বিতর্কিত পাঠ্যপুস্তক সংশোধনের উদ্যোগ ইতিবাচক তবে সতর্ক থাকতে হবে
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক রচিত স্কুলের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইতে যেসব বিষয়বস্তু লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তা যথেষ্ট আপত্তিকর, ইতিহাস বিকৃতি ও লালিত উত্তরাধিকার ঐতিহ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পুরো দেশ এটা নিয়ে ক্ষোভ, উৎকণ্ঠা ও প্রতিবাদে মুখর। ইতোমধ্যে সরকার বিতর্কিত পাঠ্যপুস্তক সংশোধনের উদ্দেশ্যে দুটি কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছে এবং কমিটিতে বিশেষজ্ঞ আলিমদের অন্তর্ভুক্তির কথাও বলেছে। আমরা এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখতে চাই। তবে সতর্ক থাকতে হবে যাতে আইওয়াশের মতো কোনো ঘটনা না ঘটে।
২০২৩ সালের পাঠ্যপুস্তকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের চিন্তা-চেতনা, আদর্শ ও কৃষ্টির প্রতিফলন ঘটেনি। সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান বইয়ে ব্রিটিশ শাসনপূর্ব মুসলিম শাসকদের হেয় ও খাটো করা হয়েছে। ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবিজয়ী ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজিকে মন্দির ধ্বংসকারী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ঘটনাটি ইতিহাসবিদগণ মিথ্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অথচ তিনি ছিলেন নিপীড়িত বাঙালি জনগোষ্ঠীর ত্রাণকর্তা। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ইলামিত্র ও প্রীতিলতার অবদান উল্লেখ করা হলেও তিতুমীর, হাজি শরিয়তুল্লাহ, দুদু মিয়া ও ফকির মজনু শাহের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়নি।
ট্রান্সজেন্ডার শিক্ষার নামে সমকামী ও তৃতীয় লিঙ্গের অনৈতিকতাকে উজ্জীবিত করা হয়েছে। এতে করে যৌনতা বিষয়ক সামাজিক শৃঙ্খলা হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। গল্পের মাধ্যমে পর্দা ও হিজাবের প্রতি সৃষ্টি করা হয়েছে বিতৃষ্ণা ও অবজ্ঞা যা অতি ভয়ংকর ও ইসলামি সংস্কৃতির প্রতি বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ। বইয়ের রচনা ও সম্পাদনার সঙ্গে যারা যুক্ত তাঁরা নাস্তিক্যবাদের পোষক, কমিউনিজম আদর্শে বিশ্বাসী ও ইসলামি মূল্যবোধের প্রতি বিদ্বিষ্ট।
ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্ব চরম বিতর্কিত বিষয়। বহু বিজ্ঞানী দ্বারা এ থিওরি প্রত্যাখাত। পাঠ্যপুস্তকে এটা ঢুকিয়ে নাস্তিক্যবাদ প্রচারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মানুষ যদি বানর বা শিম্পাঞ্জি বা এ জাতীয় কোনো প্রাণী থেকে তৈরি হয়ে থাকে তাহলে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত মানবসৃষ্টির ঘোষণা বাতিল হয়ে যায়। ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ে সুন্নত দাড়ি নিয়ে উপহাস ও বিদ্রুপ করা হয়েছে (পৃ. ১৭)।
এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, আওয়ামী লীগ যখনই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে উগ্র বামপন্থী, কমিউনিস্ট ও নাস্তিক্যবাদী একটি গোষ্ঠী ক্ষমতাবলয়ের আশেপাশে অবস্থান নিয়ে গণতন্ত্র, উত্তরাধিকার ঐতিহ্য ও বৃহত্তর জাতিগোষ্ঠীর কৃষ্টির বিরুদ্ধে গোপন অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে প্রয়াসী হয়। এ গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে প্রভাবিত করে একদলীয় বাকশাল চালুর ব্যবস্থা করে। চারটি সংবাদপত্র রেখে বাকিগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। অথচ বঙ্গবন্ধু সারাজীবন গণতন্ত্র, জনগণের অধিকার ও সংবাদপত্রের জন্য লড়াই করে গেছেন। জীবনের সোনালি দিনগুলো কাটিয়েছেন কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে। সরল এ মানুষটাকে ভুল বুঝিয়েছে মস্কো ও চীনপন্থি সমাজতন্ত্রী গ্রুপ।
বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নধর্মী অনেক অর্জন আছে। তিনি কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে এমএ আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজের সমমান দিয়েছেন পার্লামেন্টে আইন পাস করে। ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন উপজেলায় মডেল মসজিদ তৈরি করেন এবং ইমাম-মুয়াযযিন কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করেন। এছাড়া তাঁর নিজের ঘোষণা অনুযায়ী তিনি প্রত্যুষে ওঠে ফজরের নামায আদায় ও পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করে দিবসের কার্যক্রম শুরু করেন। এতে বোঝা যায় তাঁর হৃদয়ে ধর্মের প্রতি মমত্ব ও অনুরাগ রয়েছে। তাঁর উদারতার সুযোগ নিয়ে সমাজতান্ত্রিক চিন্তা চেতনায় লালিত সে চিহ্নিত গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে হাত দিয়েছে। পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা ও সম্পাদকদের প্রোফাইল চেক করলে এর সত্যতা মেলবে। সরকারের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা ধর্মবিদ্বেষী একটি গ্রুপের আস্কারা না পেলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃপক্ষ এমন স্পর্ধা দেখাতেন না। এক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় ও আশু হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
পৃথিবীর কোনো দেশে বৃহত্তর জাতিগোষ্ঠীর চাহিদা, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে পাস কাটিয়ে সিলেবাস তৈরি ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের সুযোগ নেই এবং রেওয়াজও নেই। বাংলাদেশ কেন ভুল পথে হাঁটবে। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে স্কুলের বিতর্কিত বইগুলো বাধ্যতামূলকভাবে আলিয়া মাদরাসাগুলোতে পাঠ্যতালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এর আগে মাদরাসার জন্য স্বতন্ত্র পাঠ্যপুস্তক ছিল। বর্তমান পদ্ধতি অব্যাহত থাকলে আলিয়া মাদরাসাগুলো সাধারণ স্কুলে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাকিস্তান আমলে নিউস্কিম মাদরাসাগুলো ধর্মশিক্ষা সংকোচন করতে গিয়ে বন্ধ হয়ে যায় এবং পূর্ণাঙ্গ স্কুলে রূপান্তরিত হয়। রাজশাহী হাই মাদরাসা, নওগাঁ হাই মাদরাসা এখন পূর্ণাঙ্গ সাধারণ হাইস্কুল। চট্টগ্রামের প্রাচীন মুহসেনিয়া মাদরাসা এখন হাজি মহসিন সরকারি কলেজ।
এসব পাঠ্যপুস্তকে উল্লিখিত কন্টেন্টের শিক্ষা, চর্চা ও অনুশীলন চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে পুরো জাতি নাস্তিক্যবাদের প্রতি ঝুঁকে পড়বে এবং মুসলিম সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ পরিপন্থী একটি জনগোষ্ঠী তৈরি হবে। আমরা দাবি জানাচ্ছি অবিলম্বে যোগ্য, আদর্শিক ও নীতিবান গবেষক পণ্ডিতদের সমন্বয়ের নতুন প্যানেল তৈরি করে পাঠ্যপুস্তক সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হোক। প্যানেলে সরকারি দলের বাইরে আলিম সমাজের প্রাজ্ঞ প্রতিনিধিদের সংযুক্ত করা হোক।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন