রবিবার-৪ঠা রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি-২৮শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১৩ই আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দ্রুত পাঠের শিল্প

মূল : শায়খ ইবরাহীম সাকরান । অনুবাদ : ইমরান রাইহান

 

জীবন স্বল্প, কাজ ব্যাপক—তাই ইলম অর্জনে দ্রুত পাঠ অপরিহার্য। পূর্বসূরি মনীষীগণ অল্প সময়ে অসংখ্য কিতাব অধ্যয়ন করতেন। দ্রুত পাঠের অর্থ পড়া এড়িয়ে যাওয়া নয়, বরং মর্মার্থ অনুধাবন। বর্তমান ব্যস্ত যুগেও সময়ের সুষ্ঠু ব্যবহারে দ্রুত পাঠ দক্ষতা অপরিহার্য, যাতে স্বল্প সময়ে অধিকতর জ্ঞান অর্জন সম্ভব হয়। বক্ষমাণ নিবন্ধে এ বিষয়ে সালফে সালিহিনের অনুপম কর্মপন্থা আলোকপাত করা হয়েছে বিশ্লেষণী কলমে…

 

জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে এক দুঃখজনক বাস্তবতা হলো অসাধারণ বইয়ের সংখ্যা অনেক বেশি কিন্তু জীবন খুবই সীমিত এবং ব্যস্ততাও ক্রমেই বাড়ছে। এই সহজ সমীকরণটি চিন্তা করলে আমরা বুঝতে পারি বইপাঠের জন্য বরাদ্দ সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহারের বিকল্প নেই। আপনি কীভাবে আপনার জীবনের সময়গুলোকে কাজে লাগিয়ে অনেক বেশি জ্ঞানার্জন করতে পারেন কিংবা অনেক বই পাঠ করতে পারেন তার জন্য কৌশল জানা প্রয়োজন। পাঠের সময়কে পরপূর্ণ কাজে লাগানোর একটি মাধ্যম হলো দ্রুত পাঠ করা—আধুনিক বিশ্বে যাকে স্কিমিং বলে অভিহিত করা হয়। দ্রুত পাঠ বা স্কিমিং হলো এমন একটি কৌশল যেখানে আপনি কোনো বইয়ের বিষয়বস্তু, মৌলিক কাঠামো, মূল বক্তব্য সম্পর্কে ধারনা অর্জন করেন। এই পাঠের উদ্দেশ্য হলো এর মাধ্যমে আপনি বইয়ের প্রয়োজনীয় অংশটুকু চিহ্নিত করবেন। ফলে ভবিষ্যতে আপনি প্রয়োজন অনুসারে যে কোনো তথ্য এই বই থেক এবের করতে পারবেন এবং অপ্রয়োজনীয় অংশ এড়িয়ে যেতে পারবেন। এই পাঠটি বিশ্লেষণী পাঠ থেকে আলাদা—যেখানে কোনো বইকে তার সকল আনুষাংগিক বিষয়সহ গভীরভাবে পাঠ করা হয়।

দ্রুতপাঠ কিন্তু কোনো এলোমেলো ব্রাউজিং নয় যেখানে শুধু পাতা উল্টে যাওয়াই উদ্দেশ্য থাকে। বরং এর রয়েছে নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। দ্রুত পাঠের মাধ্যমে আপনি একদিকে সময়কে পরিপূর্ণ কাজে লাগাতে পারবেন এবং ভবিষ্যতে সময়ের অযথা অপচয় থেকেও নিরাপদ থাকবেন। সালাফে সালেহীনের জীবনের দিকে তাকালে আমরা দেখি—দ্রুত পাঠ তাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। তাদের রচিত বইপত্রেও তারা এ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। মাক্কারী আত তিলিমসানী তার রচিত গ্রন্থ ফাতহুল মুতাআল ফি মাদহি খাইরিন নিয়ালে, মুহিব্বি রচিত খুলাসাতুল আসর ফি আইয়ানিল করনিল হাদি আশারে, জামালুদ্দীন কাসেমী রচিত কাওয়াইদুত তাহদীস মিন ফুনুনি মুসতালাহিল হাদীসে এবং আবদুল হাই কাত্তানী রচিত ফিহরিসুল ফাহারীস গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোচনা এসেছে।

মাক্কারী তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন আল্লামা ফাইরুজাবাদী মাত্র তিন মজলিসে সহীহ মুসলিম পূর্ণ পাঠ সমাপ্ত করেন। ইমাম কাসতাল্লানী মাত্র ৫ মজলিসে সহীহ বুখারী পুর্নপাঠ করেন। এই ঘটনা দুটি উল্লেখ করে মাক্কারী লিখেছেন, এ ধরণের দ্রুত পাঠের ঘটনা আরো অনেক রয়েছে। এরপর তিনি দ্রুত পাঠেরআরো কিছু ঘটনা উল্লেখ করেছেন। মুহিব্বি তার গ্রন্থে দ্রুতপাঠের কিছু ঘটনা উল্লেখ করে লিখেছেন, অনেক হাফেজুল হাদীসদের সম্পর্কে এর চেয়েও বিস্ময়কর ঘটনা বর্নিত আছে। জামালুদ্দীন কাসেমি তার বইতে স্বতন্ত্র একটি অধ্যায়ই এনেছেন যার শিরোনাম হচ্ছে কয়েকদিনে হাদীস পাঠের ঘটনা ।

আমরা এখন সালাফে সালেহীনের দ্রুতপাঠের কিছু ঘটনা উল্লেখ করবো যেন বিষয়টির গুরুত্ব সবার কাছে স্পষ্ট হয়। এ ধরণের একটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় খতীব বাগদাদী রচিত তারীখে বাগদাদে। এখানে তিনি মুহাদ্দিস ইসমাইল আল হিরির জীবনে চমকপ্রদ একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। ইসমাইল ছিলেন তাঁর যুগের খ্যাতনামা একজন মুহাদ্দিস। বিশেষ করে সহীহ বুখারী বর্ননার ক্ষেত্রে তাঁর সনদ ছিল উচুস্তরের। তিনি সহীহ বুখারী বর্ননা করতেন কুশমিহানী থেকে, তিনি বর্ণনা করতেন ফিরাবরী থেকে, তিনি বর্ণানা করতেন সরাসরি ইমাম বুখারী থেকে। ইসমাইল হিরী একবার হজ্ব করার জন্য নিশাপুর থেকে মক্কার দিকে যাচ্ছিলেন। পথে তিনি বাগদাদে থামেন। এখানে এসে তিনি সংবাদ পান মক্কাগামী পথে ডাকাতরা হামলা করছে, এজন্য তিনি নিশাপুর ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। খতীব বাগদাদী বিষয়টি জানতে পেরে সিদ্ধান্ত নেন তার কাছে সহীহ বুখারী পাঠ করবেন। খতীব বাগদাদী নিজের জবানিতেই সেই ঘটনা জানাচ্ছেন,

‘৪২৩ হিজরিতে ইসমাইল হিরি হজ্বের জন্য যাত্রা করেন। তিনি ছিলেন বড় মাপের একজন আলেম। তিনি যখন বাগদাদ আসেন তার সাথে ছিল এক উটের বোঝা পরিমাণ গ্রন্থাদি। তিনি হজ্বের উদ্দেশ্যে বাগদাদ এলেও পথঘাট অনিরাপদ জেনে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ফিরে যাওয়ার আগে আমি তার কাছে সহীহ বুখারী পাঠ করি। আমি তিন বৈঠকে পূর্ণ বুখারী পাঠ করে সমাপ্ত করি। এর মধ্যে দুটি বৈঠক ছিল রাতের বেলা। ওই দুটি বৈঠকে আমি মাগরিবের পর থেকে ফজর পর্যন্ত পাঠ করেছিলাম। শেষদুটি বৈঠক হয়েছিল শায়খ বাগদাদ ত্যাগের আগ মুহূর্তে। তিনি তখন বাগদাদের পূর্ব দিকের ইয়াহইয়া নামক দ্বীপে অবস্থান করছিলেন। আমি কয়েকজন সঙ্গিসহ সেখানে যাই। প্রথমে সকাল থেকে মাগরিব পর্যন্ত পাঠ করি এবং পরে মাগরিব থেকে ফজর পর্যন্ত পাঠ করে সমাপ্ত করি। সেই ভোরেই শায়খ তার এলাকায় ফিরে যান।

আলেমদের অনেকেই খতীব বাগদাদীর এই ঘটনা বিস্ময়ের সাথে উল্লেখ করেছেন। ইমাম যাহাবী সিয়ারু আলামিন নুবালায় এই ঘটনা উল্লেখ করে লিখেছেন, আল্লাহর কসম এর চেয়ে দ্রুত পাঠের কথা শোনা যায় না। ইমাম যাহাবীর অপর গ্রন্থ তারীখুল ইসলামেও তিনি ঘটনাটি গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করে লিখেছেন, আমাদের যুগে কারো পক্ষে এমনটা করাও সম্ভব না। সহীহ বুখারীর যে কোনো আধুনিক সংস্করণ দেখলেও আপনি ইমাম যাহাবীর কথার সত্যতা পাবেন। অথচ খতীব বাগদাদী মাত্র তিন বৈঠকেই তা পাঠ সমাপ্ত করেছেন এবং তিনদিনের বেশি সময় ব্যয় করেননি।

মালেকী মাযহাবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন একজন ব্যক্তি হলেন কাজী ইয়াজ। তিনি যেসব শায়খদের কাছে পড়াশোনা করেছেন তাদের নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এই গ্রন্থের নাম আল গুনইয়াহ। এই কিতাবটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তীকালের অনেক ইতিহাসবিদই তথ্যের জন্য এই গ্রন্থের দ্বারস্থ হয়েছেন। কাজী ইয়াজ এই গ্রন্থে ইবনুন নাখখাস সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, তিনি কর্ডোভায় তার বাড়িতে এক বৈঠকে ইবনু আবি যাইদ কাইরাওয়ানীর রিসালাহ সমাপ্ত করেছিলেন। ইবনু আবি যাইদ কাইরাওয়ানীর এই গ্রন্থকে বিবেচনা করা হয় মালেকি ফিকহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে। বর্তমানে এটি এক খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।

হাফেজ আবু সাদ সামআনী তার শায়খ আবুল ফাতাহ ওয়ালওয়ালজাই সম্পর্কে লিখেছেন, আমরা সমরকন্দে অবস্থানকালে শায়খের কাছে শামায়েলে তিরমিযী পড়তে চাই। তিনি আমাদের সামনে এক বৈঠকেই পুরো কিতাব পাঠ করে দেন। ইবনে তাইমিয়্যার দ্রুতপাঠ সম্পর্কে তার সমসাময়িক অনেকেই সাক্ষ্য দিয়েছেন। ইমাম যাহাবী তার বিভিন্ন গুণাবলী সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা শেষে লিখেছেন, শায়খ ছিলেন দ্রুত পাঠকারী। ইবনু আবদিল হাগী শায়খ সম্পর্কে লিখেছেন, তিনি এক বৈঠকে আল গাইলানিয়্যাত পাঠ করেছিলেন। আধুনিক সংস্করণে আল গাইলানিয়্যাত প্রায় ৩৫০ পৃষ্ঠার একটি বই। ইবনে তাইমিয়্যার অধ্যয়ন সম্পর্কে সফাদি লিখেছেন, তার কলমের গতি ছিল বিদ্যুতের মতো। তিনি যখন কোনো বিষয়ে কথা বলতেন সাথে সাথে তা লিখে ফেলতেন। অনেক সময় এক বৈঠকে দুই তিনটি খাতা লিখে শেষ করতেন। ইবনু রজব হাম্বলী আরো চমৎকার তথ্য দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ইবনু তাইমিয়্যা তার বিখ্যাত গ্রন্থ আল হামাবিয়্যাহ এক বৈঠকে লিখেছিলেন।

হাফেজ আবুল ফজল ইরাকী যখন ইবনুল খব্বাজ মুহাম্মদ বিন ইসমাইলের কাছে যান তখন ধারাবাহিক ছয়টি বৈঠকে পুরো সহীহ মুসলিম পড়ে শেষ করেন। এর মধ্যে শেষ বৈঠকেই তিনি পুরো গ্রন্থের এক তৃতীয়াংশ পাঠ করেছিলেন। তখন শায়খ যাইনুদ্দীন ইবনু রজবও উপস্থিত ছিলেন এবং তার কপির সাথে পাঠ মিলিয়ে নিচ্ছিলেন। বিখ্যাত অভিধানপ্রণেতা মাজদুদ্দীন ফাইরুজাবাদী একবার দামেশকে শায়খ নাসীরুদ্দীন বিন জাহবালের সামনে তিনদিনে সহীহ মুসলিম পাঠ করে সমাপ্ত করেন। এরপর তিনি কবিতা আবৃত্তি করেন,

‘আলহামদুলিল্লাহ। ইসলামের প্রাণকেন্দ্র দামেশকে আমি ইমাম নাসিরুদ্দীন ইবনে জাহবালের কাছে সহীহ মুসলিম পড়েছি। সামনে উপস্থিত ছিলেন বরেণ্য আলেম ও হাদীসবেত্তাগন। আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ, মাত্র তিন দিনেই পুরো পাঠ সমাপ্ত হয়েছে’।

মাক্কারী এই ঘটনা উল্লেখ করে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন, এটি কামুস প্রণেতার ওপর আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহসমূহের একটি। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অনুগ্রহ করেন।
বিখ্যাত মুহাদ্দিস সাখাবী তার শায়খ ইবনু হাজার আসকালানীর জীবনি নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই গ্রন্থের নাম আল জাওয়াহির ওয়াদ দুরার ফি তরজমাতি শাইখিল ইসলাম ইবনু হাজার। এই গ্রন্থে তিনি ইবনু হাজারের ইলমী জীবন, বর্নাঢ্য কর্মযজ্ঞ, ইলমী সফর ইত্যাদি নানা খুঁটিনাটি বিষয় আলোচনা করেছেন। এরপর তিনি লিখেছেন, তাকে আল্লাহ এমনসব বিষয়ে অনুগ্রহ করেছেন যা খুব কমই একজন মানুষের মাঝে একত্র হয়। তিনি চার বৈঠকে ইবনে মাজাহ পাঠ করেন। সহীহ মুসলিমও পাঠ করেন চার বৈঠকেই। এই মজলিসগুলো অনুষ্ঠিত হতো সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত। ইমাম নাসাঈর সুবৃহৎ গ্রন্থ আস সুনানুল কুবরা সমাপ্ত করেন দশটি বৈঠকে। প্রতিটি বৈঠক ছিল চার ঘণ্টার করে। ইমাম তবারানীর আল মুজামুস সগীর সমাপ্ত করেন এক বৈঠকে যা অনুষ্ঠিত হয়েছিল যোহর থেকে আসরের মধ্যবর্তী সময়ে। সহীহ বুখারী তিনি সমাপ্ত করেন দশটি বৈঠকে।

সহীহ বুখারীর অন্যতম বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ হলো আল্লামা কাসতাল্লানীর লেখা ইরশাদুস সারী। নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে এই ব্যাখ্যাগ্রন্থটি অনন্য হয়ে আছে। এই ব্যাখ্যাগ্রন্থের শুরুতে কাসতাল্লানী নিজের হাদীসের সনদ উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, এই গ্রন্থের শুরু থেকে শেষ সবকিছু আমি পাঠ করেছি আমাদের শায়খ আবুল আব্বাস আহমাদ বিন আবদুল কাদিরের কাছে। শায়খের বয়স ছিল নব্বইয়ের বেশি। আমি পাঁচটি বৈঠকে তার কাছে পুরো গ্রন্থ পাঠ করি। পরে অনুপস্থিতদের জন্য আবার পাঠ করি। সব মিলিয়ে দশটির মত বৈঠক লেখেছিল। এটি শেষ হয় ৮৮২ হিজরির শাউয়াল মাসের ১৮ তারিখে।

 

কাসতাল্লানী ও তার শায়খের এই ঘটনাটি আমি যতবার পড়ি ততবার আপ্লুত হই। আমি দ্বিধায় পড়ি, আমি কি কাসতাল্লানীর দ্রুত পাঠের জন্য বিস্ময় প্রকাশ করবো নাকি নব্বই উর্ধ শায়খের ইলমী নিমগ্নতা দেখে বিস্মিত হব? আমাদের সময়ের বহু তরুণও সম্ভবত ইলমের ক্ষেত্রে এমন হিম্মত করতে পারবে না।
কাসতাল্লানীর একজন বিখ্যাত ছাত্র ছিলেন আল্লামা বদরুদ্দীন আল গাজ্জী। অত্যাচারী শাসকদের সামনে হক প্রকাশের জন্য তিনি ছিলেন বিখ্যাত। তার ছেলে নাজমুদ্দীন আল গাজ্জীও ছিলেন একজন বিখ্যাত আলেম। তিনি ইতিহাস বিষয়ে আল কাওয়াকিবুস সাইরাহ বিয়াইয়ানিল মিয়াতিল আশিরাহ নামে বিখ্যাত গ্রন্থটির লেখক। নাজমুদ্দীন এই গ্রন্থে তার পিতার শিষ্যদের সম্পর্কে অনেক কিছুই উল্লেখ করেছেন। এমনই একজন আলেম হচ্ছেন বুরহানুদ্দীন বাকাই, যিনি বদরুদ্দীন আল গাজ্জীর কাছে পড়াশোনা করেছিলেন। তার সম্পর্কে নাজমুদ্দীন লিখেছেন, তিনি আমার পিতার কাছে অনেক পড়াশোনা করেছেন। তিনি আমার বাবার কাছে ছয়দিনে পুরো বুখারী এবং পাঁচ দিনে পুরো মুসলিম পাঠ করেন।
আবু বকর বাআলাভী সম্পর্কে মুহিব্বি উল্লেখ করেছেন তিনি মাত্র দশদিনে ইমাম গাযালীর ইহইয়া উলুমিদ্দীন পড়ে শেষ করেন। বর্তমানে এই গ্রন্থটি ৫ খন্ডে ছেপে এসেছে। অর্থাৎ তিনি প্রতি দুই দিনে এক খণ্ড্য সমাপ্ত করেছিলেন। মুরতাযা আজ যাবিদী আরেকজন বড় আলেম। তাজুল উরুস গ্রন্থটির জন্য ইসলামী তুরাসে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন। যাবিদির একজন বড় শিষ্য হলেন আবুল হাঁসান আলী বিন আহমাদ আলাভী।

তার সম্পর্কে যাবিদী নিজে লিখেছেন, সে আমার কাছে বারো বৈঠকে সহীহ বুখারী শেষ করেছে। প্রতিটি বৈঠক সূর্যোদয়ের পর থেকে আসর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হত। এটি ছিল ১১৮৮ হিজরির রমজানের ঘটনা। এছাড়া সে ছয় বৈঠকে সহীহ মুসলিম পড়েছে।
আল্লামা জামালুদ্দীন কাসেমীও তার গ্রন্থে আলেমদের এমন অনেক ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তিনি স্বয়ং নিজের সম্পর্কে বলেন, এই বইটি যিনি সংকলন করছেন, এই দুর্বল বান্দা, আল্লাহর অনুগ্রহে কিছু নিয়ামত লাভ করেছে। আমি সহীহ মুসলিম রিওয়ায়াত ও দিরায়াত উভয় পদ্ধতিতে ৪০ দিনে সমাপ্ত করেছি। সুনানে ইবনে মাজাহ সমাপ্ত করেছি ২১ দিনে। মুয়াত্তা ইমাম মালিক সমাপ্ত করেছি ১৯ দিনে। আমি যখন ইবনু হাজার আসকালানীর তাকরীবুত তাহযীব পড়ছিলাম তখন নিজের জন্য এতে কিছু ব্যাখ্যা ও টীকা টিপ্পনী যোগ করি। পুরো কাজটি করতে সময় লেগেছিল দশ দিন। আমি এইগুলো একটার পর একটা টানা পড়ে গেছি। আমার শরীর মন সবকিছুই দূর্বল হয়ে যায় এতে। আমার চোখের ওপর এতটা চাপ পড়ে যে ব্যাথ্যা শুরু হয়। আল্লাহর অনুগ্রহে পরে আমি সুস্থ হই। তবে আমি সতর্ক হয়ে যাই। আমার মনে হয় মধ্যপন্থাই সেরা। তবে আল্লাহর কিছু বান্দা আছেন যাদের ইন্দ্রীয় এতটাই শক্তিশালী যে তা ক্লান্ত হয় না। তবে প্রত্যেকেই তার নিজের সম্পর্কে ভালো জানে।

আবদুল হাই কাত্তানী তার গ্রন্থে অন্যদের ঘটনা বর্ননা করার পর নিজের সম্পর্কে বলেছেন, আমি সহীহ বুখারী টিকা টিপ্পনী ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণসহ ৫০ দিনে পড়ে শেষ করেছি।
পূর্ববর্তী আলেমদের দ্রুতপাঠের সকল ঘটনা একত্র করা আমার উদ্দেশ্য নয়। জীবনীগ্রন্থগুলো সামান্য অনুসন্ধান করলেই এমন শত শত ঘটনার সন্ধান মিলবে। এখানে কিছু ঘটনা উল্লেখ করা হলো উদাহরণ হিসেবে। এই ঘটনাগুলো থেকে আমরা বুঝতে পারি সালাফদের একটি পদ্ধতি ছিল দ্রুত পাঠ করা। দ্রুত পাঠের বিষয়টি পশ্চিমা জগতেও এখন স্বীকৃত। আমেরিকান চিন্তক মর্টিমার এডলার একটি বই লিখেছেন হাউ টু রিড এ বুক বা একটি বই কীভাবে পড়তে হয় শিরোনামে। বর্তমান সময়ে এটি একটি বেস্টসেলার বই। এই বইয়ে লেখক দ্রুত পাঠের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে দ্রুত পাঠের উদ্দেশ্য হলো নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া
১। বইটি কী বিষয়ে আলোচনা করেছে?
২। বইয়ের কাঠামো কী
দ্রুত পাঠের গুরুত্ব আলোচনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, অধিকাংশ পাঠক অনুসন্ধানমূলক পাঠের গুরুত্ব জানে না। তারা একটি বই সম্পর্কে প্রাথমিক ধারনা লাভের চেষ্টা এবং বইটি গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা একসাথে করতে যান যা পড়াকে দ্বিগুণ কঠিন করে তোলে। অর্থাৎ দ্রুত পাঠের উদ্দেশ্য হলো বইটি সম্পর্কে সামগ্রিক ধারনা লাভ।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগবে, দ্রুত পাঠের মাধ্যমে কি বইটি বোঝা যাবে? অনেকে মনে করেন ধীরগতিতে পড়লেই কোনো কিছু ভালো বুঝা যায়। এটি আংশিক সত্য হতে পারে। তবে পুরো সত্য নয়। অনেক সময় ধীরে পড়ার কারণেও বুঝতে সমস্যা হয়। কারণ আপনি যখন একটি বই পড়েন তখন এর বাক্য ও শব্দগুলো পৃথক ও একাকী কিছু নয় বরং একটি বৃহৎ কাঠামোরই অংশ। প্রতিটি শব্দ ও বাক্য একটি অপরটির সাথে সম্পর্কযুক্ত। এই সম্পর্ক তখনই মনের মাঝে স্পষ্ট হয় যখন আপনি এগুলোকে দ্রুত সংযুক্ত করেন।

যাই হোক, এই লেখার উদ্দেশ্য হলো এমন একটি পাঠপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা যা সালাফে সালেহীন তাদের জীবনে আমল করে দেখিয়েছেন। আধুনিককালে পশ্চিমা চিন্তাবিদ ও গবেষকরাও এটি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। আপনি যদি ইসলামী জ্ঞানভাণ্ডারের বিশাল জগতে প্রবেশ করতে চান তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন এই পদ্ধতিটি অনুসরণের বিকল্প নেই। সালাফে সালেহীন যা লিখে গেছেন তা এখন বৃহৎ বৃহৎ খন্ডে প্রকাশিত। আপনি যদি এগুলো ধারাবাহিকভাবে পাঠের সাহস করতে না পারেন তাহলে জ্ঞানের এক বড় অংশই আপনার হাতছাড়া হবে।

আমাদের সময়ে জ্ঞানের এক প্রকার বিস্ফোরণ ঘটেছে বলা যায়। প্রাসঙ্গিক সকল মাধ্যমগুলো আমাদের হাতের নাগালে অবস্থান করছে। আমরা এমন অনেক সুবিধা পাচ্ছি যা পূর্বসুরী আলেমরা পাননি। তবু যদি আমরা এ সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হই তাহলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও পিছিয়ে যাবে। আমাদের সীমিত সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে চাইলে আমাদের পাঠাভ্যাসে কিছু পরিবর্তন আনা আবশ্যক। একেকটি বইকে নানাভাবে পড়া যায়। কোনোটি প্রাথমিক দ্রুত পাঠ, কোনটি অনুসন্ধানী গভীর পাঠ। সবগুলোর সমন্বয়ের মাধ্যমেই আমাদের জ্ঞানচর্চার পথটি সুগম হবে।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ