জামেয়া ওয়েবসাইট

বৃহস্পতিবার-২১শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৫ হিজরি-৭ই ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ-২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

হৃদয়মিনারে অঙ্কিত নাম হাকিমুল ইসলাম আল্লামা শাহ মুফতি আবদুল হালীম বুখারী (রহ.)

হৃদয়মিনারে অঙ্কিত নাম হাকিমুল ইসলাম

আল্লামা শাহ মুফতি আবদুল হালীম বুখারী (রহ.)

 

বদুল আজিজ বিন আবদুল মালেক

লেখক: শিক্ষক: জামিয়া মিফতাহুল উলুম কওমী মাদরাসা (রামগঞ্জ-লক্ষ্মীপুর)

 

বহুমুখী ও বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ হাকিমুল ইসলাম, শায়খুল হাদীস ও মহাপরিচালক আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, প্রখ্যাত হাদীসবিশারদ ও ফকীহ, দুনিয়াজুড়ে হাকিমুল ইসলাম নামে সুপ্রসিদ্ধ৷ চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাসে ওলামায়ে দেওবন্দের প্রতিচ্ছবি৷ তিনি নমুনায়ে আকাবির৷ রসুল (সা.)-এর সুন্নাহের সুবাসিত পরশে স্নিগ্ধ ছিল তাঁর পুরো জিন্দেগি৷ আজীজী কাননের মণিমুক্তায় সুসজ্জিত তাঁর হৃদয় আঙিনা৷ তাঁর শান, লেবাস, চলাফেরা ও ব্যক্তিত্ব এমন যেন তিনি মুকুটহীন সম্রাট৷ যেসব গুণাবলির সমারোহ একজন মানুষকে প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসতে বাধ্য করে, সেসব গুণাবলির প্রত্যেকটা বুখারী (রহ.)-এর মধ্যে বিদ্যমান ও বিরাজমান৷ উম্মাহর তরবিয়ত ও সজাগকরণের কাজে তিনি ক্লান্তিহীন-শ্রান্তিহীন৷ তাঁর চেহারা মুবারকের দিকে তাকালে হৃদয়ে শীতলতা অনুভূত হত৷ বিষণ্ন হৃদয় প্রসন্নতায় রূপ নিত৷

লক্ষ্মীপুর দারুল উলুম চরমটুয়া মাদরাসায় পড়াকালীন এ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ও অন্যান্য উস্তায-তলাবাদের মুখে শুনতাম পটিয়া মাদরাসায় চারজন (বর্তমান শায়খুল হাদীস হাফেজ আহমাদুল্লাহ, শায়খে সানী মুফতি শামসুদ্দীন জিয়া ও ওবাইদুল্লাহ হামযাহ দা. বা.) সার্বিক বিষয়ে যোগ্য ও দক্ষ মহান ব্যক্তিত্বদের অন্যতম হচ্ছে মহাপরিচালক হাকিমুল ইসলাম আল্লামা শাহ্ মুফতি আবদুল হালীম বুখারী (রহ.)৷ বেশিরভাগ ছাত্রদের আকুতি ছিল পটিয়ায় পড়লে প্রশান্তি অনুভব হয়৷ এমনকি বাংলাদেশে সনদের দিক দিয়েও আ’লা৷

তখন থেকেই মনের আকাঙ্ক্ষা তীব্র আকার হল যে, দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) পটিয়া মাদরাসায় পড়বো৷ (কারণ আল্লামা আবু তাহের সাহেব (দা. বা.)-এর প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম চরমটুয়া মাদরাসা মেশকাত অবধি) এতে বুখারী (রহ.) এর মতো মহা মনীষীর দরসে বসার সুযোগ পাবো৷ উনার ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য অর্জনে আত্মতৃপ্তি লাভ করতে পারব৷

পরিশেষে এ মাদরাসায় ভর্তি হয়ে বুখারী (রহ.)-এর বেশ কতক দরস গ্রহণ করার সৌভাগ্য অর্জন করতে পেরেছি৷ কিন্তু পরবর্তীতে হুজুর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়৷ আইসিইউতে ভর্তি করা হয়৷ এদিকে উনার অসুস্থতার সংবাদে গোটা মাদরাসা নিরব নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে এমনকি শিক্ষক-ছাত্রদের হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে৷ সবাই দোয়ায় বিভোর৷ কিন্তু মঙ্গলবার সকালে দরস শেষ করে কিছুক্ষণ ঘুমানোর পর উঠে এমন একটি দুঃসংবাদ শুনার কল্পনাও করিনি আমি যে, বুখারী সাহেব মারা গেছে! এইতো কিছু্ দিন আগে হুজুর কতই না সুন্দরভাবে বুখারীর দরস দিয়েছেন৷

খুবই অপ্রত্যাশিত, আকস্মিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত এই দুঃসংবাদে মনটা বিষণ্ন হয়ে গেল। বিদায় ক্ষণে মনের অজান্তেই টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে বেদনার অশ্রুধারা৷ অতীতের সোনালি দিনের হাজারো স্মৃতি আজ হৃদয়ের সাগরে তরঙ্গের ন্যায় হাহাকার করে উঠছে৷ এই বিরহে কি যে নিদারুণ ব্যথা৷ কী যে জ্বালা তা শুধু অন্তরই জানে আর জানে অন্তর্যামী৷

বুখারী (রহ.)-এর নির্বাক বিদায়ের নিষ্ঠুরতম আঘাত আমার হৃদয় কে করে দিয়েছে ক্ষত-বিক্ষত ও ছিন্নভিন্ন৷ উনার বিদায়ের করুন আর্তনাদে সাড়া দিয়ে মনে হয় যেন সমগ্র সৃষ্টি নিরব, নিস্তব্ধ ও নিস্তেজ হয়ে গেছে৷ পূর্ণিমার রজনী যেন আলোর স্নিগ্ধতা হারিয়ে আঁধারে ছেয়ে গেছে৷ প্রবহমান ঝর্ণা যেন শুকিয়ে মরুভূমির আকার ধারণ করেছে৷

এমন একটি কঠিন মুহূর্ত তা কি কিছু প্রাণহীন বর্ণমালায় ব্যক্ত করা যায়? এমন একটি করুন চিত্র তা কি প্রাণহীন কাগজের বুকে চিত্রায়িত করা যায়? কখনো না! হৃদয়ের স্পন্দন সে তো কেবল হৃদয় দিয়েই অনুভব করা যায়৷ এরপর রাত সাড়ে দশটার সময় লক্ষ লক্ষ ছাত্র-শিক্ষক ভক্ত-অনুরক্তের উপস্থিতিতে আল্লামা হাফেজ আহমদুল্লাহ সাহেব (দা. বা.)-এর ইমামতির মাধ্যমে বুখারী (রহ.)-কে রাজকীয় বিদায় দেওয়া হয়েছে৷ রফীকে আ’লার সান্নিধ্যে চলে গেলেন তিনি৷

বুখারী (রহ.) নিঃস্বার্থ মনের পরশ জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার উপদেশ এবং সৌহার্দপূর্ণ ব্যবহার আমার মনের গভীরে যে রেখাপাত করেছে তা কোনো দিন মুছে যাবার নয়৷ পেয়েও হারানোর বেদনা এ অবুঝ মন কিছুতেই মানতে পারছে না৷ কিন্তু দরসে হাদীসের মসনদে আল্লামা বুখারী (রহ.)-এর মোণিমুক্তাতুল্য তথ্যবহুল ও অতুলনীয় তাকরীর এবং মধুমাখা মায়াজড়িত কথোপকথনের মুহূর্তগুলো সব আজ হৃদয়ের মণিকোঠায় ভেসে উঠছে৷

বুখারী (রহ.)-এর বুখারী শরীফ প্রথম খণ্ডের এক অনবদ্য ও বিরল তাদরীস দিতেন। আমি প্রথমে অন্য কিতাবের ইবারত পড়ার জন্য নাম দিয়েছি৷ কিন্তু ভয়ে বুখারী আওয়ালের ইবারত পড়ার জন্য আমার নাম দিইনি৷ কিন্তু পরবর্তীতে বুকভরা আশা ও প্রবল আগ্রহ নিয়ে বুখারী আওয়ালের ইবারতে নাম দিয়েছি৷ শুধুমাত্র হুজুর (রহ.)-এর নেক দৃষ্টিটা আমার ওপর পড়ার জন্য যাতে আমার জীবন আলোকময় হয়৷ এবং মহান আল্লাহ তার ওলীর কারণে আমার জীবন উজ্জ্বল করার প্রত্যাশায়৷ কিন্তু আমার পালা আসার আগেই হুজুর (রহ.) এ পরিণত হয়ে গেছে৷ কিন্তু এখনও আমার নাম ইবারতের তালিকায় ঝুলন্ত৷ হ্যাঁ অনেকবার এই পর্যন্ত বুখারী আওয়ালের ইবারত পড়ার সুযোগ হয়েছে৷

শ্রদ্ধাভাজন উস্তাযের প্রতিটি কথার মাধ্যমেই জ্ঞাত হওয়া যেত তাঁর জ্ঞানের সমাহার৷ দরসে হাদীসের মসনদে উনার তাকরীরে আমি আলোড়িত, আমি মুগ্ধ, তাঁর দরসেই দরসের পিপাসা মিটে যেত৷ নবজীবন গঠনে উৎসাহ-উদ্দীপনা পাওয়া যেত৷ বুখারী (রহ.)-কে দরসের দিক দিয়ে অদ্বিতীয় মুকার্‌রির বলা হয়। তত্ত্ববহুল, সাবলীল, গোছালো, সুস্পষ্ট তাকরীর ছিল৷ ক্লাসের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত কতই না সুন্দর তারতীব ছিল। এত লম্বা সময় তাকরীরের মাঝেও একটি শব্দকে দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করার প্রয়োজন হত না। এত বিশুদ্ধ ও সহজ শব্দচয়ন করতেন যে, সব স্তরের ছাত্ররা উপলব্ধি করতে সক্ষম হত। অনেকেই নোট করতেন যেন অন্তর থেকে মুছে গেলেও আবার স্মরণে এসে যায় দেখামাত্রই। একটি হাদীসও তাকরীর করা ব্যতীত তিনি সামনে অগ্রসর হতেন না।

দরসের এত গুরুত্ব দিতেন তিনি যা আমার জীবনেও কোথাও প্রত্যক্ষ হয়নি৷ তিনি ছিলেন বহু গ্রন্থপ্রণেতা৷ যেমন তাসহীলুল উসূল, তাসহীলুত তহাবী, তাসহীলুত তিরমিযী, তাসহীলুল বুখারী ইত্যাদি৷ সব মুতাআলা করার এখনো সৌভাগ্য আমার হয়নি কিন্তু মুকাদ্দামায়ে তাসহীলুল বুখারী নামক কিতাবটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আনন্দচিত্তে মুতাআলা করেছি৷

হাতের ফাঁক দিয়ে হঠাৎ চড়ুই পাখি যেমন ফুড়ুৎ করে উড়ে যায় তেমনিই প্রতিটি পৃষ্ঠা ফুরিয়ে গিয়েছে৷ ধারাবাহিক পড়লে সাধারণত ক্লান্তি আসে কিন্তু বুখারী (রহ.) লিখিত কোনো কিতাব অধ্যয়নে সেই ক্লান্তি আসেনা বরং পাঠ তৃষ্ণা নিবারণ হয়৷ এক কথায় বলা যায় যে, তাঁর মেসাল তিনিই৷ আরবি, উর্দু, ফারসি এমনকি ইংরেজি ভাষায় যেকোনো বিষয়ে চিন্তাহীন কবিতা আবৃতি করতে পারতেন মুহূর্তেই৷ প্রায় ভাষায় তিনি মাহের ছিলেন যার জ্বলন্ত প্রমাণ শতশত বিদ্যমান৷

বুখারী (রহ.)-এর খ্যাতি শুধু স্বদেশে সীমাবদ্ধ ছিল না৷ তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মহান ব্যক্তিত্ব৷ লোকমুখে শুনা যায় যে, যারা তাঁর কাছে তিরমিযী শরীফ পড়ে দারুল উলুম দেওবন্দে আবার পড়েছে তারা এ কথা বলতে বাধ্য হল যে, বুখারী (রহ.)-এর মতো তিরমিযীর দরস আমরা কোথাও পাইনি৷ তিনি ছিলেন মুহাক্কিক, মুদাক্কিক, মুআল্লিফ ও মুফাক্কির৷ তাঁর প্রত্যেকটা সিদ্ধান্ত বিচক্ষণতার সাক্ষ্য বহন করে।

মহান ব্যক্তিত্ব তাঁর হাতে গড়া সন্তান আল্লামা ওবাইদুল্লাহ হামযাহকে জামিয়ার নায়েবে মুহতামিম নিয়োগ দিয়ে তিনি প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন৷ পরিচালনায় দক্ষতা ও যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার ক্ষেত্রে তাকে অনন্য বলা হয়৷ কারণ, যে বিষয়গুলো কমিটি করে কিংবা কয়েকবার বৈঠক করেও সমাধান দেওয়া যেত না। সেরকম বিষয় তিনি মুহূর্তেই সামাধান করতে পারতেন। ফলে সবাই অবাক ও বাকরুদ্ধ হয়ে যেত৷

তিনি ছিলেন মুক্তচিন্তা, বুদ্ধি ও রুচিশীল মনের অধিকারী। ব্যক্তিজীবনে অপরিমেয় সারল্য ও অকপটতার জন্য তিনি সকলের শ্রদ্বাভাজন ছিলেন এবং পারিবারিক ও বাইরের জীবনে উভয় ক্ষেত্রেই একজন সুখী মানুষ ছিল।

তিনি ছিলেন একজন বাগ্মী সুবক্তা৷ দরদমাখা কণ্ঠের অধিকারী৷ তাঁর ভাষা ছিল যেমন সাহিত্যিক, সুন্দর তেমন আকর্ষণীয়৷ তাঁর বক্তৃতা কুরআন-হাদীসভিত্তিক ও বিষয়ভিত্তিক সুসংহত৷ তাঁর বেশ কিছু অসাধারণ হৃদয় নিংড়ানো আলোচনা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগের সাথে শুনেছি৷ বাহ সত্যি অনবদ্য অসামান্য বেশ চমৎকার উপস্থাপনশৈলী৷

মনের মাধুরী মিশানো সুন্দর পরিশুদ্ধ পরিপূর্ণ নির্মাণ কৌশল প্রতিটি কথায়। মননশীল মননের সঙ্গে পরিমার্জিত এবং প্রশংসনীয়, নিপুণ অনুরণ অনুরণিত সমুজ্জ্বল ও যুক্তিসংগত উপস্থাপনশৈলীতে মুগ্ধতা একরাশ পেয়েছি৷ বিনয়ে ভরপুর মন-মস্তিস্ক যার প্রমাণ তাঁর জবান থেকে প্রকাশিত প্রতিটি কথা৷

তাঁর সময়োপযোগী গুরুত্বপূর্ণ উপস্থাপনা যা হিংসা-বিদ্বেষে কলুষিত মানুষদের হৃদয়গুলোকে পরিশুদ্ধ করে তুলে৷ পটিয়া আসার পূর্বে আমার মন চেয়েছিল পাখির মতো উড়ে গিয়ে তাঁর সান্নিধ্য লাভে ধন্য হয়৷ যেকোনো দুর্যোগময় মুহূর্তে যেকোনো বিষয়ে হৃদয় নিংড়ানো দরদমাখা বয়ান করে নামধারী মুসলিম, কওমী ওলামা-তলাবা বিদ্বেষী মানুষগুলোর মনের গহীনে সঠিক বিষয় বুঝিয়ে দিতে সক্ষম ছিলেন৷

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মহামনীষীর জীবনী আমাদের জীবনে লালন এবং চর্চা করতে হবে এবং এর ব্যাপক প্রচার-প্রসার করতে হবে। তবেই আমরা শুধু উপকৃত হবো না বরং জাতি হিসেবে জ্ঞানীজনের কদর করে আমরা গর্বিত জাতি হিসেবে সমাজ ও বিশ্বে মূল্যায়িত হবো। এবং উনার উত্তরসূরি হিসেবে আমরাও সেই হিসেবে জীবন পরিচালনা করার চেষ্টা করব৷ পরিশেষে বুখারী (রহ.)-এর এক ক্ষুদ্র ও অধম শিষ্য হিসেবে আমি আবদুল আজীজ আল্লাহর সমীপে ফরিয়াদ করি তিনি যেন প্রিয় উস্তাযকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন৷ আমীন ইয়া রব্বাল আলামীন।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ