মুহাম্মদ নূরুল্লাহ
লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া বায়তুস সালাম, উত্তরা সেক্টর-২, ঢাকা
ইউরোপের মাটি, তার রস, তার মানুষের মন ও মনন এশিয়ার মাটি ও মানুষের চেয়ে ভিন্ন, অনেক বেশি ব্যতিক্রম। ইউরোপ ধর্ম, জ্ঞানবিজ্ঞানের পাঠ গ্রহণ করেছে এশিয়ার কাছে। তাদের সমাজ, সভ্যতা এজন্য অনেক বেশি ঋণী আমাদের কাছে। এশিয়ার শ্রেষ্ঠ অংশ, হাজার বছর ধরে যারা বিশ্বকে নানারকম দানে ঋণী করেছে, মুসলিম বিশ্ব; তাদের জন্য সম্ভব নয় ইউরোপ হয়ে যাওয়া বা ইউরোপের মতো হওয়া। ইউরোপের বিজ্ঞান চর্চা একদিন যার নেতৃত্ব মুসলমানরা দিয়েছিল, তা গ্রহণ করতে মুসলমানদের সমস্যা নেই। কিন্তু জ্ঞান বিজ্ঞানের নামে ইউরোপের সংশয়বাদ, অবাধ্যতা, নাস্তিকতা এশিয়া গ্রহণ করতে পারবে না, মুসলিম বিশ্বেও তার ঠাঁই হবে না। এখানে বড় করে দেখতে হচ্ছে, ইসলামি শিক্ষা ও ইউরোপীয় শিক্ষার তফাতটা। ইউরোপের শিক্ষা মুসলিম সমাজ জীবনের সঙ্গে সঙ্ঘাতধর্মী। ইসলামি সমাজের নিজস্ব শিক্ষা সিলেবাস ও মানহাজ রয়েছে। সেটা অনুসরণ না করতে পারা কিংবা সেই জিনিসটা একদম ভুলে যাওয়া মুসলমানদের ইহপরকালের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তারা জাগতিক সম্মান ও কর্তৃত্ব হতেও বঞ্চিত হচ্ছে এ কারণে।
পাশ্চাত্য সমাজ ইসলামি শিক্ষা ও সভ্যতার অনুকরণ করছে না। এটা তাদের কাছে উলটা লাগে। মুসলিম বিশ্বেও উল্টা লাগে পাশ্চাত্যের শিক্ষা। কিন্তু মুসলিম বিশ্বে পাশ্চাত্য শিক্ষা স্বীকৃত হয়েছে এবং সেই শিক্ষায় শিক্ষিতরাই সমস্ত জাগতিক কাজ করছে। এতে সেই শিক্ষায় শিক্ষিত ও দীক্ষিতদের মধ্যে এবং মুসলমান সমাজের মধ্যে একটি সংঘাত অনিবার্য; তা নানান ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। এখানে এই লেখাটিতে সমস্যা ও সংঘাতের কারণসমূহ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
মুসলিম বিশ্ব তার মর্যাদা ও নেতৃত্ব ফিরে পেতে চাইলে তাদের নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। তবে এখানে একটি কথা আগেভাগে বলে রাখি, পাশ্চাত্য সমাজ গবেষণা, নিজস্ব অনুসন্ধিৎসা বা ইতিহাস অধ্যয়নের মাধ্যমেই হোক, তারা শিক্ষা এবং বিচারব্যবস্থায় নিজেদের সমাজে ইসলামি ব্যবস্থা থেকে যথেষ্ট পরিমাণ গ্রহণ করেছে। এই ঋণ তারা স্বীকার করুক বা নাই করুক আমাদের উচিত তা ভেবে দেখা, নিজেদের যাপিত জীবনের সুখটুকু ধরতে হলেও।
মানুষ যে শিক্ষা লাভ করে, শিক্ষার মাধ্যমে যে বিশ্বাস ও সংস্কৃতি তার অন্তরে জন্ম নেয়, সেটাই তার মস্তিষ্ককে ঢেলে সাজায় এবং যান্ত্রিকভাবে সে তাই নিয়ে পরিচালিত হয়। শিক্ষা সম্পর্কিত আলোচনার পূর্বে এ জিনিসটা আমাদের ভালো করে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। আর মনে রাখতে হবে, শিক্ষার মৌল উদ্দেশ্য মানুষকে বিশেষ করে চাকরিজীবীরূপে সৃষ্টি করা হতে পারে না। বিশ্বের কোনো প্রকৃত জ্ঞানী মানুষ শিক্ষা সম্পর্কে এমন মতামত দেননি। চাকরির জন্য যেটুকু শিক্ষা প্রয়োজন ও বিশেষ বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের প্রয়োজনে যেটুকু শিক্ষা মানুষ লাভ করে তা কখনও শিক্ষাগত পূর্ণতা দান করে না। এটুকু স্বীকৃতি পেয়ে কোনো ব্যক্তি নিজেকে অনেক বড় উচ্চ শিক্ষিত ধারণা করে বসতে পারেন কিন্তু শিক্ষা সম্পর্কে তার অপূর্ণতা এবং জীবন, জগত, স্রষ্টা সম্পর্কে তার জরুরি জ্ঞান না থাকার কারণে অথবা স্পষ্ট অজ্ঞতার জন্য সেই ব্যক্তিকে আমাদের ধর্মীয় মহলে আধা শিক্ষিত বিবেচনা করা হয়। অবশ্য আমাদের সাধারণ ধারার শিক্ষিতরা আলেম সমাজ সম্পর্কে কী ধরনের মন্তব্য করে তাও জানা যায় তাদের রচনা, বক্তৃতা ও মূল্যায়ন থেকে। আলেমদের তারা শিক্ষিত বলেন না। অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত বলে সাহেবী ভাবটা জাহির করতে কসুর করেন না। মূলত শিক্ষা সম্পর্কে স্পষ্ট দর্শন জানা না থাকার ফলে কিংবা অন্য জাতিকে অবদমিত করে রাখার দূরভিসন্ধি থেকেই সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ শাসকরা ভারতবর্ষে কেরানী সৃষ্টির শিক্ষা আদর্শ ও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল। পরবর্তীতে বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মধ্যে এই ভেদনীতি বেশ গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। তারা নিজেদের জন্য একধরনের শিক্ষাপদ্ধতি ব্যবহার করে ও অধীন দুর্বলদের সন্তানদের জন্য করে আরেক রকম। তাদের পাঠপদ্ধতি ও পাঠ্যবইয়ের মধ্যেও গড়মিল অনেক। তাদের সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের অংশ হিসাবেই শিক্ষাকে করেছে অনেক ব্যয়বহুল আর উচ্চমানের শিক্ষা এর মাধ্যমে নিজেদের সন্তানদের জন্য নির্দিষ্ট করে ফেলেছে। শিক্ষাআদর্শের ক্ষেত্রে তারা মুসলিম পদ্ধতির অনেক গ্রহণ করেছে কিন্তু মুসলিমবিশ্বে তারা চায় তাদের আদর্শ চাপিয়ে দিতে। এক্ষেত্রেও তারা বেশ সাফল্যের নজির রাখতে সক্ষম হয়েছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে ইসলামের শত্রুরা পুরো মুসলিম জাহানের শিক্ষা নিয়ে অন্তহীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। এবং গোটা মুসলিমবিশ্ব দাবিয়ে রাখতে তারা শিক্ষাকে ব্যবহার করছে। এ পথে তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করতেও দ্বিধান্বিত হচ্ছে না। এক্ষেত্রে আমাদের এশিয়ার ছোট দেশগুলো তাদের নির্যাতন ও আগ্রাসনের শিকার হয়েছে বেশি। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও পেশীবল প্রয়োগ করেও তারা আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিকে মুঠোর মধ্যে রাখতে চায়।
বর্তমান পৃথিবীর নেতৃত্বে রয়েছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। তার বলয়ে চলছে ইউরোপ ও দুনিয়ার অধিকাংশ দেশ। এবং পৃথিবীর অধিকাংশ শক্তিশালী রাষ্ট্রের শিক্ষা সম্পর্কে প্রায় সমান্তরাল ধারণা রয়েছে। এদের শিক্ষা, টেকনোলজি, মতাদর্শ, চিন্তাবিশ্বাস, ভাষা ও জীবনবোধ আমাদের দেশে সাপ্লাই হচ্ছে। এই জিনিসগুলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহেও পঠিত, আলোচিত হচ্ছে। আমাদের ঘরে, আড্ডায়, ক্লাবে, কফিহাউসে এসবের আওয়াজ আছে।
বস্তুত সাহিত্য ও শিক্ষার মাধ্যমে সবাই তাদের চিন্তাবিশ্বাস, আদর্শ অন্যদের নিকট পৌঁছিয়ে দিতে চেষ্টা করে। তথাকথিত উন্নত বিশ্বের দাবিদাররা এই কাজটাই করছে। আমরা উন্নত বিশ্ব বলে যাদের অনুকরণ করছি তারা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও আছে। তারাও বিজাতীয় বিধর্মী। তাদের অনেক কিছু থাকলেও কুরআন- হাদীসের আসমানি সম্পদের অধিকারী তারা নয়, হাজার বছরের জ্ঞানসাধনার উজ্জ্বল ইতিহাসও তারা সৃষ্টি করেনি। কিতাব সুন্নাহর অনুসারী হিসেবে আমরা মুসলমানরা আমাদের অতীত মনীষীদের জ্ঞানচর্চার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য। এবং তাদের ঋণ আদায়ের প্রয়োজনেই সেইসব পাণ্ডুলিপি খোঁজে বের করা ও তা অধ্যয়ন করে মর্ম উদঘাটন করা আমাদের দায়িত্ব।
সুপ্রিয় পাঠক! আপনাকে মনে রাখতে হবে ইউরোপ আমেরিকার প্রকৃতি, মাটি, রস এশিয়ার চেয়ে ভিন্ন। পৃথিবীর সকল মহাপুরুষ, ধর্মীয়প্রধান দেখা যায় তারা এশিয়ায় এসেছেন, এশিয়ায় লালিত, পালিত, বর্ধিত হয়েছেন। ঐতিহাসিক কারণেই এশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের দীর্ঘ দ্বন্দ্ব রয়েছে। অতীতকাল থেকে এশিয়ার মাটির গুণ পরিলক্ষিত হচ্ছে: ধার্মিকতা, সততা, মানবিকতা, উদারতা, করুণা, ভালোবাসা, পরিবারের গাঢ় বন্ধন, সামাজিক আদবকায়দা ও শিষ্টাচার রক্ষা। আর সেক্ষেত্রে ইউরোপের মূল প্রকৃতি দেখা যায়, নাস্তিকতা, নৃশংসতা, বিশ্বাসঘাতকতা, পরস্ব লুটপাট, গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করা, প্রতারণা, অন্যজাতির সর্বনাশ সাধন, অবাধ্যতা। একারণেই ইউরোপ-আমেরিকার শিক্ষা, সভ্যতা এশিয়া এবং মুসলিম বিশ্বের সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।
ইসলাম যখন পৃথিবীর শিক্ষা, সভ্যতা ও শাসনের ভিত্তি ছিল তখন পৃথিবীর প্রাপ্তি ও অর্জন ছিল অনেক বেশি, মানবিক ও সকল মানুষের নিকটবর্তী। আজ প্রায় তিন শতাব্দী ধরে ইউরোপ যখন পৃথিবীর ওপর কর্তৃত্ব করছে তখন থেকে এক অন্যরকম রূপান্তর আমরা লক্ষ করছি। ইউরোপের সর্বগ্রাসী উগ্র ছোবল আমাদের শিক্ষা, সভ্যতা, চিন্তা, বিশ্বাস, মানবিকতা ও আদর্শের সবটুকু বিনষ্ট করে ফেলছে। ইউরোপের আক্রমণ শুধু সমাজ রাষ্ট্রের বিশেষ ব্যক্তিদের হত্যা করার জন্য পরিচালিত হয়নি, রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তম্ভে তাদের আক্রমণ পরিচালিত হয়েছে। খুন হত্যার রাজনীতি নয় এ, চেতনা বিশ্বাস দ্বারা, ইউরোপের অবিশ্বাস, হঠকরিতা দ্বারা পুরো সমাজমানস পালটে দেওয়া তাদের লক্ষ। তাদের শিক্ষার মাধ্যমে ভেতরের বস্তুসমূহ পরিবর্তন করিয়ে নেওয়া এই তাদের সুদূর পরিকল্পনা বা চক্রান্তের অংশ যা আমাদের প্রাচ্যের দেশসমূহকে যুগ যুগ ধরে অন্তর্কলহ আর আত্মবিকারের মধ্যে নিক্ষিপ্ত করে রেখেছে। প্রাচ্যের শিক্ষার পূর্বাদর্শ পুনরায় বহাল করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইসলামি জাহানে যে শিক্ষা কারিকুলাম চালু ছিল সেই কারিকুলাম ও মানহাজই হচ্ছে মানবশিক্ষার সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা। আমরা সেই সিলেবাসের সঙ্গে আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় করে আরও অনেকদূর অগ্রসর হতে পারি। চিন্তা করলে দেখা যায়, ইউরোপ যখন শিক্ষাক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অন্ধকারে, আমেরিকা যখন অনাবিষ্কৃত তখনই ইসলাম শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছিল। ইউরোপ যখন মধ্যযুগের বর্বর আঁধারের পঙ্কে পাঁক খেয়ে মরছিল তখন মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র জ্ঞানের শত শত নগরী আবাদ হয়েছিল। হাজার হাজার বিশ্ববিদ্যালয়, লক্ষ লক্ষ লাইব্রেরি সৃষ্টি হয়েছিল। ইউরোপ যখন গীর্জাভিত্তিক পাদ্রীদের অন্ধকার মস্তিষ্কের দাপটে শিক্ষাক্ষেত্রে দুমড়ে মরছিল, তখনই মুসলিম বিশ্বের শতশত বিজ্ঞানী বিজ্ঞান এবং জ্ঞানের শত শত শাখায় আবিষ্কারের সিদ্ধতায় জ্ঞানের জগত কর্ষণ করে চলেছেন। রসায়ন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, ন্যায়শাস্ত্র, ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, চিকিৎসা, আইনকানুন, ফিকহ, হাদীস, তাফসীর ইত্যাদি শাস্ত্র ও এর মৌলিক নীতিমালা ও সূত্রসমূহ মুসলমানদের আবিষ্কার। মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এসব শাস্ত্রে বড় বড় মনীষার আবির্ভাব হয়েছে। এমনকি কাব্য, ছোটগল্প, সাহিত্যের উৎকর্ষও তাদের সময়ে ঢের হয়েছে।
আঠারশো শতকে ফরাসি বিপ্লব ও ইউরোপে শিল্প ঘটে যাওয়ার পর ব্রিটেন ও ফ্রান্সের কর্তৃত্ব বিস্তারের মাধ্যমে পৃথিবীর ওপর ইউরোপ যে নয়া আধিপত্য কায়েম করে সে সূত্রে তাদের প্রথম আক্রমণটা পরিচালিত হয় মুসলিমবিশ্বের ওপর। মুসলমানদের ঐক্য তারা খণ্ড খণ্ড করে নস্যাৎ করে। মুসলিম সালতানাতকে টুকরো টুকরো করে। সুদীর্ঘ দখলদারি কায়েমের ইচ্ছায় তারা মুসলিম বিশ্বের মাদরাসাকেন্দ্রিক ইসলামি শিক্ষার বুনিয়াদকে নাস্তানাবুদ করে ফেলে। সেই শিক্ষার যে মানহাজ ছিল তা ধ্বংস করে।
আজ বিশ্বের যে সব মুসলিম ভূখণ্ডে সেকুলার শাসনব্যবস্থা কয়েম রয়েছে সেখানে জাতীয় শিক্ষার আওতায় ইউরোপের শিক্ষার মানহাজ অনুসরণ করা হয়, মুসলমানদের জাতীয় শিক্ষার অস্তিত্বও সেখানে নেই। সেই শিক্ষায় শিক্ষা শুরু করে যে সব মুসলিম শিশু তরুণ বয়সে তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করে তারা তাদের সমাজের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াতে হিমশিম খায়। আধুনিক শিক্ষার বদৌলতে তাদের বুদ্ধির কিছু কোষ কর্মশীল হতে পারলেও তাদের হৃদয় থাকে অন্ধকারে ভরা। কুরআন সুন্নাহর ইলম ব্যতীত হৃদয়ের রাশি রাশি অন্ধকার কখনও দূর হয় না। সে কারণেই সেই শিক্ষিতদের মনের অন্ধকার কখনও দূর হয় না, অন্ধকার আরও অন্ধকারের জন্ম দিতে থাকে। এরা সমাজের মানুষ হলেও এই সমাজের বেদনার সঙ্গে, শেকড়ের সঙ্গে অপরিচিত। ফলে সবকিছুকে তারা উলটো দেখে। তারা নিজেদেরকে বদলাতে পারে না। আবার বাপদাদার জীবনদর্শন তুড়িতে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নির্লজ্জতাও দেখাতে পারে না। কিন্তু মনের গহীনে যত বিদ্বেষ, অন্ধকার ও সংশয় তা তারা বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে যায়। তারা নিজেরা ঠিক হতে চায় না। তারা বিদ্যার অহঙ্কারটা করে, যদিও প্রকৃত বিদ্যার পরশ না পাওয়ার কারণেই তাদের এই সমস্যা হয়েছে, কিন্তু সেটা তারা স্বীকার করতে চায় না। এসব মানুষ ধার্মিক হলেও ইংরেজি শিক্ষার বিষটুকু আজীবন তাদের যন্ত্রণাকাতর করে রাখে। এই বিষ সে সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলতে পারে না। কারণ, তার শিক্ষার বদৌলতে, কিছু কথাকে পুঁজি করে সে তার দুনিয়াদারি করে যেতে পারে এতে তার অসুবিধা হয় না।
বস্তুত তাদের শিক্ষাই হয়ে থাকে অল্প, অগভীর, সীমিত কিন্তু বাচালতা বেশি। সেও অনেক সময় বোঝে তার ভেতরটা ফাঁকা, তার জীবনের বেশিরভাগ ফাঁকা বেলুনের মতো উড়ে বেড়ায়, তার উড্ডয়নে সে আত্মপ্রসাদ খুঁজে পায়। তার আত্মখুশি, উগ্রতা, বেয়াদবি ও ঔদ্ধত্বের শেষ হয়, তার ভূমিধ্বস পতন হয়, সে ইহজগত ছেড়ে যায়, শূন্য হাতে। এই দুনিয়ায় কত হতভাগা কত মানুষ এসেছে ও গিয়েছে, হয়তোবা তার পরকালীন পরিণতি খারাপ করে। তারা অসংখ্য মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি করে গেছে, নিজেদের পরকাল ধ্বংস করেছে। কিন্তু তাদের নিজেদের ক্ষতির তুলনায় তারা এই জগতের খুব বেশি ক্ষতি করতে পারেনি, আজ মানুষ তাদের নাম মনে রাখে উদাহরণ দেওয়ার জন্য। জ্ঞানীদের বিবেচনায় এসব মানুষের মৃত্যুই আসলে তার চ‚ড়ান্ত পতন।
আজ এসব কথা বলে, হতভাগাদের অভিশাপ দিয়ে আমরা আমাদের দায়িত্ব শেষ করে ফেলতে পারি না। আখেরে আমাদের সন্তানদের জীবন নষ্ট করার জন্য আমরাই দায়ী হব। অপূর্ণ শিক্ষা, ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা তাদের জীবনকে ভুলপথে পরিচালিত করছে, সেজন্য আমরা কতটুকু চিন্তিত? মনে রাখতে হবে, কুরআন হাদীসের জ্ঞান ব্যতীত মানবজীবন সার্থক হয় না। জীবন সার্থক করতে হলে, জীবনে সফল হতে হলে আসতে হবে স্রষ্টার সান্নিধ্যে। নবীরসুলের আনীত জীবনব্যবস্থার প্রতি অবিশ্বাস রেখে মানুষ তুমি যতই দৌঁড়ঝাপ করো যাপিত জীবনের শান্তি তুমি ধরতে পারবে না। শান্তি চাও তাহলে এসো আল্লাহর কোনো বান্দার কাছে। বসো। কান পেতে শুনো তিনি কেমন করে স্রষ্টার নামের যিকির করেন। তুমি তার মুখে কুরআনের তিলাওয়াত শুনো।
আজ মুসলিমবিশ্বে আবার যদি ইসলামি শিক্ষার মৌলিক কারিকুলামটা চালু করা যেত, আবার শিক্ষার সেই পরিবেশ, গুরুশিষ্যের সেই সম্পর্কটা ফিরিয়ে আনা যেত, তাহলে আবারও জ্ঞানবিজ্ঞানের সকল শাখায় মুসলমানের বাচ্চারা অভাবনীয় বিপ্লব সাধন করতো। এবং এ সত্য আবারও উদ্ভাসিত হতো যে, মুসলিমবিশ্বে শিক্ষায় ইসলামি মানহাজ ও প্রাচীন মুসলিম আদর্শ অনুসরণ করলেই মুক্তি এছাড়া নয়। কুরআন, সুন্নাহ ও মুসলিম মনীষীগণের জ্ঞানসাধনার আলোকিত ধারায় মেহনত করতে পারলেই ক্রমবর্ধমান ক্ষয়ের দিকে ধাবিত ক্ষয়িষ্ণু এই তরুণদের মধ্যে আমরা অন্যরকম তরুণের উদয় দেখতে পেতাম। সততা, ধার্মিকতা, মানবিকতা, ঔদার্য, ভালোবাসায় এদের হৃদয় স্মাত থাকতো। মুসলিম বিশ্বে শিক্ষাটা ইসলামি মানহাজে হলেই পূর্ব পশ্চিমের পার্থক্যটা সবাই দেখতো।
এখানে আরেকটি কথা আমরা জোর দিয়ে উল্লেখ করতে চাই। তাহলো, আমরা যদি বস্তুগত উন্নতি করতে চাই, তাহলেও তা আমাদের ভেতরে যে যোগ্যতা আছে তার স্বতস্ফূর্ত বিকাশ ও ভেতরের শক্তিকে জাগিয়ে তোলার মাধ্যমেই হতে পারে। আমরা যদি আপন সত্তা ও ভেতর পানে না তাকাই আর মনে করি ইউরোপের অনুকরণই জাগতিক উন্নতির চাবিকাঠি তাহলে আমরা ভুল করবো। কারণ, শুধু অনুসরণ আমাদের বড় করবে না। আমরা যদি বিজ্ঞানকে ব্যবহার করতে শিখি, আর বস্তুনীচয় সমস্ত কিছুর মালিককে স্বীকার করতে পারি তাহলেই আমাদের উত্থান হতে পারে বিশ্বজুড়ে, দুর্দমনীয়।