বাংলাদেশ নিয়মিতভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলির মধ্যে নিজেকে খুঁজে পায়। সরকারি খাতগুলো দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত। ২০২২ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি উপলব্ধি সূচকে, যা ১৮০টি দেশের পাবলিক সেক্টরকে ০ থেকে স্কোর করেছে (অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত)। স্কোর দ্বারা র্যাংকিং করা হলে, সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৭তম, যেখানে দেশটি সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি খাত হিসেবে বিবেচিত হয়। তুলনা করার জন্য, সেরা স্কোর ছিল ৯০ (র্যাংক ১), সবচেয়ে খারাপ স্কোর ছিল ১২ (র্যাংক করা হয়েছে ১৮০), এবং গড় স্কোর ছিল ৪৩। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের অ্যাক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড. ইফতেখারুজ্জামান ২০২০ সালে দুর্নীতি উপলব্ধিসূচক উপস্থাপন করে মন্তব্য করেন, দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে, বাংলাদেশ স্কোর এবং র্যাংক উভয় ক্ষেত্রেই দ্বিতীয় সর্বনিম্ন, শুধুমাত্র আফগানিস্তানের চেয়ে ভালো। (Dhaka Tribune, 28 January 2021, Retrieved 30 November 2021)
সমীক্ষায় মন্তব্য করা হয়েছে, বাংলাদেশের সরকারি অফিসগুলোতে দুর্নীতির ব্যাপকতা রয়েছে। অনেক কর্মকর্তা কোনো প্রকৃত কাজ না করেই বেতন পান। কর্মকর্তাদের নিয়োগ এবং পদোন্নতি দেওয়া হয় যে কারণে বস্তুনিষ্ঠভাবে স্পষ্ট নয়। ঘুষ চাওয়া সাধারণ ব্যাপার। ২০১৩ সালের একটি সমীক্ষায়, ৭৬% উত্তরদাতা বলেছেন যে দুর্নীতি সরকারি ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা, এবং ৩৯% বলেছেন যে তারা আগের ১২ মাসে ঘুষ দিয়েছেন। পুলিশ (৭২%), বিচার বিভাগ (৬৩%), ভূমি পরিষেবা (৪৪%) এবং রেজিস্ট্রি ও পারমিট পরিষেবাগুলি (৩৩%) নিয়ে কাজ করার সময় ঘুষ বিশেষত সাধারণ ছিল। একটি পরিষেবা (৫৮%), পরিষেবার গতি বাড়ানোর জন্য (৩৩%), ধন্যবাদ জানাতে (৭%) বা সস্তা পরিষেবা পেতে (৩%) ঘুষ দেওয়া হয়েছিল। এই সংখ্যাগুলো যদিও অপ্রীতিকর, ২০১০ সালের তুলনায় একটি উল্লেখযোগ্য উন্নতি চিহ্নিত করে৷ (Transperancy International, Bangladesh Chapter)
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের জরিপে দেখা গেছে, গতবছর প্রায় ৭১ শতাংশ বাড়িকে সেবা পেতে দুর্নীতি সহ্য করতে হয়েছে, যা চার বছর আগের তুলনায় ৪.৩ শতাংশ বেশি।
দেশব্যাপী ১৫,৪৫৪টি বাড়িতে ‘পরিষেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় গৃহস্থালি জরিপ ২০২১’ উন্মোচন করে, টিআইবি বলেছে যে, সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত সেবা খাত ছিল পুলিশ এবং এর বিভিন্ন শাখা, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট বিভাগ এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ। গতবছর পরিবারগুলোকে আনুমানিক ১০,৮৩০কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়েছিল, যা দেশের জিডিপির ০.৪ শতাংশ এবং ২০২০-২০২১ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ৫.৯ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, গতবছর সেবা পেতে প্রতিটি বাড়িতে গড়ে ৬ হাজার ৬৩৬ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। এ প্রতিবেদন দেশের সামগ্রিক দুর্নীতির একটি পার্শ্বচিত্র মাত্র। দুর্নীতি দমন কমিশন বা র্যাব বা পুলিশ অপরাধীদের ধরে ন্যায় বিচারের জন্য আদালতে সোপর্দ করে আসছে তার সংখ্যা অতিমাত্রায় ক্ষুদ্র। মূল অপরাধী হাজারগুণ বেশি। অনেক অপরাধী এত প্রভাবশালী যে, তাদের টিকিটি স্পর্শ করার করার ক্ষমতা ও সাধ্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নেই।
বাংলাদেশে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ঘুষবাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খাদ্যে ভেজাল, ব্যাংকলুট, অর্থপাচার, বিদেশে বাড়ি নির্মাণ, মাদক ব্যবসা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্বৃত্তপনা, সিন্ডিকেট করে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মামলা দায়ের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার বললে কম হবে। বলতে গেলে অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সততা, সাধুতা, পরোপকার, জনকল্যাণ, মানবিকতা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দেশসেবার মহৎ গুণাবলি ধীরে ধীরে লোপ পেতে চলেছে। যে যেখানে আছে সেখান থেকে যেনতেন প্রকারে টাকা বানানোর ধান্ধা, লুটেপুটে খাওয়ার মানসিকতা স্থায়ী রূপ পরিগ্রহ করেছে। সুযোগ পেলেই অবৈধ অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়া এখন আর অপরাধ মনে করছে না কেউ। শুরু হয়েছে দুর্নীতির অসুস্থ প্রতিযোগিতা। ঘুষের নতুন নাম এখন ‘স্পিডমানি।’ একটা স্বাধীন জাতির জন্য এটা কত বড় দুর্ভাগ্য ভাবতে গা শিউরে উঠে। যারা জনগণের সম্পদ লুঠ করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তারা কোনোক্রমে দেশপ্রেমিক হতে পারে না। তারা দেশ ও জাতির শত্রু। তাদের অবশ্য একদিন আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন