মাওলানা মাহফুয আহমদ
নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হোক নব চেতনায়, নব উদ্দীপনায়। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার দৃঢ় প্রত্যয়-প্রতিজ্ঞায়। এগিয়ে যাওয়ার সুচিন্তিত পরিকল্পনায়।
মন চায়, তালিবুল ইলম সাথীদের খেদমতে কিছু নিবেদন পেশ করতে। কিন্তু নিজের ইলমি-আমলি ব্যর্থতা ও অযোগ্যতার কারণে লজ্জা হয়। তবু মন চায়, কিছু কথা বলি, লিখি, শেয়ার করি। হয়তো এর দ্বারা নিজের মাঝেও পরিবর্তনের কিছু ছোঁয়া লাগতে পারে। ইচ্ছে ছিল এবং কিছু কাজ শুরুও হয়েছিল, বিশদভাবে তথ্য ও উপাত্তনির্ভর কয়েকটি নিবেদন পেশ করার। কিন্তু নিজের লজ্জাবোধ হওয়ায় এবং সাময়িক কিছু ব্যস্ততার কারণে তা আর হয়ে উঠলো না। তারপরও শুধু মূল পয়েন্টগুলো উল্লেখ করে দিচ্ছি।
এক. প্রথমেই দীনি ইলেমর তালিব হিসেবে আমাদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধ থাকা চাই। আমরা যে মাদরাসাগুলোতে লেখাপড়া করি, যে মাদরে ইলমির দিকে নিজেদের সম্বন্ধ করি, যে আসাতিযায়ে কেরামের শিষ্যত্ব গ্রহণ করি, যে নেসাব ও নেযামে তালিম অনুসরণ করি, আমরা বুঝি বা না বুঝি, এগুলো এক কথায় অমূল্য সম্পদ এবং অকল্পনীয় সুযোগ। আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের সুবর্ণ সুযোগ-নেয়ামত, রসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতিনিধিত্বের সৌভাগ্য-ওয়ারাসাত এবং সত্যিকার মুসলমানদের হৃদয় থেকে ভালোলাগা-ভালোবাসা। আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে এলে এখনও সর্বমহলে আমাদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এজন্যে চাই একটু সচেতনতা, সতর্কতা, পরিপক্ব যোগ্যতা, কর্মস্পৃহা এবং প্রশস্ত মানসিকতা। সংক্ষেপে বলি, আমাদের মধ্য থেকে যারা এগিয়ে গেছেন তাঁরা আরবে-আজমে, প্রাচ্যে-পাশ্চাত্যে সর্বত্র আজ নন্দিত, সমাদৃত। এখানে এই ইংল্যান্ডে এসে বিষয়টি আমার নিকট আরও স্পষ্ট হলো।
দুই. আমাদের এ মাদরাসাগুলোকে এমনিতেই আরবি মাদরাসা বলা হয়। বস্তুত এখানে আরবির গুরুত্ব অপরিসীম। সেজন্যে আমাদের আরবি ভাষা পূর্ণরূপে আয়ত্ত ও আত্মস্থ করতে হবে। কুরআন-সুন্নাহর সরাসরি ও সহীহ জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে আরবির কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান বিশ্বে এটি আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃত, সমাদৃত ও প্রয়োজনীয়। আরবিকে একটি জীবন্ত ভাষা হিসেবে শিখতে হবে। শোনা, বলা, পড়া ও লেখায় পারদর্শিতা অর্জন করতে হবে। আমি নিজে দেখেছি, এখানকার বহু অমুসলিমও আরবি ভাষা শিক্ষার জন্যে সাগ্রহে নিজের অর্থ, শ্রম ও সময় বিনিয়োগ করছে। আমাদের মাতৃভাষা এবং ইংলিশ ভাষাও আমরা যথাযথ রপ্ত করবো। সঙ্গতকারণে আপাতত আমি আরবির কথাই বললাম।
তিন. আমরা বলি, কুরআন-হাদীস নিয়েই আমরা ব্যস্ত থাকি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কুরআন-হাদীসের মূল আরবি পাঠ আমাদের খুব কম লোকেরই মুখস্থ থাকে। অথচ এটি অতীব দরকারি একটি বিষয়। বিষয়ভিত্তিক কুরআনের আয়াত, হাদীসে নববি, আসারে সাহাবা ও তাবিয়িন এবং আকওয়ালে উলামা হাওয়ালাসহ আমরা মুখস্থ করার অভ্যাস গড়ে তুলি। বিজ্ঞজনের পরামর্শ নিয়ে আজ থেকেই কাজটি শুরু করে দিই।
চার. আমরা আসাতিযার মুখ থেকে প্রায়ই শুনি, দারসে নিযামি ইসলামি উলূমের বিশাল দুনিয়ায় প্রবেশের একটি চাবিমাত্র। তো সেই চাবি পেয়ে আমাদেরকে তা ব্যবহার করা শিখতে হবে। ক্লাসে তো প্রত্যেক ফন্ন ও শাস্ত্রের মৌলিক কিছু কিতাব পড়িয়ে দেওয়া হয়, আমাদের উচিত এগুলোর আলোকে সেই বিষয়ের শাস্ত্রীয় প্রচুর গ্রন্থ অধ্যয়ন করা। মাকতাবা ও গ্রন্থাগারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা। নিজের ব্যক্তিগত মাকতাবা গড়ে তোলা। যাদের সামর্থ্য আছে তারা নিজের সম্পদ ব্যয় করে এবং যাদের সামর্থ্য নেই তারা নিজের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বিয়োগ করে গ্রন্থ সংগ্রহ করতে থাকা। তাহকীকি মেযাজ সৃষ্টি করা। নিজের মাঝে ইখলাস, ইতকান ও ইখতিসাসের মানসিকতা জাগরূক করা। এসবের জন্যে চাই একজন, নিজের আসাতিযা কিংবা অন্য কোনো বিজ্ঞজন, তালিমি মুরব্বি নির্বাচন করা।
পাঁচ. আজকাল আমরা একটু বেশি সচেতন ও আধুনিক হতে শুরু করেছি! এর লাগাম এখনই টেনে ধরা উচিত। জানি, শাবাকা বা ইন্টারনেট ব্যবহার উপকারে আসে। আমাদের এই অত্যধিক ব্যবহার কিন্তু উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করছে। সেজন্যে এ বিষয়ে পূর্ণ সতর্ক ও সচেতন হওয়া চাই।
মূলকথা হলো, আমরা নিজেদের জীবনটাকে নতুন করে সাজানোর চেষ্টা করি। আর সেজন্যে আমাদেরকে সালাফে সালিহিনের যিন্দেগি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষাবর্ষ শুরুর এই দিনগুলোতে সে বিষয়ক কিছু গ্রন্থ মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করে নিই। শায়খুল হাদীস যাকারিয়া (রহ.)-এর আপ বীতি, শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ.)-এর সাফাহাত মিন সাবরিল উলামা, কীমাতুয যামান, আলউলামাউল উযযাব, শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামা হাফিযাহুল্লাহর মাআলিমু ইরশাদিয়া, শায়খুল ইসলাম আল্লামা তকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহর আকাবেরে দেওবন্দ কিয়া থে, নুকুশে রফতেগাঁ, মাওলানা ইবনুল হাসান আব্বাসি (দা. বা.)-এর মাতায়ে ওয়াক্ত, মাওলানা আবদুল মালেক (দা. বা.)-এর তালিবে ইলম: পথ ও পাথেয় প্রভৃতি গ্রন্থ তো আগ্রহভরে প্রথম সুযোগেই পড়ে নেয়া চাই।
হায়! হৃদয় থেকে বের হওয়া এ কটি কথা যদি কোনো হৃদয়ে প্রভাব ফেলে এবং কিছুটা জাগরণ সৃষ্টি করে!!
(দেশের বিভিন্ন মাদরাসা থেকে বিগত শিক্ষাবর্ষের শুরুতে তালিবুল ইলম ভাইদের অনেক প্রশ্ন আমার নিকট জমা হয়েছিল যে, উল্লিখিত জামায়াতের কিতাবগুলো কীভাবে পড়লে ভালো হয়। সে প্রশ্নগুলোর উত্তরে লেখা অধমের বিনীত পরামর্শসমূহ এখানে জামায়াতভিত্তিক পেশ করা হলো।)
দাওরায়ে হাদীস
দাওরায়ে হাদীসের বছর কুতুবুল হাদীসের সঙ্গে একইসময়ে যে সম্পর্ক থাকে, একইসাথে সবক’টি থেকে ইস্তিফাদার যে সুযোগ থাকে, মনে হয় এভাবে আর কখনও হয় না। পরে হয়তো হাদীসের গবেষক, লেখক, শিক্ষক হবেন, কিন্তু একইসঙ্গে সবক’টি তো আর হাতে আসবে না। সুতরাং এ বছরটি জীবনের এক অমূল্য, অতুলনীয় বছর। এর প্রত্যেকটি মুহূর্ত গুরুত্ববহ।
এমনিতেই যে কোনো নতুন জামায়াতে ভর্তি হওয়ার পূর্বে সেই জামায়াতের জন্যে প্রস্তুতিমূলক মুতালাআ শা’বানের শেষ থেকেই শুরু করে দেওয়া চাই। নতুন জামায়াতের মৌলিক কিতাবগুলোর ফন্ন ও শাস্ত্র সংক্রান্ত, তারপর দারস শুরু হওয়ার পূর্বে ওই কিতাবাদি সংক্রান্ত প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করে নেওয়া চাই। আর দাওরায়ে হাদীসের জন্যে তা তো ফরজ ও অপরিহার্যের পর্যায়ভুক্ত। আশা করছি, ইতোমধ্যে এ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
এবার কথা হলো, হাদীসের এইসকল কিতাবের সঙ্গে আর কী কী মুতালাআ করা যায়। আসলে এ বছর কী কী মুতালাআ করা যায়, তাও নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। কারণ এ বছর পুঁজি সংগ্রহের বছর, যতবেশি পারা যায়, যেভাবে পারা যায়, করতে থাকা উচিত। যাতে কুতুবুল হাদীস, উলূমুল হাদীস, রিজালুল হাদীস এবং শুরুহুল হাদীসের সাথে গভীর সম্পর্ক ও আত্মিক সখ্যতা গড়ে উঠে।
আল-হামদু লিল্লাহ! উম্মাহর পূর্বসূরি, উত্তরসূরি, সর্বযুগে জাতির কাণ্ডারি আলিমগণ হাদীসের কিতাবগুলোর বিভিন্নভাবে রকমারি খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। আজ আপনি এক একটি হাদীসগ্রন্থের আরবি-উর্দু এবং অন্যান্য ভাষায় এতো প্রচুর শারহ ও ব্যাখ্যাগ্রন্থ সামনে পাবেন যা অকল্পনীয়। একই বছর সব কিতাবের সকল শারহ দেখে নেওয়া অসম্ভব না হয়, দুঃসাধ্য অবশ্যই। সে জন্যে চাই, অতিব জরুরি ও উপকারী শারহগুলো নির্বাচন করা।
সংক্ষেপে এতটুকু বলা যায়, সহীহ বুখারীর সঙ্গে হাফিয ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.)-এর ফতহুল বারী, আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (রহ.)-এর উমদাতুল কারী, আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী (রহ.)-এর ফায়যুল বারী ধারাবাহিকভাবে মুতালাআ করতে থাকুন। কিরমানী, কাসতাল্লানী, লামিউদ দারারীও সঙ্গে রাখুন। হাফিয ইবনে রাজাব হাম্বলি (রহ.)-এর ফাতহুল বারী সংগ্রহ করতে পারলে তা গনিমত মনে করুন। আবওয়াব ও তারাজিমের জন্যে শায়খুল হাদীস যাকারিয়া (রহ.)-এর আল-আবওয়াব ওয়াত তারাজিম খুব উপযুক্ত কিতাব। ক্বালা বা’যুন বিষয়ে শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ.)-এর তাহকীক কৃত, আল্লামা আবদুল গনী আল-গুনাইমী (রহ.)-এর কাশফুল ইলতিবাস অবশ্যই অধ্যয়ন করুন। উর্দুতে উসতাযে মুহতারাম, মুফতি মুজিবুর রাহমান সাহেব (দা. বা.)-এর ইযালাতুল কুসাস তো আছেই। এটি ইন্ডিয়া থেকেও ছেপেছে। আজকাল অধম বান্দাহ বাংলায় হানাফী মাযহাব ও ইমাম বুখারী (রহ.) নামে একটি রিসালা প্রস্তুত করেছি। কিছুদিনের মধ্যে ছেপে আসবে ইনশাআল্লাহ। চাইলে তাও একনজর দেখে নিতে পারেন।
সহীহ মুসলিমের সঙ্গে ইমাম নাওয়াওয়ি (রহ.)-এর আল-মিনহাজ, যা হাশিয়ায়ে নাওয়াওয়ি নামে সমধিক প্রসিদ্ধ এবং হিন্দুস্তানি নুসখার সঙ্গে যুক্ত, খুবই উপকারী। তবে আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানি (রহ.)-এর ফাতহুল মুলহিম থেকে কোনো অবস্থায় মাহরূম হবেন না। আর মুসলিম সানি’র জন্যে শায়খুল ইসলাম তকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহর তাকমিলায়ে ফাতহুল মুলহিম তো অবশ্যই মুতালাআ করবেন। ইলম ও তাহকীকের নতুন দিগন্ত আপনার সামনে উন্মোচিত হবে ইনশাআল্লাহ। সহীহ মুসলিমের মুকাদ্দামাটা খুব ভালো করে পড়া চাই। এরও পৃথক অনেক শারহ আছে। ঢাকার মাওলানা সফি উল্লাহ ফুয়াদ সাহেব তায়সিরু মুকাদ্দামাতি মুসলিম নামে একটা কাজ করেছেন।
সুনানে তিরমিয়ীর সঙ্গে গায়রে মুকাল্লিদ আলিম মুহাদ্দিস আবদুর রাহমান মুবারকপুরী (রহ.)-এর তুহফাতুল আহওয়াযী শারহ হিসেবে খুবই সুন্দর ও উপকারী। তবে ফিকহি মাসায়েলের আলোচনা দেখতে আপনি অবশ্যই আল্লামা ইউসুফ বানুরী (রহ.)-এর মাআরিফুস সুনান (যা মূলত কাশ্মীরী (রহ.)-এর অপর এক শাগরিদকৃত তাঁর দারসি তাকারীরের সংকলন আল-আরফুশ শাযী (হিন্দুস্তানি নুসখার সঙ্গে যুক্ত)-এর সংশোধিত ও সংযোজিত রূপ, কিতাবুল হজ্জ পর্যন্ত, পাকিস্তানে এর তাকমিলার কাজ চলছে, ইতোমধ্যে কিছু ছেপে এসেছে) মুতালাআ করবেন। ইবনুল আরবি (রহ.)-এর আরিযাতুল আহওয়াযি, আল্লামা রশিদ আহমদ গঙ্গুহী (রহ.)-এর দারসি তাকারীর, শায়খুল হাদীস যাকারিয়া (রহ.)-এর হাশিয়াসহ আল-কাওকাবুদ দুররিও সাথে রাখুন। সুনানে তিরমিযীর ‘ওয়া ফিল বাব’ বিষয়ে সম্ভব হলে ড. হাবিবুল্লাহ মুখতার (রহ.)-এর কাশফুন নিকাব দেখুন। শামাইলে তিরিমিযীর জন্যে মোল্লা আলী কারী (রহ.)-এর জামউল ওয়াসাইল অধ্যয়ন করুন। এর কোনো কোনো নুসখার সাথে আবদুর রউফ মুনাওয়ী (রহ.)-এর একটি শারহও যুক্ত আছে, তাও দেখুন। বাজুরী (রহ.)-এর আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া আলাশ শামাইলিল মুহাম্মদিয়াও কিছুকাল আগে শায়খ আওয়ামা হাফিযাহুল্লাহর তাহকীকসহ ছেপে এসেছে।
সুনানে আবু দাউদের সঙ্গে আল্লামা সাহারানপুরী (রহ.)-এর বাযলুল মাজহুদই দেখতে থাকুন। সম্ভব হলে গায়রে মুকাল্লিদ আলিম শায়খ শামসুল হক আযিমাবাদী (রহ.)-এর আওনুল মাবুদ এবং এরই নিচে যুক্ত হাফিয ইবনুল কাইয়িম (রহ.)-এর তাহযিব মুতালাআ করুন। খাত্তাবি (রহ.)-এর মাআলিমুস সুনান পেলে গনিমত মনে করুন। আজকাল তো আইনী (রহ.)-এর শারহটিও ছেপে এসেছে।
সুনানে নাসায়ি এবং সুনানে ইবনে মাজাহরও কিছু শারহ আছে। এগুলোর জন্যেও সময় রাখুন। শারহুস সুয়ূতি এবং হাশিয়াতুস সিন্ধি তো আছেই। তা ছাড়া কজন মনীষীর লেখা সুনানে ইবনে মাজাহর কয়েকটি শারহ একত্রে শুরুহু সুনানিবনি মাজাহ নামেও ছেপেছে। উসতাযে মুহতারাম, মাওলানা সালেহ আহমদ সালিক কালিগঞ্জী (দা. বা.)-এর আমানিল হাজাহ, যতদূর জানি বাংলাদেশ ছাড়া ভারত-পাকিস্তান থেকেও ছেপেছে।
ইমাম তাহাওয়ী (রহ.)-এর শারহু মাআনিল আসার’র সঙ্গে আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (রহ.)-এর নুখাবুল আফকার (মাওলানা আরশাদ মাদানী হাফিযাহুল্লাহর তত্ত্বাবধানে এর ওপর কিছু কাজ করা হয়েছে) দেখুন। আরও দেখুন মাওলানা ইউসুফ কান্দলবি (রহ.)-এর আমানিল আহবার। সুযোগ থাকলে ইমাম তাহাওয়ী (রহ.)-এর শারহু মুশকিলিল আসার (শারহু মাআনিল আসার আর এটি এক কিতাব নয়)-এর সাথেও পরিচিত হন।
মুআত্তা ইমাম মালিক গুরুত্বপূর্ণ কিতাব। হাফিয ইবনে আবদুল বার (রহ.) এর ওপর খুবই মূল্যবান দু’টি শারহ লিখেছেন। আত তামহিদ এবং আল-ইসতিযকার। কমপক্ষে দ্বিতীয়টি সামনে রাখুন। আর শায়খুল হাদীস যাকারিয়া (রহ.)-এর আওজাযুল মাসালিক থেকে কখনও মাহরূম হবেন না।
মুআত্তা ইমাম মুহাম্মদের সঙ্গে আল্লামা আবদুল হাই লাখনউভী (রহ.)-এর আত তা’লীকুল মুমাজ্জাদ দেখতে পারেন।
অভিজ্ঞতা সাক্ষী যে, এ কাজগুলো সম্পাদন করা অসম্ভব কিছু নয়। তবে এর জন্যে চাই উৎসাহ-উদ্দীপনা, সাহস ও মনোবল। সবকটি শারহ পূর্ণরূপে শেষ না করা গেলেও অন্তত বছরের প্রথম ছয় মাস তো কষ্টকর নয়। তা ছাড়া কিছু কিতাব ঠিক করুন যে, এগুলো আমাকে পুরোপুরি পড়তেই হবে, হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
আরেকটি বড় কাজ হলো, সবকটি শারহ অধ্যয়ন করার সময় গুরুত্বপূর্ণ, জরুরি ও উপকারী তথ্যগুচ্ছ নোট করে রাখুন। সমকালীন বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান হাদীস থেকে অনুসন্ধান করত নোটবুকে লিখে রাখুন। কাজটি করতে পারলে সারাজীবন এর সুফল ভোগ করবেন। ভবিষ্যতে ইলমি কোনো কাজের পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করতে এটা হবে অন্যতম সহায়ক ও সম্পূরক। ইতিহাস বলে, বড়রা এভাবে ইলমি কাজের জন্যে অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে থাকতেন।
মুখতারাত মিন কুতুবি শায়খিল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.), মুখতারাত মিন সিয়ারি আ’লামিন নুবালা, মুখতারাত মিন আদাবিল আরাব প্রভৃতি মুখতারাত (চয়নিকা) হতে পারলে মুখতারাত মিন ফাতহিল বারী, মুখতারাত মিন উমদাতিল কারী, মুখতারাত মিন ফায়যিল বারী, মুখতারাত মিন শারহিন নাওয়াওয়ি, মুখতারাত মিন মাআরিফিস সুনান, মুখতারাত মিন আওজাযিল মাসালিক ইত্যাদি কেন হতে পারবে না? বস্তুত এগুলো থেকে ইলমি, আমলি, আদবি অনেক সুখপাঠ্য তথ্যবহুল গ্রন্থ রচিত হতে পারে।
সর্বোপরি, দাওরায়ে হাদীসের বছর যেভাবে ইলমি জাগরণ সৃষ্টি হওয়া প্রত্যাশিত, তেমনি আমলি পরিবর্তন সাধিত হোক- চাই। এ বছর যেভাবে হাদীসের সঙ্গে সম্পর্ক হবে, তেমনি সাহিবে হাদীস (সা.)-এর সঙ্গেও তাঁর সুন্নাহর অনুসরণের মাধ্যমে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠুক চাই।
দুটি প্রশ্ন অনেকই করতে চায়, এতগুলো কিতাব সংগ্রহ করবো কীভাবে এবং এগুলো পড়ার সময় পাবো কীভাবে! ইনশাআল্লাহ পরবর্তী কোনো সুযোগে এ বিষয়ে কিছু কথা পেশ করার ইচ্ছে আছে। আল্লাহ তাআলাই তাওফিকদাতা।
মিশকাতুল মাসাবিহ
মিশকাতুল মাসাবিহের জন্যে মোল্লা আলী কারী (রহ.)-এর মিরকাতুল মাফাতিহ খুবই উপকারী। এটা শুরু করার আগে ড. আবদুল হালিম চিশতি কৃত বিযাআতুল মুযজাত লিমান উতালিউল মিরকাত অবশ্যই দেখে নেওয়া উচিত। শারহ হিসেবে আল্লামা তিবী (রহ.)-এর আল-কাশিফ আন হাকায়িকিস সুনান (যা শারহুত তিবি নামে সমধিক প্রসিদ্ধ)ও দেখা যেতে পারে। শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) মিশকাত পড়ানোর সময়ে এ শারহটি সামনে রাখতেন এবং ছাত্রদের পড়ে শুনাতেন। আর আল্লামা ফযলুল্লাহ তুরপিশতী (আরবিতে তুরিবিশতী) (রহ.)-এর আল-মুয়াসসির সংগ্রহ করতে পারলে তো সোনায় সোহাগা। মিশকাতুল মাসাবিহের হিন্দুস্তানি নুসখার শেষে যুক্ত আছে আল-ইকমাল ফি আসমায়ির রিজাল। মাত্র কয়েক পৃষ্ঠা। তা তো অবশ্যই পড়বেন। ফিকহি মাসায়েলের দলিলসমূহের তুলনামূলক পর্যালোচনা জানতে চাইলে আল্লামা ইবনে রুশদ (রহ.)-এর বিদায়াতুল মুজতাহিদ কিতাবটি সংগ্রহ করুন। এটি পড়লে ফিকহি মাসায়েলে আইম্মায়ে দীনের যে ইখতিলাফ হয়েছে তার সাবাব ও হেতু কী- সেটা জানতে পারবেন এবং হৃদয়ে প্রশান্তি অর্জিত হবে ইনশাআল্লাহ।
দুঃখের বিষয় হলো, আজকাল ‘ছাত্ররা’ মিশকাত মানেই দরসে মিশকাত বুঝে। এটা স্বীকার্য, ওটা একজন বহু বড় উসতাযুল হাদীসের দরসি তাকারীরের সংকলন। সহজ উপস্থাপনা এবং ‘ফাইনাল পরীক্ষা’র জন্যে সহায়ক (!) কিন্তু আমি মনে করি, এটাকেই মিশকাত মনে করা আমাদের ইলমি যাওকের দৈন্যতা ও শূন্যতার পরিচায়ক। অবশ্য মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী হাফিযাহুল্লাহর আব্বা মাওলানা আবুল হাসান চাটগামী (রহ.)-এর তানযিমুল আশতাত হাদীসের বড় বড় শারহগুলোর একটি চয়নিকা। সাথে রাখা যেতে পারে।
তাফসীরে বায়যাভীর জন্যে বিশদ শারহ হলো হাশিয়াতুশ শিহাব। তবে কম সময়ে মুতালাআ করার জন্যে হাশিয়ায়ে শেখ যাদাহ সুবিধাজনক হবে। উর্দুতে উসতাযে মুহতারাম হযরত কালিগঞ্জী হুজুর (দা. বা.)-এরও একটি শারহ আছে। চাইলে তাও একনজর দেখে নিতে পারেন।
হেদায়ার জন্যে আগে কোনো এক
লেখায় কিছু কথা পেশ করা হয়েছে।
শারহুল আকায়িদের জন্যে আল্লামা আবদুল আযিয ফারহারী (রহ.)-এর আন নিবরাসই যথেষ্ট। উল্লেখ্য, শারহুল আকায়িদের শেষ দিককার খালিস আকায়িদি বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে পড়া চাই। দলিলগুলো আত্মস্থ করা। সহীহ আকিদা বুঝা। নিজে ফিতনা থেকে বাঁচা এবং অন্যকে রক্ষা করার যোগ্যতা অর্জন করা। এজন্যে প্রাসঙ্গিক সম্পূরক আরও কিতাব মুতালাআ করা দরকার। বিগত বছর আকিদাতুত তাহাওয়ীর সঙ্গে ইবনু আবুল ইয হানাফীর শারহুল আকিদাতিত তাহাওয়িয়া পড়া না হলে এ বছর তা থেকে মাহরুম না হওয়া। মরহুম শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানীর কাজ করা নুসখাটি আপাতত না দেখা ভালো।
শারহু নুখবাতিল ফিকার তো খুবই জরুরি কিতাব। এটাকে খুব ভালো করে পড়া চাই। মোল্লা আলী কারী (রহ.)-এর একটি শারহ লিখেছেন, তা দেখতে পারেন। মরহুম শায়খ সালেহ আল-উসাইমীনেরও একটি সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ছাত্রজীবনে আমার চোখে পড়েছে, তবে এটি সংগ্রহ করার দরকার নেই। মাওলানা আবদুল মালেক সাহেব হাফিযাহুল্লাহ এর ওপর একটি বিশদ ইলমি কাজ করেছেন, যা এখনও পাণ্ডুলিপি আকারে রয়েছে। কতিপয় বন্ধুর নিকট ওটার কিছু অংশ দেখার সুযোগ হয়েছিল। খুবই উপকারী। ছেপে আসলে তা থেকে কোনো তালিবুল ইলম মাহরূম থাকা ঠিক হবে না। যাইহোক, এর সঙ্গে আপনার তা’লিমি মুরব্বির মাশওয়ারা অনুযায়ী উলূমুল হাদীস বিষয়ক বেশকিছু কিতাব মুতালাআ করে নেওয়া চাই।
জালালাইন
তাফসীরে জালালাইনের উর্দু/বাংলা শারহ দেখে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। আরবিও শুধু হাশিয়াতুস সাওয়ী দেখা যেতে পারে। এটি তিন খণ্ডে প্রকাশিত। তা ছাড়া শারহ দেখার চেয়ে অপরাপর তাফসীরগ্রন্থ দেখাই ভালো। যেমন তাফসীরে ইবনে কসীর, তাফসিরুল কুরতুবি, আত তাফসিরুল মুনির প্রভৃতি। এর সাথে আহকাম সংক্রান্ত আয়াতগুলোর তাফসীরবিষয়ক পৃথক অনেক গ্রন্থ রয়েছে; সেগুলো দেখে নেওয়া চাই। যেমন- আহকামুল কুরআন লিল জাসসাস, আহকামুল কুরআন লিত থানভী প্রভৃতি। এরপর উলূমুল কুরআন ও উসূলুত তাফসীর বিষয়ক প্রচুর কিতাব এ বছরই পড়ে নেওয়া দরকার। যেমন- মানাহিলুল ইরফান, আত তাফসীর ওয়াল মুফাসসিরুন, উলূমুল কুরআন; তকী উসমানী ইত্যাদি।
আর হিদায়ার শারহ হিসেবে ফাতহুল কাদির ও আল-বিনায়া দেখা যেতে পারে। ফাতহুল কাদিরের সাথে ইনায়া ও কিফায়া সংযুক্ত আছে, সেগুলোও মুতালাআ করা চাই। হাদীসের তাখরিজ এবং তৎসংশ্লিষ্ট আলোচনার জন্যে হিদায়ার হিন্দুস্তানি নুসখার সাথে ইবনে হাজার (রহ.)-এর আদ-দিরায়া সংযুক্ত আছে। তবে তা যথেষ্ট নয়। এজন্যে অবশ্যই যায়লায়ী (রহ.)-এর নাসবুর রায়া অধ্যয়ন করা দরকার।
তাছাড়া যেহেতু এ শ্রেণিতে কিতাবুল বুয়ু পড়ানো হয় তাই আধুনিক ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আধুনিক বিশ্বে ইসলামি অর্থনীতির প্রয়োগ ও প্রয়োজনীয়তা বিষয়ক সমসাময়িক আলিমদের লেখাগুলো পড়া চাই। এক্ষেত্রে শায়খুল ইসলাম তকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহর কিতাবগুলো সবচেয়ে অগ্রগণ্য।
তারপর মুসতালাহুল হাদীস বিষয়ক একটি কিতাবও এ জামায়াতে পড়ানো হয়। সেটাও খুব ভালো করে পড়া দরকার। এর সাথে উলূমুল হাদীসের প্রাথমিক কিছু কিতাব পড়ে নিলে আগামীর জন্যে সহায়ক হবে। যেমন, লামাহাত ফি উসূলিল হাদীস, আল-মাদখাল ইলা উলূমিল হাদীসিশ শারিফ, এ কিতাব পড়লে এবিষয়ক আরও অনেক নির্দেশনা পাওয়া যাবে।
সর্বশেষ কথা হলো, যেহেতু এ ক্লাসে ফাইনাল পরীক্ষা নেই তাই পরীক্ষার চিন্তা আপাতত মাথায় না রেখে নিজের ইলমি ভীত মজবুত করে নেওয়ার জন্যে প্রচেষ্টা চালানো উচিত। তাফসীরে জালালাইনের সাথে বিষয়ভিত্তিক আয়াত মুখস্থ করা এবং আদিল্লাতুল হানাফিয়া বা হাদীসের অন্য যে কিতাব এ জামায়াতে পড়ানো হয়, তার সাথে সামর্থ্যানুযায়ী প্রচুর পরিমাণে হাদীস মুখস্থ করে নেওয়া খুবই জরুরি ও উপকারী।
মুখতাসারুল মাআনী
মুখতাসারুল মাআনীর জন্য আমাদের কোনো কোনো তালিবুল ইলম সাথী তাকমীলুল আমানী আর নায়লুল আমানী এগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তা উচিত নয়। যারা আরবি পড়তে ও বুঝতে পারেন (এবং এ জামায়াতের ছাত্রের জন্য এমনই হওয়া চাই) তারা যদি শারহ দেখতে চান তবে হাশিয়াতুদ দুসুকি ভালো হবে। এতে কিছু কাজের কথা মিলতে পারে। অন্যথায় শারহ না দেখে এ বিষয়ক অন্যান্য গ্রন্থ অধ্যয়ন করা দরকার। যেমন- জুরজানীর আসরারুল বালাগা, সাইয়েদ হাশিমীর জাওয়াহিরুল বালাগা প্রভৃতি। অবশ্য মুকাদ্দামার জন্যে শায়খুল হাদীস মাহমুদ হুসাইন সাহেব (দা. বা.)-এর বুলুগুল আমানী সংগ্রহে রাখা যেতে পারে।
হিদায়ার জন্য আগে কিছু কথা আরয করা হয়েছে, এখানেও তা প্রযোজ্য। যেহেতু কিতাবুন নিকাহ পড়ানো হয় তাই এ সংক্রান্ত চলমান বিশ্বের কী সমস্যা ও সমাধান তা জানার জন্যে সমকালীন ফকিহদের লিখা আরবি, উর্দু ও বাংলা বইগুলো পড়া ভালো হবে।
নুরুল আনওয়ার এ জামায়াতে কিতাবুস সুন্নাহ থেকে পড়ানো হয়। তালিবুল ইলমের জন্যে এ অধ্যায়টি অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে মুতালাআ করা জরুরি। এর সঙ্গে উসূলুল ফিকহ বিষয়ক হানাফী ফিকহের অপরাপর লেখকদের গ্রন্থ সংগ্রহ করা উচিত। উসূল খুব ভালোভাবে রপ্ত করা; যাতে সমসাময়িক অনেক ফিতনার খণ্ডন করার যোগ্যতাও তৈরি হয়।
মাকামাতুল হারিরি প্রাচীন আরবি সাহিত্যের একটি স্মৃতিফলক। এখানে মূল লক্ষ্য থাকবে, বেশি বেশি আরবি শব্দের সাথে পরিচিতি হওয়া, অর্থ জানা। কুরআন-হাদীসে এ শব্দগুলো ব্যবহৃত কি না? হলে কোথায়, কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা জানার ও বুঝার চেষ্টা করা। এ ক্ষেত্রে আল্লামা ইদরীস কান্ধলভী (রহ.)-এর আরবি হাশিয়া অনেক বড় সহায়ক। পাকিস্তানের মাওলানা ইবনুল হাসান আব্বাসির দরসে মাকামাতও কম সুন্দর নয়। আর শায়খুল আদব ই’যায আলী (রহ.)-এর আল-কুনুযুল ই’যাযিয়া (আমাদের দরসে সাধারণত যে মাকামাত সামনে থাকে, তার সঙ্গে সেটা যুক্ত আছে) কিছুটা বিস্তারিত। তা ছাড়া শারহু মাকামাতিল হারিরি লিশ শুরায়শি (পূর্ণ মাকামাতের শারহ ৬ খণ্ডে) হিম্মতওয়ালাদের জন্যে। শব্দের একাধিক অর্থ মুখস্থ করা (পরে কোনো একটাও মনে না থাকা!) এর চেয়ে নির্দিষ্ট স্থানে কোন অর্থে ব্যবহৃত হলো এবং কুরআন-হাদীসের প্রয়োগবিধিটা জেনে নিলেই হয়। মাহাসিনুল বালাগা বিষয়ে অধমের ছাত্রজীবনর একটি নোটখাতা মাহাসিনুল বালাগা ফিল মাকামাতিল হারিরিয়া (আরবি) নামে সিলেট থেকে ছাপা হয়েছে।
আদিল্লাতুল হানাফিয়া খুব সময়োপযোগী একটা কিতাব। এর হাদীসগুলোর বিশুদ্ধ পাঠ ও অনুবাদ জানাই আপাতত যথেষ্ট। বিশদ ব্যাখা তো পরে বড় বড় জামায়াতগুলোতে পাওয়া যাবে। সুতরাং ব্যাখা-বিশ্লেষণের পেছনে সময় ব্যয় না করে বর্ণনাকারী সাহাবী এবং উদ্ধৃত কিতাবের নামসহ প্রচুর পরিমাণে হাদীস মুখস্থ করতে থাকা উচিত। এ কারণেই সিলেটের নিউ মাদানিয়া কুতুবখানার ফরমায়েশে আদিল্লাতুল হানাফিয়ার তারজামা ও তা’লিকের যে কাজ অধমের দ্বারা করানো হয়েছে সেখানে বিস্তারিত কোনো আলোচনা করা হয়নি।
সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, কুরআনে করীমের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করা। এটাকে বলা হয়, তারজমাতু মাআনিল কুরআন। এখানে তাফসীর শিখা মুখ্য নয়। তাই বিশুদ্ধ ভাবার্থ এবং তদসংশ্লিষ্ট একান্ত প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো জানাই যথেষ্ট। সাফওয়াতুত তাফাসির থেকে সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। উসতাযে মুহতারাম হযরত কালিগঞ্জী হুজুর (দা. বা.)-এর আল-লু’লুয়ু ওয়াল মারজান তো আছেই।
সর্বশেষ কথা হলো, ইলমি ইস্তি’দাদ গঠনে আত্মনিয়োগ করা চাই। আরবি ভাষাকে আয়ত্তে আনা। উত্তরপত্র আরবিতে লেখা। মাঝে মাঝে আরবি ও বাংলায় বিষয়ভিত্তিক ইলমি মাকালা ও প্রবন্ধ রচনার অভ্যাস গড়ে তুলা। সর্বোপরি নিজের তালিমি মুরব্বির সাথে মাশওয়ারা করে যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
শরহে জামী
প্রশ্ন: আমি এই বছর শরহে জামী জামায়াতে পড়ব এবং আমাদের মাদরাসায় এই কিতাবের পরিবর্তে শরহে ইবনে আকিল পড়ায়। হুজুরের নিকট বিনীত নিবেদন আমাদের জন্য অর্থাৎ জামায়াতে শরহে জামীর ছেলেদের জন্য দিকনির্দেশনা মূলক কিছুকথা পেশ করবেন। হুজুরের নিকট আরেকটি প্রশ্ন হলো, আমাদের মাদরাসায় কাফিয়ার পরিবর্তে কতরুন নিদা এবং শরহে জামীর পরিবর্তে শরহে ইবনে আকিল পড়ানো হয়। হুজুরের কাছে এর ভালো দিক মন্দ দিক সম্পর্কে জানতে চাই? এবং আমাদের মাদরাসায় মানতিক মোটেও পড়ানো হয় না তবে তাইসিরূল মানতিক এবং মিরকাত সামান্য একটু পড়ানো হয়েছিল। হয়তো সামনে আর পড়ানো হবে না। বর্তমানে কি মানতিক এর প্রয়োজনীয়তা আছে? এবং হুজুরের কাছে জানতে চাইবো, বর্তমান যুগে উর্দুর প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? উল্লেখ্য যে, আমাদের মাদরাসায় উর্দুও পড়ানো হয় না।
উত্তর: আসলে আপনাদের জামিয়ায় এই জামায়াতে কোন কোন কিতাব পড়ানো হয়, আমার জানা নেই। আমাদের সিলেটে যে কিতাবগুলো পড়ানো হয়, সেগুলোর ভিত্তিতে কিছু কথা পেশ করা যেতে পারে।
এ জামায়াতের অতীব গুরুত্বপূর্ণ কিতাব হলো, হিদায়া। হানাফী ফিকহ এবং সাধারণ ইসলামি ফিকহে এ গ্রন্থের প্রয়োজনীয়তা, কার্যকারিতা ও উপকারিতা সর্বমহলে স্বীকৃত। সাহিবে হিদায়া আল্লামা বুরহানুদ্দীন মারগিনানী (রহ.)-এর জীবনের বিভিন্ন দিক, বিশেষত ইলমে হাদীসে তাঁর মাকাম এবং হিদায়া কিতাব সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য, বিশেষত এতে উদ্ধৃত হাদীসগুলোর মান ইত্যাদি কিছু বিষয় নিয়ে অধমের আল-ইমামুল মারগিনানী ওয়া কিতাবুহুল হিদায়া (আরবি, অপ্রকাশিত, আল্লাহ পাক যেন ছাপানোর ব্যবস্থা করে দেন) গ্রন্থটি প্রস্তুত করা হয়েছে। যাইহোক, হিদায়ার শারহ হিসেবে ইবনুল হুমাম (রহ.)-এর ফাতহুল কাদির এবং বদরুদ্দীন আইনী (রহ.)-এর আল-বিনায়া দেখা যেতে পারে। ফাতহুল কাদিরের সাথে ইনায়া ও কিফায়া সংযুক্ত আছে, সেগুলোও মুতালাআ করা চাই। হাদীসের তাখরীজ এবং তৎসংশ্লিষ্ট আলোচনার জন্যে হিদায়ার হিন্দুস্তানী নুসখার সাথে ইবনে হাজার (রহ.)-এর আদ-দিরায়া সংযুক্ত আছে। তবে তা যথেষ্ট নয়। এজন্যে অবশ্যই জামালুদ্দিন যায়লায়ী (রহ.)-এর নাসবুর রায়া অধ্যয়ন করা দরকার।
নুরুল আনওয়ার এমনিতেই একটি শারহ ও বিশদগ্রন্থ। এর কোনো শারহ দেখার প্রয়োজন নেই। এর সঙ্গে উসূলুল ফিকহ বিষয়ক হানাফী ফিকহের অপরাপর লেখকদের গ্রন্থ সংগ্রহ করা উচিত। উসূল খুব ভালোভাবে রপ্ত করা; যাতে কুরআন-সুন্নাহ থেকে আহকাম আহরণের পদ্ধতি জানা হয়, সেগুলোর আলোকে নিত্যনতুন মাসায়েলের সমাধান আবিষ্কার করা যায় এবং সমসাময়িক অনেক ফিতনার খণ্ডন করার যোগ্যতাও তৈরি হয়।
বড় একটা কাজ হলো, এ জামায়াতে তারজামাতু মাআনিল কুরআনের যে অংশ পড়ানো হয় তা খুব ভালো করে বুঝা। অনুবাদ গ্রন্থের সাহায্যে নয়, নিজে নিজেই মর্মার্থ উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হওয়া চাই। কুরআনে করীমের সঙ্গে সম্পর্ক যেন মজবুত হয়।
দুরুসুল বালাগাহ অথবা বালাগাতের যে কিতাবই পড়ানো হয়, ভালো করে পড়া। আল-বালাগাতুল ওয়াযিহা কিংবা সমসাময়িক লেখকদের অন্য কোনো কিতাব; যেখানে কুরআন-হাদীস থেকে বেশি বেশি উদাহরণ পেশ করা হয়েছে সেগুলো সম্পূরক অধ্যয়নের জন্যে সঙ্গে রাখা উচিত।
আমি নিশ্চিত যে, আপনাদের ওখানে এ জামায়াতে আরবি আদাবের উপযুক্ত কোনো কিতাব পড়ানো হয়। সেটা খুব যত্নসহকারে মন দিয়ে পড়া। আমাদেরকে আরবি ভাষা পূর্ণরূপে আয়ত্ত ও আত্মস্থ করতে হবে। কুরআন-সুন্নাহর সহীহ ও সরাসরি জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে আরবির কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান বিশ্বে এটি আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃত, সমাদৃত ও প্রয়োজনীয় একটি ভাষা। আরবিকে একটি জীবন্ত ভাষা হিসেবে শিখতে হবে। শুনা ও বলায়, পড়া ও লেখায় পারদর্শিতা অর্জন করতে হবে। আরবিতে বক্তৃতা দেওয়া ও প্রবন্ধ লেখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
এবার আসি শরহে ইবনে আকিলের কথায়। এটি মূলত আলফিয়াতু ইবনে মালিকের একটি নামকরা ভালো শারহ। খুবই উপকারী। এর সঙ্গে আলফিয়ার অন্যান্য শারহ যেমন, ইবনে হিশামের আওযাহুল মাসালিক, শারহুল উশমুনি, শারহুশ শাতিবি প্রভৃতি গ্রন্থ দেখতে পারেন। আর শুধু শারহ নয়, মৌলিক কিছু কিতাবও দেখতে পারেন, যেমন সিবাওয়াইহর আল-কিতাব, ইবনে জিন্নী (জিনি/জুনি)-এর আল-খাসাইস, আবুল বারাকাত আনবারীর আল-ইনসাফ, ইবনে হিশামের মুগনিল লাবিব, সুয়ূতির হামউল হাওয়ামি ইত্যাদি।
আকাবিরে উলামা সময় ও পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে একেক জায়গায় একেক কিতাব উপযোগী মনে করেছেন। সে জন্যে আমার মনে হয়, শারহে ইবনে আকিলকেই গুরুত্ব দিন উপকৃত হবেন ইনশাআল্লাহ। ইবনে হিশামের কাতরুন নাদাও উপকারী এবং সময়োপযোগী একটি কিতাব। বস্তুত মুতাকাদ্দিমিন নাহু শাস্ত্রের জন্যে মুতুনের পর কাতরুন নাদা দিয়েই এ ফন্নের নতুন দিগন্তে তালিবুল ইলমদের প্রবেশ করতে বলতেন।
পূর্ববর্তী আলেমগণের কিতাবাদিতে অনেক মানতিকি পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। তো ইলমুল মানতিকের বড় বড় কিতাব না পড়লেও, প্রাথমিক এই কিতাবদ্বয়কে অবহেলা না করা। অন্ততপক্ষে তাঁদের কিতাবে ব্যবহৃত পরিভাষাগুলো বুঝতে সহায়ক হবে।
উর্দু ভাষা না জেনে মুহাক্কিক আলেম হওয়া যাবে না, বিষয়টি তো এমন নয়। তবে যেহেতু আমাদের এ উপমহাদেশের আকাবির উলামা এ ভাষায় অনেক বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ ইলমি খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন সেগুলো থেকে উপকৃত হওয়ার নিয়তে উর্দু ভাষা শিক্ষা করা ভালো কথা এবং প্রত্যাশিত। তবে মূলকে নষ্ট করে নয়। যাই হোক সময় ও সুযোগ থাকলে আপনি ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় উর্দু শিখতে চাইলে এবং পারলে তা হবে সোনায় সোহাগা।
সঙ্গতকারণে বিস্তারিত লেখা সম্ভব হলো না। আল্লাহ তাআলা যেন আপনাকে, আমাকে, আমাদের সবাইকে তাঁর দীনের মুখলিস ও মুতকিন খাদিম হিসেবে কবুল করেন। আমিন।