বাংলাদেশে কাদিয়ানিদের অপতৎপরতা
হাফেজ ফজলুল হক শাহ
লেখক: মুহতামিম, মাদরাসা দারুন নাঈম, পোরশা, নওগাঁ
আরবের আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মোত্তালিবের পুত্র মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ (সা.) আখেরি পয়গম্বর। তিনি সকল নবী রসুলদের মধ্যে সর্বশেষ নবী ও রসুল। তাঁর পর আর কোনো নবী পৃথিবীতে আসবেন না। তার শুভাগমনের মাধ্যমে নুবুওয়াতের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। আখেরি নবী সম্পর্কে এটাই হলো বিশ্বের সকল মুসলমানদের আকিদা ও বিশ্বাস। এ আকিদা যারা পোষণ করে না তারা মুসলমান নয়। যারা মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ (সা.)-কে একমাত্র সর্বশেষ নবী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না বা মানে না তারা নিঃসন্দেহে কাফের। এ দৃষ্টিকোণ থেকে কাদিয়ানিরা মুসলমান নয়, কাফের। কারণ তারা আরবের মরুর দুলাল মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ (সা.)-কে একমাত্র সর্বশেষ নবী হিসেবে মনে না ও বিশ্বাস করে না। মিথ্যুক মুসইলামা মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ (সা.)-কে নবী হিসেবে মানার পরও সে নিজেকে নবী হিসেবে দাবি করতো। সে জন্য সাহাবায়ে কেরাম তাকে কাফের বলে ফতওয়া দিয়েছিলেন। ঠিক অনুরূপ মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানির রুহানি খাযায়েন গ্রন্থ অধ্যয়নে জানা যায় যে, সে মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ (সা.)-কে নবী হিসেবে মানার পরও নিজেকে নবী হিসেবে দাবি করেছে। সে জন্য বিশ্বের ওলামায়ে কেরাম ঐকমত্য পোষণ করে ফতওয়া দিয়েছেন মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানিসহ তার সকল অনুসারীরা কাফের।
বিশ্বব্যাপী কাদিয়ানি সম্প্রদায় একটি মারাত্মক ও জঘন্য ফেতনা। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির লক্ষ্যে ভারতের কাদিয়ান নামক স্থানে ঊনবিংশ শতাব্দীতে তাদের উদ্ভব হয়েছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায় যে, ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ও সার্বিক সহযোগিতায় ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাব প্রদেশের অন্তর্গত গুরুদাসপুর জেলার কাদিয়ান শহরে জন্মগ্রহণকারী মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানি নিজেকে নবী দাবি করে। নিকট ও দূর অতীতে তার মতো আরও অনেকে নবী দাবি করেছে। কিন্তু তাদের মিথ্যা মিশন বেশি দূর অগ্রসর হতে পরেনি। বিশ্বের মুসলমানদের তীব্র প্রতিবাদ ও সংগ্রামের কারণে কিছুদিন পর তাদের পথচলা স্থবির হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কাদিয়ানি সম্প্রদায়। জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত তাদের অপতৎপরতা বিশ্ব মোড়লদের ছত্রছায়ায় জিয়ে রয়েছে। পৃথিবীর যত্রতত্র তারা নিজেদের ভ্রান্ত চেতনার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আশঙ্কাজনক হারে খুবই তৎপর। মুসলিম বিশ্ব তাদের মূল টার্গেট। পৃথিবীর সাধারণ মুসলমানদের তারা বেছে বেছে ঈমান হারা করছে। বাংলাদেশও তাদের দন্তনখর হিংস্র থাবা থেবে মুক্ত নয়। আমাদের দেশের অনেক সরলমনা মানুষদের তারা বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে কাদিয়ানি বানিয়ে ফেলেছে। তাদের রুখতে প্রয়োজন সর্বস্তরের মুসলমানদের সম্মিলিত প্রয়াস। এদের অপতৎপরতা যদি এখনো রুদ্ধ করা না যায় তাহলে হতে পারে এমন একদিন আসবে যখন তারা বাংলাদেশের মহান সংসদে গিয়ে নেতৃত্ব নেবে। সেদিন মুসলমানদের অনুতাপ করা ছাড়া আর কিছু থাকবে না। তারা সংসদ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে, একথা অনেকের নিকট অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে। কিন্তু না। এটি আদৌ কল্পকাহিনি নয়। নিকট অতীতে এর উজ্জ্বল উপমা রয়েছে। কাদিয়ানিরা পাকিস্তান আমলে দেশের সর্বময় ক্ষমতা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের উচ্চপর্যায়ে অধিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর প্রস্থানরত ইংরেজদের উপর্যপরী চাপের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ আসনে বসেছিল একজন পাক্কা কাদিয়ানি। তার নাম স্যার জাফরুল্লাহ খান। সে সময় সে ইসলাম ও মুসলমানদের অনেক ক্ষতি সাধন করেছে। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস।
মনে রাখতে হবে কাদিয়ানিরা শুধু ধর্মের দুশমন নয়, তারা দেশ ও জাতির শত্রু। একথার একটি ঐতিহাসিক যুক্তি রয়েছে। আল্লামা ইকবাল যখন ধারাবাহিকভাবে কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে যৌক্তিক প্রমাণাদি দ্বারা একটির পর একটি প্রবন্ধ রচনা করে চলছিলেন তখন জওহর লাল নেহেরু আল্লামা ইকবালের মন্তব্যগুলোকে ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়ন’ বলে তিনটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যা কলকাতার তৎকালীন একটি ইংরেজি পত্রিকায় ছাপানো হয়। জওহর লাল নেহেরুর প্রবন্ধ তিনটির জবাবে আল্লামা ইকবাল একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যা পরবর্তীকালে পুস্তিকা আকারে ছাপানো হয়। এ পুস্তিকার পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ২৩। তিনি তার বক্তৃতায় বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘পণ্ডিত জওহর লাল নেহেরু ইদানীং যে কাদিয়ানিদের অধিকার নিয়ে মুখ খুলেছেন এতো জোরে শোরে, যা ইতিপূর্বে মুসলমানদের অধিকারের ক্ষেত্রে কখনো দেখা যায়নি। এর একমাত্র কারণ জওহর লাল নেহেরু ও কাদিয়ানি সম্প্রদায় উভয়ই মুসলমানদের ঐক্য, শক্তি, সংহতিকে পছন্দ করে না। এটা তিক্ত হলেও বাস্তব।’
এরপর আল্লামা ইকবাল এবং জওহর লাল নেহেরুর মধ্যে কিছু কাল এ নিয়ে পারস্পরিক পত্রালাপও হয়। ১৯৩৬ সালের ২১ জুনে লাহোর থেকে আল্লামা ইকবাল এক পত্রে জওহর লাল নেহেরুর প্রতি লেখেন, ‘আমার এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, ‘আহমদী জামায়াত’ ইসলাম ও বর্তমান হিন্দুস্তান, উভয়ের জন্যই খতরনাক গাদ্দার।’
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় বিবাড়িয়া, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় মাত্র গুটি কয়েক কাদিয়ানি ছিল। পাকিস্তান আমলে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান হতে আগত কাদিয়ানি আমলাদের সাহায্যে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে আরম্ভ করে। আইয়ুব খানের শাসনামলে তার ব্যক্তিগত উপদেষ্টা ছিল মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানির দৌহিত্র এমএম আহমদ। এমএম আহমদ আইয়ুব খানকে দিয়ে পঞ্চগড়ের সীমান্ত এলাকায় কাদিয়ানিদের জন্য দুশ একর জমি বরাদ্ধ করিয়েছিল। সেখানে এখন ‘আহমদ নগর’ নামে কাদিয়ানিদের বিরাট কলোনি গড়ে উঠেছে। এখানে বর্তমানে তারা দেশময় তাদের ঘৃণ্য অপতৎপরতা ছড়িয়ে দেবার লক্ষ্যে সালানা জলসা করে। এখানে রয়েছে তাদের কাদিয়ানি মাদরাসা এবং একাধিক আহমদী কিন্ডার গার্ডেন স্কুল। এখান থেকে তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দিচ্ছে লিফলেট ও বইপুস্তক। বাংলাদেশে কাদিয়ানিদের প্রচার-প্রসারের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো পঞ্চগড় জেলার আহমদ নগর।
পাকিস্তান আমলে জনৈক কাদিয়ানি অফিসারের চেষ্টা-তদবিরের ফলে চুয়াডাঙ্গায় কাদিয়ানিদের এক বিরাট এলাকা গড়ে উঠে। বর্তমানে বিবাড়িয়ার চেয়ে চুয়াডাঙ্গায় কাদিয়ানিদের সংখ্যা অনেক বেশি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় সমগ্র বাংলাদেশে কাদিয়ানিদের সংখ্যা কয়েক হাজারের বেশি ছিল না। বর্তমানে এদের সংখ্যা লক্ষাধিক। এতো অল্প সময়ের মধ্যে এদেশে এতো কাদিয়ানি কোথা থেকে এলো? এরা অন্য কোনো দেশ থেকে আসেনি। অতীতে এরা আমাদের ভাই ছিল। এরা সকলেই ছিল মুসলিম। তাদেরকে বিভিন্ন কলাকৌশলে কাদিয়ানি বানানো হয়েছে। দিন দিন এদের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এবং মুসলমানদের ঘুম না ভাঙ্গলে পঞ্চগড়ের মতো দেশের বিভিন্ন জায়গায় আমদেরকে আরও আহমদ নগর দেখতে হতে পারে।
কাদিয়ানিরা বইপুস্তক রচনা ও প্রচারে অনেক এগিয়ে। তার মোকাবেলায় মুসলমানদের সার্বিক গবেষণার পরিধি আরও বৃদ্ধি ও জোরদার হওয়া কাম্য। কাদিয়ানিদের প্রকাশিত আহমদী শত বার্ষিকীতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে তাদের ৯৩টি (প্রচার) কেন্দ্র রয়েছে। তবে এক গবেষণায় জানা যায় যে, ১৯৯০ সালের মে মাস পর্যন্ত তাদের কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ১১০টি। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৫০০টির বেশি।
কাদিয়ানিরা তাদের সালানা জলসায় বারবার তালিম দেয়, ‘একজন কাদিয়ানি, একজন দায়ী’। এ লক্ষ্যে তারা সকলেই তাদের ধর্মমত প্রচার করে। মুসলমানদের মুরতাদ বানানোর জন্য বাংলাদেশে কাদিয়ানিদের পাঁচটি পৃথম সংগঠন কাজ করছে।
- মজলিসে আনসারুল্লাহ। চল্লিশের ঊর্ধ্বে যাদের বয়স, তারা এ সংগঠনের সদস্য। এ সংগঠন সাধারণ মুসলমান, সরকারি কর্মচারী ও শিক্ষিত লোকদের মধ্যে কাদিয়ানি ধর্মমতের প্রচার করে থাকে। এ সংগঠনের উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে জড়িত ব্যক্তিবর্গ ও সংবাদপত্র সেবিকাদেরকে কাদিয়ানি ধর্মমতের দিকে আকৃষ্ট করা।
- মজলিসে খোদ্দামে আহমদিয়া। ১৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে যাদের বয়স তারা এ সংগঠনের সদস্য। এ সংগঠন যুবকদের মাঝে কাদিয়ানি ধর্মমত প্রচার করে। এ সংগঠনের সদস্যরা শিক্ষিত যুবকদের লোভনীয় চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে কাদিয়ানি বানায়। অনেককে আবার ইউরোপে প্রেরণের লোভ দেখিয়ে নিজ ধর্মমতে দীক্ষিত করে। এ সংগঠনটি শিক্ষার্থীদের মাঝে ব্যাপকহারে কাদিয়ানি পুস্তক ও প্রচারপত্রসমূহ বিতরণ করে থাকে।
- মজলিসে আতফালুল আহমদিয়া। পনেরোর কম বয়সী শিশু কিশোররা এ সংগঠনের সদস্য। এ সংগঠনের সদস্যরা সমবয়সী শিশু কিশোরদের মধ্যে তাদের রচিত শিশু সাহিত্য’ ছড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রে তারা বেশি টার্গেট করে শহরের শিশু কিশোরদের। কারণ শহরের তথাকথিত অভিজাত পরিবারের মুসলমানরা তাদের সন্তান সন্ততিদেরকে ইসলামের মৌলিক ও প্রাথমিক শিক্ষা দান করাটা অপ্রয়োজনীয় মনে করে থাকে। এদের ছেলে মেয়েদের অন্তরে ইসলাম সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা থাকে না। এদের মধ্যে কাদিয়ানিরা তাদের রচিত ‘শিশু সাহিত্য’ ছড়িয়ে দিয়ে মুসলমানদের কোমলমতি শিশু কিশোরদের অন্তরে কাদিয়ানি ধর্মমতের বীজ বপন করে।
উপরোক্ত তিনটি সংগঠন পুরুষ ও কিশোরদের মধ্যে কাজ করে থাকে। আর মহিলাদের মধ্যে কাদিয়ানি ধর্মমত প্রচার করার জন্য রয়েছে নিম্নোক্ত দুটি সংগঠন।
- লাজনা ইমাইল্লাহ। ১৫ বছর বয়সের ঊর্ধ্ব বয়সী মহিলারা এ সংগঠনের সদস্যা। এ সংগঠনের সদস্যা মহিলারা শহর ও গ্রামাঞ্চলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাদিয়ানিদের বইপুস্তক বিতরণ করে। তারা সুযোগ পেলে মুসলিম মহিলাদের লোভ লালসা ও প্রলোভনের মাধ্যমে কাদিয়ানি ধর্মমতের প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। বর্তমানে বাংলাদেশে এ সংগঠনের ৮০/৮৫টি কেন্দ্র কার্যরত রয়েছে।
- নাসেরাত। ১৫ বছরের কম বয়সের কিশোরীরা এ সংগঠনের সদস্যা। তারা সমবয়সী মুসলিম কিশোরীদের কাদিয়ানি মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে।
কাদিয়ানিদের ভাষ্য অনুযায়ী, তাদের কেন্দ্রীয় সদর দফতর লন্ডনে অবস্থিত। সেখান থেকেই বিশ্বব্যাপী তাদের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে তাদের ১০৩টি শাখা কেন্দ্র রয়েছে। এদেশে ৪২৫টি স্থানে কাদিয়ানিদের বসবাস ও কার্যক্রম বিস্তৃত। বিবাড়িয়া, সুন্দরবন, আহমদ নগর, শালসিঁড়ি, রাজশাহী, কুমিল্লা, এবং জামালপুর-ময়মনসিংহ অঞ্চলে কাদিয়ানিদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রয়েছে ৬৫জন মোবাল্লেগ। (এই ৬৫জনের অধীনে রয়েছে একাধিক সদস্য)। তাদের মতবাদ প্রচার-প্রসারের জন্য বাংলা ভাষায় ‘আহমদী’ নামক একটি পাক্ষিক পত্রিকা রয়েছে। সারা বিশ্বে তাদের মতাবলম্বীদের সংখ্যা ১০ মিলিয়ন।