ইসলামি ব্যাংকের শরীয়া কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নিয়োগ প্রসঙ্গে
ইসলামি ব্যাংক বোর্ড অব ডিরেক্টরস কর্তৃক পটিয়া আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়ার মহাপরিচালক জনাব মাওলানা ওবায়দু্ল্লাহ হামযা (হাফি.)-কে শরীয়া কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নিয়োগকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। পুরোনো কথা নতুন করে চর্চিত হচ্ছে। জনাব মাওলানা ওবায়দু্ল্লাহ হামযা (হাফি.)-এর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর। তিনি প্রাজ্ঞ, সাহিবে ইলম ও সাহিবে কামাল। ১৩ বছর তিনি ইসলামি অর্থনীতির ওপর শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেন। দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাতের ভূমিকা বিষয়ে রয়েছে তাঁর স্পেশালাইজেশন।
নেটিজেনদের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন দাওরায়ে হাদীস পাশ করে ব্যাংকিং ও ফিন্যান্স বুঝবেন কী করে? তাঁদের হয়ত জানা নেই বাংলা, ইংরেজি, সমাজতত্ত্ব, দর্শন, ইসলামের ইতিহাস, সাধারণ ইতিহাস, ইসলামিক স্টাডিজ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, পাবলিক এড ও সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বিশেষ করে অফিসার, ম্যানেজার, ভিপি, এভিপি, ডিএমডি, এমডি হিসেবে দক্ষতার সাথে ব্যাংকিং, ইন্স্যুরেন্স ও আর্থিক খাত পরিচালনা করে আসছেন। এটা মূলত মেধা, আইকিউ ও ডেডিকেশনের ওপর নির্ভর করে।
ইসলামি ব্যাংক একটি বিশেষ ইসলামি দলের কর্মীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত, লালিত ও বর্ধিত হলেও সময়ে সময়ে অন্য ঘরানার স্কলারদেরকেও শরীয়া কাউন্সিলের সদস্য বা চেয়ারম্যান নিযুক্ত করার নজির আছে। বর্তমানে নতুন বোর্ড অব ডিরেক্টরস তাদের আস্থাভাজন ও পছন্দের মানুষদের নিয়োগ করবেন এটা স্বাভাবিক। আগামীতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও পরিবেশের যদি পরিবর্তন ঘটে হয়তো আমরা নতুন নতুন মুখ দেখবো। এটা ইতিহাসের গতি প্রকৃতি।
এসব নিয়োগ চুক্তিভিত্তিক। সাধারণত দুবছরের জন্য হয়ে থাকে। বোর্ড অব ডিরেক্টরস নিয়োগকৃত ব্যক্তির ভালো পারফর্মেন্স সাপেক্ষে ইচ্ছে করলে নবায়ন করতে পারেন। নবায়ন করে করে কেউ কেউ ২০/২৫ বছর ছিলেন এমন দৃষ্টান্ত আছে। তবে এক পদে সারাজীবন কেউ থাকেন না।
একথা সত্য বর্তমান পরিস্থিতিতে শতভাগ ইসলামি ব্যাংকিং সম্ভব নয়। কারণ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ব্যাংক, যা সুদনির্ভর। রাষ্ট্রব্যবস্থাও ইসলামি নয়৷ তবে বিজ্ঞ মুফতি ও ইসলামি স্কলাররা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন কীভাবে ব্যাংকিং লেনদেন, বিনিয়োগ ও লভ্যাংশকে সুদমুক্ত করা যায়। কারণ ব্যাংক ছাড়া বিনিয়োগ, শিল্পায়ন, ফরেন রেমিট্যান্স, আমদানি ও রপ্তানি অসম্ভব। অধিকন্তু ইসলামি ব্যাংক একটি সন্দেহজনক তহবিল পৃথক করে রাখে যেখান থেকে গ্রাহকদের লভ্যাংশ দেয় না।
ইসলামি ব্যাংকের শরীয়া কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসেবে বায়তুশ শরফের পীর সাহেব হযরত মাওলানা শাহ আবদুল জাব্বার (রহ.), বায়তুল মুকাররমের খতীব হযরত মাওলানা ওবায়দুল হক (রহ.), হযরত মাওলানা কামালউদ্দীন জাফরী (হাফি), বাহারুল উলুম হযরত মাওলানা কুতুবউদ্দীন (রহ.) ব্যাংকিং সেক্টরকে ইসলামিকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
খতীব হযরত মাওলানা উবায়দুল হক (রহ.) বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকের শরীয়া কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আনজাম দেন। এছাড়া তিনি ছিলেন ইসলামি ব্যাংকসমূহের সেন্ট্রাল শরীয়া কাউন্সিলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। বিশেষ করে সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড, শাহ জালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডসহহ বিভিন্ন ইসলামি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের শরীয়া কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসেবে যাকাতের সামাজিকায়ন ও সুদবিহীন অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
এছাড়া ফকিহুল মিল্লাত হযরত মুফতি আবদুর রহমান (রহ.) আল-আরাফাহ ব্যাংকে, হযরত মাওলানা আবদুল হালীম বোখারী (রহ.) শাহজালাল ব্যাংকে, মুফতি সাঈদ আহমদ মুজাদ্দেদী (হাফি.) আল-আরাফাহ ব্যাংকে ও জনাব মাওলানা মুফতি শাহেদ রহমানী (হাফি.) শাহজালাল ব্যাংকের শরীয়া কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শায়খুল ইসলাম মুফতি তকি উসমানী (হাফি.) পাকিস্তান, আরবদেশ ও ইউরোপের ১২টি ব্যাংকের শরীয়া অ্যাডভাইজরি বোর্ডের চেয়ারম্যান। যার কারণে ২০১৪ সালে ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক পুরস্কার লাভ করেন তিনি। তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শরিয়া বোর্ডের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মিজান ব্যাংকের অন্যতম উদ্যোক্তাও তিনি।
ব্যাংকের কার্যক্রমকে ইসলামিকরণে কোনো বিজ্ঞ মুফতি ও বিশেষজ্ঞের কোনো যৌক্তিক ফিকহি মতামত থাকলে তা ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে জানালে তাঁরা নিশ্চয় বিবেচনায় নেবেন। ভিন্নমত থাকতে পারে, থাকতে পারে ফিকহি ইখতিলাফও। আমাদের কথা, পোস্ট ও মন্তব্য যেন শালীনতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সীমা অতিক্রম না করে। আলোচনা অ্যাকাডেমিক হওয়া একান্ত কাম্য।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন