জামেয়া ওয়েবসাইট

মঙ্গলবার-১লা জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-৫ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২০শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মক্তব: ঐতিহ্যের বুনিয়াদি পাঠশালা

মক্তব: ঐতিহ্যের বুনিয়াদি পাঠশালা

 হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর

লেখক: খতীব, শহীদ তিতুমীর ইনস্টিটিউট জামে মসজিদ, কক্সবাজার

মাতখনো জায়নামাজে বসে আছেন। ফজরের নামাজ আদায় করে তাসবীহ পাঠ ও কুরআন তিলাওয়াতে মশগুল। ইশরাকের নামাজ পড়েই হয়ত গৃহস্থালির কাজ শুরু করবেন। ইতোমধ্যে কলিজার টুকরো সন্তানের কোমলকণ্ঠে ভেসে আসে মায়াবী এক ডাক, ‘মা মক্তবের সময় হয়ে এসেছে। কিছু খেয়ে তাড়াতাড়ি মক্তবে চলে যেতে হবে।’

এমন তাগাদায় মা যতদ্রুত সম্ভব কোমলমতি সন্তানকে মক্তবে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করে দেন। মমতাময়ীর যত্নমাখা মায়ায়, বাবার অভিভাবকত্বের শীতল ছায়ায় তারা ছুটে যায় মক্তবে। সেই মক্তবেই বপিত হয় কোমল হৃদয়ে নৈতিকতার বীজ। এটি যেন মুসলিম পরিবারের ঐতিহ্যের বুনিয়াদি পাঠশালা। মক্তবের শিক্ষার্থীদের তিলাওয়াতে কুরআনের সূর যেন প্রতিটি ভোরে ছড়িয়ে দেয় নূর।

কখনো ঘন কোয়াশা ভেদ করে শিশিরভেজা পথ দিয়ে, কখনো বৃষ্টিভেজা গ্রামীণ পথ মাড়িয়ে, কখনো সূর্যরাঙা পথ পাড়ি দিয়ে শিশু-কিশোরের দল ছুটে চলে মক্তব পানে। দিনের সূচনায় মক্তবই যেন তাদের প্রথম গন্তব্য। ভোর বিহানে কুরআন বুকে মক্তব পানে শিশুকিশোরদের ছুটে চলার সেই পবিত্রতামুখর দৃশ্য আলোকিত আগামীর ইঙ্গিত বহন করে। তাই তো বলা হয়, মক্তব আলোকিত প্রজন্ম গড়ার সূতিকাগার।

মক্তবে কুরআন তিলাওয়াতের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট শিক্ষক কচিকাঁচা ছেলে মেয়েদের নামাজ, তায়াম্মুম, ওজু ও গোসলের নিয়মসহ জীবনঘনিষ্ঠ দোয়া ও জরুরি মাসায়েলের তালিম দেন। সেই সাথে মাবাবা ও প্রতিবেশীর হক, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা, ছোটদের প্রতি স্নেহ প্রদর্শন, সামাজিক শিষ্টাচারিতা, মানবিক মূল্যবোধ, কর্তব্যপরায়ণতা, দেশাত্মবোধসহ জরুরি আদব-সভ্যতার তালিমও দেওয়া হয় মক্তবে।

সর্বোপরি ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতির আলোকধারায় আদর্শ সমাজ বিনির্মাণ ও আলোকিত প্রজন্ম গড়তে মক্তবের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আর তাই তো মক্তবের চাহিদা পূরণে আগের দিনে পাড়ামহল্লার বিভিন্ন বাড়ির আঙ্গিনায়ও মক্তবের আদলে শিক্ষা দেওয়া হতো। এলাকার অনেক নেককার শিক্ষিতা মহিলারা নিজেদের ঘরে পাড়াপড়শির আগ্রহী ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা দিতেন।

আমি নিজেও বাল্যকালে মক্তবে পড়েছি। আবার আমার সর্বকনিষ্ঠ খালা যিনি নিজ বাড়ির আমগাছ তলায় প্রত্যহ বাদ ফজর অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে কুরআনের তালিম দিতেন তার কাছেও পড়েছি। নিজেদের ঘরের বারান্দায় ছোট ফুফুর কাছ থেকেও কুরআন মজীদ শেখার স্মৃতি হৃদয়ে এখনো সজীব হয়ে আছে।

কুরআন তিলাওয়াতের মতো সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতটি এক সময় মুসলিম সমাজের প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে জারি ছিল মক্তবের অবদানেই। ফজরের নামাজ আদায় করেই মুরব্বিরা কুরআন তিলাওয়াতে মশগুল হয়ে যেতেন। কালো ফ্রেমের বড় চশমা চোখে আমার দাদীর কুরআন তিলাওয়াতের দৃশ্য আমার চোখে এখনো যেন ভাসছে।

সকাল বেলা আছেই, সন্ধ্যা বেলায়ও ঘরে-বাড়িতে মুরব্বিরা নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করতেন এবং ছেলেমেয়েদের কুরআন তিলাওয়াতে বসিয়ে দিতেন। ফলে প্রায় প্রতিটি ঘর থেকে সকাল-সাঝে কুরআন তিলাওয়াতের সুমধুর আওয়াজ ধ্বনিত হতো। পবিত্রতার সৌরভ ছড়িয়ে পড়তো ঘরে ঘরে, স্বচ্ছ নৈতিক চেতনা সঞ্চারিত হতো অন্তরে-অন্তরে। কারণ তিলাওয়াতে কুরআনের ফলে মুমিন অন্তরে সৃষ্টি হয় তাকওয়ার আবহ। শানিত হয় ঈমানি স্পৃহা। যেমনটি ইরশাদ করেছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা:

اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ اِذَا ذُكِرَ اللّٰهُ وَجِلَتْ قُلُوْبُهُمْ وَاِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ اٰيٰتُهٗ زَادَتْهُمْ اِيْمَانًا وَّعَلٰى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَۚۖ۰۰۲

‘মুমিনতো তারাই যাদের হৃদয় কম্পিত হয় যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয় এবং যখন তার আয়াত তাদের কাছে তিলাওয়াত করা হয়, তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং তারা তাদের প্রতিপালকের ওপরই নির্ভর করে।’ (সূরা আল-আনফাল: ২)

মক্তবকেন্দ্রিক কুরআন-হাদীসের আলোকে বুনিয়াদি তালিমের সুচারু ব্যবস্থা ছিলো বলেই এখনকার মতো শিশু-কিশোরদের বেলাগাম দূরন্তপনা, তরুণদের বখাটেপনা আর আচার-অনুষ্ঠানে বেহায়াপনার সয়লাব তখন ছিলো না। সমুন্নত ছিলো নৈতিক মূল্যবোধ, আদর্শিক চেতনা ও সামাজিক কর্তব্যপরায়ণতা। ছিলো বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা, ছোটদের প্রতি স্নেহ-মমতা, দেশপ্রেম ও আমানতদারিতা।

ছোটবেলার মক্তবে পাওয়া বুনিয়াদি শিক্ষা ধারণ করে বেড়ে উঠার কারণে অনেকে অনেক উচ্চ পদমর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েও দীনী অনুরাগ, নিরহঙ্কারী চালচলন, বিনয়-ভদ্রতার গুণে বিভূষিত। পরিণত বয়সে এসেও ছোটবেলার মক্তবের শিক্ষাই হয়ে উঠে নীতিনৈতিকতায় টিকে থাকার মূল বুনিয়াদ।

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কোমলমতি শিশু-কিশোরদের ভোর-বিহানে কুরআন বুকে মক্তবপানে ছুটে চলার সেই সুন্দরতম পবিত্রতামুখর দৃশ্য এখন আর আগের মতো দেখা যায় না। ভোরেই তাদের নিয়ে মা-বাবারাসুদ্ধ ছুটে যান তথাকথিত আধুনিক শিক্ষালয়ে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কোমল কণ্ঠে সম্মিলিতভাবে কুরআন তিলাওয়াত ও কালেমাসহ প্রয়োজনীয় দোয়া পাঠের সেই আওয়াজ এখন আর আগের মতো শোনা যায় না। মক্তবগুলোও এখন আগেকার সময়ের মতো প্রাণবন্ত নয়।

কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষাদান এবং ঘরে ঘরে তিলাওয়াতে কুরআনের যে ঐতিহ্য আবহমানকাল থেকে জারি ছিল সেই ঐতিহ্য এখন যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। সকাল-সন্ধ্যায় পাড়া-মহল্লার ঘরবাড়ি থেকে কুরআন তিলাওয়াতের সেই সুমধুর আওয়াজ এখন আর তেমন ভেসে আসে না। ভেসে আসে বিভিন্ন গান-বাজনার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি।

তথ্যপ্রযুক্তির নগ্ন থাবায় তথাকথিত আধুনিকতা ও অপসংস্কৃতির আগ্রাসনে কচি বয়সেই ছেলে-মেয়েরা বিভিন্ন ধরনের দেশি-বিদেশি, নৈতিকতাবিবর্জিত নাচ-গান শিখছে। শিখছে নানা ধরনের কৌতুক। এভাবে নবপ্রজন্ম নিমজ্জিত হচ্ছে অনৈতিকতার অতল গহ্বরে। ক্রমেই কুরআনের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে চলেছে সমাজ।

এমন ক্রান্তিকালে নবপ্রজন্মকে আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তুলে সমাজকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে ঐতিহ্যের বুনিয়াদি পাঠশালা মক্তবগুলোকে সজীব করে তুলতে হবে। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় গড়ে তুলতে হবে মক্তব। সুসংহত করতে হবে মক্তবের ব্যবস্থাপনাকে।

দুনিয়াবি সাময়িক চাকচিক্য ও ভোগ-বিলাস নয়; উভয় জগতের চিরশান্তি ও কল্যাণের ফল্গুধারায় অবগাহন করতে সন্তানদের কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষাধারায় আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সন্তানদের পুরো জীবনকে প্রকৃত আলোকধারায় উদ্ভাসিত করতে জীবনের সূচনাপর্বেই মক্তবের বুনিয়াদি শিক্ষার প্রতি অধিকতর যত্নবান হতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে ঘরে ঘরে তিলাওয়াতে কুরআনের পবিত্র ঐতিহ্য।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ