জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পবিত্র ঈদুল আযহা পরিশুদ্ধ জীবন গঠন ও উৎসুকের ঐতিহাসিক দিন

পবিত্র ঈদুল আযহা পরিশুদ্ধ জীবন  গঠন ও উৎসুকের ঐতিহাসিক দিন

 আবিদ সিদ্দিকী

লেখক: তাকমীলুল হাদীস, জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম

বিশ্বমুসলিম উম্মাহর জন্য আনন্দ উৎসবের দিনসমূহের মধ্যে সর্ববৃহৎ উৎসবমুখর দিন হলো, পবিত্র দুই ঈদের দুই দিন। এক পবিত্র ঈদুল ফিতর বা রমজানের ঈদ; যেটি রমজানের শেষে শাওয়ালের এক তারিখ পালিত হয়। আর দ্বিতীয়টি হলো পবিত্র ঈদুল আযহা বা কুরবানির ঈদ; যেটি হজের মৌসুমে জিলহজের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে পালিত হয়। এই দুই ঈদে মুসলমানদের উৎসবের কোনো সীমা থাকে না। বিশেষ করে কুরবানি ঈদের সকালে ‘আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর’ ধ্বনিতে রাস্তাঘাট মুখরিত করে ঈদগাহে যাওয়ার দৃশ্যগুলো একদম মন ছুঁয়ে যায়। ঈদগাহ থেকে এসে জন্তু জবেহ করার জন্য তলোয়ার হাতে এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করা সুনালী অতীতের কথা স্মরণ করে দেয়। কুরবানি জন্তু জবেহের দৃশ্য, গোশত কাটার দৃশ্য, গোশত টানাটানির দৃশ্য গুলো মনে প্রাণে আলাদা এক প্রশান্তি ঢেলে দেয়। সবশেষে গোশত মাংসের ভাগবাটোয়ারা, পিঠাপুলি ও গোশত নিয়ে এদিক-সেদিক ঘুরাঘুরির আনন্দটা বেশ উপভোগ করার মতই। একদম খুবই তৃপ্তদায়ক উপভোগ্যময়। এই দিনটিতে ধনী-গরিব কোনো ভেদাভেদ নেই, সবার ঘরে গোস্ত, সবাই আনন্দিত। আল্লাহ তাআলার পক্ষে থেকে বিছিয়ে দেওয়া উম্মুক্ত দস্তরখানে সবাই মেহমান। সবাই বেজায় খুশি উৎফুল্ল উৎসুকে ভরপুর।

কিন্তু বদনসিব কপাল পুড়া কিছু আবাল বলদ এই দিনেও মাহরুম। কুরবানির আনন্দ, সেরা দিনের সেরা উৎসুক উৎফুল্ল গুলো ভোগ করতে না পারায় এরা উঠেপড়ে লাগবে মুসলিম উম্মাহর সাথে। উপভোগ্য সমাদৃত এই আনন্দমুখর কর্মকাণ্ড গুলোকে তারা সন্ত্রাসীর সাথে মিলিয়ে দিতে চাইবে। কিন্তু তারা তাদের দুর্বল মিশনে সাকসেস হবে না। কারণ এই আনন্দ-উল্লাস সরাসরি আল্লাহর পক্ষ হতে।

এটি আল্লাহর বিশেষ নেয়ামতও বটে। তবে জেনে রাখা অপরিহার্য যে এই কুরবানি শুধু আনন্দ উল্লাসের না। বরং আনুগত্য ও আত্মসমর্পণেরও। এই কুরবানিতে মুসলিম উম্মাহর জন্য রয়েছে আত্মসমর্পণ, আনুগত্য ও আত্মবিসর্জন শেখার অনেক শিক্ষা।

মূলত মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু হওয়া এ কুরবানির মূল দীক্ষাই হল সকল প্রকার ঠুনকো, খোঁড়া যুক্তি ও বুদ্ধির ঊর্ধ্বে উঠে আল্লাহর হুকুম আহকামের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ করা।

যেমন আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের নমুনাস্বরূপ হযরত ইবরাহীম (আ.) নিজ প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)-কে আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করতে গিয়েছিলেন। আল্লাহর হুকুমের প্রতি অতিশয় আনুগত্যের কারণে আল্লাহ তাআলা তার এ কুরবানিকে কবুল করে নেন, এ ঘটনা আল্লাহর হুকুমের পূর্ণ আনুগত্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

ঈদুল আযহা ও কুরবানি

হজের মৌসুমে উদ্‌যাপিত এ ঈদকে ইসলামী পরিভাষায় ঈদুল আযহা বলা হয়। রসুলুল্লাহ (সা.) একে ঈদুল আযহা নামে নামকরণ করেছেন। এছাড়া ইয়াওমুন নহরও বলা হয়। জর্দান, ফিলিস্তিন, লেবানন, মিসর, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, ইরাক, লিবিয়া ও জাজীরার অধিবাসীরা এ ঈদকে ‘ঈদুল কাবীর’ বা বড় ঈদ নামে সম্বোধন করে থাকেন। বাহরাইনের লোকেরা ‘ঈদুল হুজ্জাজ’ বা হাজীদের ঈদ নামে সম্বোধন করেন। আর ইরান, আফগানিস্তানসহ এ উপমহাদেশের লোকেরা ‘ঈদুল কুরবান’ বা কুরবানির ঈদ নামে অভিহিত করেন।

কুরবানির গুরুত্ব ও তাৎপর্য

কুরবানির গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র কুরআন ও হাদীস এ ব্যাপারে ব্যাপক গুরুত্বারোপ করেছে। মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবীবকে লক্ষ করে বলেন,

فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَ انْحَرْؕ۰۰۲

‘তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো এবং কুরবানি করো।’[1]

কাফির-মুশরিকরা তাদের দেব-দেবী ও মূর্তির উদ্দেশ্যে কুরবানি করে থাকে। তার প্রতিবাদস্বরূপ এ আয়াতের মাধ্যমে মুসলমানদের আল্লাহর জন্য সালাত আদায়ের ও তাঁর উদ্দেশ্যে কুরবানি করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। মুফাসসিরদের কারো কারো মতে, এ আয়াতে বিশেষভাবে ঈদুল আযহার নামাজ ও নামাজ শেষে কুরবানির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,

وَالْبُدْنَ جَعَلْنٰهَا لَكُمْ مِّنْ شَعَآىِٕرِ اللّٰهِ لَكُمْ فِيْهَا خَيْرٌ١ۖۗ ۰۰۳۶

‘আর কুরবানির পশুসমূহকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে।’[2]

আল্লাহ আরও বলেন,

وَفَدَيْنٰهُ بِذِبْحٍ عَظِيْمٍ۰۰۱۰۷ وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْاٰخِرِيْنَۖ۰۰۱۰۸

‘আর আমরা তাঁর (ইসমাঈলের) পরিবর্তে জবেহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কুরবানি। আমরা এটিকে পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম।’[3]

আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন,

«مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةٌ، وَلَـمْ يُضَحِّ، فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانَا».

‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।’[4]

রসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন,

«مَا عَمِلَ آدَمِيٌّ مِنْ عَمَلٍ يَوْمَ النَّحْرِ أَحَبَّ إِلَى اللهِ مِنْ إِهْرَاقِ الدَّمِ».

‘কুরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করা (জবেহ করা) অপেক্ষা আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় মানুষের কোনো আমল হয় না।’[5]

এটি ইসলামের একটি ‘মহান নিদর্শন’ যা ‘সুন্নতে ইবরাহীম’ হিসেবে রসুলুল্লাহ (সা.) নিজে মদীনায় প্রতি বছর আদায় করেছেন এবং সাহাবীগণও নিয়মিতভাবে কুরবানি করেছেন। অতঃপর অবিরত ধারায় মুসলিম উম্মাহ সামর্থ্যবানদের মধ্যে এটি চালু আছে। এ ছাড়া মানব সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস এটাই সাক্ষ্য দেয় যে, হযরত আদম (আ.) হতে পৃথিবীর সব জাতিই কোনো না কোনো পদ্ধতিতে আল্লাহর দরবারে নিজেদের প্রিয়বস্তু উৎসর্গ করেছেন। এ ইতিহাসের স্বীকৃতি প্রদান করে মহান আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন,

وَلِكُلِّ اُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِّيَذْكُرُوا اسْمَ اللّٰهِ عَلٰى مَا رَزَقَهُمْ مِّنْۢ بَهِيْمَةِ الْاَنْعَامِؕ۰۰۳۴

‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কুরবানির এক বিশেষ রীতি-পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওসব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে যেসব আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন।’[6]

কুরবানির কতিপয় মৌলিক শিক্ষা:

কুরবানিতে মুমিনের জন্য অসংখ্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে,

  1. বিশ্বব্যাপী তাওহীদ প্রতিষ্ঠা: মহান আল্লাহর তাওহীদ বা একত্ববাদ বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা করা কুরবানির অন্যতম শিক্ষা। কারণ একমাত্র বিশ্বজাহানের মালিক মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে, তার নামেই পশু কুরবানি দেওয়া হয়। জগতের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা যেখানে তাদের দেব-দেবীর নামে কুরবানি করে, সেখানে মুসলিম সমাজ কুরবানি দেয় একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে।
  2. আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ: কুরবানির গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ। আল্লাহর সকল আদেশের সামনে বিনাপ্রশ্নে মাথানত করে দেওয়াই হল পূর্ণ আত্মসমর্পণের সমুজ্জ্বল বহিঃপ্রকাশ। ঈদুল আযহার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আমরা হযরত ইবরাহীম (আ.) ও তাঁর পুত্র ঈসমাইল (আ.)-এর এ ধরনের পূর্ণ আত্মসমর্পণের চিত্রই পবিত্র কুরআনুল কারীমে দেখতে পাই।
  3. ইখলাস বা একনিষ্ঠতা: সকল কাজে ইখলাস বা একনিষ্ঠতাই ইসলামের মহান শিক্ষা। ইখলাস ছাড়া পরকালীন কোনো কাজই আল্লাহ তাআলা কবুল করেন না। আন্তরিকতা ও মহব্বতবর্জিত ইবাদত প্রাণহীন কাঠামো মাত্র। তাই কুরবানিও একমাত্র আল্লাহ তাআলার রেজাবন্দী হাসিলের জন্য দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ তাআলার আদেশ:

لَنْ يَّنَالَ اللّٰهَ لُحُوْمُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَ لٰكِنْ يَّنَالُهُ التَّقْوٰى مِنْكُمْؕ ۰۰۳۷

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলার নিকট কুরবানির পশুর গোশত ও রক্ত পৌঁছে না। তাঁর নিকট তোমাদের তাকওয়া (ইখলাস) পৌঁছে।’[7]

ইখলাসপূর্ণ কুরবানি হওয়ার কারণেই আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর কুরবানি কবুল করে নিয়েছিলেন।

  1. তাকওয়াভিত্তিক জীবন-যাপন: কুরবানির সুমহান দীক্ষা তাকওয়াভিত্তিক জীবন-যাপন। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জনই মুমিনের প্রকৃত সফলতা। বস্তুত আল্লাহ তাআলা তার আমলকেই কবুল করেন, যার আমলে তাকওয়া বা খোদাভীতির সন্নিবেশন ঘটেছে। আদমপুত্র হাবিলের কুরবানি আল্লাহ তাআলা কবুল করেছিলেন তাকওয়ার প্রভাবের কারণেই।
  2. দরিদ্র ও অনাথের সুখে-দুঃখে অংশীদার: কুরবানির অন্যতম শিক্ষা দরিদ্র ও অনাথের সুখ-দুঃখে ভাগীদার হওয়া। কুরবানি দিতে না পারার যে চাপাকষ্ট তা যেন তারা বুজতে না পারে সেজন্য আমাদের সচেষ্ট থাকতে হবে পূর্ণ সহযোগিতার মাধ্যমে।

ঈদুল আযহার নামাজে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের সহাবস্থানের পাশাপাশি আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও দরিদ্র-অনাথের মাঝে কুরবানির গোশত বণ্টন আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, আমাদের সম্পদে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের অধিকার রয়েছে। কুরবানি মুসলমানদের শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং পরিশুদ্ধ জীবন গঠনের নিয়মতান্ত্রিক অনুশীলনও বটে। এর মাধ্যমে মুসলমান তাওহীদী আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ইখলাস, তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের অপূর্ব নজির স্থাপন করতে পারে। রাব্বে করীম তাওফিকঅলাদেরকে কুরবানি করার সুযোগ করে দিক। যাদের তাওফিক নেই সাহেবে নেসাব বানিয়ে দিয়ে কুরবানি করার তাওফিক দিক। যাদের তাওফিক হয়েছে তারা কুরবানি দিয়ে সেখান থেকে পরিশুদ্ধতা, একাত্মতা, শিখে নিক।

কুরবানির মাধ্যমে ইখলাস ও তাকওয়া অর্জন করে সবাই আল্লাহর আনুগত্যতা ও আত্মসমর্পণ শিক্ষা হাসেল করুক। আমিন। সুম্মা আমীন।

[1] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-কাওসার, ১০৮:২

[2] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-হজ, ২২:৩৬

[3] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আস-সাফ্ফাত, ৩৭:১০৭-১০৮

[4] ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, দারু ইয়াহইয়ায়িল কুতুব আল-আরাবিয়া, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৩৭১ হি. = ১৯৫২ খ্রি.), খ. ২, পৃ. ১০৪৪, হাদীস: ৩১২৩

[5] আত-তিরমিযী, আল-জামিউস সহীহ = আস-সুনান, মুস্তফা মুস্তফা আল-বাবী আল-হালাবী অ্যান্ড সন্স লাইব্রেরি অ্যান্ড প্রিন্টিং কোম্পানি, কায়রো, মিসর (দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৩৯৫ হি. = ১৯৭৫ খ্রি.), খ. ৪, পৃ. ৮৩, হাদীস: ১৪৯৩

[6] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-হজ, ২২:৩৪

[7] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-হজ, ২২:৩৭

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ