জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-২৪শে রজব, ১৪৪৬ হিজরি-২৬শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১২ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিচারপতির ফয়সলা: প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কার্যকর হওয়া

বিচারপতির ফয়সলা: প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কার্যকর হওয়া

মূল: শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী (রহ.)

তাসহীল ও তারতীব

শায়খুল হাদীস মুফতি সাইদ আহমদ পালনপুরী (রহ.)

মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ আমীন পালনপুরী

অনুবাদ: মুহাম্মদ আবদুল হাই নদভী

অনুবাদক: লেখক, গবেষক ও পীর সাহেব বায়তুশ শরফ, চট্টগ্রাম

প্রথমে কিছু জরুরি পরিভাষা জেনে নিতে হবে, যাতে মূল মাসআলা বুঝতে সহায়ক হয়।

 প্রত্যক্ষা ও পরোক্ষের তাৎপর্য

ظَاهِرًا (প্রত্যক্ষভাবে) ফয়সলা বাস্তবায়ন হওয়ার তাৎপর্য হচ্ছে, বিচারক তা কার্যকরীভাবে বাস্তবায়ন করবেন। উদারণত বাদীর পক্ষে ডিগ্রি হল, তো যে জিনিসের ব্যাপারে বিবাদ ও ঝগড়া আছে তা বিবাদীর কবজা থেকে বের করে বাদীর কবজায় দিয়ে দেবেন। একই সঙ্গে এ বিষয় সংশ্লিষ্ট বিধি-বিধানও বাস্তবায়ন করবেন। যেমন- কোনো পুরুষ কোনো নারীকে বিয়ের দাবি করল। আর বিচারক পুরুষের পক্ষে ফয়সলা দিলেন। তা হলে বিচারক ওই মহিলাকে পুরুষের হাতে সোপর্দ করবেন এবং স্বামীর দায়িত্বে খোরপোষ ও বাসস্থান ইত্যাদি আরোপ করবেন। যদি জায়গা-জমি বিষয়ে ঝগড়া হয় তাহলে বিচারক বিবাদ থেকে দখলমুক্ত করে বাদীকে তার দখল বুঝিয়ে দেবেন।

আর بَاطِنًا (পরোক্ষভাবে) ফয়সলা বাস্তবায়ন হওয়ার তাৎপর্য হচ্ছে, دِيَانَةً (নৈতিকভাবে) বাস্তবায়ন হওয়া। উদাহরণত উপর্যুক্ত উদাহরণে ওই মহিলার সাথে পুরুষটির জন্য সহবাস করা জায়েয হবে এবং মহিলাটির জন্য নৈতিকভাবে ওই পুরুষকে স্বীয় সত্তার ওপর অধিকার দেওয়া জায়েয হবে। যদি কোনো জায়গা-জমির ব্যাপারে বিচারক ফয়সলা করেন তাহলে বাদী এর মালিক হয়ে যাবে এবং তা বিক্রি, ইজারা দেওয়া ও দান করা ইত্যাদি কারবার বৈধ হবে।

চুক্তি ও বাতিলের সংজ্ঞা

عُقُوْدٌ শব্দটি عَقْدٌ-এর বহুবচন। ফকীহদের পরিভাষায় আকদ বলা হয়, ইজাব-কবুলের (প্রস্তাব ও গ্রহণ) মাধ্যমে কোনো কাজ সম্পাদন করা। যেমন বেচাকেনা, ইজারা দেওয়া ও বিয়ে করা ইত্যাদি।

فُسُوْخٌ শব্দটি فَسْخٌ-এর বহুবচন। ফকীহদের পরিভাষায় ফসখ বলা হয়, পুরোনো চুক্তিকে হ্রাস-বৃদ্ধি ব্যতিরেকে সমাপ্ত করা। যেমন- ইকালা (বাতিল করা) ও তালাক ইত্যাদি।

মাধ্যম ও এর প্রকারভেদ

সত্তার সাথে বিশেষত্বের সংশ্লিষ্টতা কখনো মাধ্যম ব্যতিরেকে হয় আর কখনো মাধ্যমে হয়। ‘মাধ্যম’ তিন ধরনের হয়ে থাকে। এক. وَاسِطَةٌ فِي الْإِثْبَاتِ (প্রতিপন্ন করার মাধ্যম), দুই. وَاسِطَةٌ فِي الثَّبُوْتِ (প্রমাণিত হওয়ার মাধ্যম) ও তিন. وَاسِطَةٌ فِي الْعُرُوْضِ (অস্থায়ী মাধ্যম)।

  • وَاسِطَةٌ فِي الْإِثْبَاتِ: হদ্দে আওসাতকে বলা হয়। কেননা কিয়াসে মওযু’কে মাহমুলের জন্য হদ্দে আওসাতের মাধ্যমেই প্রমাণ করা যায়। এই আলোচনায় মাধ্যমের এ প্রকারের আলাপ আসবে না।
  • وَاسِطَةٌ فِي الثَّبُوْتِ: সেই জিনিস যার মধ্যস্থতায় কোনো গুণ-বৈশিষ্ট্য কোনো সত্তার জন্য প্রমাণিত হয়। আর এটি দুই ধরনের। একটি হচ্ছে, মাধ্যম নিজে গুণ-বৈশিষ্ট্যের সাথে গুণান্বিত হবে না, শুধু গুণান্বিতের গুণ-বৈশিষ্ট্যপূর্ণতার জন্য মাধ্যম হবে। দ্বিতীয় রূপটি হচ্ছে যে, মাধ্যম নিজেও গুণ-বৈশিষ্ট্যের সাথে গুণান্বিত হবে এবং গুণান্বিতকেও গুণ-বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করবে। উদাহরণত রঙ্গক কাপড় রং করে, তখন কাপড়ই শুধু রঙের সাথে রঙিল হয়, কিন্তু রঙ্গক রঙা হয় না। আর চাবির নাড়াচড়া হাতের মাধ্যমে হয়ে থাকে এবং স্বয়ং হাতও নাড়াচড়া করে। وَاسِطَةٌ فِي الثَّبُوْتِ-এর পদ্ধতিদুইটির পৃথক পৃথক নাম রাখা হয়নি, বরং প্রথম অর্থ ও দ্বিতীয় অর্থ বলে উভয় পদ্ধতিতে পার্থক্য করা হয়।
  • وَاسِطَةٌ فِي الْعُرُوْضِ: সেই জিনিস যা প্রকৃতপক্ষে গুণ-বৈশিষ্ট্যের সাথে গুণান্বিত হয়, আর এর জন্য গুণান্বিত হওয়ার কারণ বাহ্যিকভাবে গুণ-বৈশিষ্ট্যের সাথে গুণান্বিত হয়। যেমন- রেলগাড়ির ইঞ্জিন; বগি ও ভ্রমণকারীদের প্রতিক্রিয়ার জন্য অস্থায়ী মাধ্যম। কেননা প্রকতৃপক্ষে সক্রিয় ইঞ্জিন আর বগি ও ভ্রমণকারীরা নাড়াচড়া করে অস্থায়ীভাবে।

মাসআলার সূচনা

যদি কোনো দাবিদার বিচারপতির সামনে মিথ্যা সাক্ষী পেশ করে এবং বিচারপতির বিচার-বিশ্লেষণে সেই সাক্ষী যদি সত্য বলে প্রমাণিত হয়; বিচারপতি কোনভাবেই তার মিথ্যাবাদিতা সম্পর্কে অবগত হতে না পারেন। এ কারণে বিচারপতি যদি মামলার বাদীর পক্ষে ডিগ্রি দিয়ে দেন। তা হলে প্রশ্ন হচ্ছে, বিচারপতির এ ফয়সলা কি প্রত্যক্ষভাবে কার্যকর হবে, নাকি পরোক্ষভাবেও?

عُقُوْدٌفُسُوْخٌ ছাড়া অন্যান্য সকল কারবারে সর্বসম্মতিক্রমে বিচারপতির ফয়সলা শুধু প্রত্যক্ষভাবে কার্যকর হবে। যেমন- আমলাকে মুরসালা[1]র দাবির ক্ষেত্রে। আর উকূদ ও ফুসূখে মতপার্থক্য রয়েছে।

ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মদ, ইমাম মালিক, ইমাম শাফিয়ী ও ইমাম আহমদ (ইবনে হাম্বল) s বলেন, উকূদ ও ফুসূখের ক্ষেত্রেও বিচারপতির ফয়সলা শুধু প্রত্যক্ষভাবেই কার্যকর হবে। আর ইমাম আযম আবু হানিফা w বলেন, তিনটি শর্তের সাথে এই ফয়সলা প্রত্যক্ষভাবেও কার্যকর হবে এবং পরোক্ষভাবেও। ওই শর্ততিনটি হচ্ছে,

  1. প্রথম শর্ত হচ্ছে, যে জিনিস সম্পর্কে বিচারপতি ফয়সলা দিয়েছেন সেই জিনিসে আকদ (চুক্তি সম্পাদন করা) ও ফাসখ (বাতিল করা) গ্রহণ করার সক্ষমতা থাকতে হবে। যেমন- যে মহিলা না কারও বিয়ের বন্ধনে আছে, না কারও ইদ্দতে। এমন মহিলার ব্যাপারে যদি কোনো ব্যক্তি বিয়ের মিথ্যা দাবি করে এবং মিথ্যা সাক্ষীর মাধ্যমে নিজের দাবি প্রমাণ করে আর বিচারপতি তার পক্ষে ডিগ্রি দিয়ে দেয় তাহলে এই ফয়সালা প্রত্যক্ষভাবেও কার্যকর হবে, পরোক্ষভাবে। অর্থাৎ বিচারপতি ওই মহিলাকে আদেশ দেবেন যে, সে যেন তার সত্তা এই দাবিদারকে সোপর্দ করে। আর বাদীর জন্য এই মহিলা থেকে সুযোগ গ্রহণ জায়েয আছে এবং মহিলার জন্য নৈতিকভাবে নিজের সত্তাকে সোপর্দ করাও বৈধ হবে আর পারস্পকির উপভোগ হালাল হবে। যদিও প্রকৃতপক্ষে বিয়ে হয়নি, কিন্তু বিচারপতির এই ফয়সলায় বিয়ে সংঘটিত হয়ে যাবে। সুতরাং অন্য কোনো পুরুষ এই মহিলাকে বিয়ে করতে পারবে না।

মোটকথা, পরোক্ষভাবে বিচারপতির ফয়সলা কার্যকর হওয়ার জন্য সর্বপ্রথম শর্ত হচ্ছে, প্রয়োগস্থলে আকদ ও ফাসখ গ্রহণ করার সক্ষতা থাকা। প্রয়োগস্থলে যদি আকদ ও ফসখ গ্রহণ করার সক্ষমতা না থাকে, তা সত্ত্বেও বিচারপতির ফয়সলা প্রত্যক্ষভাবে কার্যকর হবে, পরোক্ষভাবে কার্যকর হবে না। যেমন- যে মহিলা কারও বিয়ের বন্ধনে আছে কিংবা ইদ্দত পালন করছে। তার সাথে অন্য কারও বিয়ে হতে পারে না। কেননা এই মহিলার জন্য সেই অবস্থায় আকদে নিকাহ (বিয়ের চুক্তি) গ্রহণ করার সক্ষমতা নেই। অতঃপর এমন মহিলার ব্যাপারে যদি কেউ বিয়ের মিথ্যা দাবি করে এবং মিথ্যা সাক্ষীর কারণে বিচারপতি মিথ্যা দাবিদারের পক্ষে ফয়সলা করেন। তা হলে বিচারপতির এই ফয়সলা বাহ্যত কার্যকর হবে, পরোক্ষভাবে কার্যকর হবে না। অর্থাৎ বিচারপতি ওই মহিলাকে মিথ্যা দাবিদারের কাছে সোপর্দ তো করে দেবেন, কিন্তু তার জন্য এই মহিলা থেকে উপকার গ্রহণ জায়েয হবে না, না মহিলার জন্য নৈতিকভাবে নিজের সত্তাকে তার সোপর্দ করে দেওয়া জায়েয হবে এবং পারস্পরিক যে উপভোগ হবে সেই ক্রিয়াকলাপ হরাম হবে।

  1. দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, বিচারপতির পক্ষে না বাস্তবতার জ্ঞান ছিল, না সাক্ষীর মিথ্যাবাদী হওয়ার কোনো ধারণা ছিল। বিচারপতি যদি নিজ উদ্যোগে বাস্তব অবস্থা জেনে থাকেন কিংবা সাক্ষীর মিথ্যাবাদী হওয়ার কথা জেনে থাকেন। তা হলে বিচারপতির ফয়সলা শুধু প্রত্যক্ষভাবে কার্যকর হবে, পরোক্ষভাবে হবে না।
  2. তৃতীয় শর্ত হচ্ছে, বিচারপতির ফয়সলা সাক্ষ্যের ভিত্তিতে হতে হবে, মিথ্যা কসমের ভিত্তিতে হবে না। উদারণত জনৈকা মহিলা বিচারপতির নিকট দাবি করল যে, তার স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দিয়েছে আর স্বামী অস্বীকার করছে। মহিলার কাছে কোনো সাক্ষী নেই। এজন্য বিচারপতি স্বামীর নিকট থেকে কসম নিলেন, সে মিথ্যা কসম খেয়ে ফেলল এবং বিচারপতি তালাক না হওয়ার ফয়সলা দিলেন। মহিলা জানে যে, সত্যিই স্বামী তাকে তিন তালাক দিয়েছে। তা হলে বিচারপতির এই ফয়সালা পরোক্ষভাবে কার্যকর হবে না। আর মহিলার জন্য সেই স্বামীর সাথে থাকা না জায়েয হবে এবং না মহিলার জন্য সেই স্বামী থেকে মিরাসের অংশ নেওয়া জায়েয হবে। আর না স্বামীর জন্য এই মহিলার সাথে সহবাস করা জায়েয হবে।

ইমাম আবু হানিফা w-এর যে মাযহাব, ঠিক ইমাম আহমদ (ইবনে হাম্বল) w-এরও এমন একটি রেওয়ায়েত আছে। যদিও সেই বর্ণনাটি হাম্বলীদের নিকট ফতওয়াযোগ্য নয়। ইবনে কুদামা (w) লিখেছেন,

وَحَكَىٰ أَبُو الْـخَطَّابِ، عَنْ أَحْمَدَ رِوَايَةً أُخْرَىٰ، مِثْلَ مَذْهَبِ أَبِيْ حَنِيْفَةَ فِيْ أَنَّ حُكْمَ الْـحَاكِمِ يُزِيْلُ الْفُسُوْخَ وَالْعُقُوْدَ، وَالْأَوَّلُ هُوَ الْـمَذْهَبُ.

‘আবুল খাত্তাব ইমাম আহমদ (ইবনে হাম্বল) w থেকে ইমাম আবু হানিফা w-এর মাযহাবের অনুরূপ আরেকটি রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন যে, বিচারপতির ফয়সলা আকদ ও ফাসখকে পরিবর্তন করে দেয়। তবে মাযহব অর্থাৎ ফতওয়াযোগ্য বক্তব্য হচ্ছে প্রথমটি।’[2]

অনুরূপভাবে ইমাম সাহেবের যে মাযহাব প্রথম প্রথম সেটিই ইমাম আবু ইউসুফ (w)-এর বক্তব্য ছিল। হিদায়াপ্রণেতা বলেন,

وَهُوَ قَوْلُ أَبِيْ يُوْسُفَ أَوَّلًا.

‘এটি ছিল ইমাম আবু ইউসুফ (w)-এর প্রথম দিকের মত।’[3]

এভাবে অনেক ভদ্রলোক বলে থাকেন যে, ইমাম মুহাম্মদ (w)-এর মতও সেটিই যেটি ইমাম আবু হানিফা (w)-এর। কেননা ইমাম মুহাম্মদ (w) তাঁর কিতাবুল আসলে হযরত আলী y-এর সেই ফয়সলা যা সামনে আসছে তা উল্লেখ করার পর বলেছেন যে, وَبِهِ نَأْخُذُ (আর আমরা এটিই গ্রহণ করি।)[4] এতে বোঝা যায় যে, ইমাম মুহাম্মদ w ইমাম আবু হানিফা w-এর সঙ্গে। স্রেফ ইমাম আবু ইউসুফ w-এর আখেরি মত তিন ইমামের মাযহাবের অনুরূপ।

জুমহুরের নকলি দলিল

বুখারী শরীফে হযরত উম্মে সালামা i থেকে বর্ণিত আছে, নবী করীম D ইরশাদ করেছেন যে,

«إِنَّكُمْ تَخْتَصِمُوْنَ إِلَيَّ، وَلَعَلَّ بَعْضَكُمْ أَلْـحَنُ بِحُجَّتِهِ مِنْ بَعْضٍ، فَمَنْ قَضَيْتُ لَهُ بِحَقِّ أَخِيْهِ شَيْئًا بِقَوْلِهِ، فَإِنَّمَا أَقْطَعُ لَهُ قِطْعَةً مِنَ النَّارِ، فَلَا يَأْخُذْهَا».

‘তোমরা লোকজন নিজেদের বিবাদ মেটানোর জন্য আমার কাছে এসে থাক। এমন হতে পারে যে, এক পক্ষ দলিল পেশ করার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পক্ষের তুলনায় বাকপটু। কাজেই যদি আমি তার পক্ষে তার ভাইয়ের অধিকারের কোনো জিনিসের ফয়সলা দিই তার কথা সত্য মনে করে, তা হলে (সে যেন বুঝে নেয়) আমি তাকে সম্পত্তিতে জাহান্নানের একটা টুকরোই তাকে দিচ্ছি। সুতরাং সে যেন তা না নেয়।’[5]

وَفِيْ رِوَايَةٍ: «فَلَعَلَّ بَعْضَكُمْ أَنْ يَكُوْنَ أَبْلَغَ مِنْ بَعْضٍ، فَأَحْسِبُ أَنَّهُ صَدَقَ، فَأَقْضِيَ لَهُ بِذَلِكَ، فَمَنْ قَضَيْتُ لَهُ بِحَقِّ مُسْلِمٍ، فَإِنَّمَا هِيَ قِطْعَةٌ مِنَ النَّارِ، فَلْيَأْخُذْهَا أَوْ فَلْيَتْرُكْهَا».

‘অন্য আরেকটি রেওয়ায়েতে আছে যে, তোমাদের মধ্যে একপক্ষ দ্বিতীয় পক্ষের তুলনায় কথা বেশ যুক্তিগ্রাহ্য ভঙ্গিতে বোঝালে। অতএব আমি ধারণা করে নিলাম যে, সে সত্য বলছে। ফলে আমি তার জন্য সেই জিনিসের ফয়সলা করে দিই। সুতরাং যে ব্যক্তির জন্য আমি অপর মুসলামনের অধিকারের ফয়সলা করবো তা জাহান্নামের একটা টুকরোমাত্র। কাজেই সে চাইলে সম্পতি গ্রহণ করবে অথবা ত্যাগ করবে।’[6]

জুমহুরের নকলি কেবল এ হাদীসগুলোই। এই হাদীস দ্বারা তাঁরা এভাবে দলিল পেশ করেন যে, হুযুর আকরম D (অর্থাৎ বিচারপতি)-এর ফয়সলার পরেও সেই মাল যা নিয়ে দাবি করা হয়েছে জাহান্নামের এক টুকরোই থেকে যায়। সুতরাং তা গ্রহণ করা বাদীর জন্য হালাল হবে না। কাজেই বোঝা গেল যে, বিচারপতির ফয়সলা কেবল প্রত্যক্ষভাবে কার্যকর হবে, পরোক্ষভাবে কার্যকর হবে না। নতুবা সেই মাল হালাল ও পবিত্র হয়ে যেত।

জুমহুরের বুদ্ধিবৃত্তিক দলিল

(জুমহুরের বুদ্ধিবৃত্তিক দলিল) হচ্ছে, মিথ্যা সাক্ষীর ভিত্তিতে বিচারপতির করা ফয়সলা যদি পরোক্ষভাবেও বাস্তবায়ন করা হয় তা হলে تَكُنْ فِتْنَةٌ فِي الْاَرْضِ وَفَسَادٌ كَبِيْرٌؕ۰۰۷۳ (জমিনে ফিতনার অভায়রণ্যে পরিণত হবে এবং মারাত্মক বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।)[7] প্রত্যেক ধোঁকাবাজ, মিথ্যুক ও অসৎ লোক নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য মিথ্যা দাবি করবে, ভাড়ায় সাক্ষ্য চালিয়ে দেবে, নিজের পক্ষে মকদ্দমার ডিগ্রি করিয়ে নেবে এবং দুনিয়ায় মজায় মজায় ঘুরে বেড়াবে। আবার আখেরাতের আযাব থেকেও নিরাপদ হয়ে যাবে। কেননা ফয়সলা পরোক্ষভাবে কার্যকর হওয়ার কারণে সেই জিনিস যার দাবি সে করেছিল তা হালাল ও পবিত্র হয়ে যাবে।

ইমাম আযম w-এর নকলি দলিল

  1. এক ব্যক্তি নিজের গোত্রেরই এক মহিলার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। সেই পুরুষ লোকটি বংশীয় কৌলিন্যে ওই মহিলার চেয়ে নীচু স্তরের ছিল। সুতরাং মহিলাটি ওই বক্তির সাথে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। লোকটি হযরত আলী y-এর কোর্টে বিয়ে দাবি করল এবং দুজন মিথ্যা সাক্ষী উপস্থাপন করল। হযরত আলী h বিয়ের ফয়সলা দিলেন। মহিলাটি বলল, এই লোকের সাথে আমার বিয়ে হয়নি, যদি আপনি আমাকে তার কাছে পাঠাতেই চান তাহলে আপনি আমাদের বিয়ে পড়িয়ে দিন, যাতে আমরা হারাম থেকে বাঁচতে পারি। হযরত আলী y তাদের পড়াননি, বরং বললেন যে,

شَاهِدَاك زَوَّجَاك.

‘তোমার সাক্ষী দুজনই তোমার বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে।’[8]

এ বর্ণনাটি ইমামে আযম আবু হানিফা w-এর বক্তব্যের স্পষ্ট দলিল যে, বিচারপতির ফয়সলাই বিয়ে অস্তিত্ব দান করে। যদি প্রকৃত পক্ষে বিয়ে না-ও হয়ে থাকে তাহলে বিচারপতির ফয়সলা দ্বারা বিয়ে হয়ে যাবে। হযরত আলী y বিয়ের অস্তিত্বের কারণ নিজের ফয়সলাকে না ধরে সাক্ষ্যকে এজন্য ধরেছেন যে, সাক্ষ্য বিচারপতির বিচারের জন্য প্রথম অর্থে وَاسِطَةٌ فِي الثَّبُوْتِ (প্রমাণের মাধ্যম) হয়েছে। অর্থাৎ সাক্ষ্য ফয়সলা প্রদানের মাধ্যম হয়েছে। সুতরাং সাক্ষ্যই বিয়ের অস্তিত্ব দান করেছে।

  1. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর h এই শর্তে একটি গোলাম বিক্রি করেছেন যে, তা সর্বপ্রকার ত্রুটিমুক্ত। ক্রেতা ব্যাপারটি হযরত উসমান h-এর সমানে পেশ করেন। হযরত উসমান h ইবনে ওমর h-কে বলেন, আপনি কি কসম খেতে পারেন যে, আপনি ত্রুটি গোপন করে বিক্রি করেননি? ইবনে ওমর h কসম খেতে অস্বীকৃতি জানান। কাজেই হযরত উসমান h গোলামটি ইবনে ওমর h-এর কাছে ফিরিয়ে দেন। ইবনে ওমর h তা নিয়ে নেন এবং বেশ ভালো দামে বিক্রি করে দেন।

হযরত (আবদুল্লাহ) ইবনে ওমর h জানতেন, তিনি গোলামটি ত্রুটিমুক্ত হওয়ার শর্তে বিক্রি করেছেন। এজন্য হযরত উসমান h-এর خيارِ عيب (ত্রুটিপূর্ণ হলে ফেরত দেওয়ার অধিকার)-এর কারণে গোলাম ফিরিয়ে দেওয়ার ফয়সলা সঠিক ছিল না। যদি হযরত উসমান h প্রকৃত অবস্থা অবগত হতেন তাহলে তিনি গোলামটি ফেরত নেওয়ার ফয়সলা করতেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও হযরত ইবনে ওমর h ফেরত নিয়ে নেন এবং অন্য জায়গায় বেশ ভালো দামে বিক্রি করে দেন। أَنَّ فَسْخَ الْـحَاكِمِ الْعَقْدَ يُوْجِبُ عَوْدَهُ إلَىٰ مِلْكِهِ وَإِنْ كَانَ فِي الْبَاطِنِ خِلَافَهُ (বোঝা গেল যে, বিচারপতি চুক্তি ভেঙে দিলে বিক্রিত পণ্য ক্রেতার অধিকারে ফেরত আসে। যদিও বাস্তব অবস্থা এর বিপরীত।)[9]

  1. হযরত হিলাল ইবনে উমাইয়া h নিজের স্ত্রীর ওপর শরীক ইবনে সাহমার সাথে সম্পর্কে জড়িত হওয়ার অভিযোগ আনেন। অতএব লিয়ানের আয়াত নাযিল হয় এবং স্বামী-স্ত্রীর মাঝে লিয়ান প্রয়োগ করা হয় ও তাদের বিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়। এর হুযুর আকরম D ইরশাদ করেন, ‘হিলালের স্ত্রী, যে গর্ভবতী যদি সে এই এই চিহ্নসংবলিত বাচ্চা জন্ম দেয়, তা হলে তা হিলালের সন্তান হবে এবং তার অভিযোগ ভুল হবে। আর যদি এই এই অন্যান্য চিহ্নসংবলিত বাচ্চা জন্ম দেয়, তা হলে তা শরীকের সন্তান হবে, অর্থাৎ হিলালের অভিযোগ সত্য।’ অতঃপর যখন মহিলা সন্তান জন্ম দেয় তখন তার মধ্যে সেসব চিহ্নসমূহ ছিল যার পরিপ্রেক্ষিতে সেটা শরীকের বাচ্চা বলে স্বীকৃত হয়েছিল। এ সময় হুযুর আকরম D ইরশাদ করেছিলেন যে,

«لَوْلَا مَا مَضَىٰ مِنْ الْأَيْمَانِ لَكَانَ لِيْ وَلَـهَا شَأْنٌ».

‘যদি আগেই লিয়ান না হত তবে আমার এবং এই মহিলার ব্যাপারটা কিছু ভিন্ন হত (অর্থাৎ আমি তাকে কঠিন শাস্তি দিতাম।’

মহিলার মিথ্যা প্রকাশিত হওয়ার পরেও হুযুর আকরম D লিয়ানের কারণে যে বিচ্ছেদ সংঘটিত করেছিলেন তা বহাল রাখেন, নিজের ফয়সলা পরিবর্তন করেননি। فَصَارَ ذَلِكَ أَصْلًا فِيْ أَنَّ الْعُقُوْدَ وَفَسْخَهَا مَتَىٰ حَكَمَ بِهَا الْـحَاكِمُ مِمَّا لَوْ ابْتَدَأَ أَيْضًا بِحُكْمِ الْـحَاكِمِ وَقَعَ (অতএব এর দ্বারা একটি মৌলিক নিয়ম বেরিয়ে এল যে, যখন কোনো বিচারপতি আকদ ও ফাসখের ক্ষেত্রে ফয়সলা করেন তখন সেই ফয়সলা কার্যকর হবে। তবে শর্ত থাকে যে, বিচারপতির হুকুমে এটি পুনর্বিচার হতে পারে।)[10]

  1. দুই ব্যক্তি এক লোকের বিরুদ্ধে একথা মিথ্যা সাক্ষ্য দিল যে, সে তার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছে। সুতরাং বিচারপতি স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটান। অতঃপর সাক্ষী দুইজনের মধ্যে একজন ওই মহিলাকে বিয়ে করে ফেলল। তখন ইমাম আমির w (যিনি এক মহান তাবিয়ী) ফতওয়া দিলেন যে, এ বিয়ে বৈধ।[11]

ইমাম আযম w-এর বুদ্ধিবৃত্তিক দলিল

ইমাম আবু হানিফা w-এর বুদ্ধিবৃত্তিক দলিল হযরত (শায়খুল হিন্দ) u বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। যার সারসংক্ষেপ হচ্ছে, সাক্ষীদের মিথ্যাচার অবগত না হয়ে বিচারপতি যে ফয়সলা করেন, সে ফয়সলা ঐকমত্যে প্রত্যক্ষভাবে কার্যকর হবে। অর্থাৎ বিচারপতি বাদীকে সেই জিনিসের ওপর দখল দেবেন যার জন্য সে দাবি করেছে। আর বাদী যখন সে জিনিসের ওপর পূর্ণ দখল বুঝে পাবে তখন সে ওই জিনিসের মালিক হয়ে যাবে। কেননা দখল মালিকানার জন্য علّتِ تامّہ (পরিপূর্ণ প্রমাণ)। আর معمول (প্রমাণিত বস্তু) علّتِ تامّہ (পরিপূর্ণ প্রমাণ) থেকে পিছিয়ে থাকতে পারে না। ইল্লতের সাথেই মামুলের পাওয়া আবশ্যক। কাজেই যে মহিলাই বাদীর আয়ত্বে আসবে বাদী তার মালিক হয়ে যাবে এবং পরস্পর যৌনসম্ভোগ হালাল হয়ে যাবে। বাকি থাকল বিয়ে, সেটি তো কেবল মালিকানার প্রত্যক্ষ কারণ, প্রকৃত কারণ তো দখলসত্ত্ব। এজন্য প্রকৃত কারণ পাওয়ার পর রূপক কারণে প্রয়োজনীয়তা মোটেও অবশিষ্ট থাকে না।

বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের বিবরণ

উপর্যুক্ত বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের জন্য ভূমিকাস্বরূপ হযরত (শায়খুল হিন্দ) u পাঁচটি ভূমিকা বর্ণনা করেছেন, যা নিম্নে প্রদত্ত হল:

  1. প্রথম ভূমিকা হচ্ছে, মালিকানার প্রকৃত কারণ পরিপূর্ণ দখল। তবে শর্ত হচ্ছে, অধিকৃত বস্তুর মালিকানা প্রয়োগযোগ্য ক্ষেত্র হবে। অর্থাৎ এতে মালিকানা গ্রহণের যোগ্যতা থাকবে।
  2. দ্বিতীয় ভূমিকা হচ্ছে, দুনিয়ার সকল জিনিস বিশেষত মহিলাগণও পরিপূর্ণ দখলের কারণে মালিকানাধীন হয়ে থাকে।
  3. তৃতীয় ভূমিকা হচ্ছে, স্বামীর জন্য স্ত্রী থেকে উপকৃত হওয়ার যে অনুমোদন রয়েছে তা ব্যবসায়ের ভিত্তিতে, ভাড়া হিসেবে নয়। অর্থাৎ বিয়েতে নারী তার যৌনাঙ্গ ও জরায়ু স্বামীর কাছে বিক্রি করে দেয়।
  4. চতুর্থ ভূমিকা হচ্ছে, নারীর পক্ষে যৌনাঙ্গ বিক্রি করার অধিকার তো আছে, কিন্তু শরীরের অন্যান্য অঙ্গের বিক্রি করার অনুমতি নেই। এজন্য স্বামী শুধু যৌনাঙ্গের মালিক হবে, নারীর শরীরের অন্যান্য অংশের মালিক হবে না।
  5. পঞ্চম ভূমিকা হচ্ছে, মালিকানার বর্হিভুত বস্তু অর্থাৎ সাধারণভাবে বৈধ জিনিসসমূহে তো শুধু দখল দ্বারাই মালিকানাভুক্ত হয়। এখানে না বিক্রয়ের প্রয়োজন আছে, না বিচারপতির বিচারের দরকার। কিন্তু নারীর মালিকানা এভাবে সম্ভব নয়। কেননা নর-নারী যেখানে উঁচু-নীচু শ্রেণি আছে সেখানে জাতিগত সমতাও আছে। এজন্য আবশ্যক হচ্ছে যে, পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হবে অথবা বিচারপতির আদেশে নারীকে কর্তৃত্বে পাওয়ার কারণ হবে। তখনই নারীদের ওপর পরিপূর্ণ দখল মালিকানার কারণে পরিণত হবে।

উপর্যুক্ত পাঁচটি ভূমিকা সামনে রাখার পর দলিল হৃদয়ঙ্গম করতে কোনো সমস্যা থাকে না। যখন উকূদ ও ফুসূখে বিচারপতি ফয়সলা দিয়েছেন এবং সেই ফয়সলা ঐকমত্যে প্রত্যক্ষভাবে কার্যকর হয়েছে। অর্থাৎ সেই জিনিসের ওপর যার জন্য বাদী দাবি করেছিল বাদীকে পরিপূর্ণ দখলে দিয়ে দেওয়া হয়, এখন তা তার মালুল থেকে ভিন্ন হতে পারে না।  অর্থাৎ বাদী নারীর মালিক হয়ে যাবে। আর এভাবে বিচারপতির ফয়সলা পরোক্ষভাবেও কার্যকর হবে। অর্থাৎ বাদী প্রকৃত ও নৈতিকভাবে এই নারীর মালিক হয়ে যাবে।

বাকি কথা হচ্ছে, বাদী দখল পাওয়ার জন্য যে ভুল পদ্ধতি অবলম্বন করেছে, তা নিজস্ব অবস্থানে গুনাহে কাবীরা। যার শাস্তি তাকে আখেরাতে অবশ্যই ভোগ করতে হবে। বেশি দূরে নয়, দুনিয়ায়ও এর জন্য সে কিছু শাস্তি ভোগ করবে।

জুমহুরের বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের জবাব

জুমহুরের বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের জবাব হচ্ছে,

  1. প্রথম জবাব হচ্ছে, হাদীস শরীফের শানে ওয়ারূদ (প্রেক্ষাপট) পর্যালোচনা করলে অনুমিত হয় যে, ওখানে আমলাকে মুরসালার দাবি ছিল। ঘটনা হচ্ছে, দুই ব্যক্তির মধ্যে উত্তরাধিকার নিয়ে বহুদিন থেকে দ্বন্দ্ব ছিল আর এর কোনো সাক্ষী ছিল না। অতএব হযরত উম্মে সালামা i থেকে এ রেওয়ায়েতটি বর্ণিত আছে যে, أَتَىٰ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ رَجُلَانِ يَخْتَصِمَانِ فِيْ مَوَارِيْثَ لَـهُمَا لَـمْ تَكُنْ لَـهُمَا بَيِّنَةٌ إلَّا دَعْوَاهُمَا[12]

আর আয়িম্মায়ে কেরামের মাঝে যে ব্যাপারটা বিবাদপূর্ণ তা হচ্ছে উকূদ ও ফুসূখের ক্ষেত্রে মিথ্যা সাক্ষীর মাধ্যমে ফয়সলা করা। আমলাকে মুরসালার ক্ষেত্রে সাক্ষী ছাড়াই বিচারপতির ফয়সলা বিতর্কিত নয়, তা সর্বসম্মতিক্রমে স্রেফ প্রত্যক্ষভাবে কার্যকর হবে, পরোক্ষভাবে কার্যকর হবে না।

  1. দ্বিতীয় জবাব হচ্ছে, যদি একথা মেনেও নেওয়া হয় যে, হাদীস শরীফ বিতর্কিত ব্যাপারটার সাথে সম্পর্কিত। তা হলে চিন্তা করলে জানা যায় যে, হাদীস শরীফে অকার্যকর হওয়ার পরিবর্তে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিচারপতির ফয়সলা কার্যকর হওয়ার কথাই নির্দেশ করে। কেননা হাদীস শরীফের মর্ম হচ্ছে, যদি আমি কারও জিনিস বাদী ও সাক্ষীর মিথ্যাবাদিতা সত্ত্বেও ভ্রমের শিকার হয়ে অন্য কাউকে দিয়ে দিই, তা হলে সেই জিনিসের ওপর তার পূর্ণ মালিকানা হয়ে যাবে, কিন্তু মালিকানাধীন হয়ে যাওয়া কেউ যেন একথা না বুঝে যে, তার ভাগ্যে কোনো ধরনের সাজার অবকাশ রইল না। বরং মিথ্যাচার ও প্রতারণার কঠিন খড়্গ তার মাথার ওপর ঝুলে থাকবে। এজন্য ওই জিনিস নিজের অধিকারে জাহান্নামের একটা টুকরা হিসেবে মনে করা উচিত। «قِطْعَةٌ مِنَ النَّارِ» (জাহান্নামের একটা টুকরা)[13] বাক্য দ্বারা মালিকানা লাভের পদ্ধতি যে মন্দ তা স্পষ্ট বোঝা যায় এবং «أَقْطَعُ لَهُ» (তাকে দিই।)[14] থেকে বিচারপতির ফয়সলা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কার্যকর হওয়া ইঙ্গিতে বোঝা যায়। কেননা لَام (অব্যয়) মালিকানা বোঝায়।

জুমহুরের বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের জবাব

(জুমহুরের বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের জবাব) হচ্ছে, অবিবাহিতার বেলায় বিয়ের দাবির ক্ষেত্রে বিচারপতির ফয়সলা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কার্যকর হওয়া ফিতনার কোনো কারণ নয়, বরং তা রুদ্ধই করে দেওয়া হয়েছে। কেননা ফিতনা হয় মিথ্যুক বাদী তৈরি করতে পারত বা মেয়েপক্ষের অভিভাককরা সৃষ্টি করতে পারত। কিন্তু যখন মেয়েটি ওই বাদী পেয়ে গেল এবং তার জন্য সে বৈধও হয়ে গেল, তা হলে এখন সে কেন ফিতনা করবে? আর পরোক্ষভাবে কার্যকর হওয়ার উপকারিতা হচ্ছে, মেয়েটির অভিভাবকরাও নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে।

আর ব্যাপারটি বিয়েবিচ্ছেদের হয় এবং ইদ্দতের পর ওই নারীর সাথে যদি অন্য কেউ বিয়ে করে, তা হলে এখন ফিতনা সৃষ্টিার আশঙ্কা একমাত্র প্রথম স্বামীর পক্ষ থেকে সম্ভব হতে পারে। কিন্তু যেসব ভদ্র মহোদয় পরোক্ষভাবে কার্যকর হওয়ার বিপরীতে মত প্রকাশ করেন, তারাও একথা বলেন যে, প্রথম স্বামীর জন্য আইন হাতে নেওয়ার জায়েয নেই। অর্থাৎ যদিও প্রকৃতপক্ষে ওই নারী তারই স্ত্রী হয়, দ্বিতীয় স্বামীর স্ত্রী হয়নি, তবুও প্রথম স্বামীর জন্য ওই নারীকে উপভোগ করা জায়েয নয়। কেননা এখন প্রথম স্বামীর পক্ষ থেকে এই স্ত্রীর ওপর সম্পর্ক রাখা আইনকে হাতে তুলে নেওয়া হবে।

তাছাড়া এ ধরনের ঘটনা ইসলামী সমাজে বিরল এবং সাধারণভাবে এই ধরনের ঘটনা গোপনও থাকে না। মিথ্যুক বাদী ও সাক্ষী নিজের কৃতকর্মের শাস্তি পেয়েই থাকে। এজন্য এ ধরনের ধোঁকা ও প্রতারণা ইসলামী সমাজে চলতে পারে না।

লিফলেটের ব্যাখ্যা

সবচেয়ে আগে একথা জানা আবশ্যক যে, অভিযোগকারী জনাব মৌলভী আবু সাইদ মুহাম্মদ হুসাইন বাটালভী গোটা হিন্দুস্তানের হানাফীদেরকে যে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন তা হচ্ছে,

قضاء کا ظاہر وباطن نافذ ہونا، مثلًا کسی شخص نے ناحق کسی کی جورو کا دعویٰ کیا ہے کہ یہ میری جورو ہے، اور قاضی کے سامنے جھوٹے گواہ پیش کرکے مقدمہ جیت لے، اور وہ عورت اس کو مل جائے، تو وہ عورت بحسبِ ظاہر بھی اس کی بیوی ہے، اور اس سے صحبت کرنا بھی اس کو حلال ہے۔

‘বিচারপতির রায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কার্যকর হওয়া। উদারণত যদি কোনো লোক কারও স্ত্রীকে অন্যায়ভাবে নিজের বলে দাবি করে এবং বিচারপতির সামনে মিথ্যা সাক্ষী পেশ করে মকদ্দমায় জয় লাভ করে আর মহিলাকে সে পেয়ে যায়। সে অবস্থায় বাহ্য বিবেচনায় সেই মহিলা তার স্ত্রী হয় এবং তার সাথে সহবাস করাও বৈধ।’

অর্থাৎ অন্যের বিবাহিতা স্ত্রীর ব্যাপারেও বিচারপতির ফয়সলা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কার্যকর হয়। অথচ একথা সম্পূর্ণ ভুল। অভিযোগকারী মাসআলাই বুঝেননি, অন্যের বিবাহিতা স্ত্রীর ব্যাপারে বিচারপতির ফয়সলা কারও কাছেই পরোক্ষভাবে কার্যকর নয়। মতপার্থক্য কেবল অবিবাহিতা নারীর ক্ষেত্রে। (ফতওয়ায়ে) শামীতে এসেছে,

فَإِذَا ادَّعَىٰ أَنَّهَا زَوْجَتُهُ، وَأَثْبَتَ ذَلِكَ بِشَهَادَةِ الزُّوْرِ، وَهُوَ يَعْلَمُ أَنَّهَا مُحَرَّمَةٌ عَلَيْهِ بِكَوْنِهَا مَنْكُوْحَةَ الْغَيْرِ أَوْ مُعْتَدَّتَهُ أَوْ بِكَوْنِهَا مُرْتَدَّةً، فَإِنَّهُ لَا يَنْفُذُ بَاطِنًا اتِّفَاقًا.

‘যখন কোনো লোক দাবি করে যে, অমুক নারী আমার স্ত্রী। আর একথা সে মিথ্যা সাক্ষী দ্বারা প্রমাণ করে। অথচ সে জানে ওই নারী তার জন্য হারাম, অন্যের বিবাহিতা স্ত্রী হওয়ার কারণে, ইদ্দত পালন করছে এমন হওয়ার কারণে কিংবা ধর্মত্যাগী হওয়ার কারণে। তা হলে ঐকমত্যে এ ফয়সলা পরোক্ষভাবে কার্যকর হবে না।’[15]

এজন্য হযরত (শায়খুল হিন্দ) u চ্যালেঞ্জের জবাব এখান থেকেই শুরু করেছেন যে, অন্যের বিবাহিতা স্ত্রীর ব্যাপারে এটা হানাফীদের বক্তব্যই নয়। বুঝি না অভিযোগকারী মহোদয় (হানাফীদের) মানহানি করছেন নাকি মাসআলাই বুঝেননি! মাসআলাই যদি না বুঝেন তাহলে তাকলীদ পরিত্যাগের জন্য যৌক্তিক কারণ আছে। কেননা কারও তাকলীদ সেই ব্যক্তি করে যে তার প্রতি আস্থাশীল। আস্থাশীল সেই ব্যক্তি হয়ে থাকে যে কারও কথা বুঝে এবং তার গুণমুগ্ধ হয়। যে কারও কথাই না বুঝে সে কি ধুলো তার তাকলীদ করবে? এজন্য অভিযোগকারী মহোদয় যদি কোনো ইমামের তাকলীদ না করে থাকে, তা হলে এর কারণ মুজতাহিদদের বক্তব্যের দুর্বলতা নয়, বরং এটা তাদের বুঝের দুর্বলতা!

হ্যাঁ, অভিযোগকারী মহোদয় একথা বলবেন যে, চ্যালেঞ্জের ভাষায় আমরা মাসআলার যে বিবরণ বর্ণনা করেছি তাতে আমাদের ভুল হয়েছে। আর প্রত্যেক মানুষের ভুল হয়। অথবা তিনি একথাও বলবেন যে, মাসআলাটি আমরা একঝলকে দেখেছি, গভীর দৃষ্টিতে দেখিনি। এজন্য উদাহরণ বর্ণনা করতে গিয়ে ভুল হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ স্বস্থানে বহাল রয়েছে। কেননা অন্যের বিবাহিতা স্ত্রীর কথা বাদই দিই, অবিবাহিতার বৈধতাও যৌক্তিক হতে পারে না। এজন্য হযরত (শায়খুল হিন্দ) u অভিযোগকারীর ভুলকে উপেক্ষা করে জবাব ইরশাদ করেছেন এবং জবাবের ভূমিকাস্বরূপ পাঁচটি কথা বর্ণনা করেছেন।

[متن ادلۂ کاملہ]

دفعۂ ثامن: جواب تو آپ کے اس اعتراض کا فقط اتنا ہے کہ منکوحۂِ غیر کی نسبت حنفیوں کا یہ قول ہی نہیں، «دُرِّؔ مختار» اور «شاؔمی» موجود ہے، اگر آپ سچے ہیں تو سندِ معتبر دکھلایئے، اور دس نہیں بیس لے جایئے، خدا جانے یہ افتراء ہے، یا خوبئ فہم ہے!؟ اگر خوبئ فہم ہے تو ترکِ تقلید کے لئے عذر معقول ہے، مگر ہاں شاید بعد عذرِ سہو، یا قلّتِ تَدَبُّر آپ یہ ارشاد فرمائیں کہ منکوحۂ غیر نہ سہی، غیر منکوحہ کی حِلّت بھی اِس طرح معقول نہیں، اس لئے یہ گذارش ہے کہ قبل از جواب ایک دو بات سُن لیجئے، اور برائے خدا ذرا انصاف بھی کیجئے۔

অষ্টম দফা: আপনার আপত্তির জবাব শুধু এটুকেই যে, অন্যের বিবাহিতা স্ত্রীর সাথে সম্বন্ধিত এ বক্তব্য হানাফীদেরই নয়। আদ-দুররুল মুখতারফতওয়ায়ে শামী বিদ্যমান। যদি আপনি সত্যবাদী হন তাহলে গ্রহণযোগ্য সনদ দেখান এবং ১০ নয়, ২০ নিয়ে নিন। আল্লাহ জানেন, এটা অপবাদ নাকি বুঝের দীনতা!? যদি বুঝের দীনতা হয় তাহলে এটা তাকলীদ পরিত্যাগ করার জন্য কারণ হিসেবে যৌক্তিক। কিন্তু হ্যাঁ, হয়তো ভুল কালন ও আক্কল জ্ঞানের স্বল্পতা আপনি একথা বললেন যে, অন্যের বিবাহিতা স্ত্রীর কথা বাদই দিই, অবিবাহিতার বৈধতাও এভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এজন্য অনুরোধ হচ্ছে, জবাবের পূর্বে দুয়েকটি কথা শুনে নেবেন। আল্লাহর ওয়াস্তে একটু ইনসাফ করুন।’

এক. মালিকানার প্রমাণ হচ্ছে পরিপূর্ণ দখল

যেকোনো জিনিসের মালিক হওয়ার علّتِ تامّہ (পরিপূর্ণ প্রমাণ) হচ্ছে দখল। কিন্তু দখলের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে পরিপূর্ণ হওয়া অর্থাৎ প্রকৃত ও স্বতন্ত্র হওয়া। আর ‘দখলের’ উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোনো জিনিস হাতের মুঠোয় হওয়া নয়, বরং مُجَازٌ بِالتَّصَرُّفِ (ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত) হওয়া। সুতরাং চোর ও জবর দখলকারীর যে দখল সেটা প্রকৃতপক্ষে দখলই নয়। কেননা চোর ও জবর দখলকারী চোরাই মাল ও জবর দখলকৃত জিনিসের ব্যবহার শরয়ীভাবে অনুমোদিত নয়। আর ‘প্রকৃত দখল’ হচ্ছে যা শরীয়তের বিধান অনুযায়ী বিচারপতিও বহাল রাখেন এবং এ ধরনের দখল রহিত করা বিচারপতির অধিকারেও থাকে না। ‘স্বতন্ত্র’ হওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ওই দখল আসলি হবে, সাময়িক হবে না। কাজেই যে দখল অস্থায়ী ও রূপক হবে তা পরিপূর্ণ হতে পারে না। যেমন- বন্ধকি জিনিসের ওপর বন্ধকগ্রহীতার দখল, এতিমের সম্পত্তিতে তার পৃষ্ঠপোষকের দখল, হাওলাতি জিনিসের ওপর হাওলাতগ্রহীতার দখল এবং জমা ও আমানতের ওপর সেই লোকের দখল যার কাছে আমানত গচ্ছিত রাখা হয়েছে। এসব দখল প্রকৃত ও স্বতন্ত্র নয়। বরং প্রকৃত ও আসলি দখল হচ্ছে মালিকের। আর তা এসব ব্যক্তির দখলের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার জন্য وَاسِطَةٌ فِي الْعُرُوْضِ (অস্থায়ী মাধ্যম) হয়েছে। অতএব তাদের সম্পর্ক রূপক। একই সঙ্গে তাদের দখল অস্থায়ী ও সাময়িক। মালিক যখন ইচ্ছা তাদের দখল সমাপ্ত করতে পারবে।

ক্রয়বিক্রয় ইত্যাদি হচ্ছে মালিকানার

কারণসমূহের অন্যতম

আর ক্রয়বিক্রয়, সদকা ও দান ইত্যাদি মালিকানার প্রমাণ নয়, বরং কারণসমূহের অন্যতম। যাকে রূপকভাবে প্রমাণ বলা হয়ে থাকে, নতুবা প্রকৃত প্রমাণ হচ্ছে দখল। কেননা সাধারণভাবে বৈধ জিনিস যেমন বন্য ও সামুদ্রিক প্রাণী এবং বন্য গাছ ও ফল যা মালিকনায় আসে তা কেবল দখলের কারণেই আসে, ক্রয়বিক্রয় ইত্যাদি মালিকানার কারণ সেখানে নামগন্ধও নেই। বরং ক্রয়বিক্রয় ইত্যাদি দখল প্রক্রিয়ার পরই সম্পাদিত হতে পারে। এজন্য কোনো জিনিস ক্রয়ের পর যতক্ষণ পর্যন্ত তার ওপর দখল না হবে তা বিক্রি করা জায়েয নয়। কেননা যদিও ওই জিনিস ক্রয় হয়ে গেছে, কিন্তু ক্রয়ই মালিকানার প্রমাণ নয়, যখন দখল হবে তখনই ক্রেতা ক্রয়কৃত জিনিসের মালিক হবে এবং এর পরই বিক্রি জায়েয হবে। যদি ক্রয়ই মালিকানার প্রমাণ হত তবে ক্রয়মাত্রই ক্রেতা মালিক হয়ে যেত এবং তা বিক্রিও জায়েয হয়ে যেত, অথচ এমন নয়। অতএব বোঝা গেল যে, ক্রয়বিক্রয় ইত্যাদি মালিকানার প্রমাণ নয়, বরং কারণসমূহের অন্যতম।

দখল মালিকানার কারণ হওয়ার দলিল

আর দখল মালিকানার কারণ হওয়ার একটি স্পষ্ট দলিল হচ্ছে, যে সকল সাহাবায়ে কেরাম নিজের ধন-সম্পদ ছেড়ে খোদার রাহে হিজরত করে মদীনা মুনাওয়ারা এসেছিলেন। তাঁদেরকে আল্লাহ তাআলা সূরা হাশরের অষ্টম আয়াতে فُقَرَاءٌ বলেছেন। আর ফকির বলা হয় সেই ব্যক্তিকে যার স্বত্বাধিকারে কিছুই নেই অথবা প্রয়োজনমতো নেই। তাঁরা দারুল কুফরে বেশকিছু সম্পদ ছেড়ে এসেছিলেন। কাজেই যদি সেসব সম্পত্তি তাঁদের মালিকানায় থাকতো তাহরে তাঁরা فُقَرَاءٌ কীভাবে আখ্যায়িত হতো? فُقَرَاءٌ তাঁরা সেই অবস্থায় হতে পারেন, যখন তাঁদের সম্পত্তির দখল ওঠে যাওয়ার কারণে এবং কাফেররা দখলদার হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের মালিকানা থেকে বেরিয়ে যায়। সুতরাং প্রমাণিত হয় যে, দখল মালিকানার কারণ।

এক সংশয় ও তার জবাব

যদি কেউ বলে থাকেন যে, মুহাজিরদেরকে فُقَرَاءٌ এজন্যই বলা হয়েছে যে, তাঁদের সম্পত্তি তাঁদের সাথে ছিল না। তা হলে এর জবাব হচ্ছে যে, একথা ভুল। আয়াতে সদকা অর্থাৎ যাকাতের ব্যয়ের খাতের বর্ণনাসংবলিত আয়াত: اِنَّمَا الصَّدَقٰتُ لِلْفُقَرَآءِ ؕ ۰۰۶۰[16]-এ فُقَرَاءٌ-কে পৃথকভাবে গণ্য করা হয়েছে এবং ابْنِ السَّبِيْلِؕ ۰۰۶۰ (মুসাফির) ও فِيْ سَبِيْلِ اللّٰهِ ؕ ۰۰۶۰ যার উদ্দেশ্য অভাবগ্রস্ত ও যুদ্ধরত তাদেরকে পৃথকভাবে গণ্য করা হয়েছে। যদি ফকিরের অর্থ এই হতো যে, তার সম্পদ তার সাথে নেই, তাহলে সেই বিবেচনায় মুসাফির প্রমুখও ফকির হতো। তাদেরকে পৃথকভাবে গণ্য করার কি প্রয়োজন ছিল? এজন্য সঠিক বক্তব্য হচ্ছে যে, ফকির সেই ব্যক্তি নয়, যার সম্পদ তার কাছে নয়। বরং ফকির হচ্ছে যার মালিকানায় কোনো সম্পদ নেই অথবা অযথেষ্ট সম্পদ আছে।

দ্বিতীয় সংশয় ও তার জবাব

আর যদি কেউ এ সন্দেহ করেন যে, স্বত্বাধিকারীর মৃত্যুর পর ওয়ারিসের দখলের আগেই মৌরসি সম্পতির মালিক হয়ে যায়। কেননা উত্তরাধিকারে মালিকানা জরুরি হয়ে থাকে। যদি দখল মালিকানার কারণ হয় তাহলে দখলের আগেই সে মালিক হয় কীভাবে?

এর জবাব হচ্ছে যে, যদিও সাধারণ দৃষ্টিতে ওয়ারিস দখলের আগেই মালিক হিসেবে দেখা যায়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ওয়ারিস দখলের আগে মিরাসের মালিক হয় না। বরং দখলের পরেই মিরাসের মালিক হয়। কেননা ওয়ারিসের দখল স্বতন্ত্র ও নতুন নয়। অর্থাৎ যেভাবে ক্রয়বিক্রয়ে প্রথমে বিক্রেতার দখলের অবসান হয়, তারপর ক্রেতার ক্রীতের ওপর নতুন দখল হয় সেভাবে মিরাসে হয় না; প্রথমে স্বত্বাধিকারীর দখল সমাপ্ত হবে, এরপর ওয়ারিসের দখল সাব্যস্ত হবে। বরং স্বত্বাধিকারীর নিজের সম্পত্তির ওপর যে দখল ছিল হুবহু সেই দখলই ওয়ারিসের পক্ষে হস্তান্তরিত হয়ে যায়। এজন্য নতুনভাবে দখলের প্রয়োজন নেই। ফিকহের সর্বসিদ্ধ নীতি হচ্ছে, الْـمَلْكُ الثَّابِتُ لِلْوَارِثِ هُوَ الْـمِلْكُ الَّذِيْ كَانَ لِلْمُوْرِثِ (ওয়ারিসের জন্য যে মালিকানা সাব্যস্ত হয় তা সেই একই মালিকানা যা স্বত্বাধিকারীর ক্ষেত্রে ছিল)।[17]

মৌরসি সম্পতির মালিক ও দখলদারের এই পরিবর্তন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। এজন্য মিরাসের বিধি-বিধানের বর্ণনা আল্লাহ তাআলা এভাবে প্রারম্ভ করেছেন, يُوْصِيْكُمُ اللّٰهُ فِيْۤ اَوْلَادِكُمْۗ ۰۰۱۱ (আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে আদেশ করছে, তোমাদের সন্তানদের বিষয়ে)।[18]

এটি আনুভাব্য উদাহরণের মাধ্যমে এভাবে বোঝানো যায় যে, আপনার রুমে টেবিলের ওপর গ্লাস রাখা আছে। যার ওপর ছাদ এবং নীচে টেবিল। এখন যদি আপনি গ্লাসটি উঠিয়ে সেই জায়গায় পাত্র রেখে দেন, তা যে উপরিস্থিতি ও নিম্নস্থিতি ছাদ ও টেবিলের তুলনায় ক্লাসের বিদ্যমান ছিল সেই সম্পর্ক হুবহু পাত্র লাভ করবে। অনুরূপভাবে স্বত্বাধিকারী উঠে যায় এবং ওয়ারিস তার জায়গায় বসে যায়। স্বত্বাধিকারী যেসব জিনিসের যেভাবে মালিক ছিল ওয়ারিস সেসব জিনিসের সেভাবে মালিক হয়ে যায়। বিক্রয়-ক্রয়ে যেভাবে মানুষ অন্যের মালকে টেনে নিজে মা বানিয়ে নেয় উত্তরাধিকারে সেভাবে হয় না। এজন্য বিক্রয়-ক্রয়ে নতুন দখল চায় এবং মৌরসি সম্পত্তিতে স্বত্বাধিকারীর দখলই যথেষ্ট।

অতঃপর হযরত (শায়খুল হিন্দ) u লিখেছেন যে, এখন তো এতটুকু কথায় সংক্ষেপ করছি। যদি আপত্তিকারী দখলের মালিকানার কারণ হওয়ার ওপর কোনো আপত্তি করে, তা হলে এমন এমন জ্ঞানগর্ব পর্যালোচনা উপস্থাপন করা হবে যে, লোকজন শুনে বাহ বাহ করবে। হযরত (শায়খুল হিন্দ) u-এর এ ভবিষদ্বাণী বাস্তবে পরিণত হয়। আপত্তিকারীর উকিল মৌলভী মুহাম্মদ হাসান আমরূহী (যিনি প্রথমে গায়রে মুকাল্লিদ ছিল, পরে কাদিয়ানি হয়ে যায়) মিসবাহুল আদিল্লা লিখে এবং এতে উপর্যুক্ত বক্তব্যের ওপর ত্রুটি আরোপ করে। অতএব হযরত (শায়খুল হিন্দ) u মিসবাহুল আদিল্লায় সেসব আপত্তির জবাব দিতে গিয়ে অনুমানিক ৮০ পৃষ্ঠায় এমন এমন (জ্ঞানগর্ভ) পর্যালোচনা উপস্থাপন করেছেন যে, বিবেককে বিস্ময়াভিভূত করে দেয়।

[متن ادلۂ کاملہ]

ایسی علّتِ ملک جس سے اُس کا معلول مُتَخَلَّفْ[19])) ہی نہ ہوسکے بدلائلِ عقل ونقل وہ قبضہ ہے، حدوثِ[20])) ملک اول اسی سے ہوتا ہے، اُس کے بعد کہیں بیع وشرا کی نوبت آتی ہے، بیع قبل القبض[21])) کا ممنوع ہونا بھی اِسی بات پر[22])) دلیلِ کامل ہے، کہ قبضہ علتِ ملک ہے—اُدھر مہاجرین کو خدا کا فُقراء کہنا حالانکہ اکثر صاحب بہت کچھ چھوڑکر گئے تھے، وہ بھی بے اس کے مُتَصَوَّر[23])) نہیں کہ علّتِ ملک قبضہ ہے، اِس کے اُٹھ جانے سے ملک گئی، تو وہ فقراء کہلائے۔

اور وارث گو ظاہر پرستوں کی نظر میں قبل القبض مالک ہو جاتا ہے، مگر جب یہ لحاظ کیا جائے کہ وارث قائم مقام مورث ہو جاتا ہے، اور بحکم يُوْصِيْكُمُ اللّٰهُ ۗ۰۰۱۱ {النساء: 11} خدا کی طرف سے یہ تبدیلی ہوتی ہے، تو یہ بات خود واجب التسلیم ہوجاتی ہے، کہ جیسے در صورتِ تبدیلئ اجسام، یکے بجائے دیگرے، وہ فوقیت وتحتیت جو جسمِ اول کی بہ نسبت فرش وسَقَفْ حاصل تھی، بعینہٖ جسمِ ثانی کی طرف عائد ہو جاتی ہے، ایسے ہی اس صورت میں قبضۂ مورث بعینہٖ اس کی طرف خود عائد ہو جاتا ہے، یہ نہیں کہ مثلِ بیع وشراء دوسروں کے مال کو اپنی طرف کھینچتا ہے، اور اپنے مال کے قائم مقام کر لیتا ہے، یہ فرق بشرطِ فہم اس بات کو مقتضی ہے کہ یہاں[24])) تازہ قبضہ چاہئے، اور وہاں وہی قبضۂ مورث اُس کی طرف آجاتا ہے۔

اس وقت اتنی بات پر اکتفا کرتا ہوں، اگر آپ صاحبِ فہم وفراست ہیں تو اتنی ہی بات سے اصل بات کو سمجھ جائیں گے، ورنہ آپ کچھ اعتراض فرمائیں گے، تو پھر ہم بھی ان شاء اللہ آپ کو تماشا دِکھائیں گے۔

‘মালিকানার এমন কারণ যা থেকে এর প্রমেয় বিষয় পৃথকই হতে পারে না যৌক্তিক ও ঐশী দলিলে সেটিই দখল। মালিকানা তার থেকেই প্রথম সৃষ্টি হয়। তার পরই অন্যত্র ক্রয়বিক্রয়ের সুযোগ আসে। দখলের পূর্বে বিক্রি নিষিদ্ধ হওয়াও এই কথার ওপরই পূর্ণাঙ্গ দলিল যে, দখল মালিকানার কারণ।—অন্য দিকে মুহাজিদেরকে খোদার فُقَرَاءٌ আখ্যায়িত করা, অথচ তাঁরা অধিকাংশই বেশকিছু ছেড়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা একথা কল্পনা করা ছাড়াই যে, মালিকনার কারণ হচ্ছে দখল, এটি উঠে গেলে মালিকানা চলে যায়। অতএব তাঁরা فُقَرَاءٌ আখ্যায়িত হন।

বাহ্যিকতা পূজারিদের দৃষ্টিতে তো ওয়ারিস দখলের পূর্বেই মালিক হয়ে যায়, কিন্তু যখন এটি বিবেচনা করা হয় যে, ওয়ারিস স্বত্বাধিকারীর স্থলাভিষিক্ত হয়ে থাকে এবং يُوْصِيْكُمُ اللّٰهُۗ۰۰۱۱-এর আদেশমতে খোদার পক্ষ থেকে এই পরিবর্তন হয়ে থাকে। তখন একথা অবশ্যই স্বীকার্য হয়ে যায় যে, যেভাবে অঙ্গ-প্রতঙ্গের একটি দ্বিতীয়টির জায়গায় পরিবর্তনের পরিস্থিতিতে সেই উপরিস্থিতি ও নিম্নস্থিতি যা প্রথম অঙ্গের জন্য স্থল ও ছাদ হিসেবে বিদ্যমান ছিল তা হুবহু দ্বিতীয় অঙ্গের প্রতি প্রত্যার্তিত হয়। একইভাবে এক্ষেত্রে স্বত্বাধিকারীর দখল হুবহু তার প্রতি প্রত্যাবর্তিত হয়ে থাকে। এই নয় যে, বিক্রয়-ক্রয়ের মতো অন্যের সম্পদকে নিজের প্রতি টেনে নেয় এবং নিজের মালের স্থলাভিষিক্ত করে নেয়। এই পার্থক্য বোঝার শর্তে একথারই দাবি করে যে, এখানে নতুন দখলের প্রয়োজন এবং ওখানে স্বত্বাধিকারীর দখলই তার প্রতি প্রত্যাবর্তিত হয়।

এ সময় একটুকু কথায় সংক্ষেপ করছি। যদি আপনারা জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান হয়ে থাকেন তাহলে এতটুকু কথায়ই মূল বক্তব্য বুঝে যাবেন। নতুবা আপনারা কিছু আপত্তি করবেন, তখন আমরাও ইনশাআল্লাহ আপনাদেরকে ক্যারিশমা দেখাবো।’

দুই. পুরুষরা নারীদের মালিক হতে পারে

দ্বিতীয় কথা হচ্ছে যে, যেভাবে দুনিয়ার সকল জিনিস দখলের কারণে মালিকানাধীন হতে পারে, ঠিক সেভাবে নারীরাও পুরুষদের মালিকানাধীন হতে পারে। কেননা কুরআনে করীমে উভয়ের জন্য একই ব্যাখ্যা এসেছে। বারী তাআলা ইরশাদ হচ্ছে,

هُوَ الَّذِيْ خَلَقَ لَكُمْ مَّا فِي الْاَرْضِ جَمِيْعًاۗ ۰۰۲۹

‘আল্লাহ সেই পবিত্র সত্তা, যিনি তোমাদের উপকারের জন্য সেই সব জিনিস সৃষ্টি করেছেন যা জমিনে বিদ্যমান।’[25]

আর পর্দানশিনদের প্রসঙ্গে বারী তাআলার ইরশাদ হচ্ছে,

وَمِنْ اٰيٰتِهٖۤ اَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِّنْ اَنْفُسِكُمْ اَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوْۤا اِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَّوَدَّةً وَّرَحْمَةًؕ ۠۰۰۲۱

‘আর আল্লাহ তাআলার নিদর্শনসমূহের মধ্যে এই যে, তিনি তোমাদের উপকারের জন্য তোমাদের মধ্য হতে স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন। যাতে তোমাদেরকে তাদের কাছে শান্তি মিলে এবং আল্লাহ তাআলা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।’[26]

لَام প্রকৃতপক্ষে স্বত্বাধিকার বোঝানোর জন্য। যেমন لِلّٰهِ مَا فِي السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِؕ۰۰۲۶[27]-এ لَام স্বত্বাধিকার বোঝানোর জন্য এসেছে। সুতরাং প্রথম আয়াত থেকে সাব্যস্ত হয় যে, পৃথিবীর সকল জিনিস মানুষের মালিকানাধীন। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার হেকমত সকল জিনিসের সৃষ্টির পেছনে মানুষের প্রয়োজনীয়তার ব্যবস্থা করা। কোনো জিনিস নিজস্ব সত্তায় কারও বিশেষ মালিকানাধীন নয়, বরং প্রত্যেক জিনিস প্রকৃত সৃষ্টিতত্ত্ব বিবেচনায় সকল মানুষের অংশীদারিত্ব। অর্থাৎ প্রত্যেক জিনিস একদিক দিয়ে সকলের মালিকানাধীন। হ্যাঁ, ঝগড়া নিষ্পন্ন করার জন্য এবং উপভোগকে সম্ভবপর করার জন্য দখলকে মালিকানার কারণ হিসেবে স্থির করা হয়েছে। এজন্য যতক্ষণ কোনো জিনিসের ওপর কোনো ব্যক্তির স্বতন্ত্র দখলস্বত্ব বজায় থাকে ততক্ষণ অন্য কোনো ব্যক্তি সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।

দ্বিতীয় আয়াতের বর্ণনাশৈলীও হুবহু সেটিই যা প্রথম আয়াতের। সুতরাং এ আয়াতের অর্থও এই হবে যে, সকল পর্দানশিন পুরুষদের মালিকানাধীন। অর্থাৎ পুরুষদের প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু অংশীদারিভাবে উপভোগের ক্ষেত্রে যেহেতু শক্ত ঝগড়ার আশঙ্কা রয়েছে, এজন্য বিশেষ মালিকানা জরুরি বলে স্থির হয় এবং এর জন্যও সাধারণ কারণ হিসেবে দখলকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে। আর বিয়ের আকদকে এজন্য মৌলিক উপকরণ গণ্য করা হয়েছে।

[متن ادلۂ کاملہ]

دوسری بات یہ ہے کہ جیسے بشہادت: خَلَقَ لَكُمْ مَّا فِي الْاَرْضِۗ۰۰۲۹ {البقرة: 29} مَا فِي الْاَرْضِ قابلِ ملکِ بنی آدم ہیں، ایسے ہی بدلالت خَلَقَ لَكُمْ مِّنْ اَنْفُسِكُمْ اَزْوَاجًاؕ۠۰۰۲۱ {الروم: 21} وغیرہ عورتیں قابلِ ملکِ شوہر ہیں، یہاں بھی وہی قبضہ ہوگا تو ملک ہوگی، نہیں تو نہیں۔

‘দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, যেভাবে خَلَقَ لَكُمْ مَّا فِي الْاَرْضِۗ۰۰۲۹ (তোমাদের জন্য পৃথিবীর সকল জিনিস সৃষ্টি করেছেন।)[28]-এর সাক্ষ্য দ্বারা দুনিয়ার সকল জিনিস আদম সন্তানের মালিকানার যোগ্য, অনুরূপভাবে خَلَقَ لَكُمْ مِّنْ اَنْفُسِكُمْ اَزْوَاجًاؕ۠۰۰۲۱ (তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন।)[29] ইত্যাদি নির্দেশ করে যে, নারীরা স্বামীর মালিকানার যোগ্য। এখানেও সেই দখল হবে তাহলে মালিক হবে। নতুবা নয়।’

তিন. বিয়ের প্রকৃতি হচ্ছে বিক্রয়

যদি কেউ একথা জিজ্ঞাসা করে যে, বিয়ের আকদের প্রকৃতি কী? অর্থাৎ স্বামী স্ত্রীকে উপভোগের যে অনুমিত রয়েছে তার ধরন কী? বিক্রয়ের ভিত্তিতে নাকি ভাড়ার ভিত্তিতে? কেননা এখানে মোটামুটি দুটি সম্ভাবনাই হতে পারে। হযরত (শায়খুল হিন্দ) u বলেন, বিয়ের আকদের প্রকৃতি হচ্ছে বিক্রয়, ভাড়া নয়। কেননা ভাড়ার জন্য হয় মেয়াদ নির্দিষ্ট হওয়া চায় অথবা কাজ সুনির্ধারিত হওয়া চায়। নতুবা ভাড়ার ভঙ্গ হবে। ফিকহের গ্রন্থসমূহে আছে যে,

‘ভাড়ার যথার্থতার জন্য মুনাফা সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া জরুরি। আর মুনাফা কখনো মেয়াদ নির্দিষ্ট করার দ্বারা জানা যায়। যেমন থাকার জন্য ঘর ভাড়ায় নেওয়া, চাষাবাদের জন্য জমি ভাড়ায় নেওয়া; সেই সময় ন্যায্য হবে যখন এর মেয়াদ নির্ধারণকৃত হবে। আর কখনো মুনাফা সম্পর্কে অবগতি কাজ সুনির্দিষ্ট হওয়ার মাধ্যমে হয়। উদারণত কাপড় রং করার জন্য কিংবা সেলাইয়ের জন্য কাউকে শ্রমিক হিসেবে রেখেছে অথবা আসবাবপত্র খোঁজার জন্য বা ভ্রমণের জন্য বাহন ভাড়ায় নিয়েছে; এসব অবস্থায় সেকাজের পরিপূর্ণ বিবরণ জানা জরুরি যার জন্য ভাড়ার কারবার করা হয়েছে।’

আর বিয়ের না তো কোনো মেয়াদ নির্দিষ্ট হয়, না কাজের কোনো সীমা নির্ধারিত হয়। এজন্য বিয়ে ভাড়ার কারবার হতে পারে না।

দ্বিতীয় দলিল হচ্ছে যে, যদি বিয়ে ভাড়ার (কারবার) হতো তাহলে উচিত ছিল যে, মুতা (নির্দিষ্ট মেয়াদের বিয়ে) ন্যায্য হতো, প্রচলিত বিয়ে যা স্থায়ীভাবে হয়ে থাকে এবং যেখানে কোনো মেয়াদ নির্ধারিত হয় না যথাযথ হতো না।

তৃতীয় দলিল হচ্ছে যে, খোলা ও তালাক হচ্ছে একতরফা পদক্ষেপ। তালাকের পরিপূর্ণ এখতেয়ার হল স্বামীর আর খোলার প্রস্তাব স্ত্রীর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। কাজেই তালাক ই’তাক (গোলাম আজাদ করা)-এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, যা মনিবের পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে এবং খোলা[30] আকদে কিতাবতে[31]র সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, যা মালিকাধীনের ইচ্ছায় হয়ে থাকে। আর এটি সেসময়ই হতে পারে যখন বিয়ের প্রকৃতি হবে বিক্রয়, ভাড়া হবে না।

[متن ادلۂ کاملہ]

تیسری بات یہ ہے کہ عقدِ نکاح کو بیع نہ کہیے تو اجارہ کہنا پڑے گا، مگر اجارہ کہیے تو اُس کے بُطلان کے لئے یہی کافی ہے کہ نہ اَجَل معلوم، نہ کار محدود، پھر جائز ہو تو کیونکر ہو؟ اگر اجارہ ہوتا تو نکاح بطور معروف جائز نہ ہوتا، ہوتا تو متعہ جائز ہوتا، اُدھر طلاق یک طرفی اُس اِعْتاق کے مُشابہ ہے، جو مالک ہی کی طرف سے ہوتا ہے، اِدھر خُلع کا مُشابہ کتابت ہونا اس بات پر شاہد ہے کہ یہاں بھی ملک ہی ہوگی، جو یہ لَیْن دِین ہے۔

‘তৃতীয় কথা হচ্ছে যে, বিয়ের আকদকে বিক্রয় না বললে তো ভাড়া বলতে হবে। কিন্তু ভাড়া বললে তো এর অসারতার জন্য এটিই যথেষ্ট যে, না মেয়াদ জানা আছে, না কাজ নির্দিষ্ট। সুতরাং জায়েয হলে কীভাবে হবে? যদি ভাড়া হত তাহলে প্রচলিত বিয়ে জায়েয হত না, হলে তো মুতাও জায়েয হত। অন্য দিকে একতরফা তালাক গোলাম আজাদ করার সাথে সাদৃশ্য রাখে, যা মনিবের পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে। এ দিকে খোলার সাদৃশ্য কিতাবতের সাথে হওয়া একথার সাক্ষ্য দেয় যে, এখানেও মালিকানা হবে, এটি যাকে লেনদেন (বলা হয়)।’

চার. বিয়েতে কোন জিনিসের বিক্রয় হয়?

যখন একথা সাব্যস্ত হয় যে, বিয়ের প্রকৃতি হচ্ছে বিক্রয়। তো এখন এ প্রশ্নের জন্ম হবে যে, বিয়ের আকদের মাধ্যমে নারীরা কোন জিনিসটি স্বামীকে বিক্রি করে? (সে) কি নিজের পুঁজি (সারাশরীর) বিক্রি করে? নাকি শুধু নিজের স্ত্রীজননেন্দ্রিয় (জন্মদান ও প্রজননের যোগ্যতা) বিক্রি করে? তবে জেনে নেওয়া চায় যে, বিয়েতে নারীরা সারাশরীর বেচাকেনা করে না, নারীরা নিজের সারাশরীর বিক্রয়ের অনুমতিপ্রাপ্তও নয়। বরং লেনদন স্রেফ স্ত্রীজননেন্দ্রিয়েরই হয়ে থাকে, অবশিষ্ট শরীর নারীদেরই মালিকানায় থাকে।

আত্মা শরীরের ওপর দখলদার

আর এর কারণ হচ্ছে যে, আত্মা শরীরের ওপর দখল রাখে এবং শরীরের ওপর আত্মার দখল নামমাত্র নয়, বরং অত্যন্ত উচ্চস্তরের দখল। এই দখলের মাধ্যমে মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে উপকার লাভ করে। যদি শরীরের ওপর আত্মার দখল না হবে তাহলে অন্যান্য প্রাণীতে উপকাল লাভ করাও অসম্ভব ও অসাধ্য হবে।

জীব-জন্তু থেকে উপকার লাভের বৈধতার কারণ

বাকি থাকল একথা যে, যদি শরীরের ওপর আত্মার দখল না হবে তাহলে অন্যান্য প্রাণী থেকে উপলাভও অসাধ্য হবে। তো এর কারণ হচ্ছে যে, মানুষসহ সকল প্রাণীর শরীরের মালিক হচ্ছে তাদের আত্মা। আর সকল আত্মার মালিক হচ্ছেন আল্লাহ তাআলা এবং আল্লাহ তাআলার মালিকানাই পূর্ণাঙ্গ। এজন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষে তাঁর সকল সৃষ্টির মধ্যে সর্বপ্রকার নিষ্পত্তির অধিকার রয়েছে। এ দিকে মানুষকে আল্লাহ তাআলা আশরফুল মাখলুকাত (সৃষ্টির সেরা জীব) বানিয়েছেন এবং সেরা জীবের জন্য নগণ্য জীবকে কাজে লাগানো এক সাধারণ নিয়ম। এজন্য মহান প্রজ্ঞাবান (আল্লাহ) তাঁর শ্রেষ্ঠতম জীবকে অনুমতি দিয়েছেন যে, সে অন্যান্য প্রাণী থেকে উপকার লাভ করবে এবং খোদায়ী অনুমতিতে তাদেরকে জবাই করে খাবে। আর অনুমতিপত্র হিসেবে তাসমিয়া (আল্লাহর নাম নেওয়া) নির্ধারণ করা হয়েছে। কাজেই যে ব্যক্তি আত্মাসমূহের মালিকের অনুমতিক্রমে অন্যান্য প্রাণী থেকে উপকার লাভ করে সে কোনোভাবেই জালিম হতে পারে না। জালিম হচ্ছে শুধু কাফেররা (অবাধ্য লোক), যাদেরকে আত্মাসমূহের মালিক অনুমতি দেননি, তারপরও তারা প্রাণীদের জবাই করে এবং খেয়ে থাকে।

মোদ্দা কথা হচ্ছে, ভালোভাবে স্মরণ রাখা উচিত যে, প্রাণীসমূহ হালাল হওয়ার প্রকৃত কারণ জবাই নয়, বরং হালাল হওয়ার সাধারণ কারণ হচ্ছে আত্মাসমূহের মালিকের অনুমতি এবং জবাই ও তাসমিয়া নিছক হালাল হওয়ার অনুমতিপত্র। এ কারণে হারাম শরীফে তাসমিয়া-সহকারে জবাই করা সত্ত্বেও শিকার করা হারাম হয়ে থাকে। কেননা আত্মাসমূহের মালিক হারামে শিকার করে মানুষকে উপকার লাভের অনুমতি দেননি। সঙ্গে সঙ্গে ইহরামকারী যদি তাসমিয়া-সহকারে কোনো শিকারকে জবাই করে তাহলে সেটাও হারাম হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে মুমিন (ব্যক্তি) খাবার অনুপযোগী প্রাণীদেরকে বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবর বলে জবাই করে, তা হলেও সেটা খাওয়া হারাম। কেননা আত্মাসমূহের মালিক এসব প্রাণী থেকে উপকার লাভের অনুমতি দেননি।

মানুষের শরীর সম্পদ

অন্য দিকে প্রত্যেক প্রাণীর শরীর বিশেষ করে মানুষের শরীর সম্পদ। কেননা সম্পদ প্রত্যেক সেই উপকারী জিনিসকে বলা হয় যার প্রতি হৃদয় আকর্ষিত হয়, যা সংরক্ষিত ও মালিকাধীন হতে পারে এবং এর লেনদেন হওয়া সম্ভব। আর প্রাণীর শরীর উপকারী হওয়া এবং তাদের প্রতি হৃদয় আকর্ষিত হওয়া এটি স্পষ্ট বিষয়। মানুষের শরীরের ক্ষেত্রে একই অবস্থা। কেননা এর প্রতি হৃদয় আকর্ষিত হয়। অন্যান্য জিনিস মানুষের শরীরের সংরক্ষণ ও সুরক্ষারই কারণে উপকারী হয়ে থাকে এবং সম্পদ আখ্যায়িত হয়। সুতরাং খোদ মানুষের শরীর উপকারী ও সম্পদ কেন হবে না?

মানুষ নিজের শরীরের মালিক

বস্তুত যখন শরীরের ওপর আত্মার দখল পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ এবং এ কারণে আত্মা শরীরের পরিপূর্ণ মালিক, কাজেই শরীরও আত্মার পুরোপুরি মালিকানাধীন হবে। কেননা মালিক হওয়ার জন্য দখল জরুরি, যে পরিমাণ দখল পরিপূর্ণ হবে সেই পরিমাণ মালিকানা পুরোপুরি হবে। আর মালিকানাধীন হওয়ার জন্য সম্পদ হওয়া জরুরি, সম্পদ হওয়া যে পরিমাণ বৃদ্ধি হবে সেই পরিমাণ মালিকানাধীন হওয়া শক্তিশালী ও মজবুত হবে। সারাংশ হচ্ছে, মানুষ নিজের শরীরের মালিক এবং শরীর আত্মার মালিকানাধীন।

নারীরা তার শরীর বিক্রি করতে পারে না

বিস্তারিত এ বিবরণ থেকে একথা স্পষ্ট হয় যে, নারীরা যদিও নিজের শরীরের পরিপূর্ণ মালিক, কিন্তু সে তা বিক্রি করতে পারবে না। কেননা প্রজননের উপকারিতা (সন্তান জন্মদানের উপকারিতা) ছাড়া শরীরের অন্যান্য উপকারিতা থেকে নিজে উপকার লাভ করতে পারবে; চোখ দিয়ে দেখতে পারবে, কান দিয়ে শুনতে পারবে, মুখ দিয়ে বলতে পারবে, وَقِسْ عَلَىٰ هَذَا (এর ওপর সবকিছু অনুমান করুন)। অতএব নারীরা প্রজননের উপকারিতা ছাড়া নিজের অবশিষ্ট শরীর বিক্রি করতে পারবে না আর এর দলিল নিম্নে প্রদত্ত হল:

  1. প্রথম দলিল: হচ্ছে যে, অন্য কারও পক্ষে নারীর শরীরের মালিক হওয়ার অধিকারই নেই। কেননা শরীর বিশেষত তারই আত্মার জন্য সৃষ্ট হয়েছে। আর বিক্রয় শুধু সেসব জিনিসে বৈধ হয়ে থাকে যা সকলের জন্য তৈরি হয়েছে। যেমন مَا فِي الْاَرْضِۗ۰۰۲۹ (পৃথিবীর সকল জিনিস)[32] সকলের জন্য সৃষ্টি হয়েছ। যুক্তি ব্যতিরেকে خَلَقَ لَكُمْ مَّا فِي الْاَرْضِۗ۰۰۲۹ (তিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীর সকল জিনিস সৃষ্টি করেছেন।)[33] পবিত্র আয়াতও এর প্রমাণ। এজন্য পৃথিবীর সকল জিনিসের বিক্রয় হতে পারে, কিন্তু নারীর শরীর যেহেতু তার জন্যই সৃষ্ট হয়েছে সেহেতু না সে বিক্রয়ের অনুমতিপ্রাপ্ত, না অন্য কেউ মালিক হওয়ার অধিকার রাখে।
  2. দ্বিতীয় দলিল: হচ্ছে যে, বিক্রয়ে অসম্মানবোধ রয়েছে। কেননা মানুষ সেই জিনিসই বিক্রি করে যা থেকে তার হৃদয় ওঠে যায়। তাছাড়া ফুকাহায়ে কেরাম বায়য়ে ফাসিদ (বেআইনি বিক্রয়) প্রাসঙ্গিক আলোচনায় নারীদের দুধ ও মানুষের চুল ইত্যাদির বিক্রয় বেআইনি হওয়ার কারণ হিসেবে সম্মানহানি ও অপমানকে উল্লেখ করেছেন। মানুষ আশরফুল মাখলুকাত (সৃষ্টির সেরা জীব), কাজেই তার সম্মান এবং তাকে অসম্মানের অধিকার একমাত্র আল্লাহ তাআলারই। এজন্য আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও কাছে চাওয়াও নিষিদ্ধ। কেননা চাওয়াও একপ্রকারের অপমানজনক। নবীজি (D)-এর ইরশাদ হচ্ছে, «الْيَدُ الْعُلْيَا خَيْرٌ مِّنَ الْيَدِ السُّفْلَىٰ» (উপরের হাত অর্থাৎ খরচকারী হাত নীচের হাত অর্থাৎ যাচ্ঞাকারীর চেয়ে উত্তম)।[34]

এখান থেকে একথাও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, যখন আল্লাহ ছাড়া কারও কাছে চাওয়াও বৈধ নয়, তো আল্লাহ ছাড়া কারও ইবাদতের প্রশ্নই কোথা থেকে উঠতে পারে? কোনো মানুষের জন্যই নিজের মালিক ও মনিবের দরবার ছাড়া অন্য কারো চৌকাঠে কপাল বিচড়ানো শুভা দেয় না। মানুষ নিজে নিজেকে স্বীয় স্রষ্টা ও মালিকের সামনে তো সর্বনিম্ন স্তরের অপমানিত (হিসেবে উপস্থাপিত) করতে পারে, বরং এটা তার জন্য গর্বের কারণ। কিন্তু অন্য কারও সামনে অপমানজনক কপাল ঠেকা সম্ভব নয়। না নিজের আত্মসম্মানের সওদা করতে করতে পারে। সুতরাং নারী নিজের শরীর বিক্রি করে অহেতুক নিজেকে নিজে কেন অপমানিত করবে?!

  1. তৃতীয় দলিল: হচ্ছে যে, বিক্রয়ে শর্ত আরোপ করার ক্ষেত্রে হাদীস শরীফে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আর ফুকাহায়ে কেরাম এমন বিক্রয় যেখানে চুক্তির দাবির বিপরীতে কোনো শর্ত আরোপ করা হয়েছে (সেটা) বেআইনি বলে বিবেচতি হয়েছে। এর ভিত্তিতে যদি নারী তার শরীর বিক্রি করে দেয়, তাহলে বিক্রীত জিনিসের হস্তান্তর এবং বিক্রীত জিনিস থেথে উপকার লাভ বিক্রেতার সাহায্য ছাড়া অর্থাৎ নারীর আত্মার সহযোগিতা ব্যতিরেকে সম্ভব নয়। এই অতিরিক্ত শর্ত ছাড়া নারী তার শরীর বিক্রিই করতে পারে না। আর এমন অতিরিক্তি শর্তের সাথে বিক্রয় বিক্রয়কে বেআইনি করে দেয়। কাজেই নারী কিংবা অন্য কোনো ব্যক্তি খোদ নিজের শরীর বিক্রি করতে চাইলে বিক্রি করতে পারে না।

ফায়েদা: হ্যাঁ, যদি কোনো ব্যক্তি কারও গোলাম বা মালিকানাধীন হয় এবং সে তার মনিবের সাথে কিতাবতের চুক্তি করে নিজের শরীরকে ক্রয় করে নেয় অর্থাৎ স্বাধীনতা লাভ করে তাহলে এটি জায়েয। কেননা এ ধরনের বিক্রয়ে কোনো অতিরিক্ত শর্ত নেই।

নারীরা শুধু তার প্রজননের

উপকারিতা বিক্রি করতে পারবে

অবশ্য নারীরা নিজের প্রজননের উপকারিতা বিক্রি করতে পারবে। কেননা নারীরা নিজেরা নিজেদের এসব উপকারিতা থেকে উপকৃত হতে পারে না। এজন্য এ বিশেষ লেনদেনে নারীদের অবস্থা জড়বস্তু যেমন; যেভাবে জড়বস্তু নিজে নিজ থেকে উপকৃত হতে পারে না, নারীরও নিজেদের যোনি ও গর্ভাশয় থেকে উপকৃত হতে পারে না। এ কারণে তারা এটি স্বামীর কাছে বিক্রি করতে পারে।

নারীরা তার প্রজননের উপকারিতা

কেন বিক্রি করতে পারে?

যদি কেউ একথা জিজ্ঞাসা করে যে, আল্লাহ পাক যোনি ও গর্ভাশয় নারীদের জন্য বানিয়েছেন, তাহলে তা অন্যদেরকে কীভাবে বিক্রি করতে পারে? এর এক জবাব তো তা-ই যা ইতঃপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে, নারী যেহেতু নিজের সাধারণ শরীরের মতো নিজের যোনি ও গর্ভাশয় দ্বারা নিজে উপকৃত হতে পারে না, এজন্য তা বিক্রি করা জায়েয। আর দ্বিতীয় জবাব হচ্ছে যে, خَلَقَ لَكُمْ مِّنْ اَنْفُسِكُمْ اَزْوَاجًاؕ۠۰۰۲۱ (তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন।)[35] থেকে একথা সাব্যস্ত হয় যে, নারীদের গর্ভাশয় ও প্রজননের উপকারিতা তার জন্যই নয়, বরং পুরুষদের জন্য। এজন্য নারীরা যদি নিজেদের প্রজননের উপকারিতা পুরুষদেরকে বিক্রি করে দেয় তাহলে তাতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

প্রজননের উপকারিতা বিক্রয়ে কোনো সম্মানহানি নেই

যদি কেউ এ আপত্তি করে যে, বিক্রয় তো অপমানজনক কথা, তবুও নারীরা নিজেদের যোনি ও গর্ভাশয় বিক্রয়ের এখতিয়ার কীভাবে পেল? এর জবাব হচ্ছে যে, অপমান হচ্ছে প্রকৃত মর্যাদায় হ্রাস পাওয়ার নাম, সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে কাজে লাগানো কোনোভাবেই অপমানের কথা নয়। উদারণত মানুষ সৃষ্টির মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর বন্দেগি। এজন্য আল্লাহ পাকের বন্দেগি করা অর্থাৎ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিজেকে নিজে বিনয়াবনত করা কোনোভাবেই অপমানের কথা নয়। কেননা আল্লাহর বন্দেগি করা নিজের সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে পূরণ করা। হ্যাঁ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সামনে নিজেকে অপমানিত করা প্রকৃত মর্যাদায় হ্রাস করার নামান্তর। এজন্য এটা জায়েয নেই। অনুরূপভাবে বোঝা উচিত যে, প্রজননের উপকারিতা নারীদের জন্য সৃষ্টি করা হয়নি, বরং পুরুষদের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। অতএব নারী যদি সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে কাজে লাগায় তাহলে এতে প্রকৃত মর্যাদায় কোনো হ্রাস হয় না এবং এ বিক্রয়ে নিজেকে অপমানিত করাও আরোপিত হয় না।

প্রজননের উপকারিতা বিক্রয়ে

কোনো সমস্যা আরোপিত হয় না

যদি কারও মনে এমন সংশয়ের সৃষ্টি হয় যে, যেভাবে অবশিষ্ট শরীর বিক্রয়ের অবস্থায় অতিরিক্ত শর্তের কারণে বিক্রয় বেআইনি হয়ে যায়, অনুরূপভাবে প্রজননের উপকারিতা বিক্রয়ের অবস্থায়ও পুরুষ নারীর আত্মিক সহযোগিতা ছাড়া উপকারিতা লাভ করতে পারে না। কাজেই এ বিক্রয়ও অতিরিক্ত শর্তের কারণে বেআইনি হওয়া উচিত?

এর জবাব হচ্ছে যে, এ অবস্থায় অতিরিক্ত এ শর্ত চুক্তির দাবির সাথে সাংঘর্ষিক নয়, বরং চুক্তির দাবি। আর এ ধরনের শর্ত যাকে স্বয়ং চুক্তিই দাবি করে বিক্রয়ে নিষিদ্ধ নয়। সেই শর্তই শুধু নিষিদ্ধ হয় যা বিক্রয়ের দাবি নয় এবং এতে চুক্তি সম্পাদনকারী একপক্ষের উপকার হয়। কেননা এ ধরনের শর্ত হচ্ছে রিবা (সুদ[36])। এজন্য বিক্রীত পণ্য ও মূল হচ্ছে একটি অপরটির বিনিময় এবং অতিরিক্ত শর্তের বিপরীতে কোনো বিনিময় থাকবে না। কাজেই অতিরিক্ত শর্ত সুদ হিসেবে গণ্য হওয়ার কারণে নিষিদ্ধ। কিন্তু যে শর্ত চুক্তির দাবিসম্মত, যেমন বিক্রয়ে দখলের শর্ত দেওয়া। এটি তো প্রকৃতপক্ষে কোনো শর্ত নয়, বরং অস্পষ্ট বিষয়ের বিবরণ, এজন্য এমন শর্ত আরোপ করা বৈধ।

আলোচনার সারসংক্ষেপ

এ দীর্ঘ আলোচনার সারসংক্ষেপ হচ্ছে, যেহেতু আত্মা তার শরীরের ওপর দখল বজায় রেখেছে এবং শরীর হচ্ছে সম্পদ, সেহেতু আত্মা মালিক ও শরীর মালিকানাধীন। যখন নারী তার শরীরের মালিক, তো সে নিজের প্রজননের উপকারিতা স্বামীর হাতে বিক্রি করতে পারবে। কেননা তাকে স্বামীর উপকারের জন্য সৃষ্ট হযেছে। আর অবশিষ্ট শরীর বিক্রি করতে পারবে না, কেননা তা নারীর নিজের উপকারের জন্য সৃষ্ট হয়েছে।

(চলবে)

[1] أَمْلَاكٌ:مِلْكٌ -এর বহুবচন। আর مُرْسَلَةٌ –এর তালাকপ্রাপ্ত ও ছেড়ে দেয়া। মিলকে মুরসালের দাবি হচ্ছে যার কোনো নির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করা হয়নি। উদারণত কোনো মানুষ দাবি করছে যে, এই ঘর, এই জমি আমার এবং এর স্বপক্ষে কোনো কারণ বর্ণনা করেনি যে, সে এই সম্পত্তি ক্রয় করেছে বা মিরাসে পেয়েছে কিংবা কেউ দানপত্র করেছে। দাবিদার তার দাবির পক্ষে মিথ্যা সাক্ষী উপস্থাপন করে বিচারপতির পক্ষ থেকে নিজের স্বপক্ষে ফয়সলা করিয়ে নেয়। তা হলে বিচারপতির এই ফয়সলা ‍শুধু প্রত্যক্ষভাবেই কার্যকর হবে। কেননা মিলকে মুরসালের দাবি, কোনো চুক্তিসম্মত দাবি নয়।

[2] ইবনে কুদামা, আল-মুগনী, খ. ১০, পৃ. ৪৫

[3] আল-মারগীনানী, আল-হিদায়া ফী শরহি বিদায়াতুল মুবতাদী, খ. 4, পৃ. 332

[4] মুহাম্মদ ইবনুল হাসান আশ-শায়বানী, কিতাবুল আসল, মাতবাআতু মাজলিসি দায়িরাতিল মাআরিফ আল-উসমানিয়া হায়দরাবাদ, দাক্ষিণাত্য, ভারত (প্রথম সংস্করণ: ১৩৮৬ হি. = ১৯৬৬ খ্রি.), খ. ৪, পৃ. ১৮

[5] আল-বুখারী, আস-সহীহ, খ. ৩, পৃ. ১৮০, হাদীস: ২৬৮০

[6] আল-বুখারী, আস-সহীহ, খ. ৩, পৃ. ১৩১, হাদীস: ২৪৫৮ ও খ. ৯, পৃ. ৭২, হাদীস: ৭১৮১

[7] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-আনআম, ৮:৭৩

[8] (ক) ইবনে কুদামা, আল-মুগনী, খ. ১০, পৃ. ৫৩; (খ) যফর আহমদ উসমানী, লাউস সুনান, খ. ১২, পৃ. ৬৭০১, হাদীস: ৪৯২৮; (গ) আল-জাস্সাস, আহকামুল কুরআন, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪১৫ হি. = ১৯৯৪ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ৩০৬, তিনি বর্ণনা করেন,

عَنْ عَمْرِو بْنِ الْـمِقْدَامِ، عَنْ أَبِيْهِ، أَنَّ رَجُلًا مِنَ الْـحَيِّ خَطَبَ امْرَأَةً وَهُوَ دُوْنَهَا فِي الْـحَسَبِ، فَأَبَتْ أَنْ تُزَوَّجَهُ، فَادَّعَىٰ أَنَّهُ تَزَوَّجَهَا وَأَقَامَ شَاهِدَيْنِ عِنْدَ عَلِيٍّ، فَقَالَتْ: إنِّيْ لَـمْ أَتَزَوَّجْهُ، قَالَ: قَدْ زَوَّجَكِ الشَّاهِدَانِ; فَأَمْضَىٰ عَلَيْهِمَا النِّكَاحَ.

[9] আল-জাস্সাস, আহকামুল কুরআন, খ. ১, পৃ. ৩০৬, তিনি বর্ণনা করেন,

وَأَمَّا ابْنُ عُمَرَ، فَإِنَّهُ بَاعَ عَبْدًا بِالْبَرَاءَةِ، فَرَفَعَهُ الْـمُشْتَرِيْ إلَىٰ عُثْمَانَ، فَقَالَ عُثْمَانُ: أَتَحْلِفُ بِاللهِ مَا بِعْتَهُ وَبِهِ دَاءٌ كَتَمْتَهُ؟ فَأَبَىٰ أَنْ يَحْلِفَ; فَرَدَّهُ عَلَيْهِ عُثْمَانُ، فَبَاعَهُ مِنْ غَيْرِهِ بِفَضْلٍ كَثِيْرٍ، فَاسْتَجَازَ ابْنُ عُمَرَ بَيْعَ الْعَبْدِ مَعَ عِلْمِهِ بِأَنَّ بَاطِنَ ذَلِكَ الْـحُكْمِ خِلَافُ ظَاهِرٍ، وَأَنَّ عُثْمَانَ لَوْ عَلِمَ مِنْهُ مِثْلَ عِلْمِ ابْنِ عُمَرَ لَـمَا رَدَّهُ، فَثَبَتَ بِذَلِكَ أَنَّهُ كَانَ مِنْ مَذْهَبِهِ أَنَّ فَسْخَ الْـحَاكِمِ الْعَقْدَ يُوْجِبُ عَوْدَهُ إلَىٰ مِلْكِهِ وَإِنْ كَانَ فِي الْبَاطِنِ خِلَافَهُ.

[10] আল-জাস্সাস, আহকামুল কুরআন, খ. ১, পৃ. ৩০৬-307, তিনি বর্ণনা করেন,

وَمِمَّا يَدُلُّ عَلَىٰ صِحَّةِ قَوْلِ أَبِيْ حَنِيْفَةَ فِيْ ذَلِكَ حَدِيْثُ ابْنِ عَبَّاسٍ فِيْ قِصَةِ هِلَالِ بْنِ أُمَيَّةَ وَلِعَانِ النَّبِيِّ ﷺ بَيْنَهُمَا، ثُمَّ قَالَ: «إنْ جَاءَتْ بِهِ عَلَىٰ صِفَةِ كَيْتَ وَكَيْتَ فَهُوَ لِـهِلَالِ بْنِ أُمَيَّةَ، وَإِنْ جَاءَتْ بِهِ عَلَىٰ صِفَةٍ أُخْرَىٰ فَهُوَ لِشَرِيْكِ ابْنِ سَحْمَاءَ الَّذِيْ رُمِيَتْ بِهِ»، فَجَاءَتْ بِهِ عَلَى الصِّفَةِ الْـمَكْرُوْهَةِ، فَقَالَ النَّبِيُّ ﷺ: «لَوْلَا مَا مَضَىٰ مِنْ الْأَيْمَانِ لَكَانَ لِيْ وَلَـهَا شَأْنٌ»، وَلَـمْ تَبْطُلْ الْفُرْقَةُ الْوَاقِعَةُ بِلِعَانِهِمَا مَعَ عِلْمِهِ بِكَذِبِ الْـمَرْأَةِ وَصِدْقِ الزَّوْجِ، فَصَارَ ذَلِكَ أَصْلًا فِيْ أَنَّ الْعُقُوْدَ وَفَسْخَهَا مَتَىٰ حَكَمَ بِهَا الْـحَاكِمُ مِمَّا لَوْ ابْتَدَأَ أَيْضًا بِحُكْمِ الْـحَاكِمِ وَقَعَ.

[11] আল-জাস্সাস, আহকামুল কুরআন, খ. ১, পৃ. ৩০৬, তিনি বর্ণনা করেন,

قَالَ أَبُوْ يُوْسُفَ: وَكَتَبَ إلَيَّ شُعْبَةُ بْنُ الْـحَجَّاجِ يَرْوِيْهِ عَنْ زَيْدٍ، أَنَّ رَجُلَيْنِ شَهِدَا عَلَىٰ رَجْلٍ أَنَّهُ طَلَّقَ امْرَأَتَهُ بِزُوْرٍ، فَفَرَّقَ الْقَاضِيْ بَيْنَهُمَا، ثُمَّ تَزَوَّجَهَا أَحَدُ الشَّاهِدَيْنِ، قَالَ الشَّعْبِيُّ: ذَلِكَ جَائِزٌ.

[12] আল-জাস্সাস, আহকামুল কুরআন, খ. ১, পৃ. ৩০৫

[13] আল-বুখারী, আস-সহীহ, খ. ৩, পৃ. ১৩১, হাদীস: ২৪৫৮ ও খ. ৯, পৃ. ৭২, হাদীস: ৭১৮১

[14] আল-বুখারী, আস-সহীহ, খ. ৩, পৃ. ১৮০, হাদীস: ২৬৮০

[15] ইবনে আবিদীন, রদ্দুল মুহতার আলাদ দুররিল মুখতার, খ. ৫, পৃ. ৪০৬

[16] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আত-তওবা, ৯:৬০

[17] আল-বরকতী, কাওয়ায়িদুল ফিকহ, আস-সদফ পাবলিশার, করাচি, পাকিস্তান (প্রথম সংস্করণ: ১৪০৭ হি. = ১৯৮৬ খ্রি.), পৃ. ১২৮, কায়েদা: ২৪৬

[18] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আন-নিসা, ৪:১১

[19] مُتَخَلَّفْ: পেছনে, পৃথক।

[20] حدوث: সৃষ্টি হওয়া।

[21] بیع قبل القبض: বিক্রিত জিনিস বুঝে নেওয়ার পূর্বে বিক্রয় করা।

[22] پر: এর।

[23] مُتَصَوَّر: সম্ভব, কল্পনায় আনা।

[24] یہاں: অর্থাৎ ক্রয়বিক্রয়ে।

[25] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-বাকারা, ২:২৯

[26] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আর-রূম, ৩০:২১

[27] আল-কুরআনুল করীম, সূরা লোকমান, ৩১:২৬

[28] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-বাকারা, ২:২৯

[29] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আর-রূম, ৩০:২১

[30] খোলা: এটি স্ত্রী স্বামী থেকে কিছু মোহর বা পুরো মোহর মাফ করার ভিত্তিতে বা সেই সঙ্গে অন্য কোনো সম্পদের ভিত্তিতে পরিত্রাণ লাভ করে।

[31] আকদে কিতাবত: এটি কোনো গোলাম-বাঁদি তার মনিব থেকে নির্দিষ্ট অঙ্ক আদায়ের শর্তে আজাদি লাভের কারবার।

[32] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-বাকারা, ২:২৯

[33] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-বাকারা, ২:২৯

[34] (ক) আল-বুখারী, আস-সহীহ, খ. ২, পৃ. ১১২, হাদীস: ১৪২৯; (খ) মুসলিম, আস-সহীহ, খ. ২, পৃ. ৭১৭, হাদীস: ১০৩৩, হাদীসটি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর k থেকে বর্ণিত

[35] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আর-রূম, ৩০:২১

[36] সুদ: সেই বর্ধিত অংশ যার বিপরীতে কোনো বিমিনয় নেই।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ