জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-২৪শে রজব, ১৪৪৬ হিজরি-২৬শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১২ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মানবজীবনে সময়ের গুরুত্ব

মানবজীবনে সময়ের গুরুত্ব

হাফেজ মাওলানা নূরুল হুদা

 

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ k، قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ لِرَجُلٍ وَهُوَ يَعِظُهُ: «اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ: شَبَابَكَ قَبْلَ هِرَمِكَ، وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ، وَغِنَاءَكَ قَبْلَ فَقْرِكَ، وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ، وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ».

সরল অনুবাদ: প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, কোন এক ব্যক্তিকে রসুল (সা.) উপদেশ দেওয়ার সময় বললেন, তুমি পাঁচটি বিষয়ের পূ্র্বে পাঁচটি বিষয়কে গুরুত্ব দাও। (১) বার্ধক্য আসার পূর্বে তোমার যৌবনকে গুরুত্ব দাও। (২) অসুস্থতার পূর্বে তোমার সুস্থতাকে গুরুত্ব দাও। (৩) দরিদ্রতা আসার আগে তোমার সচ্ছলতাকে গুরুত্ব দাও। (৪) তোমার ব্যস্ততার পূর্বে অবসরের প্রতি গুরুত্বারোপ করো (৫) এবং তোমার ‍মৃত্যু আসার আগেই তোমার জীবনের গুরুত্ব দাও।[1]

রাবী পরিচিতি: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) হযরত নবী করীম (সা.)-এর একজন বিখ্যাত সাহাবী। মহানবী (সা.)-এর আবদুল্লাহ নামক চার জন বিশিষ্ট সাহাবী—যাদেরকে একত্রে চার ইবাদালা বলা হয়, তিনি তাদের অন্যতম। তিনি কুরাইশ বংশের হাশেমি শাখার সন্তান। হযরত রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সর্বকনিষ্ঠ চাচা হযরত আব্বাস (রাযি.)-এর জ্যেষ্ঠ ছেলে। তিনি নবী করীম (সা.)-এর প্রিয় পাত্র ছিলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) ছিলেন একজন বিশিষ্ট সুবিজ্ঞ ফকীহ ও পবিত্র আল-কুরআনের তাফসীরের ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় মুফাসসির। মুসলিম বিশ্বে তাকে রইসুল মুফাসসিরীন বা সাইয়িদুল মুফাসসিরীন বলা হয়। অগাধ জ্ঞান পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি আরব জাতি তথা উম্মতে মুহাম্মদীর আল-হিবর ও বাহর (পুণ্যবান জ্ঞানী ও সমুদ্র) উপাধি লাভ করেছিলেন। তাকওয়া ও পরহেজগারির তিনি ছিলেন বাস্তব নমুনা। কারণ যে কোন দীনী জিজ্ঞাসার জবাব তিনি প্রজ্ঞার সাথে উপস্থাপন করতেন। এক অনন্য ইসলাম ধর্মবিশারদ বলে তাকে মনে করা হতো। আর এ জন্যেই তার উপাধি হিবরুল উম্মাহ।

গ্রন্থ পরিচিতি: আলোচ্য হাদীসটি মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ আল-হাকিম আন-নিসাপুরী (রহ.) কর্তৃক সংকলিত মুসতাদরিকে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি মনে করেন, তাঁর এ গ্রন্থে সংকলিত হাদীসগুলো সহীহ এবং ইমাম বুখারী (রহ.) ও ইমাম মুসলিম (রহ.) যে পদ্ধতিতে হাদীস সংকলন করেছেন তিনিও তার গ্রন্থে হাদীস সংকলনে সেই পদ্ধতিই অনুসরণ করেছেন। অর্থাৎ রাবীর বিশ্বস্তা, ন্যায়পরায়ণতা, স্বরণশক্তি এবং হাদীসটি শায ও মুয়াল্লাল না হওয়া। কিন্তু আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের হাদীস বিশারদগণের মতে এ গ্রন্থে কিছু যয়ীফ ও জাল হাদীস রয়েছে।

হাদীসের ব্যাখ্যা: আল্লাহর রসুল (সা.) হাদীসের শুরুতে বলেছেন, اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ অর্থাৎ পাঁচটি বিষয়ের পূর্বে পাঁচটি বিষয়কে গুরুত্ব দাও। তিনি চাইলে এখানে إِحْفِظْ অর্থাৎ সংরক্ষণ কর অথবা বলতে পারতেন, ‌إِهْتَمْ অর্থাৎ গুরুত্ব দাও। যদিও হাদীসের শাব্দিক অর্থে ‌إِهْتَمْ তথা গুরুত্ব দাও অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে। মূলত রসুল (সা.) বুঝাতে চেয়েছেন উল্লেখিত পাঁচটি বিষয় গনিমতের মতো যা মানুষ কোন রকম হিসেব ছাড়া লাভ করে। পবিত্র কুরআনে এই শব্দটি ব্যবহার হয়েছে গনিমত তথা যুদ্ধলব্দ সম্পদ হিসেবে। (গনিমত শব্দের ব্যবহারে আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَاعْلَمُوْۤا اَنَّمَا غَنِمْتُمْ مِّنْ شَيْءٍ فَاَنَّ لِلّٰهِ خُمُسَهٗ وَلِلرَّسُوْلِ وَلِذِي الْقُرْبٰى وَالْيَتٰمٰى وَالْمَسٰكِيْنِ وَابْنِ السَّبِيْلِ١ۙ ۰۰۴۱

অর্থাৎ ‘আরও জেনে রাখ যে, যুদ্ধে যা কিছু তোমরা (গনিমত) লাভ কর তার এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহ, তাঁর রসূলের, রসূলের নিকটাত্মীয়, পিতৃহীন এতীম, দরিদ্র এবং পথচারীদের জন্য।’[2]

এ হাদীসে আল্লাহর রসুল (সা.) বুঝাতে চেয়েছেন যে গনিমতের সম্পদ যেমন মানুষ লুফে নেয়, সবচেয়ে দামিটাকে আগে প্রাধান্য দেয় তেমনি মানুষের উচিত তার জীবন চলার পথে উল্লেখিত পাঁচটি বিষয়ের আগে পাঁচটি বিষয়কে গনিমতের মতো লুপে নেওয়া। মানুষ যেন এই পাঁচটি বিষয়কে আকর্ষণীয় সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। গনিমতের মাল যেমন পিছনে ফেলে আসলে আর ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না তেমনি ‍উল্লেখিত গুরুত্বপূর্ণ পাঁছটি বিষয় মানুষের জীবন থেকে হারিয়ে গেলে তা ফিরে পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ হাদীসে রসুল (সা.) মানুষের জীবনের মৌলিক পাঁটি সময়কে উল্লেখ করে তার প্রতি গুরুত্বারোপের কথা উল্লেখ করেছেন।

প্রথমত شَبَابَكَ قَبْلَ هِرَمِكَ (তোমার বার্ধক্য আসার আগেই তোমার যৌবনের গুরুত্ব দাও)। অর্থাৎ যৌবন নামক যে গনিমত তোমাকে আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন তা ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই তুমি তার ফায়দা লুফে নাও কারণ তোমার বার্ধক্য তোমাকে আর তোমার যৌবনে ফিরে আসতে দেবেনা। তুমি তোমার যৌবনেই আল্লাহর আনুগত্যে সময় ব্যয় কর। আল্লাহর রসুল (সা.) যৌবনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন কারণ এই বয়সেই মানুষ তার মনের মতো করে সবকিছু সাজিয়ে নিতে পারে। এই বয়স পার হয়ে গেলে সে তার জীবনের অসংখ্য চাহিদা পূরণ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। একজন বৃদ্ধ যেমন যুবকের মতো হাড্ডি চিবিয়ে খাওয়া দেখে আপসোস ছাড়া আর কিছূই করতে পারে না। ঠিক তেমনি যৌবন পার হয়ে বার্ধক্যে এসে গেলে অসংখ্য অগনিত কাজের ইচ্ছা থাকা সত্তেও সে তা বাস্তবায়ণ করতে পারে না। কারণ তখন তার মন সায় দিলেও তার দেহ তাকে সায় দেয় না। তাই যৌবনের ইবাদতর প্রতি আল্লাহর রসুল (সা.) বলেছেন,

«سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللهُ فِيْ ظِلِّهِ يَوْمَ لَا ظِلَّ إِلَّا ظِلُّهُ: الْإِمَامُ الْعَادِلُ، وَشَابٌّ نَشَأَ فِيْ عِبَادَةِ رَبِّهِ».

‘আল্লাহ রব্বুল আলামীন কিয়ামতের ‍দিন সাত ব্যক্তিকে তাঁর ছায়ায় ছায়া দেবেন যেদিন তাঁর ছায়া ব্যাতিত আর কোন ছায়া থাকবে না। তার মধ্যে প্রথম হলো ন্যায়পরায়ণ বাদশা আর দ্বিতীয় হলো যে তার যৌবন আল্লাহর আনুগত্য তথা ইবাদতে কাটিয়ে দিয়েছে।’[3]

অন্য হাদীসে রসুল (সা.) বলেন,

«لَا تَزُوْلُ قَدَمُ ابْنِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ حَتَّىٰ يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ، عَنْ عُمُرِهِ فِيْمَ أَفْنَاهُ، وَعَنْ شَبَابِهِ فِيْمَ أَبْلَاهُ، وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيْمَ أَنْفَقَهُ، وَمَاذَا عَمِلَ فِيْمَا عَلِمَ».

‘কোনো বনি আদম কিয়ামতের দিন তাঁর রবের নিকট থেকে এক কদম ও নড়া ছড়াও পারবে না যথক্ষণ না সে পাঁছটি প্রশ্নের উত্তর দেবে একটি হলো সারাটা জীবন সে কোন পথে ব্যয় করেছে? দ্বিতীয় প্রশ্ন করা হবে তার যৌবনকাল কোথায় ব্যয় করেছে?’[4]

আল্লাহর রসুল (সা.) এ হাদীসদ্বয়ে যৌবনের ইবাদতের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন কারণ যৌবনে মানুষ যেভাবে প্রতিটি ইবাদত যথাযথভাবে করতে পারে পড়ন্ত বয়সে তেমন করতে পারে না। যৌবনকালে চাইলে হিমালয় পর্বত জয় করা সম্ভব কিন্তু বার্ধক্যে হিমালয় পর্বত তো দূরের কথা সমতলে হাঁটতেও হাঁপিয়ে ওঠে। আজ আমাদের সমাজে যুব সমাজকে টার্গেট করে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাদের শয়তানী কার্যকলাপ পরিচালনা করে আসছে। এ অবস্থায় প্রতিটি যুবকের ‍উচিত তাদের শত্রূকে চেনা এবং তাদের এড়িয়ে চলা। সুতরাং যুবকদের উচিত যৌবন নামক সোনালী সময়কে গুরুত্ব দিয়ে আল্লাহর ইবাদতে নিজেকে ব্যস্ত রাখা এবং ক্ষেত্রে সমাজে প্রতিষ্ঠিত সকল পাপাচার মূলৎপাটনে সর্বচ্ছো চেষ্টা করা।

দ্বিতীয়ত وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ তোমার অসুস্থতার পূর্বে সুস্থতাকে গুরুত্ব দাও। সুস্থতা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য এক বিশাল নেয়ামত। সুস্থ অবস্থায় একজন মানুষ যেভাবে ইবাদত করতে পারে অসুস্থ অবস্থায় সেভাবে পারে না। শুধু ইবাদতই নয়, মানুষ তার কোন কাজ-কর্মই সঠিকভাবে করতে পারে না। কখনো কখনো মানুষ তার প্রচণ্ড অসুস্থতায় আল্লাহর হুকুমকে অমান্য করে। মানুষ যখন সুস্থ থাকে তখন সে এ সুস্থতাকে তেমন মূল্যায়ণ করে না। আর যখনই সে কোন রকম অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন সে চরম হতাশ হয়ে পড়ে। সে মনে করে তার রোগটাই পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন রোগ। তারা যন্ত্রণাই কঠিন যন্ত্রণা। অথচ সুস্থ থাকা অবস্থায় সে একে তেমন কোন রোগই মনে করতো না। এই কারণেই রসুল (সা.) বলেছেন,

«نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيْهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ: الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ».

‘মানুষের মধ্যে অধিকাংশ মানুষ দুটি নেয়ামতের খুব অবহেলা করে: একটি হলো সুস্থতা অপরটি হলো অবসরতা।’[5]

অসুস্থতার আগে সুস্থতার গুরুত্ব ওই পরীক্ষার্থীই সবচেয়ে বেশি বুঝতে পারবে যে কিনা পরীক্ষার আগের দিন পড়বে বলে তার সকল পড়া জমা করে রেখে ছিল কিন্তু কোন কারণে সে পরীক্ষার আগের দিন এতো বেশি অসুস্থ হলো যে পড়াতো দূরের কথা পড়ার টেবিলেও বসতে পারেনি। তখন তার কাছে মনে হবে তার সুস্থতার সময়েই সে পড়াটা পড়ে রাখলে সবচেয়ে ভালো হতো। এজন্যই বলা হয়, ‘সুস্থতা স্বাস্থ্যের মাথার ওপর এমন একটা মুকুট যা অসুস্থ ব্যক্তি ছাড়া কেউ দেখতে পায় না।’ সুতরাং প্রতিটি মানুষের ‍উচিত তার সুস্থতাকে গুরুত্ব দিয়ে সে তার রবের দেওয়া সকল দায়িত্ব পালন করে নেওয়া। কারণ সুস্থ অবস্থায় ইবাদতের যে পরিপূর্ণতা আসে তা অসুস্থ অবস্থায় আসে না।

তৃতীয়ত وَغِنَاءَكَ قَبْلَ فَقْرِكَ অর্থাৎ তোমার দরিদ্রতার পূর্বে সচ্ছলতাকে গুরুত্ব দাও। একজন প্রকৃত বুদ্ধিমান ধনী কখনই তার ভবিষ্যত সম্পর্কে উদাসীন থাকে না। সে তার আগত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তার অর্জিত সম্পত্তির পুরোটাই ব্যয় না করে কিছু কিছু করে সে সঞ্চয় করে রাখে। অথবা তার অতীব প্রয়োজনীয় কাজ গুলো অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সে তার সচ্ছলতার সময় সম্পন্ন করে ফেলে। ঠিক তেমনি একজন সচেতন মুমিন মুসলিমও তার সচ্ছলতার সময় সে তার সম্পত্তি থেকে আল্লাহর রাহে দান করে, গরীব অসহায় মানুষের প্রতি দয়া করে তার মৌলিক ইবাদত তথা যাকাত আদায় করে, হজ্জ পালন করে। বুদ্ধিমান সে মহান আল্লাহ তাআলার দেয়া বিশেষ অফার গ্রহণ করবে আল্লাহ তাআলা বলেন,

مَثَلُ الَّذِيْنَ يُنْفِقُوْنَ اَمْوَالَهُمْ فِيْ سَبِيْلِ اللّٰهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ اَنْۢبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِيْ كُلِّ سُنْۢبُلَةٍ مِّائَةُ حَبَّةٍ١ؕ وَاللّٰهُ يُضٰعِفُ لِمَنْ يَّشَآءُ١ؕ وَاللّٰهُ وَاسِعٌ عَلِيْمٌ۰۰۲۶۱

অর্থাৎ ‘আল্লাহর পথে যারা তাদের সম্পদ থেকে দান করে তাদের দানের ‍উদাহরণ হলো একটি বীজের মতো যা বপন করার পর তা থেকে সাতটি শীষ বের হয় আর প্রতিটি শীষ থেকে বের হয় আরও একশত দানা। তাছাড়া আল্লাহ তাআলা যাকে চান তাকে দ্বিগুন করে দেন। আর আল্লাহ তাআলা প্রাচুর্যময় মহাজ্ঞানী।’[6]

অপর এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَاَنْفِقُوْا مِنْ مَّا رَزَقْنٰكُمْ مِّنْ قَبْلِ اَنْ يَّاْتِيَ اَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَيَقُوْلَ رَبِّ لَوْ لَاۤ اَخَّرْتَنِيْۤ اِلٰۤى اَجَلٍ قَرِيْبٍ١ۙ فَاَصَّدَّقَ وَاَكُنْ مِّنَ الصّٰلِحِيْنَ۰۰۱۰ وَلَنْ يُّؤَخِّرَ اللّٰهُ نَفْسًا اِذَا جَآءَ اَجَلُهَا١ؕ وَاللّٰهُ خَبِيْرٌۢ بِمَا تَعْمَلُوْنَؒ۰۰۱۱

অর্থাৎ ‘আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছি, তা থেকে তোমাদের কারো মৃত্যু আসার আগেই ব্যয় কর। অন্যথায় সে বলবেঃ হে আমার পালনকর্তা, আমাকে আরও কিছুকাল অবকাশ দিলে না কেন? তাহলে আমি সদকা করতাম এবং সৎকর্মিদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। (তখন আল্লাহ প্রতিত্তরে বলবেন) প্রত্যেক ব্যক্তির নির্ধারিত সময় যখন উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ কাউকে অবকাশ দেবেন না। তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে খবর রাখেন।’[7]

অতএব সচেতন ও সচ্ছল মুমিনের উচিত তার মৃত্যু বা অসচ্ছলতা আসার আগেই সে আল্লাহর পথে তার সম্পদ দান করবে।

চতুর্থত وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ অর্থাৎ তুমি তোমার ব্যস্ততা আসার আগে তোমার অবসরকে গুরুত্ব দাও। কারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি অবহেলা করে তার অবসরতাকে। অবসর সময়তে মানুষ বেশি আল্লাহর থেকে বেশি গাফেল থাকে। এ কারণে আল্লাহর রসুল (সা.) বলেছেন,

«نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيْهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ: الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ».

‘দুটি নেয়ামতের ব্যাপারে মানুষ সবচেয়ে বেশি বেখবর! একটি হলো তার সুস্বাস্থ্য অপরটি হলো অবসরতা।’[8]

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তার রসুলকে লক্ষ করে বলেন,

فَاِذَا فَرَغْتَ فَانْصَبْۙ۰۰۷ وَاِلٰى رَبِّكَ فَارْغَبْؒ۰۰۸

অর্থাৎ ‘কাজেই যখনই অবসর পাও ইবাদতের কঠোর শ্রমে লেগে যাও এবং নিজের রবের প্রতি মনোযোগ দাও।’[9]

সুতরাং প্রতিটি মুসলমানের উচিত তার সময়কে যথাযথ কাজে লাগানো এং অবসরতাকে আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে ব্যয় করা। কারণ তাকে অযথা অনর্থক সৃষ্টি করা হয়নি। আল্লাহ তাআলা কুরআনে করীমে ইরশাদ করেন,

اَفَحَسِبْتُمْ اَنَّمَا خَلَقْنٰكُمْ عَبَثًا وَّاَنَّكُمْ اِلَيْنَا لَا تُرْجَعُوْنَ۰۰۱۱۵

অর্থাৎ ‘তারা কি ধারণা করে নিয়েছে তাদের অনর্থক সৃষ্টি করা হয়েছে। তাদেরকে আমার দিকে ফিরে আসতে হবে না?’[10]

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,

اَيَحْسَبُ الْاِنْسَانُ اَنْ يُّتْرَكَ سُدًىؕ۰۰۳۶

‘মানুষকে ধারণা করে নিয়েছে তাকে এমনিতে ছেড়ে দেওয়া হবে।’[11]

পঞ্চমত وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ অর্থাৎ তোমার মৃত্যু আসার আগে তুমি তোমার জীবনকে গুরুত্ব দাও। কেননা যখন মৃত্যুর দূত আসবে তখন কোন অযর আপত্তিই মানুষকে তার মৃত্যু থেকে রক্ষা করতে পারে না। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَاَنْفِقُوْا مِنْ مَّا رَزَقْنٰكُمْ مِّنْ قَبْلِ اَنْ يَّاْتِيَ اَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَيَقُوْلَ رَبِّ لَوْ لَاۤ اَخَّرْتَنِيْۤ اِلٰۤى اَجَلٍ قَرِيْبٍ١ۙ فَاَصَّدَّقَ وَاَكُنْ مِّنَ الصّٰلِحِيْنَ۰۰۱۰ وَلَنْ يُّؤَخِّرَ اللّٰهُ نَفْسًا اِذَا جَآءَ اَجَلُهَا١ؕ وَاللّٰهُ خَبِيْرٌۢ بِمَا تَعْمَلُوْنَؒ۰۰۱۱

অর্থাৎ ‘আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছি, তা থেকে মৃত্যু আসার আগেই ব্যয় কর। অন্যথায় সে বলবে, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে আরও কিছুকাল অবকাশ দিলে না কেন? তাহলে আমি সদকা করতাম এবং সৎকর্মিদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। প্রত্যেক ব্যক্তির নির্ধারিত সময় যখন উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ কাউকে অবকাশ দেবেন না। তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে খবর রাখেন।’[12]

যখন মানুষের নিকট মৃত্যু উপস্থিত তখন ‍দুনিয়াতে আল্লাহকে অস্বীকারকারীগণ আল্লাহর কাছে দুনিয়ার আবার দুনিয়াতে ফিরে আসার ‍সুযোগ প্রার্থনা করবে। নষ্ট করে ফেলা কিন্তু আল্লাহ রব্বুল আলামীন তা প্রত্যখ্যান করবেন। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,

حَتّٰۤى اِذَا جَآءَ اَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ رَبِّ ارْجِعُوْنِۙ۰۰۹۹ لَعَلِّيْۤ اَعْمَلُ صَالِحًا فِيْمَا تَرَكْتُ كَلَّا١ؕ اِنَّهَا كَلِمَةٌ هُوَ قَآىِٕلُهَا١ؕ وَمِنْ وَّرَآىِٕهِمْ بَرْزَخٌ اِلٰى يَوْمِ يُبْعَثُوْنَ۰۰۱۰۰

অর্থাৎ ‘যখন তাদের কারও কাছে মৃত্যু আসে, তখন সে বলে, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে পুনরায় (দুনিয়াতে) প্রেরণ করুন। যাতে আমি সৎকর্ম করতে পারি, যা আমি করিনি। কখনই নয়, এ তো তার একটি কথার কথা মাত্র। তাদের সামনে পর্দা আছে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত।’[13]

সুতরাং কোনো বিবেকবানের উচিত নয় সকালে তার কাজের জন্য বিকেলের অপেক্ষা করা। কারণ হতে পারে আজকের সকালটিই তার জন্য শেষ সকাল আর হয়তো বিকাল খুঁঝে পাবেনা। হযরত সুফিয়ান আস-সাওরী (রহ.) বলেন,

«النَّاسُ نِيَامٌ، فَإِذَا مَاتُوْا انْتَبَهُوْا».

‘অধিকাংশ মানুষ তার মৃত্যুর ব্যাপারে উদাসীন।’[14]

যখনই তার মৃত্যু আসে তখন সে হাহুতাস করতে করতে লজ্জিত হয়। সে ভাবে আগামীকাল সে ভালো কাজ করবে। অথবা আজকের পর থেকে সে আর মন্দ কাজ করবে না। কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় হলো তার মৃত্যু হঠাৎ এসে তার সকল পরিকল্পনা ভেস্তে দেয়। বাংলায় প্রবাদ আছে, ‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়।’ কিয়ামতের মাঠে যখন সব কিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে তখন অবিশ্বাসীগণ আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাবে তাদের আবার দুনিয়াতে পাঠাবে, তারা দুনিয়ায় এসে সৎকাজ করে আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করবে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাদের এই আবেদন প্রত্যাখ্যান করবেন। আল্লাহ তাআলা তাদের কথাকে কুরআনে এভাবে উল্লেখ করেছেন,

وَلَوْ تَرٰۤى اِذِ الْمُجْرِمُوْنَ نَاكِسُوْا رُءُوْسِهِمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ١ؕ رَبَّنَاۤ اَبْصَرْنَا وَسَمِعْنَا فَارْجِعْنَا نَعْمَلْ صَالِحًا اِنَّا مُوْقِنُوْنَ۰۰۱۲

অর্থাৎ ‘(হে রসুল) যদি তুমি দেখতে! অপরাধীরা যখন তাদের প্রতিপালকের সম্মুখে মাথা নত করে বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা দেখলাম ও শুনলাম এখন তুমি আমাদের পুনরায় (পৃথিবীতে) পাঠিয়ে দাও, আমরা সৎকাজ করব। নিশ্চয়ই আমরা (এখন) দৃঢ় বিশ্বাসী।’[15]

মোদ্দাকথা হলো জীবনের প্রতিটি সময় আল্লাহর দেওয়া বিশেষ নেয়ামত, এটি মানুষের জীবনে অমূল্য সম্পদ। যার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা সূরা আসরের শুরুতে শপথ করেছেন। তাছাড়া আরও বিভিন্ন সূরায় আল্লাহ তাআলা দিনের শপথ, কখনো রাতের শপথ, আবার কখনো দ্বিপ্রহরের সময়ের শপথ, কখনো মধ্য রাতে, আবার প্রভাতের শপথ করে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বোঝাতে চেয়েছেন মানব জীবনে সময়ের গুরুত্ব অনেক বেশি। ইমাম ফখরুদ্দীন আর-রাযী (রহ.) সময়ের গুরুত্ব বোঝাতে সূরা আসরের তাফসীরের কথা উল্লেখ করে বলেন, আমি একদিন বাজারে গিয়ে দেখি এক বরফ বিক্রেতা চিৎকারে করে বলেন কে আছ পুঁজি হারানো লোকটির প্রতি রহম করো। অর্থাৎ সূর্য উঠার সাথে সাথে তার বরফ গলতে শুরু করছে। অর্থাৎ তার পুঁজি গলে যাচ্ছে। আমাদের জীবনের সময় বরফ খন্ড গলার মতো যা প্রতিনিয়ত ইতিহাসের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্চে। সুতরাং প্রতিটি মানুষের উচিত তার জীবনের প্রতিটি সময়েকে গুরুত্ব দেওয়া।

হাদীসের শিক্ষা: সময়ের যথাযথ ব্যবহার করা। কাজটি আজ নয় আগামী কাল করব, এমন কথা না বলা। আখেরাতের চিন্তা নিয়ে সময়ের সৎ ব্যবহার করা। ইবাদতের জন্য আগামীকালকে নির্ধারণ না করা।

[1] আল-হাকিম, আল-মুসতাদরাক আলাস সহীহাঈন, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪১১ হি. = ১৯৯০ খ্রি.), খ. ৪, পৃ. ৩৪১, হাদীস: ৭৮৪৬

[2] আল-কুরআন, সূরা আল-আনফাল, ৮:৪১

[3] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ১৩৩, হাদীস: ৬৬০

[4] আত-তিরমিযী, আস-সুনান, মুস্তফা আলবাবী অ্যান্ড সন্স পাবলিশিং অ্যান্ড প্রিন্টিং গ্রুপ, কায়রো, মিসর (দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৩৯৫ হি. = ১৯৭৫ খ্রি.), খ. ৪, পৃ. ৬১৩, হাদীস: ২৪১৬

[5] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ১৩৩, হাদীস: ৬৬০

[6] আল-কুরআন, সূরা আল-বাকারা, ২:২৬১

[7] আল-কুরআন, সূরা আল-মুনাফিকূন, ৬৩:১০-১১

[8] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ১৩৩, হাদীস: ৬৬০

[9] আল-কুরআন, সূরা আল-ইনশারাহ, ৯৪:৭-৮

[10] আল-কুরআন, সূরা আল-মুমিনূন, ২৩:১১৫

[11] আল-কুরআন, সূরা আল-কিয়ামা, ৭৫:৩৬

[12] আল-কুরআন, সূরা আল-মুনাফিকূন, ৬৩:১০-১১

[13] আল-কুরআন, সূরা আল-মুমিনূন, ২৩:৯৯-১০০

[14] আবু নুআয়ম আল-আসবাহানী, হিলয়াতুল আওলিয়া ওয়া তাবাকাতুল আসফিয়া, খ. ৭, পৃ. ৫২

[15] আল-কুরআন, সূরা আস-সাজদা, ৩২:১২

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ