জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দেওবন্দি চিন্তাধারার মুখপাত্র ও আদর্শ ব্যক্তিত্ব আল্লামা মুফতি তকী উসমানী

দেওবন্দি চিন্তাধারার মুখপাত্র আদর্শ ব্যক্তিত্ব আল্লামা মুফতি তকী উসমানী

 

সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী

        লেখক: শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম

নানা কারণে বিগত কয়েক সংখ্যায় ‘শিক্ষার্থীদের পাতা ও শিক্ষা পরামর্শ’ বিভাগে লেখা প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। এ সংখ্যায় এমন একটি প্রশ্ন সামনে এসেছে, যা কিছু লিখতে বাধ্য করেছে। এক ছাত্র আল্লামা মুফতি তকী উসমানী (হাফি.) সম্পর্কে জানতে চেয়ে একটি চিরকুট লিখে প্রশ্ন পাঠালেন। যা পড়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম। কলম ধরে বসে আছি। প্রশ্নটি দেখে অনেকটা হতবুদ্ধি ও স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি! নির্বাক ও দিশেহারা হয়ে ভাবতে লাগলাম, এর উত্তর কী হতে পারে?! মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম, আমাদের শিক্ষার্থীরা আমাদের পূর্বসূরি আকাবির-আসলাফ সম্পর্কে এমন ধারণা পোষণ করতে পারে?! আমাদের এই কওমী মাদরাসাগুলোকে আদব-কায়দার সূতিকাগার মনে করা হয়। এখানে শিক্ষক-ছাত্রের মাঝে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও আন্তরিকতা এবং পরস্পর শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। উস্তাদের কথা বিনাদ্বিধায় ছাত্ররা মেনে নেয়। শিক্ষকরা যখন আকাবির-আসলাফের কথা বলেন, তখন ছাত্ররা তা অধীর আগ্রহে শোনে এবং আমলের প্রতি প্রবুদ্ধ ও জাগরিত হয়।

তাহলে বর্তমানে তাতে কি ভাটা পড়েছে? ছাত্রদের অন্তরে কি শিক্ষকমণ্ডলির সেই অকুণ্ঠ ভালোবাসা নেই?! আকাবির-আসলাফের প্রতি তাদের নিরঙ্কুশ শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে যাচ্ছে?!

যদি সত্যিই তা হয়ে থাকে, তাহলে তা কেবল বড় দুঃখজনক নয়, বরং আমাদের কওমী অঙ্গনের জন্য বড় বিপদজনকও বটে।

মনে রাখতে হবে, আকাবির ও আসলাফের জীবনী শিক্ষালাভ ও আত্মিক উৎকর্ষলাভেরও অন্যতম মাধ্যম। আল্লামা ইবনুল জাওযী (রহ.) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ সায়দুল খাতিরে লিখেছেন,

رأيت ‌الاشتغال ‌بالفقه ‌وسماع ‌الحديث لا يكاد يكفي في صلاح القلب؛ إلا أن يمزج بالرقائق، والنظر في سير السلف الصالحين. فأما مجرد العلم بالحلال والحرام، فليس له كبير عمل في رقة القلب؛ وإنما ترق القلوب بذكر رقائق الأحديث، وأخبار السلف الصالحين؛ لأنهم تناولا مقصود النقل، وخرجوا عن صور الأفعال المأمور بها إلى ذوق معانيها والمراد بها. وما أخبرتك بهذا إلا بعد معالجة وذوق، لأني وجدت جمهور المحدثين وطلاب الحديث همة أحدهم في الحديث العالي، وتكثير الأجزاء، وجمهور الفقهاء في علوم الجدل، وما يغالب به الخصم. وكيف يرق القلب مع هذه الأشياء. وقد كان جماعة من السلف يقصدون العبد الصالح للنظر إلى سمته وهديه لا لاقتباس علمه، وذلك أن ثمرة علمه هديه وسمته. فافهم هذا، وامزج طلب الفقه والحديث بمطالعة سير السلف والزهاد في الدنيا، ليكون سببًا لرقة قلبك.

‘আমি গভীরভাবে ভেবে দেখেছি, শুধুমাত্র ফিকহ ও হাদীস শ্রবণে শ্রম ব্যয় করার মাধ্যমে ব্যক্তির মাঝে পরিপূর্ণ যোগ্যতা ও উৎকর্ষ জন্ম নেয় না। এর সাথে সম্পূরক হিসেবে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দিকগুলোর অন্যতম হচ্ছে পূর্ববর্তী নেক, খোদাভীরু ও আল্লাহওয়ালা সালাফের জীবনী অধ্যয়ন করা। হারাম-হালাল নিয়ে দিনরাত পর্যালোচনার পাশাপাশি এমন সালাফদের জীবনী পাঠ অতীব জরুরি, যারা তাদের ব্যক্তিজীবনে ইসলামকে ঠিক সেভাবে চর্চা করে গেছেন, যেভাবে এটি নবীজির ওপর নাজিল করা হয়েছে। তাদের জীবনীপাঠের পর অন্তরে যে পরিমাণ আমলের ঝোঁক ও আল্লাহকে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়, তা শুধু অভিজ্ঞ ব্যক্তিই স্বীকার করবেন। মনে রাখবেন, আমি বহু মনীষীর নিকট থেকে এ শিক্ষাটি শ্রবণের পাশাপাশি নিজেও বহুবার বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখেছি। সাধারণত মুহাদ্দিসরা উঁচুমানের হাদীস সংগ্রহে নিজেদের অধিকাংশ সময় ব্যয় করে থাকেন। ফকীহরা তাদের দিনরাত একাকার করেন দলিলের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের মত দুর্বল দেখানোর জন্য। কিন্তু এতসবের মাঝেও তারা একটি সময় পৃথক করে নিতেন। এ প্রহরে তারা ওলি-আল্লাহ বুজুর্গদের দরবারে গমন করতেন, কোনো পেশাগত উদ্দেশ্যে নয়; শুধু তাদের জীবনপ্রণালি পর্যবেক্ষণ করতে। এটা সেই জীবনধারা, কিতাব ও সুন্নাত থেকে যার শুদ্ধ রূপ প্রণয়নে তাদের (মুহাদ্দিস ও ফকীহ) জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় হয়। অথচ এই সালাফরাই প্রহরের পর প্রহর এই আল্লাহওয়ালাদের সান্নিধ্য গ্রহণ করতেন। অবশ্যই এর ইতিবাচক প্রভাব তারা তাদের জীবনে উপলব্ধি করতেন। আমাদেরও উচিত, তত্ত্বমূলক জ্ঞানগবেষণার পাশাপাশি বেশি বেশি সিরাত ও সালাফদের জীবনচরিত অধ্যয়ন করা। এটাই সেই কাজ—দীনের ওপর চলার পথ মসৃণ করতে যা আমাদের সবচেয়ে বেশি সহায়তা করে থাকে।’ (সায়দুল খাতির, পৃ. ২২৮-২২৯)

যাক, সেই চিরকুটে প্রশ্নকারী উর্দু ভাষায় প্রশ্নটি করেছেন। প্রশ্নটি কিঞ্চিৎ পরিমার্জনসহ উর্দুভাষায় উল্লেখ করা হল:

حضرت! آپ کے متعلق ہم جانتے ہیں کہ آپ بہت شفیق اورمفیدا ستاد ہے۔ اس لیے ہم کو جب بھی کوئی امر دقیق پیش آئے تو آپ کے سپرد کرتے ہیں، اورآپ اس کی آسان اوربہترین حل پیش کرتے ہیں۔ آج ہم جاننا چاہتے ہیں کہ ہم بچپن ہی سے سنکر آئے ہیں کہ حضرت علامہ مفتی تقی عثمانی -بارک اللہ فی حیاتہ -دیوبند ی علمائے کرام کے ایک روشن ستارہ ہیں۔ بہت بڑا عالم، مفتی اور فقیہ ہیں۔ لیکن افسوس کے ساتھ کہنا پڑتا ہے کہ آج کل کے کچھ نامنہاد عالم ان کے بارے میں طرح طرح کے اعتراضات کرتے ہیں، یہاں تک کہ بعض نے تو انکو -العیاذ باللہ- شیخ الحدیث کے بجائے شیخ الکفار کا الزام دے دیا ہے۔ تو یہ بات سن کر ہم بہت پریشان ہیں، اس لیے حضرت والاکی خدمت اقدس میں عرض ہے کہ اس کی حقیقت واشگاف فرماکرممنون فرمائے۔ اللہ تعالی آپ کو جزائے خیرعطافرمائے۔ آمین۔

عرضگذار

یکے از طلبۂ جامعہ اسلامیہ پٹیہ، چاٹگام

প্রিয় শিক্ষার্থী! বর্তমান বিশ্বের সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমে দীন, মুফাক্কিরে ইসলাম, শায়খুল ইসলাম, জাস্টিস আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ তকী উসমানী (হাফি.)। তিনি বিশ্বনন্দিত মুসলিম স্কলার ও বর্তমান বিশ্বের একজন প্রখ্যাত ইসলামি ব্যক্তিত্ব। হাদীস, ফিকহ, তাসাউফ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও ইসলামি বিচার ব্যবস্থা; ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর সমানভাবে বিশেষজ্ঞতা ও পাণ্ডিত্য রয়েছে। তিনি বর্তমানে ইসলামি অর্থনীতিতে সক্রিয় ব্যক্তিদের অন্যতম। তিনি ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শরীয়াহ আদালতের এবং ১৯৮২ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের শরীয়াহ আপিল বেঞ্চের বিচারক ছিলেন।

তিনি বিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থ মাআরিফুল কুরআনের রচয়িতা মুফতি শফী উসমানী (রহ.)-এর সন্তান এবং বিখ্যাত দুই ইসলামি ব্যক্তিত্ব মাওলানা রফী উসমানী (রহ.) ও মাওলানা ওয়ালী রাজীর ভাই। আল্লামা তকী উসমানী (হাফি.) ৫ শাওয়াল ১৩৬২ হিজরী মুতাবেক ১৯৪৩ সালের ৫ অক্টোবর ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ভারত বিভাগের পর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১লা মে তাঁর পরিবার হিজরত (স্থানান্তরিত) করে পাকিস্তান গমন করে। মাওলানা তকী উসমানী পাঁচ ভাইবোনের মাঝে দ্বিতীয়। তাঁর বংশধারা ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা উসমান (রযি.)-এর সাথে মিলিত হয়েছে।

শিক্ষাজীবন: পরিবারে মায়ের কাছেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। মার কাছেই তিনি উর্দু ও ফারসি ভাষার প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ করেন। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে ৮ বছর বয়সে তিনি দারুল উলুম করাচিতে ভর্তি হন। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই প্রতিষ্ঠান থেকেই দরসে নেযামি সিলেবাসের সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদীস সমাপন করেন। দাওরায়ে হাদিসের কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় তিনি সর্বকালের সেরা নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হন।

এরপর তিনি তাঁর পিতা মুফতি শফী উসমানী (রহ.)-এর তত্ত্বাবধানে ইসলামি ফিকহে উচ্চতর শিক্ষা অর্জন করেন। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি দারুল উলুম করাচি থেকে ফিকহ ও ফতওয়ার ওপর তাখাস্সুস (পিএইচ.ডির সমমানের ডিগ্রি) সম্পন্ন করেন। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি এবং রাজনীতি বিজ্ঞানে বি.কম এবং ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পাশ করেন।

এছাড়া তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ ডিগ্রিও অর্জন করেন। তিনি শায়খ হাসান মাশাত, মুফতি মুহাম্মদ শফী উসমানী (রহ.), মাওলানা ইদরীস কান্দলভী (রহ.), মুফতি রশীদ আহমাদ লুধিয়ানভী (রহ.) ও শায়খুল হাদীস মুহাম্মদ যাকারিয়া কান্ধলভী (রহ.)-এর কাছ থেকে হাদীস বর্ণনার ইজাযত (অনুমতি) গ্রহণ করেন।

আত্মশুদ্ধির গুরুত্ব অনুধাবন করে দেওবন্দের আলেমদের ধারা অনুসারে তিনি আল্লামা আশরাফ আলী থানভী (রহ.)-এর খলীফা শায়খ ডা. আবদুল হাই আরিফীর হাত বায়আত গ্রহণ করেন। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে ডা. আবদুল হাই আরিফী মৃত্যুবরণ করেন। তখন তিনি আল্লামা আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর আরেক খলীফা মাসীহুল্লাহ খান থেকে বায়আত গ্রহণ করে ইজাযত প্রাপ্ত হন।

কর্মজীবন: ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে দাওরায়ে হাদীস সমাপনের পর থেকেই তিনি দারুল উলুম করাচিতে অধ্যাপনা করে আসছেন। ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০০২ খ্রিস্টাব্দের মে মাস পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের শরীয়া অ্যাপিলেট বেঞ্চের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মিজান ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পাকিস্তানে সর্বপ্রথম তিনিই ইসলামি ব্যাংকিং চালু করেন। আল্লামা মুফতি তকী উসমানী আন্তর্জাতিক ফিকহ অ্যাকাডেমি (ওআইসির একটি শাখা সংস্থা)-এর একজন স্থায়ী সদস্য। নয় বছর তিনি আন্তর্জাতিক ফিকহ অ্যাকাডেমির ভাইস চেয়ারম্যানও ছিলেন।

২০০৪ সালের মার্চ মাসে মাওলানা তকী উসমানীকে দুবাইয়ে আন্তর্জাতিক ইসলামি অর্থনীতি সংস্থার বার্ষিক অনুষ্ঠানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী ইসলামি অর্থনীতিতে তাঁর অবদান ও অর্জনের কারণে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে। প্রতি সপ্তাহের রবিবার তিনি করাচির দারুল উলুম মাদরাসায় আত্মশুদ্ধি সম্পর্কে বয়ান করেন।

বর্তমানে তিনি দারুল উলুম করাচিতে সহীহ বুখারী, ফিকহ ও ইসলামি অর্থনীতির দরস (কোনো বিষয়ে পরামর্শ বা বক্তব্য প্রদান করা) দেন। ১৯৭০ সালে প্রেসিডেন্ট যুলফিকার আলী ভুট্টোর আমলে পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি কর্তৃক কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করার ব্যাপারে আলিমদের মধ্য হতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

জেনারেল জিয়াউল হকের শাসনামলে হদ্দ, কিসাস ও দিয়ত সম্পর্কিত আইন প্রণয়নে তিনি অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৭ সাল থেকে তিনি উর্দু মাসিক পত্রিকা আল-বালাগ এবং ১৯৯০ সাল থেকে ইংরেজি মাসিক পত্রিকা আল-বালাগ ইন্টারন্যাশনালের প্রধান সম্পাদক পদে আছেন। ইসলামি ব্যাংকিং ও অর্থনীতি সম্পর্কে তিনি বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীতে বহু প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি আরবি, উর্দু এবং ইংরেজি ভাষায় ষাটের অধিক গ্রন্থের রচয়িতা। তার রচিত অধিকাংশ বই বাংলায় অনূদিত হয়েছে।

যাঁর অবদানে তিনি পাকিস্তানের বিচারপতি: আল্লামা তকী উসমানী লিখিত গ্রন্থ নুকুশে রাফতাগা কিতাবে তার বিচারপতি হওয়ার ঘটনা এভাবে লিখেছেন, বাংলাদেশ হওয়ার পর ১৯৮০ সালে প্রথমবারের মত আমি বাংলাদেশ সফরে আসি। তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মরহুম জিয়াউল হক (রহ.)।

বাংলাদেশে আসার পর আমীরে শরীয়ত হযরত হাফেজ্জী হুযুর (রহ.)-এর সাথে নূরিয়া মাদরাসায় দেখা হয়। আমি হযরাতের খেদমতে একদিন একরাত থাকি। যাওয়ার সময় হযরত হাফেজ্জী হুযুর (রহ.) আমার হাতে একটি পত্র প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের নামে দিলেন। আমি পত্রখানা পড়লাম। দেখলাম আমার ব্যাপারে কিছু কথা লেখা হয়েছে। পত্রখানা পড়ে আমি হযরাতের খেদমতে আদবের সাথে নিবেদন করলাম, হযরত শেষের লাইনটা কেটে দিলে ভাল হত।

হযরত হাফেজ্জী হুযুর (রহ.) বললেন, যেভাবে আছে সেভাবে থাকতে দাও। আমি যা বলি তাই করো। পাকিস্তান পৌঁছার পর পত্রখানা প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক এর হাতে দিও। এরপর আল্লামা তকী উসমানী লিখেন, হযরাতের এ পত্রদ্বারাই আমাকে প্রেসিডেন্টের পরামর্শদাতা এবং বিচারপতি বানানো হয়।

আকাবিরে দারুল উলুমের দৃষ্টিতে আল্লামা তকী উসমানী (হাফি.): বিগত ২০১০ সালে আল্লামা তকী উসমানী (হাফি.) ভারত সফর করেন। তাঁর সফরের কথা শুনে দারুল উলুম দেওবন্দের তদানীন্তন মুহতামিম আল্লামা মরগুবুর রহমান (রহ.) তাঁকে চিঠির মাধ্যমে দারুল উলুমে দাওয়াত করেন। চিঠিটির অনুবাদ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

বিসমিহী তাআলা

মাননীয় ও সম্মানিত হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ তকী উসমানী সাহেব (আল্লাহ আপনার সম্মান বৃদ্ধি করুন) করাচি, পাকিস্তান।

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু

আশা করি ভালো আছেন। দারুল উলুম দেওবন্দের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মাদ্রাজের জনাব মালিক মুহাম্মদ ইবরাহীম সাহেবের মাধ্যমে জানতে পেরে অত্যন্ত খুশি হয়েছি যে, আপনি অতি সত্বর হিন্দুস্তানে তাশরীফ আনছেন। আল্লাহ আপনার এ সফর কল্যাণ ও নিরাপত্তার সাথে সম্পন্ন করুন, আমীন।

এ পর্যায়ে আমরা যারা দারুল উলুমের খাদেম আছি, আমাদের বাসনা এই যে, জনাব দারুল উলুম দেওবন্দকেও নিজের প্রোগ্রামের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করবেন। দেওবন্দের সঙ্গে আপনার যেমন পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে, তেমনি দারুল উলুম দেওবন্দের সঙ্গেও রয়েছে বিরাট ও গভীর সম্বন্ধ। আপনার আগমনে অবশ্যই হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শফী সাহেব (কু. সি.)-এর স্মরণ তাজা হয়ে উঠবে। দারুল উলুমের এবং আসতেযায়ে কেরামও আপনার সাক্ষাৎ লাভে আনন্দিত হতে পারবেন। দারুল উলুমের ছাত্ররাও এ সুযোগে আপনাকে দেখার ও আপনার নসীহত শোনার জন্য আগ্রহী। তাদের সে তৃষ্ণাও নিবারিত হবে।

আমাদের শুধু আশাই নয়, বরং পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে যে, আপনি দারুল উলুমের খাদেমদের এ দাওয়াত গ্রহণ করে ভূষিত করবেন এবং দেওবন্দের প্রোগ্রামকে এভাবে বাস্তবে রূপ দেবেন যে, এক বেলা উপস্থিত যা-কিছু থাকে আমাদের সঙ্গে আহার করবেন। প্রিয় ছাত্রদের উদ্দেশ্যেও মেহেরবানি করে বয়ান করবেন। আশা করি আমাদের এ বাসনা পুরো করে বাধিত করবেন।

সালামান্তে

(মাওলানা) মারগুবুর রহমান

মুহতামিম, দারুল উলুম দেওবন্দ

২৩/০৭/১৪৩১ হি., ৬/০৭/২০১০ খ্রি.

সারা বিশ্বে আপনি হলেন দারুল উলুম দেওবন্দের মুখপাত্র: আল্লামা মুফতি তকী উসমানী (হাফি.)-এর আগমন উপলক্ষ্যে দারুল উলুমের আলিশান মসজিদে রশীদে এক বিশাল সভার আয়োজন করা হয়। দারুল উলুম দেওবন্দের তিরমিযি শরীফের উস্তাদ ও নাজেমে তালিমাত হযরত মাওলানা রিয়াসত আলী বিজনূরী (রহ.) উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন। তিনি তাঁর উদ্‌বোধনী বক্তব্যে বলেন, ‘দারুল উলুম দেওবন্দে কোনো মেহমান এলে আমরা তার সামনে দারুল উলুমের পরিচয় তুলে ধরি, কিন্তু আজ এমন একজন মেহমানকে আমরা অভ্যর্থনা জানাচ্ছি, যিনি নিজেই দারুল উলুমের সদস্য। তাঁর সামনে দারুল উলুমের পরিচয় তুলে ধরার পরিবর্তে আমাদেরকে তাঁর নিকটেই জিজ্ঞাসা করতে হবে যে, দারুল উলুম দেওবন্দ কী? এর কারণ এই যে, আমরা তাঁকে সারা পৃথিবীতে দারুল উলুম দেওবন্দের মুখপাত্র মনে করি।’ আল্লামা মুফতি তকী উসমানী (হাফি.) লিখেন, এ কথাগুলো ছিল আমার জন্যে অত্যন্ত সম্মানজনক। আল্লাহ তাআলার নিকট দোয়া করি, তিনি যেন আমাকে এর যোগ্য হওয়ার তাওফীক দান করেন। আমীন। (আমার দেখা পৃথিবী, ৪/৩১৯)

আল্লামা মুফতি তকী উসমানী (হাফি.) বর্তমান বিশ্বের এক অনন্য আদর্শ ব্যক্তিত্ব। ইসলামি গবেষক হিসেবে তাঁর খ্যাতি সর্বজন বিদিত। লেখালেখি ও বক্তব্য-লেকচারের মাধ্যমে ইসলামের সর্বজনীন আদর্শ ও কালজয়ী শিক্ষা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর নিকট তুলে ধরতে রীতিমতো কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর প্রখর মনীষা, অনন্য স্মৃতি শক্তি ও বুদ্ধিদীপ্ত প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব গোটা বিশ্বের মুসলমানদেরকে বিমোহিত করেছে।

তিনি একজন দক্ষ মুফতি। ফিকহী ইজতিহাদ করার ক্ষেত্রে তাঁর যোগ্যতা রয়েছে। গবেষণালব্দ মাসয়ালা বর্ণনা করতে গেলেই ইখতিলাফ দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। ইসলামী শরীয়তের পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণার (তাফাককুহ ফিদ দীন) সক্ষমতা সব আলিম, বক্তা ও ওয়ায়েজের থাকে না। এটা আল্লাহ তাআলা এমন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দান করে থাকেন যাদের রয়েছে কুরআন, তাফসীর, হাদীস, উসূলে হাদীস, ফিকহ, উসূলে ফিকহ, আরবি ভাষা, সাহিত্য ও বালাগাত শাস্ত্রে অগাধ পাণ্ডিত্য ও নিরলস সাধনা। গবেষণার বিভিন্ন পর্যায়ে ভিন্নমত থাকাটা বিচিত্র নয়। পৃথিবীর সব মানুষ একই মাযহাব, একই দল বা একই চিন্তাধারার অনুসারী হবেন এটা ভাবা সঙ্গত নয়; সম্ভবও নয়।

এ সম্পর্কে আমাদের মাসিক আত-তাওহীদের সম্পাদক ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন মহোদয় চমৎকার লিখেছেন, ‘মতের ভিন্নতা, সাধারণ বিষয়ে ইখতিলাফ ও মাযহাবী বিরোধ নিয়ে আমরা মুসলমানেরা যুগে যুগে যেভাবে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত ও সহিংসতায় রক্ত ঝরিয়েছি তা ইসলামের ইতিহাসে এক বিভীষিকাময় স্মৃতি। মুফাসসিরে কুরআন ইমাম ইবন জারীর (রহ.)-কে বাগদাদের কবরস্থানে দাফন করতে দিইনি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর কট্টরপন্থী অনুসারীগণ। নিজ বাড়ির উঠানে তাঁকে কবর দিতে হয়েছে। দামেস্কের মসজিদে উমাইয়াদের হাতে নির্মম পিটুনির শিকার হয়ে প্রাণ হারালেন বিশ্ববরেণ্য মুহাদ্দিস ইমাম নাসায়ী খলীফা মু’তাসিম বিল্লাহ তথা সুন্নিদের শায়েস্তা করার জন্য হালাকু খানকে বাগদাদে ঢেকে এনেছিলেন শীয়াপন্থী লোকেরাই। ফলশ্রুতিতে ধ্বংস হয়ে গেল সভ্যতার লীলাভূমি ঐতিহাসিক নগরী বাগদাদ; জ্বলে পুরে ভস্ম হয়ে গেল মুসলমানদের পাঁচশ বছরের সমৃদ্ধ পাঠাগার ও লাখ লাখ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি। আহলে হাদীস ও বেরলভী ঘরানার এক শ্রেণীর সম্মানিত আলিম ও ওয়ায়েজিন কেরাম ‘দেওবন্দী’ ও ‘তাবলীগ জামায়াতকে গোমরাহ ও বিভ্রান্তরূপে চিহ্নিত করে রীতিমতো গ্রন্থ রচনা ও প্রচারণা চালিয়ে আসছেন বহুদিন ধরে। ইন্টারনেট ও ইউটিউবে তাঁদের সরব উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। আবার এর বিপরীত চিত্রও বেশি সুখকর নয়। এভাবেই তৈরি হয়ে গেছে বিভেদ ও বিরোধের কঠিন প্রাচীর।’ (প্রসঙ্গ ডা. জাকির নায়েক, দারুল উলুম দেওবন্দের সম্মানিত মুফতিদের মূল্যায়ন, পৃ. ৫)

প্রিয় শিক্ষার্থী, আল্লামা মুফতি তকী উসমানী (হাফি.)-এর সাথে ইসলামি ব্যাংকিংসহ নানা বিষয়ে কিছু কিছু ওলামায়ে কেরামের ইখতিলাফ রয়েছে। কিন্তু মতের অমিলের কারণে তাঁকে তাকফীর করা, কাফের ফতওয়া দেওয়ার এমন দুঃসাহস যারা দেখায়, তাদেরকে অনেকেই নব্য খারেজির অর্ন্তভুক্ত মনে করে। কারণ খারেজিরা তো হযরত আলী (রযি.)-এর মতো খলীফা সাহাবীকেও তাকফীর করেছিলো। খারেজিরা হযরত আলী (রযি.) ও হযরত মুআবিয়া (রযি.)-এর চুক্তিতে لا حكم إلا الله অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম মানি না বলে স্লোগান তুলেছিল। আর তারা বলেছিল যে, হযরত আলী (রযি.) হযরত আবু মুসা আশআরী (রযি.)-কে সালিশ মেনে কুফরি করেছেন, (নাউযুবিল্লাহ)।

অতএব আমাদেরকে আরও সতর্ক হতে হবে। মুরব্বিদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে সজাগ থাকতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং আল্লামা মুফতি তকী উসমানী (হাফি.)-সহ আমাদের সকল আকাবির-আসলাফকে সকল ষড়যন্ত্র থেকে মুক্ত রাখুন এবং এ সকল মুরব্বিদের ছায়াকে দীর্ঘ করুন, আমীন।

 

ইসলামী ব্যাংকের শরীআহ কমিটির নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন জামিয়ার মহাপরিচালক আল্লামা ওবায়দুল্লাহ

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের শরীয়া সুপারভাইজরি কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন চট্টগ্রামের পটিয়া আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া মাদরাসার মহাপরিচালক মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযা। বর্তমানে তিনি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের শরীয়া সুপারভাইজরি কমিটির চেয়ারম্যান এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ও এনআরবিসি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের শরীয়া সুপারভাইজরি কমিটির সদস্য এবং সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্টের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ১৯৯২ সালে দাওরায়ে হাদীসে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন এবং পরবর্তীতে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। কওমি মাদরাসার জন্য সরকার অনুমোদিত সুপ্রিম কাউন্সিল আল-হাইতুল উলিয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া, বাংলাদেশের সদস্য।

তিনি সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা ও বিমান মন্ত্রণালয়ের অধীনে শিক্ষক ও অনুবাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া থেকে প্রকাশিত আরবি ও ইংরেজি ম্যাগাজিন বালাগ আশ-শরক পত্রিকার প্রধান সম্পাদক এবং বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন মাসিক পত্রিকা আত-তাওহীদ-এরও প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। চট্টগ্রামের হালিশহর কে-ব্লক কেন্দ্রীয় মসজিদের খতীব ওবায়দুল্লাহ হামযা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে তাঁর অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

তিনি সৌদি সরকার ও মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগের আমন্ত্রণে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ করেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। এছাড়াও বিভিন্ন সংস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে দক্ষিণ আফ্রিকা, সৌদি আরব, লেবানন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান ও তুরস্ক সফর করেন। আরবি, ইংরেজি, উর্দু ও ফারসিসহ কয়েকটি ভাষায় তিনি পাণ্ডিত্য অর্জন করেন।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ