি বোর্ড গঠন করে তা ফিকহসমূহকে তিনি সংকলিত করেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ইয়াহইয়া ইবনে আবু যায়দ, আবু ইউসুফ (রহ.), হাফস ইবনে গিয়াস (রহ.) ও ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) ছিলেন বিখ্যাত। মুহাদ্দিস ওয়াকী ইবন জুররাহ (রহ.) বলেন, কি করে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ভুল করতে পারেন যেখানের তাঁর সাথে তার সাথে ইমাম মুহাম্মদ (রহ.), ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) ও ইমাম যুফারের মতো দক্ষ ফকীহ, হাফস ইবনে গিয়াস (রহ.), মিন্দাল (রহ.) ও হাব্বান (রহ.)-এর তো দক্ষ মুহাদ্দিস ছিলেন, কাসিম ইবনে মান (রহ.) এবং ফুযয়েল ইবনে আইয়ায (রহ.)-এর মতো মুত্তাকী ব্যক্তি ছিলেন। সেখানে কোনো ভুল-ভ্রান্তি হতে পারে না এবং তা হলে তাঁরা তাঁর বিরুদ্বে প্রতিবাদ করত।
সুদীর্ঘ ২২ বছর পরিশ্রম করে তিনি কুতুবী হানিফা নামক একটি গ্রন্থ সংকলন করেছিলেন। এত সর্বমোট ৮৩ হাজার মাসআলা লিপিবদ্ধ করা যায় যার মধ্যে প্রায় ৩৮ হাজার মাসআলা ইবাদত সংক্রান এবং ৪৫ হাজার মাসআলা সামাজিক বিধান ও দণ্ডবিধি সংক্রান্ত। এটি ছিল ইতিহাসের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকীহ গ্রন্থ। এর জন্য তিনি সেই সময়ে ইমামে আযম বা শ্রেষ্ঠ ইমাম হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন।
আল-মুওয়াফফিক মক্কী (রহ.) বলেন, ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর ফিকহী মাসআলা পরস্পর আলোচনা এবং পরামর্শের ভিত্তিতে রচনা হত। মজলিশে শুরার সাথে আলোচনা ছাড়া তিনি নিজে একা কিছুই করতেন না।
ফিকহ সংকলনের পদ্ধতি
তিনি যেভাবে তাঁর মাসআলাসমূহের সমাধান দিতেন তা ছিল এমন যে, তিনি কোনো সমস্যার সমাধান দেওয়ার জন্য তিনি প্রথমে কুরআন ঘাটাঘাটি করতেন। তিনি কুরআনের প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ, সুপ্ত, ইশারা-ইঙ্গিতে যেকোনোভাবে প্রাপ্ত ইলমের দ্বারা সমাধান দিতেন। যদি তা কুরআনে পাওয়া না যেত তাহলে তা হাদীসের দ্বারা দেওয়া হত। যদি তা তিনি হাদীসে না পেতেন তাহলে তিনি তাঁর সমাধান সাহাবাদের ফতওয়া এবং তা না হলে তাবিয়ীদের ফতওয়ার আলোকে প্রদান করতেন। তা না হলে তিনি ইজমার ওপর নির্ভর করতেন। সেখানেও যদি তিনি তাঁর ফয়সালা না পেতেন তাহলে তিনি কুরআন, হাদীস ও ইজমার সাথে সামঞ্জস্য রেখে কিয়াস বা ইসতিহসানের মাধ্যমে ফতওয়া প্রদান করতেন। যেসব বিষয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়নি সেসব ব্যাপারে তিনি সমাধান দিয়ে গিয়েছেন। তাঁর মাসআলা পরবর্তীতে বাড়তে বাড়তে ৫ লক্ষ হয়। তাঁর এ ফিকহ সংকলন মানুষের ঈমান-আকীদা, আমল-আখলাক, কাজ-কারবার, ব্যবসা-বাণিজ্য, আইন-আদালতের জন্য বিশেষভাবে সাহায্য করেছে।
তিনি ফিকহের ব্যাপারে যেই অবদান রেখে গেছেন সেই ব্যাপারে ইমাম শাফিয়ী (রহ.) বলেন, ‘মানবজাতি ইলমে ফিকহে আবু হানিফা (রহ.)-এর সন্তান।’ আল্লামা মক্কী (রহ.) বলেন, ‘ইমাম আবু হানিফা (রহ.)ই সর্বপ্রথম ইলমে ফিকহ সংকলন করেছিলেন।’ আবদুল্লাহ ইবনে মুবারাক (রহ.) বলেন, ‘তিনি ছিলেন ইলমের খাটি নির্যাস।’ আনাস ইবনে মালিক (রাযি.), ইমাম আ’মাশ (রহ.) ও ইমাম মালিক (রহ.) সকলে একথায় নির্ধিধায় বলেছেন যে, তিনি একজন বড় ফকীহ ছিলেন।
হাফিয যাহাবী বলেন, ‘ইমাম আবু হানিফা (রহ.) যদিও হিফযে হাদীসের একটি বিরাট কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন। তারপরও তিনি অনেক স্বল্পসংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেছেন। এর কারণ ছিল এই যে, তিনি হাদীস রিওয়াতের পরিবর্তে সেখান থেকে ফিকহী মাসআলা বের করা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।’
অনেকে তার বিরুদ্বে এ অভিযোগ করেন যে, তিনি মাসআলা প্রণয়নে হাদীস এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু এ অভিযোগকারীদের অভিযোগ সত্য নয় তা উপর্যুক্ত বক্তব্যের দ্বারা প্রামাণিত হয়। এছাড়াও ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন, ‘ওই ব্যক্তির ওপর আল্লাহর লা’নত যে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কথার বিরুদ্বারাচণ করল।’ তাঁর বদৌলতে আল্লাহ আমাদের ঈমানের মর্যাদা দান করেছেন এবং আমাদেরকে ধ্বংসের হাতে থেকে রক্ষা করেছে।
তিনি দুর্বল হাদীস ছাড়া কোনো ক্ষেত্রে হাদীসকে বর্জন করতেন না। তিনি রায়কে কখনও হাদীসের ওপর প্রাধান্য দিতেন না।
মাযহাব প্রতিষ্ঠা ও তার ক্রমবিকাশ
ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মাযহাব অত্যন্ত প্রসিদ্ধ একটি মাযহাব। তাঁর নামানুসারে এ মাযহাবের নাম হয় হানাফী মাযহাব। তাঁর এ মাযহাব প্রসারে তাঁর ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)-এর অবদান অতুলনীয়। তাঁকে যখন খলীফা হারুনুর রশীদ বাগদাদের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত করলেন তখন তিনি ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতবাদকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তাই আব্বাসীয়গণ তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা সেই সময় থেকে শুরু করে। তাঁর অন্যন্য ছাত্রদের মধ্যে ইমাম যুফার (রহ.), ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) ও ইমাম হাসান (রহ.)-এর ভূমিকা অন্যন্য। প্রথম যুগে কয়েকজন হানাফী আলিমগণের মধ্যে ইবরাহীম ইবনে রুস্তম (রহ.), আহমদ ইবনে হাফস (রহ.) ও বশীর ইবনে ওয়ালিদ (রহ.) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইমাম ফার (রহ.) বসরায় এ মাযহাব প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অবদান রাখেন। এভাবে করে পর্যায়ক্রমে তাঁর মাযহাব ইরাক, সিরিয়া, আবিসিনিয়ায়, হিন্দুস্তান প্রভৃতি অঞ্চলে ব্যপক প্রসাস লাভ করে। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ফিকহের ব্যাপারে যে মতবাদ গড়ে তুলেছিলেন তা সদূর সিরিয়া, তুরস্ক, মধ্যএশিয়া, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছে।
হানাফী মাযহাবের গ্রন্থাবলি
হানাফী মাযহাবের গ্রন্থাবলির মধ্যে জামি সাগীর, জামি কবীর, মাবসূত, যিয়াদাত, সিয়ারে সগীর, সিয়ারে কবীর, কুতুবে নাওয়াদির বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ।
হানাফী মাযহাবের বৈশিষ্ট্যাবলি
১. কুরআনের প্রাধান্য,
২. কুরআনের পর হাদীসের গুরুত্ব। হাদীসের বিধানসমূহ দৃঢ় ও যুক্তিগ্রাহ্য দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণ করা হয়।
৩. ইজমা ও কিয়াসের ওপর গুরুত্বারোপ।
৪. সহজ-সরলভাবে উপস্থাপন।
৫. ইসিতিহসান পদ্বতি চালু।
৬. যুগ ও সমাজের চাহিদা অনুযায়ী মাসআলাসমূহ লিপিবদ্ধকরণ।
৭. রিওয়ায়ত ও দিরিওয়াতের ভিত্তিতে মাসআলা প্রণয়ণ করা হয়েছে। এর বাস্তব জীবন ব্যবস্থার অংশ খুব ব্যাপক, দৃঢ় ও নিয়মতান্ত্রিক।
৮. তাহযীব-তামাদ্দুন জন্য যা প্রয়োজন সেই তুলনায় অন্যান্য ফিকহের চেয়ে অনেক বেশি উপাদান আছে।
৯. অমুসলিমদের অধিকার ও রাষ্ট্র পরিচালনার কথা বলা হয়েছ।
১০. তত্ত্ব ও বাস্তবভিত্তিক।
১১. শক্তিশালী মতামত গ্রহণ।
১২. রাষ্ট্র ও বিচার কার্যক্রমের জন্য সহজ নীতিমালা।
১৩. ইজতিহাদের ওপর প্রাধান্য।
১৪. ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সীমালঙ্ঘন থেকে মুক্তি।
তাঁর চরিত্র ও কর্ম
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) চারিত্রিক গুণাবলিতে এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি একজন পরহেযগার ব্যক্তি এবং ইবাদত মশগুল ব্যক্তি ছিলেন। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইবাদতে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ছিলেন এবং কার-কর্মে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ছিলেন। তিনি সর্বদা হারাম কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখতেন এবং তিনি অত্যন্ত দয়ালু ও দানশীল ছিলেন। অন্যের প্রতি অপবাদ দেওয়া থেকে নিজেকে সর্বদা বিরত রাখতেন এবং পরোপকারিতা, ন্যায়পরায়ণতা, সত্যবাদিতা, সাধুতা, ধৈর্য, সংযম, দানশীল এবং উস্তাযগণের প্রতি ভক্তি ও সম্মানের অধিকারী ছিলেন তিনি। তিনি তার জীবনে মোট ৫৫ বার হাজ্জ স¤পন্ন করেছেন।
আল্লামা ফুদায়েল তাঁর পরহেযগারিতার ব্যাপারে বলেন, তিনি ছিলেন মহান ফকীহ, অগাধ স¤পদশালী, অত্যন্ত দানশীল, দিন-রাতে জ্ঞান অন্বেষণকারী, চিন্তা-মগ্ন ও স্বল্পভাষী।
দৈনন্দিন কার্যাবলি
ইমাম সাহেবের দৈনন্দিন কার্যাবলি একটি রুটিনের মধ্যে পরিচালিত হত। তিনি প্রতিদিন ফজরের সালাত আদায় করার পর থেকে ছাত্রদের দীনী শিক্ষা প্রদান করতেন। বিভিন্ন সনাম-ধন্য শিক্ষার্থীগণ এসে তার কাছে থেকে মাসআলার উত্তর জানতেন। তিনি এভাবে কএর যুহরের ওয়াক্ত পর্যন্ত কাটানোর পর যুহরের নামায আদায় করে বাসায় ফিরে আসতেন এবং এরপর তিনি আসরের পর থেকে আবার সকলকে পাঠদান করতেন। বাকি সময়ে তিনি রোগীদের দেখা-শোনা, সেবা, দুঃখীদের খোঁজ-খবর রাখতেন। তিনি মাগরিবের পর পুনরায় পাঠদান করতেন। তিনি ইশার পর ইবাদতে মশগুল থাকতেন। তিনি অধিক হারে তাহাজ্জুদের নামায আদায় করতেন। তিনি একটানা ৩০ বছর ইশার নামায এবং ফজরের নামায একই উযুতে আদায় করেছেন। তিনি কখনো তার এই সকল কার্যাবলি দোকানে বসেও করতেন।
রচনাবলি
তার নিজস্ব রচনাবলি হল ফিকহুল আকবর, কিতাবুল আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম, কিতাবুর রাদ্দি ওয়াল জামিয়া।
শেষজীবন ও কারাবরণ
উমাইয়া খলীফাদের শাসনামলে আলিমদের ওপর অত্যাচার মাত্রারিক্ত হারে বেড়ে যায়। ইমাম যায়দ (রহ.)-এর মৃত্যুর পর থেকে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-কে উমাইয়াগণ সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেতেন। ১৩০ হিজরীতে তিনি মক্কায় চলে আসেন এবং এখানে তাঁর জনপ্রিয়তা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৩২ সালে উমাইয়াদের পতন ঘটলে ইমাম সাহেব আবার কূফায় ফিরে আসেন। কিন্তু আব্বাসীয়গণ তাকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। খলীফা মানসূর তাঁকে প্রধান বিচারপতির পদ প্রদান করতে চাইলে পরে তিনি তা গ্রহণে অসম্মতি প্রকাশ করলে তাকে বেত্রাঘাত করা হয় এবং কারারুদ্ধ করা হয়। এর মধ্যেও তাঁর মাসআলা প্রদানের কাজ চলতে থাকে। তাঁর এ জনপপ্রিয়তাকে খলীফা সুনজরে দেখলেন না। তাই তিনি খলীফাকে এ দুনিয়া থেকে বিদায় করার চিন্তা-ভাবনা শুরু করলেন।
মৃত্যু
অবশেষে খলীফার নির্দেশে তাঁকে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ১৫০ হিজরীতে হত্যা করা হয়। ইমাম সাহেব তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করার সময় সিজদাহরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জানাযা ছয়বার হয়। প্রথমবার প্রায় ৫০ হাজার মুসাল্লী তাঁর জানাযায় অংশগ্রহণ করে। তাঁকে বাগদাদে সমাধিস্থ করা হয়।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায় যে, ইসলামী ফিকহের সংকলনে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর অবদান অতুলনীয়
ও অকল্পনীয়। তাই তিনি ইলমের ফিকহের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন।