বৃহস্পতিবার-২২শে জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি-২২শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

হযরত বোখারী সাহেব হুজুর স্মরণে কেঁদেও পাবো না যাকে

হযরত বোখারী সাহেব হুজুর স্মরণে কেঁদেও পাবো না যাকে

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

 

১৯৬৮ সালের কথা। আমি তখন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া আলিয়া মাহমুদুল উলুম মাদরাসায় পড়ি। এটি ছিল মূলত কওমি মাদরাসা। পরে আলিয়ায় রূপান্তরিত হয়। দারুল উলুম দেওবন্দের মুহাদ্দিস আওলাদে রসুল সাইয়েদ আসগর হোসাইন মিয়া সাহেব (রহ.) ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। একঝাঁক দেওবন্দী আলেম বিশেষত পটিয়া জামেয়ার সাবেক ইফতা বিভাগের প্রধান মুফতি ইবরাহীম (রহ.), চট্টগ্রাম মুযাহিরুল উলুম মাদরাসার সাবেক শায়খুল হাদীস মাওলানা মাসউদ আহমদ কাসিমী (রহ.), পটিয়া জামেয়ার সাবেক শায়খুল হাদীস মাওলানা ইসহাক কানাইমাদারী (রহ.), পটিয়া জামেয়ার আরবি সাহিত্যের প্রধান মাওলানা মুহাম্মদ দানিশ সাতকানভী (রহ.), কুমিল্লার বরুরা মাদরাসার সাবেক শায়খুল হাদীস মুফতি ইউসুফ ইসলামাবাদী (রহ.), হাটহাজারী চারিয়া মাদরাসার সাবেক শায়খুল হাদীস মাওলানা আবদুর রহমান কৈয়গ্রামী (রহ.) ও তাবলীগের মুরব্বী মাওলানা এরশাদ সাহেব (রহ.) এখানে শিক্ষকতা করেন। মাওলানা এরশাদ সাহেব (রহ.) ছিলেন বোখারী সাহেব হুজুরের শ্বশুর। প্রত্যেকের কাছে আমার সবক পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। নতুন এক উস্তাদ আরবি আদবের ক্লাশ নিলেন। সবক প্রদানের পদ্ধতি বেশ আকর্ষণীয় মনে হলো। তখন পড়তেন খদ্দরের কুর্তা। সাদাসিধে ও অনাড়ম্বর জীবন। তাঁর নাম মাওলানা আবদুল হালিম বোখারী (রহ.)। প্রতি সোমবার যোহরের নামাযের পর মাদরাসা মসজিদে ইসলাহী বয়ান হত। তিনি কখনো বাংলায়, কখনো আরবি, কখনো ইংরেজি আবার কখনো উর্দুতে বয়ান করতেন। তাঁর ভাষাদক্ষতা আমাদের কিশোরমনে ব্যাপক রেখাপাত করে। আমরা তাঁকে আইকন মনে করি।

আমার বাবা মাওলানা হাবিবুল্লাহ (রহ.) তখন সাতকানিয়া আলিয়ার প্রিন্সিপাল। বোখারী সাহেব হুজুরের বাবা পদুয়া হেমায়তুল ইসলাম মাদরাসার সাবেক মুহতামিম মাওলানা আবদুল গনী সাহেব (রহ.) আমার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। খতীবে আযম মাওলানা সিদ্দিক আহমদ (রহ.) আমার বাবার উস্তাদ। একদিন আমার বাবা খতীবে আযম সাহেবকে বলেন, আমার মাদরাসার জন্য একজন দক্ষ উস্তাদ প্রয়োজন। সাথে সাথে তিনি বলেন, মাওলানা আবদুল গনী সাহেবের এক ছেলে আছে নাম আবদুল হালিম। ভালো আলেম, এক রাতে আপনাকে একটি রিসালা লিখে দিতে পারবে। আমি মাওলানা আবদুল গনী সাহেবের সাথে আলাপ করে তাকে ঠিক করে দেব ইনশাআল্লাহ। কথামত ১৯৬৮ সালে বোখারী সাহেব টাঙ্গাইল আলিয়া থেকে ইস্তেফা দিয়ে সাতকানিয়া আলিয়ায় যোগদান করেন। ১৯৭২ পর্যন্ত আমি হুজুরের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কিতাবগুলো অধ্যয়ন করি। সাতকানিয়ার বাবুনগরে আমাদের গ্রামের বাড়িতে হুজুরের নিয়মিত যাতায়াত ছিল।

১৯৬৯ সালে বোখারী সাহেব হুজুর আমাকে সাথে নিয়ে এসে পটিয়া জামিয়ায় ভর্তি করে দেন। হযরত দানিশ সাহেব হুজুরের পাশের কক্ষে থাকতাম। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মাদরাসা বন্ধ হয়ে যায়। আমি গ্রামে ফিরে আসি। আবার সাতকানিয়া আলিয়ায় ভর্তি হই। পুনরায় বোখারী সাহেব হুজুরের সান্নিধ্য লাভ করি। ১৯৭২ সালে হুজুর টাঙ্গাইল আলিয়ায় মুহাদ্দিস হিসেবে যোগ দেন। আমি ১৯৭৫ সালে তাকমিলে হাদিস সম্পন্ন করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি হই। ১৯৮২ সালে বোখারী সাহেব হুজুর টাঙ্গাইল আলিয়া ছেড়ে পটিয়া জামেয়ায় উস্তাদ হিসেবে যোগ দিলে তাঁর সাথে আমার পুনর্যোগাযোগ স্থাপিত হয়।

১৯৯৬ সালে হুযুর একবার আমার চট্টগ্রামের সিএন্ডবি কলোনির বাসায় তাশরিফ আনেন। অন্যত্র প্রোগ্রাম থাকায় হুজুরের সাথে আমার দেখা হয়নি। সে সময় আমি ওমরগনী এমইএস কলেজে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। চা-নাস্তা সেরে তিনি একটি চিরকুট রেখে যান, আমি যেন তাঁর সাথে ফোনে কথা বলি। বাসায় এসে ফোন করলাম। হুজুর জানালেন, তিনি নেজামে ইসলাম পার্টির পক্ষে ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী হিসেবে মিনার মার্কা প্রতীকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। আমি যেন তাঁর কর্মি হিসেবে কাজ করি এবং বড় বড় জনসভায় বক্তৃতা প্রদান করি। হুযুরের নির্দেশনা মেনে চট্টগ্রাম ১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা করে প্রচার অভিযান চালাই। তখন দেখেছি অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় তিনি নির্বাচনী পরিস্থিতি সামাল দেয়ার সক্ষমতা রাখেন।

বোখারী সাহেব হুজুরের সুপারিশে, মাওলানা হাফেজ আনোয়ার আশিয়ায়ী (রহ.)-এর আগ্রহে পটিয়া জামেয়ার সাবেক প্রধান পরিচালক মাওলানা হারুন ইসলামাবাদী (রহ.) পটিয়া জামেয়ার বাংলা সাহিত্য ও অনুবাদ বিভাগে আমাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। আমি তখন চট্টগ্রাম ওমর গনী এমইএস কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। রোববার ও সোমবার দুটি করে চারটি ক্লাশ নিয়েছি প্রায় পাঁচ বছর। ২০০৩ সালে ইসলামাবাদী (রহ.) ইন্তেকাল করলে আমি ইস্তেফা দেই। বোখারী সাহেব হুজুর আমাকে ফোন করে একদিন হলেও পটিয়ায় ক্লাশ নেওয়ার কথা বলেন। আমি অপারগতা প্রকাশ করি। কারণ লেখালেখি ও দেশব্যাপী দাওয়াতী ময়দানে আমার ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় পটিয়া যাতায়াতের সময় বের করা কঠিন হয়ে পড়ে। পটিয়া জামেয়া থেকে বিদায় নিলেও বার্ষিক মাহফিল ও ছাত্রদের আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতাম নিয়মিত।

২০০৬ সালে বোখারী সাহেব হুজুর আমাকে ফোন করে বলেন, তোমাদের বাড়ির মাটির মসজিদ কী পাকা হয়েছে? আমি জানালাম এখনো হয়নি। চিন্তা ভাবনা চলছে। ফান্ডের ক্রাইসিস। হুজুর আমাকে বলেন, তাঁর কাছে পাঁচ লাখ টাকার একটি ফান্ড আছে। আমি আগ্রহী হলে তা দুই কিস্তিতে নিতে পারি। তবে শর্ত হচ্ছে মাটির পুরনো স্থাপনা ভেঙে ফেলতে হবে। আমি কমিটির সাথে আলাপ করে সম্মতি জানাই। দুই কিস্তিতে মসজিদ কমিটির দায়িত্বশীলসহ পটিয়া গিয়ে পাঁচলাখ টাকা নিয়ে আসি। পুরনো স্থাপনাটি এখন দৃষ্টিনন্দিত দ্বিতল মসজিদ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড.আবু তাহের সাহেবের ঐকান্তিক প্রয়াসে এটা কমপ্লেক্সে রূপান্তরিত হয়। প্রায় ২৫ লাখ টাকা এতে ব্যয়িত হয়। বোখারী সাহেব হুজুর প্রদত্ত পাঁচ লাখ টাকা না পেলে এ কাজ শুরু করতে বিলম্বিত হত। আমি হুজুরকে গ্রামে নিয়ে মসজিদটি উদ্বোধন করি এবং তিনি মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজ-নসিহত করেন।

হুজুরের সাথে আমি শত শত মাহফিল করেছি। আমার বয়ান হুজুর মনোযোগ সহকারে শুনতেন। ভুল-ত্রুটি শুদ্ধ করে দিতেন। আমাকে তিনি নসিহত করেন, ‘ওয়াজ ও বক্তৃতার উসলুব রাখবে সব সময় দাওয়াতী, এতে মানুষের মনে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। যদি সিয়াসী উসলুব হয় মানুষের মধ্যে ইন্তেকামী জযবা (প্রতিশোধ স্পৃহা) বৃদ্ধি পায়।’ আমি সব সময় হযরতের এ নসিহত মনে রেখেছি।

২০০৭ সাল বোখারী সাহেব হুজুর আমাকে ডেকে বলেন, মাসিক আত-তাওহীদের সম্পাদনার দায়িত্ব তোমাকে দিতে চাই। তোমার নাম থাকলে গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। আর তোমার সহযোগিতার জন্য আমি লোক দেবো। এছাড়া তোমার লেখাগুলো নিয়মিত ছাপার জন্য তো একটি প্লাটফরম দরকার।’ একটু ইতস্তত করে সম্মতি জানাই। হুজুর প্রধান সম্পাদক আর আমি সম্পাদক। প্রতিটি সংখ্যা ছাপার আগে তিনি দেখতেন। মাঝেমধ্যে ফোন করে মতামত জানাতেন। মাঝখানে একবার লিখিতভাবে ইস্তেফা দিয়েছিলাম। হুজুর মোবাইল করে জানালেন, তোমার ইস্তেফা কবুল হয়নি। কাজ করে যাও। সুবিধা-অসুবিধা আমাকে জানাবে। দেখতে দেখতে ১৫ বছর হয়ে গেল। বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মুহতামিম মাওলানা উবায়দুল্লাহ হামযা (হাফি.) আমাকে প্রতি সংখ্যায় পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রদান করেন। চলতি সংখ্যা বের হচ্ছে হুজুর ছাড়াই। এ কথা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে।

বোখারী সাহেব হুজুর ২০২২ সালের ২২ জুন বিদায় নিলেন ইহজগত থেকে। আগের দিন তাঁকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। হুজুরের ছেলে মাওলানা মানযার হালিম বোখারী, মাওলানা আহমদ হালিম বোখারী ও হুজুরের পিএস মাওলানা সোহাইলের সাথে কথা বলি। মৃত্যুর পর ফ্রিজারের ভেতর সৌম্য ও কান্তিময় জান্নাতী চেহারা দেখে মন হু হু করে কেঁদে উঠল। কোন মেঘের আড়ালে লুকালো শতাব্দীর দীপ্তিময় সূর্য। আজ বেশি বেশি মনে পড়ছে হুজুরের কথা। জান্নাতের চিরনিবাসে আল্লাহ তায়ালার পরম শান্তির শীতল ছায়ায় থাকুন, হে রাহবার, হে উস্তাদে মুহতরম।

هَيْهَاتَ؛ لَا يَأْتِي الزَّمَانُ بِمِثْلِهِ
إِنَّ الزَّمَانَ بِمِثْلِهِ لَبَخِيْلُ

 

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ