জামেয়া ওয়েবসাইট

সোমবার-৯ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-১৪ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইসলামি দৃষ্টিতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি: কারণ ও প্রতিকার

ইসলামি দৃষ্টিতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি: কারণ ও প্রতিকার

সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমি

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ইতিকথা

বর্তমানে সর্বত্র দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও মূল্যস্ফীতির কারণে জনজীবন অতিষ্ঠ। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণে প্রতিটি মানুষ বিচলিত। দৈনন্দিন পারিবারিক চাহিদা মেটাতে পরিবার প্রধানদের উঠছে নাভিশ্বাস। এটি কি বর্তমান সময়ের সংকট, না ইতিপূর্বেও মানুষ এ ধরনের সংকটের সম্মুখীন হয়েছে? ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নতুন কিছু নয়। সকল যুগের মানুষকে এই সমস্যায় পড়তে হয়েছে। আজ থেকে প্রায় চৌদ্দশত বছর পূর্বে কিছু সাহাবী আল্লাহর রসুল (সা.)-এর খেদমতে এসে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির অভিযোগ করলেন এবং ভোজ্য জিনিসের দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার দাবি জানালেন। কিন্তু মহানবী (সা.) তা প্রত্যাখ্যান করলেন এবং বললেন, ‘আল্লাহ দাম কমিয়ে দেন এবং বাড়িয়ে দেন।’ (তিরমিযী: ১৫৪৩)

নববী যুগের পর খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগেও মানুষ দুর্ভিক্ষ, অনাহার, মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মতো সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু আব্বাসী খলীফাদের যুগের মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সংকট ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। যেমন ইমাম মাকরিযী (রহ.) তাঁর ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থে বর্ণনা করেন, ‘আব্বাসীয় যুগে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির কারণে সাধারণ ব্যবহারের জিনিসপত্র মানুষের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছিল। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে ছিলো যে, মানুষ কুকুর-বিড়াল ধরে খেতে শুরু করল। দেশে কুকুর- বিড়াল দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়লে সেগুলোও পাঁচ দিরহামে বিক্রি হতে থাকে। এক পর্যায়ে মানুষ নরখাদক হয়ে গেল। আর একে অপরকে খেতে লাগলো। একদল লোক নিজেদের ঘরের ছাদে দাঁড়িয়ে পথচারীদের জাল দিয়ে ধরে নিয়ে যেতো এবং তাদেরকে খেয়ে ফেলত। তৎকালীন খলীফা মুসতানসিরের অবস্থা এমন ছিল যে, তিনি তাঁর দরবারের সমস্ত জিনিসপত্র বিক্রি করে মাদুরে বসতে লাগলেন। এক সময় তার এক মন্ত্রী একটি গাধায় চড়ে তার কাছে আসেন। মানুষ প্রথমে মন্ত্রীর গাধা, পরে মন্ত্রীকে খেয়ে ক্ষুধা মিটায়।’[1]

এই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় কী? এর কারণ ও প্রতিকার কী? এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ বুদ্ধিমত্তা ও বোধগম্যতা অনুযায়ী এর কারণ ও প্রতিকার নিয়ে মন্তব্য করছেন। তবে সাধারণ বিশ্লেষকরা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাহ্যিক উপকরণ ও সাধারণ কারণগুলো উল্লেখ করছেন। কিন্তু এর মূল কারণ ও প্রকৃত অনুঘটকের প্রতি তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হচ্ছে বলে মনে হয় না।

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জ্ঞানী ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব হলেন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি সর্বশেষ নবী ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। তিনি এই ধরনের সংকটপূর্ণ সমস্যার কী সমাধান দিয়েছেন? তা জানা জরুরি। বস্তুত এই বরকতময় ব্যক্তিত্ব হযরত মুহাম্মদ (সা.) এ সমস্যার কারণ ও এর প্রতিকার বলে গেছেন। তিনি যে কারণগুলোর কথা বলেছেন, তা হল প্রকৃত কারণ ও বাস্তব অনুঘটক। সেগুলোকে বাস্তব কারণ হিসেবে বিশ্বাস করা আমাদের ঈমানের অংশ। তিনি বলেছেন, মূল্যবৃদ্ধি বা মূল্যহ্রাস; এ দুটির স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ নয়। তাঁর ইচ্ছা ও ক্ষমতা ছাড়া এর কিছুই সংঘটিত হয় না। তবে আল্লাহ তাআলা কখনো কখনো কতিপয় বান্দার কর্মকে কিছু ঘটনার কারণ হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। যেমন হত্যাকারীর হত্যাকে নিহত ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ বানিয়েছেন। বান্দাদের যুলুমের কারণে তিনি কখনো মূল্যবৃদ্ধি করেন এবং কখনো কিছু মানুষের ইহসানের কারণে মূল্যহ্রাস করেন।

আর যে কারণগুলো আমাদের বুদ্ধি ও উপলব্ধি দ্বারা ব্যাখ্যা করা হচ্ছে, সেগুলো বাহ্যিক ও স্বভাবজাত কারণ। বাস্তব ও প্রকৃত কারণ নয়। তাই প্রকৃত কারণ নির্ণয় না করে সঠিক সমাধান বের করা সম্ভব হয় না। যেমন প্রকৃত রোগ নির্ণয় না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসা করা যায় না। বর্তমান সমস্যার বাস্তব কারণ উদ্ঘাটনপূর্বক সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষ্যে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে নিম্নে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রধান কারণ আল্লাহর অবাধ্যতা ও পাপ

আজ আমরা যে পরিবেশ এবং যে যুগে বসবাস করছি, নিঃসন্দেহে তা হল পাপাচারের পরিবেশ ও ফিতনার যুগ। চারিদিকে অশ্লীলতার বাজার সরগরম। সমাজ ঢেকে গেছে মন্দের মোটা চাদরে। চর্তুপার্শ্বে ফ্যাশনের নামে আল্লাহর বিধানকে বিলিন করা হচ্ছে। ইসলামি মূল্যবোধ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এবং মানুষের ঈমান ও বিশ্বাস নড়েবড়ে হয়ে যাচ্ছে। এখন আমরা নামেমাত্র মুসলমান। না আছে আমাদের ঈমানে দৃঢ়তা, না আছে আমাদের অন্তরে আধ্যাত্মিক শক্তি। সমাজ অশ্লীলতা ও নগ্নতার মতো পাপাচারে জড়িয়ে পড়ছে, যা মানবিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করেছে। মানুষ মানবতার সীমার বাইরে পশুত্ব এবং দানবত্ব গ্রহণ করছে। তাই সমাজের সংকট ও পরিবর্তন অস্বাভাবিক কিছু নয়। এটি অনেকটা প্রকৃতির সাথে সংগতিপূর্ণ। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন, ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ اَيْدِي النَّاسِ۰۰۴۱‘মানুষের কৃতকর্মের কারণে সমুদ্রে ও স্থলে ফাসাদ দেখা দেয়।’[2]এটি শতভাগ সঠিক যে, আজকাল সকলে দুনিয়ার পেছনে উটের মতো ছুটছে। পরকাল, হিসাব-নিকাশ ও মৃত্যুর কোনো বোধ আমাদের মধ্যে আছে বলে মনে হয় না। ফলে মানবতা বোধও আছে বলে মনে হয় না। চারিদিকে হাহাকারের শব্দ হৃদয়ের যন্ত্রণা প্রকাশ করছে। এ সবকিছু কেয়ামতের নির্দশনমাত্র। কারণ আল্লাহর বিধান অনুসারে পৃথিবীতে বসবাসকারী অবাধ্য মানুষের ধ্বংস অনিবার্য।আপনি প্রকৃতির নিয়ম অধ্যয়ন করুন! বিভিন্ন জাতির ইতিহাস পুনরাবৃত্তি করুন! তাদের পতনের কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন! তাহলে আপনি এই পর্যায়ে পৌঁছে যাবেন যে, আল্লাহর অবাধ্যতা, অহংকার ও দাম্ভিকতা এবং সম্পদের অসার আত্মগৌরব সেই শক্তিশালী জাতিকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।বর্তমান আমাদের সমাজের অবস্থাও ঠিক একই রকম। মানুষ শরীয়া নির্দেশনা পালন করছে না। তাই মানুষ মহান আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও দ্রব্যমূল বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির মতো সমস্যায় ভুগছে। সুতরাং আমাদেরকে সচেতন হতে হবে এবং আল্লাহ তাআলা মুদ্রাস্ফীতির চেয়েও বড় সমস্যায় আক্রান্ত করার পূর্বে আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে তাওবা করতে হবে। আল্লাহর অবাধ্যতা ও অশ্লীলতা পরিহার করার সংকল্প করতে হবে। তাতেই আমরা এ মসিবত থেকে মুক্তি পেতে পারি।এছাড়াও বিভিন্ন হাদীস শরীফে দুর্ভিক্ষ, সময়মতো বৃষ্টি না হওয়া, দ্রব্যমূল বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি এবং রিজিক হ্রাসের কারণ হিসেবে নিম্নের কারণগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে। (১) পরিমাপে কম দেওয়া, (২) যাকাত না দেওয়া, (৩) ব্যভিচার করা, (৪) সর্বশক্তিমান আল্লাহর অবাধ্য হওয়া ও পাপ করা, (৫) কুরআন ও সুন্নাহবিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। যেমন- আল্লাহর রসুল (সা.) নিম্নের বাণীগুলোতে স্পষ্টভাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণ উল্লিখিত হয়েছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ، قَالَ: أَقْبَلَ عَلَيْنَا رَسُوْلُ اللهِ ﷺ، فَقَالَ: «يَا مَعْشَرَ الْـمُهَاجِرِيْنَ خَمْسٌ إِذَا ابْتُلِيْتُمْ بِهِنَّ، وَأَعُوْذُ بِاللهِ أَنْ تُدْرِكُوْهُنَّ: لَـمْ تَظْهَرِ الْفَاحِشَةُ فِيْ قَوْمٍ قَطُّ، حَتَّىٰ يُعْلِنُوْا بِهَا، إِلَّا فَشَا فِيْهِمُ الطَّاعُوْنُ، وَالْأَوْجَاعُ الَّتِيْ لَـمْ تَكُنْ مَضَتْ فِيْ أَسْلَافِهِمُ الَّذِيْنَ مَضَوْا، وَلَـمْ يَنْقُصُوا الْـمِكْيَالَ وَالْـمِيْزَانَ، إِلَّا أُخِذُوْا بِالسِّنِيْنَ، وَشِدَّةِ الْـمَئُوْنَةِ، وَجَوْرِ السُّلْطَانِ عَلَيْهِمْ، وَلَـمْ يَمْنَعُوْا زَكَاةَ أَمْوَالِـهِمْ، إِلَّا مُنِعُوا الْقَطْرَ مِنَ السَّمَاءِ، وَلَوْلَا الْبَهَائِمُ لَـمْ يُمْطَرُوْا، وَلَـمْ يَنْقُضُوْا عَهْدَ اللهِ، وَعَهْدَ رَسُوْلِهِ، إِلَّا سَلَّطَ اللهُ عَلَيْهِمْ عَدُوًّا مِنْ غَيْرِهِمْ، فَأَخَذُوْا بَعْضَ مَا فِيْ أَيْدِيْهِمْ، وَمَا لَـمْ تَحْكُمْ أَئِمَّتُهُمْ بِكِتَابِ اللهِ، وَيَتَخَيَّرُوْا مِمَّا أَنْزَلَ اللهُ، إِلَّا جَعَلَ اللهُ بَأْسَهُمْ بَيْنَهُمْ».

‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে সম্বোধন করে বলেছেন, ‘হে মুহাজিরগণ! তোমরা পাঁচটি বিষয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। তবে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি যেন তোমরা তার সম্মুখীন না হও। যখন কোনো জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে মহামারী আকারে প্লেগরোগের প্রাদুর্ভাব হয়। তাছাড়া এমন সব ব্যাধির উদ্ভব হয়, যা পূর্বেকার লোকদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। যখন কোনো জাতি ওজন ও পরিমাপে কারচুপি করে তখন তাদের ওপর নেমে আসে দুর্ভিক্ষ, শাসকের তরফ থেকে অত্যাচার ও কঠিন বিপদ-আপদ। যখন যাকাত আদায় করে না, তখন আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদি ভূপৃষ্ঠে চতুষ্পদজন্তু না থাকতো তাহলে আর কখনো বৃষ্টিপাত হতো না। যখন কোনো জাতি আল্লাহ ও তাঁর রসুলের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তখন আল্লাহ তাদের ওপর তাদের বিজাতীয় দুশমনকে ক্ষমতাসীন করেন এবং তারা তাদের সহায় সম্পদ সবকিছু কেড়ে নেয়। যখন তোমাদের শাসকবর্গ আল্লাহর কিতাব মোতাবেক মীমাংষা করে না এবং আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে গ্রহণ করে না, তখন আল্লাহ তাদের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেন।”[3]

حَدَّثَنَا عَبْدُ اللهِ، حَدَّثَنَا أَبِيْ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّزَّاقِ، حَدَّثَنَا بَكَّارٌ، قَالَ: سَمِعْتُ وَهْبًا يَقُوْلُ: «إِنَّ الرَّبَّ f قَالَ فِيْ بَعْضِ مَا يَقُوْلُ لِبَنِي إِسْرَائِيْلَ: إِنِّيْ إِذَا أُطِعْتُ رَضِيْتُ، وَإِذَا رَضِيتُ بَارَكْتُ، وَلَيْسَ لِبَرَكَتِيْ نِهَايَةٌ، وَإِنِّيْ إِذَا عُصِيتُ غَضِبْتُ، وَإِذَا غَضِبْتُ لَعَنْتُ، وَلَعْنَتِيْ تَبْلُغُ السَّابِعَ مِنَ الْوَلَدِ».

‘ইমাম আহমদ (রহ.) হযরত ওয়াহিব থেকে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ বনি ইসরাইলকে বলেছেন, যখন আমার আনুগত্য করা হয়, তখন আমি সন্তুষ্ট হই। আর যখন আমি সন্তুষ্ট হই, তখন বরকত দান করি। আমার বরকতের কোনো শেষ নেই। আর যখন আমার নাফরমানি করা হয়, তখন আমি রাগান্বিত হই। আর যখন আমি রাগান্বিত হই, তখন আমি লানত দিই। আমার লানত সাত প্রজন্ম পর্যন্ত চলতে থাকে।’[4]

عَنْ ثَوْبَانَ، قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: «لَا يَزِيْدُ فِي الْعُمْرِ إِلَّا الْبِرُّ، وَلَا يَرُدُّ الْقَدَرَ إِلَّا الدُّعَاءُ، وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيُحْرَمُ الرِّزْقَ بِالذَّنْبِ يُصِيْبُهُ».

‘হযরত সাওবান (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সৎকর্ম ব্যতীত অন্য কোনো বস্তু মানুষের আয়ুস্কাল বাড়াতে পারে না এবং দোয়া ব্যতীত অন্য কিছুতে তাকদীর রদ হয় না। মানুষ তার পাপকাজের দরুণ তার প্রাপ্য রিজিক থেকে বঞ্চিত হয়।”[5]

রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন,

«وَلَا مَنَعُوا الزَّكَاةَ إِلَّا حُبِسَ عَنْهُمُ الْقَطْرُ».

‘কোনো জাতি যখন যাকাত বন্ধ করে দেয়, তখন আল্লাহও তাদের থেকে বৃষ্টি বন্ধ করে দেন।’[6]

দ্রব্যমূল্যে বৃদ্ধির দ্বিতীয় কারণ সামাজিক অসহযোগিতা

যেকোনো দেশ ও সমাজের উন্নয়নের জিম্মাদার হল সেখানকার অধিবাসীরা। এ কারণেই ইসলাম সমাজে বসবাসকারী মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের অধিকার নির্ধারণ করে যাকাতকে ফরজ ঘোষণা করা হয়। সমাজের সকল সদস্য যেন সুখ-শান্তিতে জীবন যাপন করতে পারে। কারণ এটি দরিদ্রদের সাহায্য করে এবং তাতে তাদের কষ্ট লাঘব হয়। কেননা পারস্পরিক সম্প্রীতি হচ্ছে সুন্দর ও চিরন্তন নীতি, যা দ্বারা একটি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র এগিয়ে যেতে পারে। যেকোনো সংকট তাকে থামাতে পারে না এবং দুঃখ-কষ্ট তাদের মধ্যে বাসা বাঁধতে পারে না। সাহাবায়ে কেরামের আমলে সমৃদ্ধি, স্বস্তি ও শক্তির একমাত্র রহস্য ছিল তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, সহযোগিতা ও ভালোবাসা পরিপূর্ণরূপে বিদ্যমান ছিল। ধনীরা দরিদ্রদের আর্থিক সাহায্য করতেন। তাই তাদের কাউকে ক্ষুধার্ত থাকেতে হতো না।ঘটনাটি সর্বজনবিদিত: সাইয়েদুনা আবু বকর (রাযি.)-এর খিলাফতকালে দুর্ভিক্ষের সময় হযরত উসমান (রাযি.) (যিনি সাহাবীদের মধ্যে সম্পদের কারণে ‘ধনী’ উপাধিতে পরিচিত ছিলেন) গম ও অন্যান্য শস্য বোঝাই এক হাজার উটের একটি কাফেলা মদীনায় নিয়ে এলেন। কিছু স্বচ্ছল সাহাবী এই শস্য ক্রয় করে মদীনার গরীবদের মধ্যে বিতরণ করার জন্য হযরত উসমান (রাযি.)-এর খেদমতে আসেন। কিন্তু সাইয়িদনা উসমান (রাযি.) তা থেকে লাভ না নিয়ে, তা বিক্রি না করে গরীবদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। এটি সাহাবীদের পারস্পরিক সহযোগিতার একটি উদাহরণ। আজও যদি সমাজের সদস্যদের মধ্যে কল্যাণ ও পরোপকারের চেতনা তৈরি হয়, তাহলে নিশ্চয় কোনো সমাজ দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ও মুদ্রাস্ফীতির মতো সমস্যায় ভুগতে পারে না।পক্ষান্তরে জাতি ও সমাজ যদি পারস্পরিক শত্রুতা, নৈরাজ্য ও স্বার্থপরতার মতো নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করে, তাহলে বাস্তবতা যা হওয়ার তা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। এ ধরনের সমাজ সকল অপশক্তির প্রজননক্ষেত্রে পরিণত হয়। এটি কোনো ভুল উপস্থাপনা নয় বরং একটিই তিক্ত সত্য ও বাস্তবতা।হযরত থানভী (রহ.)দৃষ্টিতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিরকারণ ও প্রতিকার

হযরত হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদুল মিল্লাত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.)-এর চমৎকার সমাধান ও প্রতিকার লিখেন,

ذکر کردہ تفصیل سے موجودہ دور کی مشکلات کے اسباب متعین ہو چکے، تو علاج اس کا اُن اسباب کا ازالہ ہے، یعنی: ایمان کی درستی، تمام معاصی سے توبہ واستغفار کرنا، خصوصًا حقوق العباد میں کوتاہی کرنے سے، اور زکوٰۃ ادا نہ کرنے سے، اور زنا اور اس کے مقدمات سے کہ وہ بھی بحکم زنا ہی ہیں، جیسے: بُری نگاہ کرنا، نامحرم سے باتیں بقصدِ لذت کرنا، اس کی آواز سے لذت حاصل کرنا، خصوصاً گانے بجانے سے، چنانچہ حق تعالیٰ نے صریحًا اس کو علاج فرمایا ہے کہ اپنے پروردگار کے روبرو (اعمالِ سیاہ سے) استغفار کرو، پھر (اعمال صالح سے) اس کی طرف متوجہ ہو، وہ تم پر بارش کو بڑی کثرت سے بھیجے گا۔ اب اکثر لوگ بجائے ان اسبابِ اصلیہ کے اسبابِ طبیعیہ کو مؤثر سمجھ کر علاجِ مذکور کی طرف توجہ نہیں کرتے، اور صرف حکایت، شکایت، یا رائے زنی، وپیشین گوئی، یا تخمینی کا شُغل رکھتے ہیں، جو محض اضاعتِ وقت ہے۔ ہم اسبابِ طبیعیہ کے منکر نہیں، مگر اس کا درجہ اسبابِ اصلیہ کے سامنے ایسا ہے جیسے: کسی باغی کو بحکمِ شاہی گولی سے ہلاک کیا گیا۔ دوسرا دیکھنے والا اصلی سبب، یعنی: قہرِ سلطانی کو سبب نہ کہے، اور طبعی سبب، یعنی: صرف گولی کو سبب کہے، حالانکہ اس طبعی سبب کے استعمال کا سبب وہی سببِ اصلی ہے، مگر جو شخص اس کو نہ سمجھے گا وہ بغاوت سے پرہیز نہیں کرے گا، گولی کا توڑ تجویز کرے گا جو کہ اس کی قدرت سے خارج ہے، سو کیا یہ غلطی نہیں ہو گی؟ یہی حالت ہم لوگوں کی ہے۔

‘উপরোক্ত বিবরণ দ্বারা বর্তমান সময়ের সমস্যার কারণসমূহ নির্ণয় করা হয়েছে। তাই এর প্রতিকার হল সেই কারণসমূহের সমাধান করা, যথা- ঈমানে দৃঢ়তা পয়দা করা। আল্লাহর দরবারে তওবা-ইস্তিগফার অর্থাৎ সকল গুনাহ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করা; বিশেষ করে মানুষের হক নষ্ট করা থেকে তাওবা করা। যাকাত প্রদান করা। ব্যভিচার ও ব্যভিচারের আনুসাঙ্গিক বিষয়গুলো পরিহার করা, যা ব্যভিচারও বটে, যেমন- কুদৃষ্টি, বেগানা মহিলার সাথে আত্মতৃপ্তির জন্য কথা বলা, তার কণ্ঠস্বর দ্বারা তৃপ্তি অনুভব করা। তেমনি গান বাজনা পরিহার করা। সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে প্রতিকার বলে দিয়েছেন। তিনি বলেন, আপনার পালনকর্তার কাছে ক্ষমা পার্থনা করুন। অতঃপর তাঁর দিকে ফিরে আসুন, তিনি আপনার ওপর প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তানাদি বাড়িয়ে দেবেন, তোমাদের জন্য বাগান সৃষ্টি করবেন এবং তোমাদের জন্য নদীনালা প্রবাহিত করবেন।

এখন অধিকাংশ মানুষই এসব সংকটের বাস্তবিক কারণগুলো নির্ণয় করার পরিবর্তে বাহ্যিক কারণগুলোকে অধিক ফলপ্রসূ বিবেচনা করার কারণে উল্লেখিত প্রতিকারগুলোর প্রতি মনোযোগ দেয় না। শুধুমাত্র অভিযোগ ও অনুযোগ এবং অনুমানভিত্তিক মন্তব্য ও মতামতে ব্যস্ত, যা সময়ের অপচয় মাত্র।

আমরা প্রাকৃতিক কারণগুলোকে অস্বীকার করি না। কিন্তু বাস্তব কারণগুলোর সামনে এর মান হবে, যেন বাদশার নির্দেশে কোনো বিদ্রোহীকে বুলেট দ্বারা হত্যা করা হল। এখন এই লোকটি মৃত্যু বরণ করার প্রকৃত কারণ হল বাদশাহের রাগ ও ক্রোধ; প্রকৃত কারণ বুলেট নয়। তাই যে এটা বুঝবে না সে বিদ্রোহ থেকে বিরত থাকবে না। বরং সে বুলেট ভাঙার পরামর্শ দেবে, যা তার আয়ত্তের বাইরে। যদি কেউ এমনটি করে, তাহলে এটা কি ভুল হবে না? এই হল আমাদের বর্তমান অবস্থা।[7]

চলবে ইনশাআল্লাহ

লেখক: গবেষক ও শিক্ষক, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম

[1] আল-মাকরীযী, ইগাসাতুল উম্মা বি-কাশফিল গুম্মা, আয়নুন লিদ-দিরাসাত ওয়াল বুহূসিল ইনসানিয়া ওয়াল ইজতিমায়িয়া, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২৭ হি. = ২০০৭ খ্রি.), পৃ. ৪১

[2] আল-কুরআন, সুরা আর-রূম, ৩০:৪১

[3] ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, দারু ইয়াহইয়ায়িল কুতুব আল-আরাবিয়া, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৩৭১ হি. = ১৯৫২ খ্রি.), খ. ২, পৃ. ১৩৩২, হাদীস: ৪০১৯

[4] আহমদ ইবনে হাম্বল, আয-যুহদ, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২০ হি. = ১৯৯৯ খ্রি.), পৃ. ৪৭, হাদীস: ২৮৯

[5] ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, খ. ২, পৃ. ১৩৩৪, হাদীস: ৪০২২

[6] আত-তাবারানী, আল-মু’জামুল কবীর, মাকতাবাতু ইবনে তায়মিয়া, কায়রো, মিসর (দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৪০৪ হি. = ১৯৮৩ খ্রি.), খ. ১১, পৃ. ৪৫, হাদীস: ১০৯৯২

[7] আশরফ আলী থানভী, যিওয়ালুস সিনা আন আমালিস সানা = সাল ভর কে মসনূন আমাল, ইদরায়ে ইসলামিয়াত, লাহোর, পাকিস্তান, পৃ. ৪৭-48

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ