মুফতি মাহমুদ হাসান
তারাবীহে রাকাআত সংখ্যা শরীয়তের বিশুদ্ধ দলিল-প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত। গ্রহণযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত রসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে ২০ রাকাআত তারাবীহ পড়েছেন। সাহাবায়ে কেরামের আমলও তদ্রূপ ছিল।
কেউ কেউ হযরত রসুলুল্লাহ (সা.)-এর ২০ রাকাআত তারাবীহবিষয়ক হাদীসটিকে সূত্রের বিচারে অনির্ভরযোগ্য প্রমাণ করলেও বিশুদ্ধ সূত্রে সাহাবায়ে কেরামের আমলই প্রমাণ করে যে, হযরত রসুলুল্লাহ (সা.) থেকে সাহাবায়ে কেরাম ২০ রাকাআতের শিক্ষা পেয়েছেন। আমিরুল মুমিনীন হযরত ওমর ফারুক (রাযি.)-এর খেলাফতকাল থেকে অবিচ্ছিন্ন কর্মধারায় এখন পর্যন্ত মক্কা শরীফের মসজিদুল হারাম ও মদীনা শরীফের মসজিদে নববীসহ সকল মসজিদে ২০ রাকাআত তারাবীহ পড়া হয়। এ দীর্ঘ সময়ে কোথাও আট রাকাআত তারাবীহে প্রচলন ছিল না।
সর্বপ্রথম ১২৮৪ সালে ভারতবর্ষের আহলে হাদীস আলেম আট রাকাআতের ফতওয়া দিয়ে উম্মাহের ঐকমত্যপূর্ণ মাসআলায় বিভক্তি সৃষ্টি করেন। তখন অন্যান্য আহলে হাদীসরাও তার বিরোধিতা করেছে। অতঃপর আরবের কতিপয় বিচ্ছিন্ন আলেমও তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন। কিন্তু আরববিশ্বের আলেমদের বেশিরভাগই ২০ রাকাআত তারাবীহে আদায় করেন।
হযরত ওমর (রাযি.)-এর যুগে সাহাবায়ে কেরামের আমল
॥এক॥
عَنِ السَّائِبِ بْنِ يَزِيْدَ قَالَ: «كَانُوْا يَقُوْمُوْنَ عَلَىٰ عَهْدِ عُمَرَ بْنِ الْـخَطَّابِ h فِيْ شَهْرِ رَمَضَانَ بِعِشْرِيْنَ رَكْعَةً»، قَالَ: «وَكَانُوْا يَقْرَءُوْنَ بِالْـمَئِيْنِ، وَكَانُوْا يَتَوَكَّئُوْنَ عَلَىٰ عِصِيِّهِمْ فِيْ عَهْدِ عُثْمَانَ بْنِ عَفَّانَ h مِنْ شِدَّةِ الْقِيَامِ».
‘হযরত ইয়াযীদ ইবনে খুসাইফা (রহ.) বলেন, ‘সাহাবী সায়িব ইবনে ইয়াযীদ (রাযি.) বলেছেন, সাহাবায়ে কেরাম হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযি.)-এর যুগে রমজান মাসে ২০ রাকাআত তারাবীহ পড়তেন।’ তিনি আরও বলেন যে, ‘তারা নামাজে শতাধিক আয়াতবিশিষ্ট সূরাসমূহ পড়তেন এবং হযরত ওসমান ইবনে আফফান (রাযি.)-এর যুগে দীর্ঘ নামাজের কারণে তাঁদের (কেউ কেউ) লাঠিসমূহে ভর দিয়ে দাঁড়াতেন।’’[1]
অপর সূত্রে বর্ণিত আছে,
॥দুই॥
عَنِ الْـحَارِثِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمٰنِ بْنِ أَبِيْ ذُبَابٍ، عَنِ السَّائِبِ بْنِ يَزِيدَ قَالَ: «… وَكَانَ الْقِيَامُ عَلَىٰ عَهْدِ عُمَرَ ثَلَاثَةً وَعِشْرِيْنَ رَكْعَةً».
তাবেয়ী ইবনে আবু যুবাব (রহ.) বলেন, হযরত ওমর (রাযি.)-এর যুগে রমজানের কিয়াম তথা তারাবীহ ছিল ২৩ রাকাআত।’[2]
হাদীসটির সূত্র বিশুদ্ধ। এতে ২৩ রাকাআত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, ২০ রাকাআত তারাবীহ ও তিন রাকাআত বিতর।
॥তিন॥
عَنْ عَبْدِ الْعَزِيزِ بْنِ رُفَيْعٍ قَالَ: «كَانَ أُبَيُّ بْنُ كَعْبٍ يُصَلِّيْ بِالنَّاسِ فِيْ رَمَضَانَ بِالْـمَدِيْنَةِ عِشْرِيْنَ رَكْعَةً، وَيُوتِرُ بِثَلَاثٍ».
‘তাবেযী হযরত আবদুল আযীয ইবনে রুফাই (রহ.) বলেন, ‘উবাই ইবনে কা’ব (রাযি.) রমজানে মদীনায় লোকদের নিয়ে ২০ রাকাআত তারাবীহ এবং তিন রাকাআত বিতর পড়তেন।’’[3]
॥চার॥
عَنْ يَحْيَى بْنِ سَعِيْدٍ، «أَنَّ عُمَرَ بْنَ الْـخَطَّابِ أَمَرَ رَجُلًا يُصَلِّيْ بِهِمْ عِشْرِيْنَ رَكْعَةً».
‘তাবেয়ী হযরত ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আল-আনসারী (রহ.) বলেন, ‘ওমর (রাযি.) এক ব্যক্তিকে আদেশ করেন, তিনি যেন লোকদের নিয়ে বিশ রাকাআত পড়েন।’’[4]
॥পাঁচ॥
عَنْ يَزِيْدَ بْنِ رُومَانَ قَالَ: «كَانَ النَّاسُ يَقُوْمُوْنَ فِيْ زَمَانِ عُمَرَ بْنِ الْـخَطَّابِ h فِيْ رَمَضَانَ بِثَلَاثٍ وَعِشْرِيْنَ رَكْعَةً».
‘তাবেয়ী হযরত ইয়াযীদ ইবনে রুমান (রহ.) বলেন, ‘হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযি.)-এর যুগে লোকেরা রমজানে ২৩ রাকাআত পড়তেন।’’[5]
হযরত আলী (রাযি.)-এর যুগে সাহাবায়ে কেরামের আমল
عَنْ أَبِيْ عَبْدِ الرَّحْمٰنِ السُّلَمِيِّ، عَنْ عَلِيٍّ h قَالَ: «دَعَا الْقُرَّاءَ فِيْ رَمَضَانَ فَأَمَرَ مِنْهُمْ رَجُلًا يُصَلِّيْ بِالنَّاسِ عِشْرِيْنَ رَكْعَةً»، قَالَ: وَكَانَ عَلِيٌّ h يُوتِرُ بِهِمْ».
‘বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম আবু আবদুর রহমান আস-সুলামী (রহ.) বলেন, ‘হযরত আলী (রাযি.) রমজানে হাফেযদের ডাকেন এবং তাদের একজনকে লোকদেরকে নিয়ে ২০ রাকাআত পড়ার নির্দেশ দিলেন।’ তিনি বলেন, ‘আলী (রাযি.) তাঁদের নিয়ে বিতর পড়তেন।’’[6]
عَنِ ابْنِ أَبِي الْـحَسْنَاءِ، «أَنَّ عَلِيًّا أَمَرَ رَجُلًا يُصَلِّيْ بِهِمْ فِيْ رَمَضَانَ عِشْرِيْنَ رَكْعَةً».
‘তাবেয়ী ইবনে আবুল হাসনা (রহ.) বলেন, ‘আলী (রাযি.) এক ব্যক্তিকে আদেশ করেন, তিনি যেন লোকদের নিয়ে বিশ রাকাআত তারাবীহ পড়েন।’’[7]
উপর্যুক্ত বর্ণনাগুলোসহ আরও অন্যান্য বর্ণনাসমূহ এবং সাহাবী-তাবেয়ীনের সর্বসম্মতিক্রমে আমলের ভিত্তিতে এবং যুগ-যুগ ধরে চলে আসা সম্মিলিত অবিচ্ছিন্ন কর্মের ভিত্তিতে আলেমদের অভিমত হলো ২০ রাকাআত তারাবীহ সুন্নতে মুওয়াক্কাদা। বিনাওজরে এর কম পড়লে সুন্নতে মুওয়াক্কাদা ছেড়ে দেওয়ার গোনাহ হবে।
যারা বর্তমানে আট রাকাআত তারাবীহে প্রচার করছে, তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী দলিল হলো সহীহ আল-বুখারী শরীফের একটি হাদীস, যা আসলে তারাবীহ সম্পর্কে নয়, বরং ওই হাদীসটি হলো তাহাজ্জুদ সংক্রান্ত একটি হাদীস। তাতে বর্ণিত হয়েছে, রমজানে ও রমজানের বাইরে হযরত রসুলুল্লাহ (সা.) চার রাকাআত করে আট রাকাআত পড়তেন। অথচ আমরা জানি, রমজানের বাইরে কোনো তারাবীহ নেই এবং তারাবীহে নামাজ হলো দুই রাকাআত করে। যদি হযরত রসুলুল্লাহ (সা.) থেকে আট রাকাআতই প্রমাণিত হতো, তাহলে সাহাবায়ে কেরাম হযরত রসুলুল্লাহ (সা.)-এর বিরুদ্ধাচরণ করে বিশ রাকাআত পড়তেন না। নাউযু বিল্লাহ!
তারাবীহে মাসআলা
মাসআলা: ২০ রাকাআত তারাবীহে নামাজ বালেগ পুরষ-মহিলা সবার ওপর সুন্নতে মুওয়াক্কাদা। অসুস্থ ও রুগী ব্যক্তির ওপর তারাবীহ জরুরি নয়, তবে কোনো কষ্ট না হলে তাদেরও পড়া মুস্তাহাব। রদ্দুল মুহতার: ১/৭৪২
মাসআলা: তারাবীহে নামাজ জামাতে আদায় করা মুস্তাহাব, একাকি আদায় করলেও আদায় হয়ে যাবে। বাদায়েউস সানায়ে: ১/২৯০
মাসআলা: কারো যদি তারাবীহে জামাত থেকে কিছু রাকাআত ছুটে যায় তাহলে বেতরের নামাজের পর তা পড়ে নিবে। রদ্দুল মুহতার: ২/৪৪
মাসআলা: নাবালেগ হাফিজের পিছনে বালেগ পুরুষ মহিলা কারো জন্যই ইক্তিদা করা বৈধ নয়। মাজমাউল আনহুর: ১/১৬৭, হিদায়া: ১/২৩৮, আল-বাহরুর রায়িক: ১/৩৫৯
খতমে কুরআনের
কতিপয় মাসআলা
মাসআলা: ফরজ, নফল বা তারাবীহ যে নামাজেই প্রত্যেক সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহ নিঃসন্দেহে পড়া সুন্নত। তবে বিসমিল্লাহ নিঃশব্দে পড়া সুন্নত। তাই তারাবীহে নামাজেও খতমে কুরআনের সময় প্রত্যেক সূরার শুরুতে নিঃশব্দে পড়া সুন্নত। তবে যেহেতু বিসমিল্লাহর রহমানির রহীমও কুরআনের একটি আয়াত; তাই মুসল্লীদের খতম পূর্ণ হওয়ার জন্য যেকোনো সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহ সশব্দে পড়ে নিলে সবার খতম পূর্ণ হয়ে যাবে। প্রতি সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহ সশব্দে পড়লেও কোনো সমস্যা নেই। উভয়ের ওপর আমল করার অবকাশ আছে। রদ্দুল মুহতার: ১/৪৯০
মাসআলা: শরীয়তের দৃষ্টিতে নামাজের ভেতর লোকমা দেওয়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়ো না করা উচিত এবং ইমাম সাহেবের জন্য লোকমার অপেক্ষা না করে অন্য আয়াত পড়ে নামাজ শেষ করা উচিত। লোকমা দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি হলো- প্রথমে ইমাম সাহেবকে আয়াত পুনরাবৃত্তির সুযোগ দেওয়া, এতদসত্ত্বেও ইমাম সাহেব শুধরে নিতে না পারলে সেক্ষেত্রে মুক্তাদি লোকমা দিলে কোনো ক্ষতি হবে না। তারাবীহ নামাজে খতমে কুরআনে যদি হাফেজ সাহেব লোকমার অপেক্ষা না করে, তাহলে লোকমা না দিলে কোনো অসুবিধা হবে না। তবে ভুলে যাওয়া আয়াত পরবর্তীতে সূরা ফাতেহার পর পড়ে নিতে হবে। রদ্দুল মুহতার: ১/৬২৩
তারাবীহে নামাজে ভুল করলে
তারাবীহে নামাজে দ্বিতীয় রাকাআতে না বসে দাঁড়িয়ে গেলে তৃতীয় রাকাআতে সিজদা করার পূর্বে স্মরণ হলে বসে তাশাহহুদ ও সেজদায়ে সাহু আদায় করলে তেলাওয়াত ও নামাজ শুদ্ধ হয়ে যাবে। যদি তৃতীয় রাকাআতে সিজদা করে ফেলে, তবে চতুর্থ রাকাআত মিলিয়ে নেবে। এতে শেষের দুই রাকাআত তারাবীহে নামাজ হিসেবে ধর্তব্য হবে এবং শেষ বৈঠক না করার কারণে প্রথম দুই রাকাআত তারাবীহ হিসেবে গণ্য না হওয়ায় তেলাওয়াতসহ পুনরায় পড়তে হবে। বাদায়েউস সানায়ে: ১/২৮৯, রদ্দুল মুহতার: ২/৩৫, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/১১৮
যদি কোনো ব্যক্তি তারাবীহে নামাজ চার রাকাআতের নিয়ত করে শুরু করে এবং ভুলে দুই রাকাআতের পর বৈঠক না করে চার রাকাআত শেষ করেই বৈঠক করে, তাহলে সে যদি নামাজ শেষে সেজদায়ে সাহু করে থাকে, তবে শুধু শেষের দুই রাকাআত তারাবীহ হিসেবে গণ্য হবে। আল-বাহরুর রায়িক: ২/১১৭
বসে তারাবীহে নামাজ
মাটিতে বসে রুকু-সেজদার মাধ্যমে তারাবীহ নামাজ বৈধ। অনুরূপ তারাবীহে কেরাতের সময় চেয়ারে বসে রুকু সেজদা নামাজের নিয়মমাফিক আদায় করলে তাও বৈধ। কিন্তু বিনাওজরে এরূপ করলে নামাজের পূর্ণ সওয়াব পাবে না, বরং অর্ধেক সওয়াব পাবে। তবে হ্যাঁ, নিয়মমাফিক রুকু সেজদায় সক্ষম ব্যক্তি চেয়ারে বসে ইশারায় রুকু সেজদার মাধ্যমে নামাজ পড়লে নামাজ শুদ্ধ হবে না। ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/১১৮
লেখক: ফতোয়া গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশ, বসুন্ধরা ঢাকা
[1] আল-বায়হাকী, আস-সুনানুল কুবরা, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, বয়রুত, লেবনান, খ. ২, পৃ. ৬৯৯, হাদীস: ৪২৮৮
[2] আবদুর রাযযাক আস-সান‘আনী, আল-মুসান্নাফ, আল-মাকতাবুল ইসলামী, বয়রুত, লেবনান (দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৪০৩ হি. = ১৯৮২ খ্রি.), খ. ৪, পৃ. ২৬১, হাদীস: ৭৭৩৩
[3] ইবনে আবু শায়বা, আল-মুসান্নাফ ফিল আহাদীস ওয়াল আসার, মাকতাবাতুর রাশাদ, রিয়াদ, সৌদি আরব (প্রথম সংস্করণ: ১৪০৯ হি. = ১৯৮৯ খ্রি.), খ. ২, পৃ. ১৬৩, হাদীস: ৭৬৮৪
[4] ইবনে আবু শায়বা, আল-মুসান্নাফ ফিল আহাদীস ওয়াল আসার, খ. ২, পৃ. ১৬৩, হাদীস: ৭৬৮২
[5] আল-বায়হাকী, আস-সুনানুল কুবরা, খ. ২, পৃ. ৬৯৯, হাদীস: ৪২৯০
[6] আল-বায়হাকী, আস-সুনানুল কুবরা, খ. ২, পৃ. ৬৯৯, হাদীস: ৪২৯১
[7] ইবনে আবু শায়বা, আল-মুসান্নাফ ফিল আহাদীস ওয়াল আসার, খ. ২, পৃ. ১৬৩, হাদীস: ৭৬৮১