জামেয়া ওয়েবসাইট

সোমবার-৯ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-১৪ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মুহাম্মদ মারমাডিউক উইলিয়াম পিকথাল: ইউরোশিয়ার আলোকসেতু

মুহাম্মদ মারমাডিউক উইলিয়াম পিকথাল: ইউরোশিয়ার আলোকসেতু

খন্দকার মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ

লেখক: আলিমপ্রাবন্ধিক

মুহাম্মদ মারমাডিউক উইলিয়াম পিকথাল। ব্রিটিশ নাগরিক। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এ ব্যক্তিত্ব কুরআন মজীদের অনুবাদক, ইসলাম-বিষয়ক চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, গবেষক, সাংবাদিক, দাঈ ও সুবক্তা। যেসব মনীষা পৃথিবীতে বহু শতক পর জন্ম নেন এবং শতশত বছরজুড়েধরনীর বুকে নিজের প্রভাবচিহ্ন রেখে যানতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। অসাধারণসব যোগ্যতায় সমৃদ্ধ এক বিস্ময়-মানব মারমাডিউক। তাঁর প্রতি মহান আল্লাহর সবচেয়ে অনুগ্রহ ছিলো ঘোর অন্ধকারে জন্ম নিয়েও একটি পরিচ্ছন্ন হৃদয়ের কল্যাণে ইসলামের আলোকোদ্ভাসিত সিরাতুল মুস্তাকিমের মহাসড়কে উঠে আসতে পেরেছেন। অন্যান্য রচনা ছাড়াও তিনি ইংরেজি ভাষায় কুরআন মজীদের এক অনবদ্য তরজমার কাজ সম্পন্ন করেছেন যা পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত ইংরেজি ভাষাভাষী আগ্রহী পাঠকদের জন্য অমূল্য উপহার হিসেবে গাইডলাইন হয়ে থাকবে। তাছাড়া স্বয়ং পিকথালের জন্যও একটি অসামান্য এক সাদাকায়ে জারিয়া হয়ে আছে।

বাল্যকাল ও স্কুলজীবন

ব্রিটেনের সাফুক শহরের কাছে ১৮৭৫ সালের এক স্নিগ্ধ-সুন্দর ভোরের আলোয় চোখ মেলেছিলেন মারডিউক উইলিয়াম পিকথাল। তার পিতা চার্লস গ্রে পিকথাল ছিলেন নিকটস্থ একটি গির্জার পাদরি। তার মায়ের নাম মেরি। তিনি সর্দার এলজার্ডি এইচ ও ব্রায়ানের কন্যা। চার্লসের প্রথম স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান ছিলো দশজন। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি মেরির সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার এই এ স্ত্রীর গর্ভে জন্ম হয় মারমাডিউকের। উইলিয়াম মারমাডিউকের শৈশব-কৈশোরের ছয় বছর অতিক্রান্ত হয় গ্রামের নির্মল পরিবেশে স্থানীয় বিদ্যালয়ে। পিতার মৃত্যুর পর তিনি গ্রাম ছেড়ে লন্ডন শহরে এসে কিংস্টোন নামের এলাকায় বাড়ি নিয়ে বসবাস শুরু করেন। এখানে তাকে একটি স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। এখানকার বিদ্যালয়ে শুরু থেকেই তিনি মেধার সাক্ষর রাখেন। বিশেষত, গণিত বিষয়ে বেশ পারঙ্গমতা দেখাতে সক্ষম হন। কিছুদিন পর তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ডাক্তার তাকে এক বছরের বিশ্রামের যাওয়ার নির্দেশনা দেন।

আবারও বিদ্যালয়ে

পরিপূর্ণ সুস্থ হওয়ার পর তাকে একটি বিখ্যাত পাবলিক স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। সেখানে তিনি ভূগোল ও ভাষা বিষয়ে সকলকে ছাড়িয়ে মেধা তালিকার শীর্ষে উঠে আসেন। ছাত্রজীবনে তার সঙ্গে উইস্টন চার্চিলের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে এই চার্চিল ব্রিটেনের রাজনীতিতে বিখ্যাত ব্যক্তিতে পরিণত হন। এই স্কুলে অধ্যয়নকালেই মারমাডিউকের মাঝে লেখালেখির আগ্রহ তৈরি হয়: যা অনাগত দিনের বড় এ সাহিত্যিক সম্ভবত তার নানা ওব্রায়ান থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছিলেন। যিনি নিজের নৌযুদ্ধের বীরত্বগাঁথা ও নেপোলিয়ানের যুদ্ধে বন্দি হওয়ার পর নিজেকে মুক্ত করার চাঞ্চল্যকর বর্ণনা লিখেছেন দুইখণ্ডে।

পড়ালেখার মাধ্যমিক স্তর সম্পন্ন করে তিনি ফ্রান্সে চলে যান। সেখানে ফরাসি শিখে নেন এবং ইটালির ফ্লোরেন্স শহর থেকে রপ্ত করে ইটালি ভাষাও। পরে জার্মান ফিরে এসে হিস্পানিস ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। একইসঙ্গে সাহিত্য ও ইতিহাসে তার অনুরাগ ছিলো গভীর। ফলে প্রাচ্যের জীবনধারা, সামাজিক ঐতিহ্য ইত্যাদির সঙ্গে ব্যাপকভাবে পরিচিত এবং এর দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন।

কর্মজীবন

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করার পর মারমাডিউক ঊনিশ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম স্থান অধিকার করার পরও অজ্ঞাত কারণে তাকে সেই চাকুরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এতে তিনি খুবই ক্ষুব্ধ ও মনক্ষুণ্ন হন। সে সময়ের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেন,

‘আমি খুবই হতাশ ছিলাম। মাসের পর মাস আমার প্রত্যাশা যেন লন্ডনের রাস্তায় পিষ্ট হচ্ছিল। নিঃসঙ্গতা, দুশ্চিন্তা আর জরাজীর্ণ সভ্যতার এই উত্তপ্ত নগরীর রুদ্ধশ্বাস পরিবেশ থেকে মুক্তির জন্য হাঁসফাঁস করছিলাম। এই জনপদ ছেড়ে বহুদূরে প্রাচ্যের রৌদ্রোজ্জ্বল মরুপ্রান্তর, সারি সারি উটের কাফেলা আর খর্জুরবিথীকার ছায়াশীতল মায়াকুঞ্জ যেন আমাকে হাতছানি ডাকছিলো। যেন এক অপেক্ষমান জান্নাত যা আমি হারাতে বসেছি নিজের অলসতায়। আমার মন-মস্তিষ্ক এক নিদারুণ অস্থিরতায় তড়পাচ্ছিল এবং প্রাচ্যের সফরকে আমার প্রতিশেধক হিসেবে স্থির করলেন আমার মা। ফলে আমার দুর্বার আকাঙ্ক্ষার নেপথ্যে এক অপার্থিব উদ্দীপনা সক্রিয় ছিলো এবং আমর মায়ের সহানুভুতিও ছিলো পুরোমাত্রায়।’ যদিও তার ঘনিষ্টজনদের দিক থেকে প্রস্তাব ছিলো অক্সফোর্ডে ভর্তি হওয়ার। কিন্তু প্রাচ্য চষে বেড়ানোর দুনির্বার প্রত্যয়ের কারণে ডুলাংক নামের এক বন্ধুর সঙ্গে তিনি পৌঁছে গেলেন মিসর।

মিসরে গিয়েই মারমাডিউক সেখানকার কৃষ্টিকালচার অধ্যয়ন শুরু করেন। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করে চলে গেলেন সিরিয়া এবং সেখানে মিলিত হনহিনওয়ার নামের এক পাদরির সঙ্গে; যিনি প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে অধ্যয়ন করছিলেন। তিনি পাদরির সঙ্গে বেশ খাতির জমানোর পাশাপাশি তার কাছ থেকে আরবি ভাষাও শেখা শুরু করেন। কিছুদিন পর একজন গাইড যোগাড় করে রওনা পৌঁছে যান রামাল্লা ও গাজা উপত্যকায়। সেখানে তিনি তুর্কি ভাষার জ্ঞান রাখেন এমন একজন আরব মুখপাত্র ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ লাভ করেন। সেই গল্পটা শুনতে পারি মারডিউকের ভাষ্যে: ‘আমি প্রায় প্রতিদিন ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে বেরিয়ে পড়তাম। গাজা, লুদ প্রভৃতি অঞ্চলে কৃষকদের আশেপাশে ঘোরাঘুরির পর গাজার কপি হাউজে বসে সময় কাটছিলো। যেখানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুবাদে বিশেষ কষ্ট ছাড়াই তার আরবি ভাষা আয়ত্ব হয়ে যায়। অধিকাংশ তুর্কি স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে ব্যাপকভাবে মেলামেশা এমনকি তাদের বাড়িতে স্থানীয় খাওয়া-দাওয়া গ্রহণ থেকে শুরু করে তাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রায় সকল কিছুতে একাত্ম হয়ে গিয়েছে। তিনি বলেন, বিচিত্র ব্যাপার হলো, এ জীবনটি আমার কাছে খুবই প্রশান্তিদায়ক আর সুখকর মনে হতে লাগলো। ইউরোপে বসবাসকারী একজন প্রত্যক্ষদর্শী আমি সেখানকার কাউকে এই আরবদের মতো নিশ্চিন্ত, ফুরফুরে আর প্রশান্ত জীবনযাপন করতে দেখিনি। তাদের জীবনধারা খুবই সাদামাটা এবং প্রকৃতির কোলে বেশ শান্তি-সুখের জীবন। অথচ অধিকাংশ আরব জনপদ পশ্চিমের উপনিবেশ ছিলো। পশ্চিমারা তাদেরকে অত্যন্ত নিকৃষ্ট পন্থায় শাসন করেছে দীর্ঘকাল। এখানে ইউরোপিয়ানদের রাজত্ব করতে দেখে তাদের ধারণা হয়েছে মানুষ মানুষের কত জঘন্য শত্রু হতে পারে! প্রকৃতপক্ষে ওরা কেবল নিজেদের স্বার্থে এই নিরীহ মানুষগুলোকে ইচ্ছেমতো শোষণ করে গেছে।’

তাদের পরবর্তী প্রজন্মের ওপর এর প্রভাব-প্রতিক্রিয়া বিষয়ে মারমাডিউক তার ওরিয়েন্টাল এনকাউন্টার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এ সময় থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত পুরোসময় তার চিন্তাজুড়ে ছিলো কেবলই প্রাচ্যের জীবনধারা ও সংস্কৃতি। এ সময় তিনি রচনা করেন তার বিখ্যাত উপন্যাস, একজন মাছ শিকারীসাঈদ। যা ইউরোপের সকল প্রকাশক ছাপাতে অস্বীকৃতি জানায় তবে সিসার্জ মিউথন বইটি প্রকাশ করে এবং পরপর উপন্যাসটির চৌদ্দটি সংস্করণ শেষ হয়ে যায়। পরবর্তীসময়ে ফরাসি, জার্মানসহ ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় তা অনূদিত হয়।

আবারও ব্রিটেনে ফেরা

মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণের পর মারডিউক ব্রিটেনেফিরে আসেন। কিছুদিন লন্ডন, সফুক ও সুইজারল্যান্ড বসবাস করেন। এ-সময়টাতে পড়াশোনা আর অধ্যয়নই ছিলো তার প্রিয় ব্যস্ততা। তবে অন্যদিকে সমানে বাড়ছিলো তার মনের অস্থিরতা। বস্তুত, ইউরোপের পরিবেশ তাকে প্রকৃত স্বস্তি আর প্রশান্তি দিতে বরাবরই অপারগ ছিলো। এমন সময়ে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত লর্ড ক্রোমার তাকে মিসরে ডেকে পাঠান মিসরীয়দের কাছ থেকে মনস্তাত্তি¦ক নির্দেশনা গ্রহণের জন্য। সময়টা ছিলো মিসরে ব্যাপক অস্থিতিশীলতার যদিও ব্রিটিশ সাম্রাজের ছিলো পূর্ণ যৌবন আর উত্থানকাল। মিসরীয়রা ব্রিটিশদের ক্ষুব্ধতার পরিণতি বিবেচনায় না নিয়ে বিদ্রোহ-বিক্ষোভে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

মারডিউক মিসর পৌঁছালেন ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে। তিনি মিসরে আসার পর অনেকে তাকে সরকারের চর ভাবতে শুরু করে; যদিও এটি একেবারে অবাস্তব ছিলো। প্রকৃতপক্ষে তাদের সঙ্গে তার দূরতম সম্পর্কও ছিলো না। তবে তারপর তিনি এক প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা হিসেবে নিজে ভালো-মন্দ অনেককিছু সহ্য করেছেন। মিসরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলো তিনি পরিদর্শন করার মধ্য দিয়ে মিসরীয় সমাজের বিভিন্ন নতুন দিক তার সামনে উন্মোচিত হয়। পরে নিজের পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার আলোকে দি চিলড্রেন অব দি নিল (নীল দরিয়ার শিশু) দি ওয়েল্ড ডোমেন (নিকাব পরিহিতা মেয়ে) পরে পিকথাল সস্ত্রীক বৈরুত চলে যান এবং সেখান থেকে সিরিয়া। পরবর্তীসময়ে দীর্ঘসময় বায়তুল মুকাদ্দাসে অতিবাহিত করেন মারমাডিউক। সেখানে তিনি পুরোপুরি আরবি ভাষা আয়ত্ব করে ইসলামের বিভিন্ন শাস্ত্রে গভীর অধ্যয়নে প্রবৃত্ত হন। অন্যদিকে সাক্ষাৎ করেন সমকালের শীর্ষআলেম ও ধর্মীয় স্কলারদের সঙ্গে। এ সময় তিনি ইসলামের প্রতি এতই মুগ্ধ হন যে, শায়খুল জামিয়ার (ভাইস চ্যান্সেলর) কাছে আরবি পড়ার এক পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেন। তার শিক্ষাগুরু বয়োবৃদ্ধ এবং বিস্তর অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ ছিলেন; ফলে মারডিউকের এই আগ্রহ যেন একজন তরুণের স্রেফ আবেগপ্রসূত পদক্ষেপে পরিণত না হয় সেই চিন্তা থেকে বললেন, ইসলাম গ্রহণের আগে যেন তার মাতা-পিতার সঙ্গে পরামর্শ করে আসেন এবং আরও ভালোভাবে চিন্তা-ভাবনা করেন। পিকথাল বলেন, ‘আমার শিক্ষকের এমন পরামর্শ আমার মনে বিস্ময়কর প্রভাব ফেলে। কারণ আমি ভেবেছিলাম ইসলাম অন্যান্য ইউরোপীয়দের মতো করে ভাবছিলাম যে মুসলমানরা অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষকে ইসলাম গ্রহণে জবরদস্তি করে। কিন্তু তার এমন কথা আমার ধারণাকে সম্পূর্ণ বদলে দিলো। আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম যে, মুসলমানরা অত্যন্ত উদার এবং বাস্তববাদী। তাদের বিরুদ্ধে হঠকারিতার অভিযোগ সর্বেব ভিত্তিহীন।’

পিকথালের চোখে ইউরোপ, ক্রুসেড ও মুসলমান

তখনকার কথা, যখন উসমানি খেলাফতে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা শুরু হয়েছিলো এবং সম্মিলিত ইউরোপীয় শক্তি উসমানি সাম্রাজ্যকে গুড়িয়ে দেবার অভিলাষে ছিলো অগ্রসরমান। ত্রিপোলিও বলকানের যুদ্ধে খানিকটা উসমানি সাম্রাজ্যে ভাঙন শুরুও হয়েছিলো। পিকথালের মনে প্রবল ধারণা জন্মায় যে, কেবল ইসলামবিদ্বেষের কারণেই ইউরোপীয় শক্তি উসমানি খেলাফতকে টুকরো টুকরো করতে চায়। ১৯১২ সালে তিনি মধ্যপ্রাচ্য থেকেব্রিটেন ফিরে গিয়ে অ্যাংলো-উসমানিয়া সোসাইটি গঠন করেন। এই সোসাইটির উদ্দেশ্য ছিলো তুর্কি খেলাফতের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ির প্রতিরোধ গড়ে তোলা। তবে কঠিন হঠকারিতা, প্রতিকূলতা ও প্রচণ্ড বৈরী পরিবেশে এ আন্দোলন সফল হতে পারেনি। সীমাহীন মানসিক অত্যাচারের ফলে পিকথাল রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। পিকথাল এ বিষয়ে লিখেছেন: ‘১৯১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি কয়েক মাসের জন্য তুরস্কে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। যাতে যে অবস্থা ও আবহের কারণে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি তা থেকে মুক্তি লাভ করি। বিশ শতকের এই দিনগুলিতে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ও সাধারণ নাগরিকেরা তুর্কিদের বিরুদ্ধে কতিপয় বলকান শাসকদের সমর্থনে তাদের ক্রুসেডীয় স্লোগানউচ্চকিত করছিলো।

আমার ধারণামতে ইউরোপীয় শাসকগোষ্ঠী এই হিংসাত্মক লড়াইয়ের উন্মাদনায় নিজেদের স্বার্থে নয় বরং তাদের রুশ মিত্রদের স্বার্থে হাওয়া দিচ্ছিলো। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডীয় এই বৃহৎ ঐক্যে অনেক খ্রিস্টান একাত্ম হলেও সেসব খ্রিস্টধর্মাবলম্বী মানুষদের পীড়িত এবং বেদনাহত করেছে যারা প্রাচ্যকে ভালোবাসতো। সেসময় আমার মনে হতো খ্রিস্টবাদ যেন দুইভাগে বিভক্ত। এক শ্রেণির খ্রিস্টান হলো যাদের সদাচার আর জনহিতৈষণা কেবল খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ আর দ্বিতীয় শ্রেণি হলো যারা দাবি করেন তাদের মানবিকতা ও কল্যাণের বেলায় ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠীর ভেদ-বৈষম্য মানে না। কিন্তু রুশ, ব্রিটেন ও বলকানের শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে প্রথমোক্ত শ্রেণির খ্রিস্টানদের প্রভাব ছিলো অনেক বলিষ্ঠ।

তাদের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা, হঠকারিতা ও সংকীর্ণতা এতো চরম মাত্রার ছিলো যে, একই অবস্থা যদি আমরা স্বল্পশিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে দেখতাম তবে সেই ধর্মকে তুলোধুনা করতে পিছপা হতাম না। কিন্তু আমরা প্রাচ্যের দেশগুলোতে দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত লোকদের চেতনা বাস্তবায়িত হতে দেখেছি। মানবিকতা ও ঔদার্য মানুষকে নতুন জীবনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। আমি যদি দ্বিতীয় প্রকারের খ্রিস্টানদের প্রত্যাখ্যান করে প্রথম প্রকারের খ্রিস্টানদের আচরণের দিকে ঝুঁকে পড়তাম তাহলে প্রাচ্যের যেসব লোক আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করে তারাআমাদের নীচু ও হীনচিন্তার বলে অভিযোগ করতো।

আমি ভাবলাম, ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষাকারী দেশ তুরস্ক প্রাচ্যে উন্নয়ন-অগ্রগতির আন্দোলনগুলোতে নেতৃত্বস্থানীয়। তুর্কি ইউরোপকে বোঝা এবং মানুষের সামনে যথাযথভাবে উপস্থাপনে সক্ষম। কাজেই আমি তুর্কিদের অবস্থা ও পরিবেশ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য তুরস্কে রওনা হই।’

মারডিউকের ইসলাম গ্রহণ

পিকথাল আগে থেকেই তুর্কি জাতি দ্বারা প্রভাবিত ছিলো। তবে টানা কয়েকমাস নিবিড় অভিনিবেশে সেখানে সময়যাপনের সুযোগ ঘটেছে তার। এর ফলে তুর্কিদের সামাজিক সাংস্কৃতিক সৌন্দর্য তাকে খুবই প্রভাবিত করে। তিনি গাজী তালআত বে-সহ কতিপয় তুর্কি সরদার সম্পর্কে বলেন, ‘একবার তুর্কি সরদার তালআতকে বললাম, আপনি সাধারণত নিরস্ত্র অবস্থায় থাকেন। আপনার তো একজন সশস্ত্র দেহরক্ষী সঙ্গে রাখা দরকার! জবাবে তিনি বললেন, আল্লাহর চেয়ে বড় কোনো রক্ষাকারী নেই। এ বিষয়ে আমার পূর্ণ ভরসা আছে। আর মৃত্যুর সময়ক্ষণ নির্ধারিত আছে। ইসলাম এটাই শিক্ষা দেয়।’ পিকথাল গাজী আনওয়ার পাশা, শওকত পাশাসহ অন্যান্য তুর্কি সরদারের কথা অত্যন্ত ইতিবাচক ও সমীহবোধের সঙ্গে বর্ণনা করে থাকেন। তার মন্তব্য হলো, লোকেরা অযথাই তুর্কিদেরকে মুক্তমনা ও ধর্মহীনতার অপবাদ দেয়; আমি তো তাদেরকে সাচ্চা মুসলমান হিসেবেই পেয়েছি। গাজী তালআতকে মারমাডিউক পিকথাল ইসলাম গ্রহণের ইচ্ছের কথা জানালে তিনি বলেন, আপনি এটা ইস্তাম্বুলে নয়; ভালো হবে লন্ডনে গিয়ে ঘোষণা করলে। ইউরোপে এই ঘোষণার ফলে ইসলামের প্রচার-প্রভাব হবে বড়সড়।

১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে পিকথাল লন্ডন গিয়ে নিজের ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। এর প্রতিক্রিয়ায় সেখানকার শিক্ষিত ও রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। খ্রিস্টানবিশ্বের সাধারণ মন্তব্য ছিলো, ‘পিকথালের মতো ব্যক্তি যে ধর্ম গ্রহণ করবেন সেটা নিঃসন্দেহে অনেক ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের ধারক হবে।’

বিশ্বযুদ্ধকালে পিকথাল লন্ডনে ইসলামের দাওয়াহ-তাবলিগের দায়িত্ব আঞ্জাম দিচ্ছিলেন। পাশাপাশি জুমার খুতবা, নিয়মিত পাঁচওয়াক্ত এবং বিভিন্ন সময়ে ঈদের নামাজ ও তারাবির ইমামতি আরইসলামিক রিভিউ গ্রন্থের সম্পাদনা করেন। তুর্কি বিষয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাড়াও তারটেইল ফ্রম ফাইভ চিমনিজ (Tales form five Chimneys: 1915) তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে। দি হাউস অব ওয়ার: ১৯১৬ ও নাইটস অব আরাবি: ১৯১৭ বইগুলো প্রকাশিত হয়েছে।

১৯২০ সালে তিনি ওমর সাজানির আমন্ত্রণে পিকথাল মুম্বাই চলে আসেন এবং সেখানকার মর্যাদাশীল পত্রিকা মুম্বাই ক্রনিকল-এর সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯২৫ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বহু সম্পাদকীয় নিবন্ধে খেলাফতে উসমানিয়া ধ্বংসে খ্রিস্টানদের ভূমিকা প্রসঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছেন। বিশ্লেষণ করেছেন, মুসলিম দুনিয়ার বিরুদ্ধে তাদের চক্রান্তের মাত্রা ও তীব্রতা প্রসঙ্গে।

…১৯২৭ পিকথাল বিভিন্ন মাদ্রাজে নানান বিষয়ে লেকচার দিয়েছেন। সেসক লেকচারে ইসলামি সংস্কৃতির নানা দিক সম্বন্ধে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আছে। যা পরে কালচারাল সাইড অব ইসলাম নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।

চিন্তাবিদ ও স্কলার মুহাম্মদ মারমাডিইক ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের এক সকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ ইন্তেকাল করেন। ১৮ মে রাতে ঘুমানোর আগে একটি কাগজে তিনি এই আয়াতটি লিখে রেখেছিলেন, ‘সত্য হলো, যে নিজেকে আল্লাহর আনুগত্যের কাছে সঁপে দেয় এবং কার্যক্ষেত্রে সদাচারের পথ অবলম্বন করে; তার জন্য আল্লাহর কাছে এর যথাযথ পুরস্কার রয়েছে। এমন লোকের জন্য দুশ্চিন্তা ও ভয়ের অবকাশ নেই (আল-কুরআন, ২:১১২)।’

পিকথাল ইউরোপীয় হওয়ার পরও পরিপূর্ণ ইসলামি আদর্শে আলোকিত ছিলেন। ইবাদত-বন্দেগির ব্যাপারে ছিলেন খুবই যত্নবান ও নিয়মানুবর্তী। তার মুখে আল্লাহ ও রাসুলের আলোচনাই থাকতো সদা-সর্বদা। দৃপ্ত ঈমান আর অসাধারণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী মুহাম্মদ মারমাডিউক পিকথাল হায়দারাবাদে থাকাকালে অস্বচ্ছল পরিবারের অনেক শিক্ষার্থীকের প্রাণখুলে আর্থিক সহযোগিতা করতেন। অনেক উত্তরাধিকাসূত্রে মুসলমানের বেলায় ইসলামের বড় খেদমত সম্পাদনের সুযোগ অনেকসময় ঘটে না কিন্তু আল্লাহর কুদরতের কারিশমা মারডিইক পিকথাল জন্মসূত্রে অমুসলিম হয়েও ইসলামের ছায়াতলে এসে ব্যাপক ও বিরল অবদান রেখেছেন যা ইসলামের ইতিহাসে চিরকাল সংরক্ষিত থাকবে।

উপাত্ত সংগ্রহ: তুরাকিনা কাজীর প্রবন্ধ অবলম্বনে

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ