কেন বাংলাদেশি আলিমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন না?
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন
গণকমিশন কর্তৃক প্রকাশিত শ্বেতপত্র দেখলে বোঝা যায় এদেশের সব ঘরানার উলামায়ে কেরামকে এতে যুক্ত করা হয়েছে। মোটকথা এদেশে যারা ইসলামকে ফোকাস করেন ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রচার করেন তাদের সবাইকেই টার্গেট করা হয়েছে। দেওবন্দি, আলিয়া, জামায়াতে ইসলামী, চরমোনাই, বেরলভী, আহলে হাদীস ও জৈনপুরী কাউকেই বাদ দেওয়া হয়নি। গণকমিশনের এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সব মাসলাকের আলিমদের ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এখন অস্তিত্বের প্রশ্ন। দলীয় বা গোষ্ঠীয় সঙ্কীর্ণতা পরিহার করতে হবে এবং হৃদয়কে করতে হবে বড় ও প্রসারিত। ‘ইত্তেফাক মাআল ইখতিলাফ’ হযরত কায়েদ সাহেব হুজুরের এই নীতিমালাকে সামনে রেখে একে অপরের কাছে আসতে হবে। ইখতিলাফ ও ভিন্নমত থাকবে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। অপরের মতো, পরামর্শ, ধ্যান-ধারণার প্রতি ইসলাম সবসময় শ্রদ্ধাশীল। গঠনমূলক সমালোচনাকে ইসলাম সবসময় স্বাগত জানায়। ভিন্নমতের প্রতি ইসলামের আচরণ সহানুভূতিপূর্ণ। সহিষ্ণুতা নিঃসন্দেহে মানবিক গুণাবলির মধ্যে শ্রেষ্ঠতম এবং সামাজিক মূল্যবোধ নির্মাণের তাৎপর্যপূর্ণ বুনিয়াদ। অপরের কথা, বক্তব্য, মতামত, পরামর্শ ও জীবনাচার যতই বিরক্তিকর ও আপত্তিকর হোক না কেন তা সহ্য করার মত ধৈর্য ও স্থৈর্য যদি মানুষের মধ্যে না থাকে তা হলে সমাজে নৈরাজ্য, উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে বাধ্য। ইখতিলাফ নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ঐক্য গড়ে তোলা যায়। নিয়মতান্ত্রিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আইনের পথে লড়াই করতে হবে। পাতানো ফাঁদে পা দেয়া যাবে না। জোশকে নিয়ন্ত্রণ করে হুঁশকে প্রাধান্য দিতে হবে। মনে রাখতে হবে ঐক্যই শক্তি, বিভেদে পতন। আগামীতে আরও বড় ধরণের বিপর্যয় আঘাত হানতে পারে।
বিভিন্ন ঘরানা আলিমদের সাথে আলাপ করে জানা যায় তারা ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টির পক্ষে কিন্তু তাদের একটি অংশ মারাত্মকভাবে অহংবাদী, হিংসাশ্রয়ী ও কলহপ্রিয়। নিজেদের সম্পর্কে মাত্রাতিরিক্ত উচ্চধারণা, যশলিপ্সা, পদমোহ ও কাউকে না মানার একটি বেদনাদায়ক প্রবণতা তাদের প্রাণশক্তিকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। এক অপরের প্রতি উদারতার অভাব এত তীব্র যে, নিজেদের দলীয় বৃত্ত, মাসলাকি চেতনা ও তরিকার বলয়ের বাইরে তারা কাউকে চিন্তা করতে পারেন না। এ অনুদার মানসিকতা বৃহত্তর ঐক্যের পথে বড় অন্তরায়। এদেশে আলিম, পীর, মাশায়েখ ও মুরশিদের সংখ্যা প্রচুর। তাদের গণভিত্তি বেশ মজবুত। সাধারণ জনগণের সাথে তাদের সম্পর্ক গভীর। মাদরাসা শিক্ষা ও ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ দ্বীনে ইসলামের আলো পাচ্ছে। ওয়াজ ও নসিহত হাজার বছরের বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি। আলিমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আবহ তৈরির জন্য জনগণকে আহবান করে থাকেন। ওলামায়ে কেরাম মাহফিলে মাদক, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, যৌতুক, ধর্ষণ, ইভটিজিং, নারী নির্যতন, খুন-খারাবি, ব্যভিচারসহ নানা সামাজিক অপরাধ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে জনগণকে সচেতন করে যাচ্ছেন। ইসলামের নির্দেশনা মেনে জীবন পরিচালনা করা, ইহ জীবনে সমৃদ্ধি, পরকালে মুক্তি এবং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই ওয়াজের মূল সূর। ওয়ায়েজ ও আলিমদের শেকড় মজবুত। তৃণমূল পর্যায়ে রয়েছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা। তারা সামাজিক শক্তির প্রতিভূ। ধর্মচর্চা ও ধর্মীয় ভাবাবেগ বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের গভীরে প্রোথিত। কিন্তু আফসোস! মাসলাক ও ফিরকাবন্দীর সংকীর্ণ গণ্ডি হতে তারা বেরুতে পারেননি। ফলে এর প্রভাব পড়েছে তাদের ছাত্র, শিষ্য ও অনুরক্তদের ওপর।
আলিমদের অপর একটি গ্রুপ অত্যন্ত চরমপন্থী ও অসহিষ্ণু, যারা অন্য দল, তরিকা বা মাসলাকের অনুসারীদেরকে মুসলমানই মনে করেন না অথবা গোমরাহ ভাবেন। অন্তর্মুখী মানসিকতা তাদেরকে বহির্মুখী করতে পারেনি। ওয়াজ, মিলাদ ও তাফসির মাহফিলে অপরাপর চিন্তাধারার লোকদের সমালোচনা, বিষোদগার ও গালমন্দ করা তাদের চিরবৈশিষ্ট্য। ছোট খাট ইখতিলাফি মাসায়েল নিয়ে এত বেশি পারস্পরিক ঘৃণা ছড়ানো হয় যে, স্থায়ী বিভেদের দেয়াল তৈরি হয়ে যায়। আলিমদের বিভেদের সুযোগ নিয়ে বৈরি শক্তি ও কায়েমি স্বার্থবাদীরা সব সময় চক্রান্তের জাল বুনেছে এবং আগামীতেও বুনবে। মাওলানা এহসান এলাহী জহির, মাওলানা নওয়াব সিদ্দিক হাসান ভূপালী, মাওলানা সানাউল্লাহ অমৃতসরী, মাওলানা শামসুল হক আজিমাবাদী ও মাওলানা আবদুল্লাহিল কাফি আল-কুরায়শীর মতো উদারমনস্ক আলিম বাংলাদেশি আহলে হাদীসের মধ্যে এখন আর নেই। আল্লামা সাইয়েদ সোলায়মান নদভী, মুফতি মুহাম্মদ শফী, মাওলানা আতহার আলী, মাওলানা যফর আহমদ উসমানী ও খতীবে আযম মাওলানা সিদ্দিক আহমদের মতো ওয়াহাদাতে উম্মতের চেতনায় বিভোর মানুষ বাংলাদেশি দেওবন্দীদের মধ্যে এখন বিরল। মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী, মাওলানা কাজী হোসাইন আহমদ, অধ্যাপক গোলাম আজম ও সাইয়েদ মুনাওয়ার হাসানের মতো অ্যাকোমোডেটিভ মানসিকতাসম্পন্ন নেতা জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ চ্যাপ্টারে আর অবশিষ্ট নেই। পাকিস্তানের বেরলভীদের নেতা মুফতি শফী উকাড়ভী, মাওলানা শাহ আহমদ নূরানী, মুফতি মুনিবুর রহমান ও মাওলানা ড. তাহের আল-কাদেরীর মতো উদার ব্যক্তি বাংলাদেশি বেরলভীদের মধ্যে অনুপস্থিত। এটা নিঃসন্দেহে বহুমুখী ও দূরদর্শী নেতৃত্বের শূন্যতা।
বিভিন্ন মতাদর্শের আলিমগণ একদিন নিজেদের ভেদাভেদ ও বিভেদ ভুলে গিয়ে একক প্লাট ফরমে আসতে বাধ্য হবেন। তবে এর আগে একটি প্রচণ্ড ঘুর্ণিবাত্যার তাণ্ডব প্রয়োজন। তীব্র ঝড়ো হাওয়ার আঘাত-অভিঘাতে যখন সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে তখন তারা একে অপরের হাত ধরে বাঁচতে চাইবেন। তখন হয়ত দেরি হয়ে যাবে। সময়ের ও যুগের চ্যালেঞ্জ ওলামা-মাশায়েখদের ঐক্যবদ্ধ করেছে, ইতিহাসের পাতায় রয়েছে তার বহু প্রমাণ। ৪৭ সালের দেশ বিভক্তির পর পাকিস্তানের ওলামা-মাশায়েখ যখন ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার দাবি তুললেন তখন শাসকচক্র চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন কোন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করবো? দেওবন্দীর ইসলাম? বেরলভীর ইসলাম? মওদুদীর ইসলাম? শিয়ার ইসলাম? আহলে হাদীসের ইসলাম? এই চ্যালেঞ্জ পেয়ে তৎকালীন পাকিস্তানের বিভিন্ন মত ও পথের আলিমগণ ঐক্যবদ্ধ হতে বাধ্য হন। ১৯৫১ সালে বিভিন্ন মতাদর্শের ৩১ আলিম করাচীতে হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভীর বিখ্যাত খলিফা আল্লামা সাইয়েদ সোলায়মান নদভীর সভাপতিত্বে মিলিত হয়ে ঐতিহাসিক ২২ দফা প্রণয়ন করেন। চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুফতি মুহাম্মদ শফী, মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী, মাওলানা যফর আহমদ ওসমানী, মাওলানা আতাহার আলী, মাওলানা শফি উকাড়ভী, মাওলানা শামসুল হক আফগানী, মাওলানা আবদুল হামিদ কাদেরী বাদায়ুনী, মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী, মাওলানা দাউদ গজনভীসহ দুজন শিয়া মুজতাহিদ। ফলশ্রুতিতে রচিত হয় ৫৬ সালের ইসলামী সংবিধান।
ভারতে নানা পথ ও মতের আলিমদের মধ্যে ঐক্যের একটি বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। জাতীয় ও আঞ্চলিক সম্মেলনে তারা একে অপরকে অতিথি হিসেবে দাওয়াত দেন। ইসলামী শিক্ষা সঙ্কোচন নীতির বিরুদ্ধে দারুল উলুম দেওবন্দ কর্তৃক আহুত সর্বভারতীয় সম্মেলনে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ, জামায়াতে ইসলামী, জমিয়তে আহলে হাদীস, আহলে সুন্নাত বেরলভী জামায়াত, শিয়া ওয়াকফ বোর্ড, দিল্লি ও আজমীরের দরগাহের মুতাওয়াল্লি বক্তব্য রাখেন। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ কর্তৃক দিল্লি, মুম্বাই, আজমির, কোলকাতা ও হায়দারাবাদে আয়োজিত সন্ত্রাসবাদ বিরোধী ও জাতীয় সংহতি সম্মেলনে মুসলমানদের বিভিন্ন চিন্তাধারার আলিমদের পাশাপাশি উদারপন্থী হিন্দু সাধু ও সন্তরাও বক্তব্য পেশ করেন। ২০১৮ সালে জমিয়তে আহলে হাদীসের উদ্যোগে দিল্লির রামলীলা ময়দানে আয়োজিত ‘বিশ্ব শান্তি পুন প্রতিষ্ঠা ও মানবতা সংরক্ষণ’ শীর্ষক ৩৪তম জাতীয় সম্মেলনে দারুল উলুম দেওবন্দের মুহাদ্দিস ও জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম হিন্দের সভাপতি মাওলানা আরশাদ মাদানি অতিথি হিসেবে অংশ নেন এবং বক্তব্য উপস্থাপন করেন। অতি সম্প্রতি ২৮ ও ২৯ মে’২২ ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দে ওসমান নগর ঈদগাহ ময়দানে দেশটির মুসলমানদের সর্ববৃহৎ পুরনো সংগঠন জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের দুই দিনব্যাপী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মাওলানা সাইয়েদ মাহমুদ মাদানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন মাওলানা সাইয়েদ আরশাদ মাদানী, দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম মুফতি আবুল কাসেম নোমানী, আসাম রাজ্যের লোকসভার সদস্য মাওলানা বদরুদ্দীন আজমল, জামায়াতে ইসলামী হিন্দের আমির সাইয়েদ সাআদাতুল্লাহ হোসাইনী, মাওলানা আহমদ রেজা খান বেরলভীর দৌহিত্র বেরলভী নেতা মাওলানা তাওকির রেজা খান, আহলে হাদীসের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ, মুসলিম পারসোনাল ল’ বোর্ড, সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডসহ ভারতের বৃহৎ বৃহৎ মুসলিম সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। সম্মেলনে জ্ঞানবাপী মসজিদ, মথুরা ঈদগাহের শাহি মসজিদ, দিল্লির কুতুব মিনারসহ ভারতে মুসলিমদের অন্যান্য চলমান সঙ্কট বিষয়ে আলেম, বুদ্ধিজীবী ও মুসলিম প্রতিনিধিরা মতবিনিময় করেন। ভারতে কোনোভাবেই ইউনিফর্ম সিভিল কোড গ্রহণযোগ্য নয় বলে মত দিয়েছেন দেশটির শীর্ষ আলেমরা। তারা বলছেন, এটি বাস্তবায়ন ইসলামে হস্তক্ষেপের শামিল। আলেমরা বিজেপি সরকারের নেয়া পরিকল্পনা ইউনিফর্ম সিভিল কোড তথা ‘অভিন্ন নাগরিক নীতি’র তীব্র বিরোধিতা করেন। মাওলানা সাইয়েদ মাহমুদ মাদানি বলেন, ভারতে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টির ষড়যন্ত্রের চেষ্টা করা হচ্ছে। যদি এমনটি ঘটে, তাহলে দেশের নিরাপত্তা ও ভ্রাতৃত্ববোধ হুমকির মুখে পড়বে (নয়াদিগন্ত, ঢাকা, ৩০ মে ২০২২)
১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে দ্বীনি শিক্ষা, ইসলামী রাজনীতি ও মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধে যখন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন তখন পাকিস্তানের সব চিন্তাধারার আলিম জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের আমির মাওলানা ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে ‘মুত্তাহিদা মজলিশে আমল’ নামক ঐক্যমঞ্চ গড়ে তুলতে বাধ্য হন। জামায়াতে ইসলামীর আমির কাজী হোসাইন আহমদ আলিমদের একতাবদ্ধ করার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মাওলানা ফজলুর রহমান ছিলেন তখন পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে সম্মিলিত বিরোধ দলের নেতা। এ কথা সন্দেহাতীতভাবে সত্য যে, বাংলাদেশের মাটি, পরিবেশ, জনমানস ইসলামী আন্দোলনের সফলতার অনুকূলে; কিন্তু আলিমদের দলাদলি, ইসলামী দলগুলোর দুর্বল নেতৃত্ব, সংকীর্ণতা ও অনৈক্য এ উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে অনিশ্চিত করে দিয়েছে। নেতা ও কর্মিগণ ইসলাম, ইসলামী শাসন ও ইকামতে দ্বীনের কথা বললেও জনগণের ব্যথা-বেদনা অভাব-অভিযোগ ও হাসি কান্নার কথা বলেন খুব কম। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় কাকে বসালে রাষ্ট্রের উন্নতি হবে, আইনের শাসন কায়েম হবে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে ও ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে সাধারণ মানুষ তা জানে ও বোঝে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান মানুষের স্বাভাবিক চাহিদা। দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির তীব্রতা অনেক সময় ইসলামপন্থীদের মন ও মানসকে এতই আচ্ছন্ন করে রাখে যে, অন্য প্লাট ফরমের মানুষের প্রতি সম্মান দেখাতে কুন্ঠিত হয়। ভিন্নতার মাঝে ঐক্য (Unity in divrsity) ইসলামী আন্দোলেনের কর্মিদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হওয়া অপরিহার্য, একথা ভুলে গেলে চলবে না।
এ ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ জনাব এজেডএম শামসুল আলমের অভিমত প্রণিধানযোগ্য। ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যও ইসলামী আন্দোলনের বহু নেতা এক সঙ্গে এক দলে কাজ করতে পারেন না। নিজের নেতৃত্ব স্বীকৃত না হলে উপদল করবেন বা ক্ষুদ্র সংগঠন করবেন। কিন্তু কোনো পুরাতন দলে যোগ দেবেন না। ইসলামী আন্দোলনকারী বহু নেতার মধ্যে নাফসানিয়ত, খাহেশাত, আমিত্ব এবং অহংকারবোধ এত বেশি যে, অদূর ভবিষ্যতেও তাদের মধ্যে এ মারাত্মক ব্যাধির চিকিৎসার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। আন্দোলনের উদ্দেশ্য লিল্লাহ (আল্লাহর জন্য) বলা হলেও আন্দোলন তারা করে থাকেন লিন্নাফস (নিজের জন্যে) এবং নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে। এটা অনেকের মনে সচেতনভাবে থাকে, অনেকের মনে থাকে অবচেতনভাবে। অবচেতন খায়েশ সচেতন খায়েশ অপেক্ষা মারাত্মক কারণ অবচেতন খায়েশকারীর মনে কোনো Guilt Guilt Feeling বা অপরাধবোধ থাকে না। কিন্তু ফল একই। ইসলামী সংগঠনগুলো মধ্যে কোনো ঐক্য নেই অথচ ধর্মবিরোধী শিবিরে ঐক্যের ঐকতান লক্ষণীয়। ধর্মনিরপেক্ষ কোন বিরাট দল পার্টির স্বার্থে এক থাকতে পারে, অথচ তুলনামূলকভাবে অনেকগুলো ক্ষুদ্র ডানপন্থী দল ইসলামের স্বার্থে এক থাকতে পারে না। এ অবস্থায় তারা কিভাবে জনগণের আস্থা দাবি করতে পারেন? ইসলামপন্থীরা অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মান্ধ। চোখ থেকেও তারা অন্ধ। চোখের সম্মুখে তারা দেখতে পাচ্ছেন যে, ইসলাম বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও বামপন্থীদের সভা সমিতিতে জনগণ জমায়েত হয়। কারণ বামপন্থীরা যুগ-যন্ত্রণার কথা বলে। অর্থনৈতিক সমস্যা বিশ্লেষণ করে রাজনৈতিক সমাধান নির্দেশ করে। একই বক্তব্য যদি ইসলামপন্থীরা পেশ করতে পারেন তাদের সভায় তো লোক আরও বেশি হওয়ার কথা। কারণ তাদের থেকে জনগণ শুধু যে যুগের সমস্যার সমাধান পাবে তা নয়; বরং জীবনজিজ্ঞাসার জবাবও পাবে। এ সাধারণ সত্য বোঝার জন্য দার্শনিকের দরকার হয় না। ইসলামপন্থীরা কি তা বোঝেন?’ (ইসলামী প্রবন্ধমালা, পৃ. ৪৮৪-৪৯৮)।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুর্যোগের ঘনঘটা লক্ষ করা যাচ্ছে এবং অশুভ শক্তির অশনি সংকেত স্পষ্ট হতে চলেছে। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ইসলামোফোবিয়া বিশেষত উপমহাদেশীয় ঘটনাপ্রবাহ ও ভূরাজনীতির বাস্তবতাকে ভুললে চলবে না। পঞ্চাশ বছরেও সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি এদেশে। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সংঘর্ষের পথে এগুচ্ছে দেশ। মুদ্রাস্ফীতি, নিত্য প্রয়েজনীয় পণ্যসামগ্রীর ক্রমোর্ধগতি, নিন্মমুখী রিজার্ভ, শেয়ার বাজার লোপাট, বিদেশে পুঁজিপাচার, দুর্নীতির মহোৎসব ও গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট সফলতার সম্ভাবনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. মইনুল ইসলামের মতে ‘আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ৩ হাজার কোটি ডলার ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। প্রতি বছর ৭৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চার লাখ কোটি টাকায়’ (প্রথম আলো, ৩১ মে ২০২২)। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে একটি ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে। এ ঘূর্ণিঝড় আশীর্বাদও হতে পারে। হতে পারে অভিশাপও। এদেশের আম ইসলামী জনতা ঘূর্ণির প্রলয়-নৃত্য ও ঘূর্ণি পরবর্তী বেঁচে থাকার সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করার জন্যে অপেক্ষমান। সেই সংগ্রাম হতে হবে নিশ্চিতভাবে ঐক্যনির্ভর।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক