কুরআনি দর্শনের শক্তি এবং বাঙালি মুসলিমদের ব্যর্থতা
ডা. ফিরোজ মাহবুব কামাল
যে দর্শনটি জাহেলি আরবদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল সেটি হল পবিত্র কুরআনের দর্শন। বাঙালি মুসলিমদের ব্যর্থতার মূল কারণ তাঁরা বাঁচছে সেরূপ একটি দর্শন ছাড়াই। তারা কুরআন পাঠ করে না বুঝে। কুরআনের দর্শনটি জানার আগ্রহ যেমন নেই, সে সামর্থ্যও তাদের নেই। অথচ সে সামর্থ্যটিই একজন মুসলিমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামর্থ্য যা তার কর্ম ও চরিত্রে বিপ্লব আনে।
সে আমলের মুসলিমগণ গ্রহ-নক্ষত্রের পরিচয় না জানলেও তাঁরা নিজেদের পরিচয়কে জেনেছিলেন সঠিকভাবেই। সে সাথে জেনেছিলেন মহান স্রষ্টার পরিচয়। মানবরূপে বেড়ে উঠার জন্যই এটিই তো অতি অত্যাবশ্যকীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম পাঠ। তারা সে পাঠটি পেয়েছিলেন যিনি তাদের স্রষ্টা এবং যিনি স্রষ্টা সমগ্র বিশ্বজগতের ও সকল সৃষ্টিকুলের সেই মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে। এবং সেটি তাঁর নাযিলকৃত গ্রন্থ পবিত্র কুরআন থেকে। সেটি মহান নবী করীম (সা.) মারফত।
তারা নিজ মনে এ বিষয়টি সঠিকভাবে এবং গভীরভাবেই বদ্ধমূল করেছিলেন যে, ইহকালীন এই স্বল্প কালের জীবনটি অনন্ত অসীম জীবনের শুরুর পর্ব মাত্র। এ জীবন শেষে যেমন পুরস্কার বা প্রমোশন আছে, তেমনি শাস্তি বা ডিমোশনও আছে। প্রমোশন ও ডিমোশন নির্ধারণে অনিবার্য পরীক্ষাও আছে। দুনিয়ার এই জীবন মূলত সেই পরীক্ষাকেন্দ্র। পরীক্ষা নেওয়াটিই হল ইহকালীন জীবনের মূল লক্ষ্য। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পরীক্ষার সমাপ্তি হয়, তবে তাতে জীবনের সমাপ্তি ঘটে না। শুরু হয় ফলাফল ভোগের পালা। মহান আল্লাহ তাআলার সে ঘোষণাটি এসেছে এভাবে:
ا۟لَّذِيْ خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيٰوةَ لِيَبْلُوَكُمْ اَيُّكُمْ اَحْسَنُ عَمَلًاؕ ۰۰۲
‘তিনি মৃত্যু ও জীবনকে এজন্য সৃষ্টি করেছেন যে তিনি পরীক্ষা করবেন তোমাদের মধ্যে কে আমলের দিক দিয়ে উত্তম।’[1]
বস্তুত মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হল কুরআনের এই হুঁশিয়ারিপূর্ণ বার্তা। এটুকু জানা না হলে জীবনে সব জানাশোনাই ব্যর্থ হয়ে যায়। পরীক্ষার হলকে তখন শুধু নাট্যশালা, প্রমোদশালা, পানশালা বা কর্মশালা মনে হয়। তখন মানুষ মত্ত হয় ফুর্তিতে। কর্মজীবী, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী বা পেশাদার রূপে জীবনে সফল হওয়াটাই জীবনের মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়। উপার্জন, আনন্দ-উল্লাস বা নিছক সময় কাটানোই বাঁচবার উদ্দেশ্য মনে হয়। জানাই হয় না যে, এ জীবন একটি পরীক্ষা কেন্দ্র মাত্র। পরকাল হল ফলাফলের জায়গা। তখন নিদারুণ অজ্ঞতা থেকে যায় কিসে সফলতা এবং কিসে বিফলতা সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও। অথচ এ পরম সত্যটুকু জানাতেই নবী-রসুলগণ এসেছিলেন। এবং সে সত্য নিয়ে তাদের ওপর নাযিল হয়েছিল আসমানি কিতাব এবং সর্বশেষে এসেছিল পবিত্র কুরআন।
পরীক্ষাকালীন সময়ে কেউ নাচগান, আমোদ-ফুর্তি করে না। অলস অবকাশে অনর্থক সময় কাটায় না। তখন প্রতি মুহূর্তের চেষ্টাটি হয়, পরীক্ষার খাতায় কি করে নাম্বার বাড়ানো যায় -তা নিয়ে। সাহাবায়ে কেরাম এ জীবনকে পরীক্ষাপর্ব রূপে গ্রহণ করেছিলেন বলেই তারা দিবারাত্র নেক আমলে ব্যস্ত থাকতেন। নেক আমলে তাড়াহুড়া ছিল তাদের সর্ব-অস্তিত্ব জুড়ে। পবিত্র কুরআনেও সেটিরই তাগিদ এসেছে এভাবে:
وَسَارِعُوْۤا اِلٰى مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمٰوٰتُ وَالْاَرْضُ١ۙ اُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِيْنَۙ۰۰۱۳۳
‘তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে ছুটে যাও যার সীমানা হচ্ছে আসমান ও জমিন, যা তৈরি করা হয়েছে পরহেজগারদের জন্য।’[2]
সুরা হাদীদের ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
سَابِقُوْۤا اِلٰى مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَآءِ وَالْاَرْضِ١ۙ اُعِدَّتْ لِلَّذِيْنَ اٰمَنُوْا بِاللّٰهِ وَرُسُلِهٖؕ ۰۰۲۱
‘প্রতিযোগিতা করো তোমার রব থেকে মাগফিরাত লাভে এবং জান্নাত লাভের জন্য যার প্রশস্ততা আসমান ও জমিনের সমান যা প্রস্তুত করা হয়েছে তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও রসুলকে বিশ্বাস করে।’[3]
উপর্যুক্ত দুটি আয়াতে যেমন হুঁশিয়ারি জানানো হয়েছে, তেমনি মানব জীবনের মূল অ্যাজেন্ডা কি হওয়া উচিত সেটিও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এ পার্থিব পরীক্ষার শেষ ঘণ্টাটি যেকোনো সময় বিনা নোটিশে বেজে উঠতে পারে। তাই সন্ন্যাসী সেজে সমাজ-সংসার, অর্থনীতি-রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, দাওয়াত ও জিহাদের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র থেকে হাত গুটিয়ে বসে থাকার সুযোগ ইসলামে নেই। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই হল মহামূল্যবান নিয়ামত। বুদ্ধিমান তো তারাই যা সে অমূল্য নিয়ামতকে সময়ের স্রোতে হারিয়ে যেতে দেয় না, বরং নেক আমলে ব্যয় করে। এভাবেই তারা আখেরাতে সঞ্চয় বাড়ায়। সাহাবায়ে কেরাম যেমন অবিরাম দীনের দাওয়াত দিয়েছেন, তেমনি বুদ্ধিবৃত্তি, রাজনীতি ও প্রশাসনে নেমেছেন। জ্ঞানচর্চা যেমন করেছেন, তেমনি জ্ঞানদানও করেছেন। তাঁরা জিহাদেও নেমেছেন। তাঁরা কর্মময় ছিলেন প্রতি ক্ষেত্রে।
বুঝতে হবে, ঈমানদারের কোন কর্মই দুনিয়াদারি নয়, বরং তার প্রতিটি কর্মই হল নেক আমল। দুনিয়াদারি নয় তাঁর যুদ্ধবিগ্রহ, জ্ঞানার্জন, রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাষাবাদ, শিক্ষকতা, চিকিৎসাবৃত্তি এবং লেখালেখি। পথের কাঁটা সরানো যেখানে উত্তম নেক আমল, সেখানে গলা থেকে বা সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে কাঁটা সরানোর চেষ্টা দুনিয়াদারি হয় কি করে? খলীফাগণ রাতে না ঘুমিয়ে অভাবী মানুষ খুঁজেছেন। আটার বস্তা পিঠে নিয়ে গরিবের ঘরে পৌঁছে দিতে ছুটেছেন। বিশাল রাষ্ট্রের শাসক উটের পিঠে চাকরকে বসিয়ে নিজে পায়ে হেঁটে শত শত মাইল রশি ধরে টেনেছেন। ইসলামের দাওয়াত নিয়ে পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, মরুভূমি ও সাগর অতিক্রম করেছেন। যখন কাগজ-কলম আবিষ্কৃত হয়নি তখনও তারা জ্ঞানচর্চায় ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। এভাবে তাঁরা প্রতিটি মুহূর্ত কাটিয়েছেন পরীক্ষায় পাশের চিন্তায় ও মহান আল্লাহ তাআলাকে খুশি করার কাজে। এভাবেই পরকালের অ্যাকাউন্টে তারা লাগাতর সঞ্চয় বাড়িয়েছেন। প্রতিটি মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে যখন এরূপ সৃষ্টিশীল কাজে ব্যয় হয় তখন তো দেশে সমৃদ্ধি ও শান্তি আসবেই। ইসলামের গৌরব যুগে উচ্চতর ও সভ্যতর সভ্যতা তো এভাবেই নির্মিত হয়েছে।
বিকল পাওয়ার হাউস
ঈমানদারের প্রতিটি সৃষ্টিশীল ও কল্যাণধর্মী কর্মই হল ইবাদত। এগুলিকে বলা হয় নেক আমল। একমাত্র নেক আমলের মাধ্যমেই সঞ্চয় বাড়ে আখেরাতের অ্যাকাউন্টে। নেক আমল বৃদ্ধির লাগাতার চেষ্টায় সৃষ্টিশীল প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ পরিণত হয় শক্তিশালী পাওয়ার হাউসে। ঈমানদার কখনোই কর্মহীন ও অলস হতে পারে না। এজন্যই দেশে প্রকৃত ঈমানদারের সংখ্যা বাড়লে দেশে উন্নয়নের প্লাবন আসে। অথচ সে পাওয়ার হাউস বিকল হলে, বিপর্যয় শুরু হয় জাতীয় জীবনে। জাতি তখন ভিক্ষুকে পরিণত হয়। প্রকৃত ঈমানদারের এই সদা সৃষ্টশীলতাকে বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরেছেন আল্লামা ইকবাল তার ফার্সি কবিতায় লিখেছেন,
پیش ما جز کافر و زندیق نیست * ہر کہ او را قوت تخلیق نیست
‘যার মধ্যে নেই সৃজনশীলতা, আমাদের কাছে সে কাফির ও নাস্তিক ভিন্ন অন্য কিছু নয়।’
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,
وَلِكُلٍّ دَرَجٰتٌ مِّمَّا عَمِلُوْاؕ ۰۰۱۳۲
‘এবং মানুষের সকল মর্যাদা নির্ধারিত হবে তাঁর আমলের মধ্য দিয়ে।’[4]
পবিত্র কুরআনের এই আয়াতে অর্থ দাঁড়ায়: যার জীবনে কর্ম নেই, মহান আল্লাহ তাআলার কাছে তার মর্যাদাও নেই। তাই ধর্মের লেবাসধারী কোন ব্যক্তির কর্মহীন দান-খয়রাত-নির্ভর জীবনটি আদৌ কোন দীনদারি নয়, সেটিই হল ধর্মহীনতা। বরং ঈমানের সাথে কর্মশীলতা বাড়বে সেটিই তো স্বাভাবিক।
মুসলিমকে প্রতি মুহূর্ত মহান আল্লাহ তাআলার যিকির নিয়ে বাঁচতে হয়। সেটি যেমন ইবাদতে, তেমনি পানাহারে, কর্মে ও বিশ্রামকালে। এভাবেই মুমিনের জীবনে আল্লাহভীরুতা ও সততা আসে। মহান আল্লাহ তাআলার যে যিকির মিথ্যা কথা, গালিগালাজ, গিবত, সুদ-ঘুষ ও অন্যান্য হারাম কর্ম থেকে বাঁচাতে পারে না তাকে কি যিকির বলা যায়? এমন ব্যক্তি সারা রাত যিকিরে কাটালেই বা তার লাভ কি?
মুমিন ব্যক্তি শুধু উত্তম চাষাবাদ ও বীজই ছিটায় না, কাজের মধ্যে মহান আল্লাহ তাআলার কাছে রহমতও চায়। যুদ্ধে বিজয় চায় শুধু নামাজের জায়নামাজে নয়, বরং জিহাদের ময়দানে শত্রুর সামনে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নেমে। সাহায্যদানের পূর্বে মহান আল্লাহ তাআলা বান্দার নিজের বিনিয়োগটি দেখতে চান। তাই তাঁর সাহায্য পেতে হলে নিজের বিনিয়োগ বাড়াতে হয়। বিশাল বিশাল শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে মুসলিমগণ তখনই বিজয়ী হয়েছেন যখন সে লক্ষ্যে তারা নিজেদের প্রাণ কুরবানি তে দুই পায়ে দাঁড়িয়েছিলেন। মুসলিমদের সে বিনিয়োগ দেখে মহান আল্লাহ তাআলা তাদের বিজয় বাড়াতে ফেরেশতা পাঠিয়েছেন।
দোয়া কবুলের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান হল আরাফার দিনে আরাফার ময়দান। দোয়া কবুলের উত্তম স্থান হল বায়তুল্লাহ কাবা, মসজিদে নববী, মসজিদুল আকসা। লক্ষ লক্ষ মানুষ এসব পবিত্র স্থানে বসে দীর্ঘ দোয়া করে। কিন্তু সেসব দোয়ায় কি ফিলিস্তিনি, কাশ্মীরি, উইঘুর ও রোহিঙ্গা মুসলিমদের দুঃখ লাঘব হচ্ছে? নবীজী (সা.) শুধু মসজিদে নববীতে বসে দোয়া করেননি। তিনি বদর, ওহুদ, খন্দক ও অন্যান্য বহু যুদ্ধে ময়দানে শত্রুদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দোয়া করেছেন। তাঁর সে দোয়া তখন কবুল হয়েছে।
বিনিয়োগহীন তথা জিহাদহীন দোয়া বনি ইসরাইলিদের জন্য আযাব নামিয়ে এনেছিল। তারা চেয়েছিল, তাদের ঘরে বিজয় এনে দিক খোদ মহান আল্লাহ তাআলা নিজে এবং তাঁর ফেরেশতারা। আজ বনি ইসরাইলিদের সে পথ ধরেছে বিশ্বের কোটি কোটি মুসলিম। তারা রণাঙ্গনে না নেমে দোয়া করে মহান আল্লাহ তাআলা যেন তাঁর নিজ শক্তি বলে শত্রুদের ধ্বংস করে দেন এবং তাদের ঘরে বিজয় তুলে দেন। তাদের নিজেদের ভূমিকা যেন স্রেফ দর্শকের। এরূপ দোয়া এমন কি আরাফতের ময়দানে দাঁড়িয়ে করলেও যে কবুল হয় না সে প্রমাণ তো অনেক। কবুল হলে প্রতি বছর যে প্রায় ২০ লাখ হাজী আরাফার ময়দানে চোখের পানি ফেলে দোয়া করে তা কি বৃথা যেত?
[1] আর-কুরআনুল করীম, সূরা আল-মুলক, ৬৭:২
[2] আর-কুরআনুল করীম, সূরা আলে ইমরান, ৩:১৩৩
[3] আর-কুরআনুল করীম, সূরা আল-হাদীদ, ৫৭:২১
[4] আর-কুরআনুল করীম, সূরা আল-আনআম, ৬:১৩২